ছোটবেলা থেকেই আমরা আমাদের পাঠ্যবইয়ে পড়ে আসছি, “পাটকে বাংলাদেশের সোনালি আঁশ বলা হয়”। একসময় বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পণ্যের মাঝে পাটজাত পণ্য ছিল সবার উপরে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে এই বস্তুটি তার পুরনো গৌরব হারাতে শুরু করে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, বহির্বিশ্বে সিনথেটিক পণ্যের অপেক্ষাকৃত বেশি চাহিদার কারণে বাংলাদেশে পাটের রপ্তানির বাজার আর আগের মতো রমরমা নেই। কিন্তু তবুও এ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাটের ভূমিকা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পাট যাতে এ দেশে তার পুরনো গৌরব ফিরে পায়, তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন একজন বিজ্ঞানী। তিনি হলেন ড. মাকসুদুল আলম। পাটের জিন উন্মোচন করে তিনি সারা পৃথিবীতে তাক লাগিয়ে দেন।
ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই এর প্রখ্যাত অণুজীব বিজ্ঞানী ছিলেন ড. মাকসুদুল আলম। পাটের আগে তিনি মালয়েশিয়া ও জার্মানির বিজ্ঞানীদের সাথে মিলে যথাক্রমে পেঁপে ও রাবার গাছের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু যে মাতৃভূমিতে জন্মেছিলেন, তাকে প্রতিদান হিসেবে কিছু দেওয়ার তাড়না কাজ করছিল তার মনে। এই তাড়না থেকেই তার মাথায় আসে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জিন উন্মোচন নিয়ে কাজ করার। বাংলাদেশের বেশ কিছু উঠতি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নিয়ে তিনি তার অভিযান শুরু করেন। অবশেষে তার নেতৃত্বে ‘তোষা’ নামক এক বিশেষ প্রজাতির পাটের জিন উন্মোচন করা হয়। তার এই আবিষ্কার গোটা পৃথিবীতে প্রচুর সাড়া ফেলে দেয়। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যান। দেশের অনেক তরুণ বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রদের অনুপ্রেরণার পাত্র হলেও তার জীবন সম্পর্কে আমরা অনেক কমই জানি। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে।
ছোটবেলা থেকেই মাকসুদুল আলম ছিলেন বিজ্ঞানপ্রেমী
ড. মাকসুদুল আলম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পাট চাষের জন্য অনুকূল এই জায়গায় জন্মালেও তিনি বেড়ে ওঠেন পিলখানায়। তার বাবা দলিল উদ্দীন আহমেদ তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। মাকসুদুল আলমের মা লিরিয়ান আহমেদ ছিলেন একজন শিক্ষিকা ও সমাজসেবিকা।
ছোটবেলা থেকেই মাকসুদুল আলম ছিলেন অনেক বিজ্ঞান মনস্ক। তিনি ছোট ভাই মাহবুবুল আলম ও বন্ধু জোনায়েদ শফিককে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাব’। ক্লাবের প্রধান কার্যালয় ছিল নিজের বাসার ছাদ। এখানে তাদের প্রধান কাজ ছিল গাছ সংগ্রহ, এগুলো যাচাই-বাছাই ও পাতা সংগ্রহ করা। তিনি গাছের পাতাগুলো অ্যালবাম আকারে সংগ্রহ করতেন এবং বই পড়ে এগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম বের করতেন। আর এভাবেই যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের সফল একজন জীববিজ্ঞানীর।
ড. মাকসুদুল আলম ঢাকায় গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার প্রবল ইচ্ছা তাকে তাড়া করে বেড়াত। এই গবেষণার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তিনি পাড়ি জমান সুদুর রাশিয়ায়। রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুজীববিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি শেষ করেন। এছাড়াও ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট থেকে নিজের দ্বিতীয় পিএইচডি অর্জন করেন প্রাণরসায়ন বিষয়ে।
কর্মজীবন
ক্যারিয়ারের শুরুতে ড. মাকসুদুল আলম সিগনাল ট্রান্সডাকশন নামক একটি বিষয়ের উপর গবেষণা শুরু করেন। রাশিয়ার ইন্সটিটিউট অফ বায়োঅরগানিক ক্যামিস্ট্রি নামক প্রতিষ্ঠানে পোস্টডক্টোরাল প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়েও তিনি এই বিষয়ের উপর কাজ করছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই-এ অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্স স্টাডি অফ জিনোমিকস, প্রোটিওমিকস অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিক্স (এএসজিপিবি) নামক একটি গবেষণামূলক কমিটির পরিচালক পদে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। এএসজিপিবির মূল কাজ হলো অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর সাথে সম্মিলিতভাবে কোনো প্রজেক্টে কাজ করা।
মাকসুদুল আলম ইউনিভার্সিটি সেইন্স মালয়েশিয়ার সেন্টার ফর ক্যামিকাল বায়োলজির প্রধান নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জুট জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রজেক্টটিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশ-বিদেশের নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তার দল ২০১০ সালে ‘তোষা’ পাটের জিনোম সিকোয়েন্সে করতে সক্ষম হয়। এরপর তার নিরবচ্ছিন্ন তত্ত্বাবধানে ২০১২ ও ২০১৩ সালে যথাক্রকে পাটের ক্ষতিকর ছত্রাক ও সাদা পাটের জিনোম সিকোয়েন্সের পাঠোদ্ধার করা হয়।
নিজের কর্মজীবনে তিনি পেঁপে, রাবার গাছ, পাট ও ছত্রাকের জিন উন্মোচনের গবেষণা করেছিলেন। তার এই কাজগুলো গবেষক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি অণুজীব নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আর কর্মফলের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেছিলেন একাধিক পুরষ্কার। নিজ কর্মসংস্থান ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই থেকে তিনি ২০০১ সালে এক্সিলেন্স অফ রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। জার্মান সায়েন্স ফাউন্ডেশন তার কাজের জন্য বিশেষ স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৭ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (এনআইএইচ) তাকে শ্যানোন অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এভাবে নিজের ছোটবেলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেন এই বাঙালি গবেষক। নিজের কাজ দ্বারা তিনি দেশবাসীর মনও জয় করে নেন।
পাটের জিনোম ব্যবচ্ছেদের সেই বৈপ্লবিক কাহিনী
ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একদল বাংলাদেশী গবেষক মিলে পাটের জিনোমের পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হন। পাট মূলত একটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট অর্থনৈতিক উদ্ভিদ। এর আঁশ বা তন্তু দিয়ে নানা নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। গবেষকদের মতে, জিন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এই উদ্ভিদের দৈর্ঘ্য, গুনাগুণ, রং, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা ইত্যাদি বৃদ্ধি করা যায়। পাটের জিন উন্মোচনের মাধ্যমে এর ডিএনএ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। এর ফলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আরো উন্নত জাতের পাট প্রস্তুত করা সম্ভব। অত্যন্ত সফলভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার পর দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে সংকর জাতের পাট উৎপাদন শুরু করে।
জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে একটু সংক্ষিপ্তভাবে ধারণা দেওয়া যাক। জিন হলো প্রত্যেক জীবের বংশগতির ধারক ও বাহক। জেনেটিক কোড একটি জীবের সকল বৈশিষ্ট্য বহন করে। এক প্রজাতির জীবের কোড অন্য প্রজাতি থেকে বেশ আলাদা। জিনোম সিকোয়েন্সিং বলতে এই জেনেটিক কোডের বিশ্লেষণ করা বোঝায়। কোন জিনটি উদ্ভিদের কোন বৈশিষ্ট্য বহন করে তা নির্ণয় করার পদ্ধতিকেই জিনোম সিকোয়েন্সিং বলে। এর মাধ্যমে যেকোনো জীবের জিন পরিবর্তন করে আরো উন্নত করা সম্ভব।
ড. মাকসুদুল আলম তার গবেষকদের দলকে নিয়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে পাট নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার নেতৃত্ব দেওয়া এই দলটির নাম ছিল ‘স্বপ্নযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা কেন্দ্র এবং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ডাটাসফট সরাসরি এই প্রজেক্টের সাথে যুক্ত ছিল। এছাড়াও দেশের বাইরে থেকে মালয়েশিয়া ও আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতির জোগান দেওয়া হয়।
গবেষণার কাজটি শুরু করা আদতে এতটা সহজ ছিল না। কারণ বড় পরিসরে এই গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ড. মাকসুদুল আলম তাই নানা দেশি-বিদেশি সংস্থা্র কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য দ্বারস্থ হন। সরকারি ও বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে তিনি তহবিল সংগ্রহ করতে থাকেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই গবেষণার স্টেকহোল্ডার হিসেবে অর্থ বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশ সরকার তার এই গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য দশ কোটি টাকার ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করে। টানা দুই বছর নিরলস পরিশ্রম করার পর অবশেষে ২০১০ সালে গবেষক দল ‘স্বপ্নযাত্রা’ তাদের গবেষণায় সফল হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সফলতার ঘোষণা দেন।
ড. মাকসুদুল আলম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলেন যে, তাদের এই অর্জন পাটকে সোনালি আঁশ হিসেবে সেই পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। বিশাল জমিতে আগে যারা পাট চাষ করতো, সেই সকল পাট চাষিদের মুখের হাসিও ফিরিয়ে আনবে এই সফল গবেষণাটি। কেবল ‘তোষা’ জাতের পাট নিয়ে গবেষণা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। এরপর তিনি সাদাপাট ও পাটের ক্ষতিকর ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করেও সাফল্য অর্জন করেন।
বাংলাদেশকে নিয়ে ড. মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন
ড. মাকসুদুল আলম বলেন,
সরকার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিনিয়োগ না করলে আমাদের এসব অর্জন ভুলে যেতে হবে। পুনরায় মস্তিষ্কের অবনতি শুরু হবে। মানবজাতির ইতিহাস, আমাদের নিজেদের ইতিহাস এবং নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, স্বাস্থ্যকর সমাজ ও অর্থনীতি নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষায় নানা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাছাড়া কৌতুহল উদ্রেক করে এমন গবেষণায় জোড় দেওয়া আবশ্যক।
দেশে নিজের বিভাগের গবেষকদের সাথে কাজ করে তিনি এদেশের গবেষণার পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার মতে, আমাদের দেশে প্রচুর প্রতিভাবান ও উঠতি গবেষক রয়েছেন। কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতা ও উন্নত সরঞ্জামের অভাব তাদের গবেষণার পথে এক বিরাট বাঁধা। তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, ধীরে ধীরে এই অভাবগুলো পূরণ হয়ে যাবে। এদেশের বিজ্ঞানীরা আরো সফলভাবে দেশের উন্নতির কথা মাথায় রেখে গবেষণা কাজে লিপ্ত হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের সকল স্তরের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের অনুপ্রেরণা দানকারী এই বিজ্ঞানী ৬০ বছর বয়সে মারা যান। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমেরিকায় নিজের আবাস হাওয়াইয়ে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তার মৃত্যুতে দেশের নানা গণ্যমান্য ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেন। গবেষণার কাজে সুদূর আমেরিকায় চলে গেলেও তিনি নিজ দেশকে কখনো ভুলে যাননি। নিজের অর্জিত জ্ঞান ও প্রতিভার প্রতিদানস্বরূপ তিনি দেশকে কিছু দিতে চেয়েছিলেন। তার এই মানসিকতা দেশের অন্যান্য উঠতি গবেষকদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। এই মহানায়ককে বাংলাদেশ কখনো ভুলবে না।
পাট শিল্প সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি