পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ইরান বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইসলামিক বিশ্বেও ইরান সবচেয়ে বড় শক্তিমান দেশগুলোর মাঝে অন্যতম হিসেবে পরিচিত। তবে ইরানের এই শক্তিশালী হয়ে ওঠার কাহিনী কিন্তু খুব বেশি দিনের না। অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও প্রচুর মানুষের জীবনের বিনিময়ে ইরান তার আজকের সক্ষমতা অর্জন করেছে। তৎকালীন পারস্যের আজকের ইরান হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে তার নিজ দেশের অধিবাসী ছাড়াও আরও কিছু দেশের নাগরিকদের অবদান রয়েছে। যারা ইরানকে আজকের ইরান হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মার্কিন নাগরিক মরগান সুস্টার। জেনে অবাক হতে পারেন, বর্তমান ইরানের সবচেয়ে বড় শত্রুদের অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সরকারিভাবে নিয়োগ করেছিল যাতে সুস্টার পারস্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করেন।
১৯০৬ সাল চলছে, বাইরের বিশ্ব তখন ইরানকে ‘পারস্য’ নামে চেনে। পারস্য তখন কেবলই তার ‘সাংবিধানিক বিপ্লব’ অর্জন করেছে। পারস্যের জনগণ সেসময়ের শাসনক্ষমতার অধিকারী রাজা মোজাফফর আদ-দীন শাহকে গণতান্ত্রিক সংবিধান ও সংসদ বা মজলিশ মেনে নিতে বাধ্য করেছে। পারস্যের পূর্ববর্তী রাজারা সীমাহীন দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত লাভের জন্য ইরানের সম্পদ ব্যয় করেছিল এবং ইংল্যান্ড ও রাশিয়াকে পারস্যের অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দিয়েছিল। নতুন সরকারের সমর্থকরা মজলিশের ওপর ভরসা করে পুর্ববর্তী রাজাদের দুর্নীতির শেষ দেখার দিন গুনছিল।
কিন্তু সংবিধানের জন্য সংঘটিত সে আন্দোলনের বেশ কিছু শক্তিশালী শত্রু ছিল। ১৯০৭ সালের জানুয়ারিতে মোজাফফর আদ-দীন শাহ মারা যাবার পর তার ছেলে মোহাম্মদ আলী শাহ এর পদ লাভ করেন। মোহাম্মদ আলীও ছিলেন রাশিয়ার বন্ধুবৎসল। রাশিয়া ইরানে সংবিধানের বিরোধিতা করে এবং উত্তর ইরানকে এ আন্দোলনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সেখানে কড়া প্রতিরক্ষা নিয়োগ দেয়। ১৯০৮ সালে মোহাম্মদ আলীকে হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর, তার রাশিয়ান সমর্থনকারী বাহিনী মজলিশ বিলুপ্ত করে এবং সংবিধানপন্থীদের গ্রেফতার ও হত্যা করে। পরের বছরই সংবিধানপন্থীরা ক্ষমতা দখল করে এবং মোহাম্মদ আলীকে নির্বাসনে পাঠায়। কিন্তু ইরান ততদিনে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। ইরানের অভিজাত বংশীয় লোকজন, ইউরোপীয় এবং রাশিয়ানরা সেদেশের অর্থনীতিকে চুষে খাচ্ছিল।
এ অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি পাবার পথ খুঁজছিল ইরানের সংবিধানপন্থীরা। তৎকালীন পারস্যের নতুন সরকার মার্কিন সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায় এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে। ১৯১১ সালে পারস্য সরকার উইলিয়াম মরগান সুস্টার নামক এক মার্কিন আইনজীবী এবং সেদেশের সরকারি কর্মচারীকে আমন্ত্রণ জানায় পারস্যের প্রধান কোষাধ্যক্ষের পদগ্রহণ করার জন্য। মার্কিন সরকারের সাড়া পাবার পর সুস্টার এ পদ গ্রহণ করেন। সুস্টার পারস্যে আসেন সেদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া একটি দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করে সেদেশের ট্যাক্সকে কেন্দ্রীভূত করে দুর্নীতিকে বিলুপ্ত করার মিশন নিয়ে।
তেহরানে দুর্নীতিগ্রস্থ অভিজাত বংশীয় এবং ইউরোপীয়রা ক্রমাগতভাবে অজুহাত দানের মাধ্যমে দেশের অর্থভাণ্ডার লুটে যাচ্ছিল। সরকারের বিনামূল্যে শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৈরি, স্মার্ট ট্যাক্স সার্ভিস চালু করা সহ প্রচুর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তার জন্য দরকার ছিল প্রচুর পরিমাণ অর্থের। এই উভয় সংকটে পড়ে ইরানের সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা অন্য কোনো দেশের সহযোগিতা গ্রহণ করবে। ইউরোপীয়দের সাহায্য গ্রহণে অনিচ্ছুক হওয়ায় তারা ভিন্ন কোনো দেশের সন্ধান করেন। মার্কিন সরকারের চোখে তখনও পারস্যের ‘মন্দ’ কোনো অতীত ছিল না। সরকারি সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৯১০ সালের ২৫শে ডিসেম্বরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসায়েন কুলি খান যুক্তরাষ্ট্রে পারস্যের কূটনৈতিক দূতাবাসে নির্দেশনা দেন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি লোকজনের সাথে আলাপ করে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যসংস্থা মরগান সুস্টারের নাম সুপারিশ করে পারস্যকে সহায়তা করার জন্য। অতীতে সুস্টার কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে কিউবা, ফিলিপাইন এবং স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধের পর মার্কিন এক উপনিবেশে কাজ করেন। ফিলিপাইনের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তার ভূমিকা ছিল। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন-আমেরিকান ব্যবসা মালিক সমিতি সংগঠিত করেন, যেটি এর নিজস্ব ভূমিকায় সফল ছিল।
ইরান সম্পর্কে সুস্টারের আগের কোনো ধারণা না থাকলেও, সেসময় ওয়াশিংটনে অবস্থানকারী ইরানের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি মির্জা আলি কুলি খান তাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ইরানে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন। সুস্টার প্রাচ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড গ্র্যানভিল ব্রাউনের ‘১৯০৫-০৯ এর পারস্য বিপ্লব’ (The Persian Revolution of 1905–1909) বইটি পড়েও এ ব্যাপারে আগ্রহী হন। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রেও ইরানের ঘটনাবলী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “এ ঘটনাবলী বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি প্রাচ্যের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। প্রাচ্যের ঐ অংশে শান্তিপূর্ণ কার্যক্রমের মাধ্যমে মার্কিন স্কুল, মিশনারি কার্যক্রম ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু অবস্থা আগের চেয়ে অনেক শান্তিপূর্ণ, সেহেতু প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যে অংশীদারিত্ব করার সম্পূর্ণরুপে উপযুক্ত কারণ আছে।” পরবর্তীতে সুস্টার লিখেছিলেন, “আমি শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম সেসব মানুষকে সাহায্য করার জন্য, যারা আমাদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক পদ্ধতি বিশ্বাস করার প্রমাণ দিয়েছে।”
১৯১১ সালের এপ্রিলে মরগান সুস্টার একজন স্টাফ ও তার পরিবারকে সাথে নিয়ে তেহরানের পথে তার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যাত্রা শুরু করেন। নিউইয়র্ক থেকে সমুদ্রপথে প্যারিস, ভিয়েনা হয়ে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল), বালাম, বাকু হয়ে পারস্যের আনযালি বন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে স্থলপথে তারা তেহরানে পৌঁছান।
ইরানে থাকাকালীন স্মৃতিকথা নিয়ে সুস্টার পরবর্তীতে স্মৃতিবেদনাতুর আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তেহরান দেখার পর তার প্রথম অনুভূতি ছিলো,“প্রায় রুপকথার রাজ্যের মতো!” সুস্টার জানতেন, তিনি ইরানে প্রচুর ক্ষুব্ধ প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পাবেন, প্রধানত পারস্য সরকার এবং সেদেশের অভিজাতদের অধীনে কাজ করা ইউরোপীয়দের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। তিনি খুব দ্রুতই তার বুদ্ধিমত্তা ও কাজের পারদর্শীতা দেখিয়ে পরিস্থিতি তার অনুকূলে নিয়ে নেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে তখনকার ইরানের পরিস্থিতিকে সফলভাবে মঞ্চায়িত নাটক বলে অভিহিত করেন।
রাশিয়া পারস্যের প্রভাবশালী সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে সুস্টারের পারস্যে আগমন বন্ধ করার অনেক চেষ্টা করেছিল। সুস্টার সেখানে পৌঁছানোমাত্র রাশিয়া ও মুহাম্মদ আলী শাহের তার প্রতি ক্ষুব্ধতার কথা জেনেছিলেন। রাশিয়ানরা নিজেদের স্বার্থে সংবিধানপন্থীদের সফল হতে দেখতে চায়নি। তবে তারা দাবি করেছিল, তারা ইরানের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের শ্রদ্ধার নমুনা হিসেবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিককে পারস্য সরকার দ্বারা নিয়োগদানের উপর অভিযোগ প্রদান বন্ধ করেছিল। ব্রিটেনও সুস্টারের কার্যক্রমে সম্মতি প্রদান করেছিল। উভয় দেশই তার উপস্থিতি উপলক্ষ্যে লাগাতার বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছিল, যাতে সুস্টার তাদের কূটনৈতিক দূতাবাস ভ্রমণ করেন।
কিন্তু আদতে দু’পক্ষই সুস্টারের মজলিশে প্রস্তাব করার জন্য তৈরি করা অর্থনীতি সংক্রান্ত আইন নিয়ে চিন্তিত ছিল। যেহেতু সেটি পাশ হয়ে গেলে সুস্টার সমস্ত সরকারি তহবিল থেকে ব্যয়কৃত অর্থের হিসাব সহ সকল ধরনের অর্থপ্রদান সংক্রান্ত অনুরোধ পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পেতেন। বিদেশী শক্তিসমূহও এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। সুস্টারও কিঞ্চিৎ চিন্তিত ছিলেন, যেহেতু তিনি জানতেন, ইরানে অবস্থানকারী কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ ও বৈদেশিক বিশেষজ্ঞরা ক্রমে ইরানকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
নিজ দায়িত্ব যাতে ঠিকভাবে পালিত হয় সেজন্য সুস্টার তার কাজের ক্ষেত্রে কারো নির্দেশ পালন করতেন না। যখন ইরানিরা দেখলো সুস্টার অন্য পশ্চিমাদের প্রতি কীরূপ ব্যবহার করেন, তখন তারা নিজেদের মাঝে বলাবলি করতো, “আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের মাঝে একজন বিদেশী আছেন, যিনি তার কাজের নির্দেশ বিদেশীদের কাছ থেকে নেন না। আমরা তাকে সাহায্য করবো।”
কিন্তু সুস্টার টিকে থাকতে পারেননি সবকিছুর পরেও। রাশিয়ান ও ব্রিটিশরা সুস্টারকে সরানোর জন্য প্রচুর ষড়যন্ত্রের ছক আঁকছিলো। যখন ইরানের সরকার মুহাম্মদ আলী শাহের ভাইকে তার সমস্ত সম্পদ হস্তান্তরের জন্য নির্দেশ দিয়ে সুস্টারের ওপর এ কাজ সম্পন্ন করার ভার অর্পণ করলো, সুস্টার জোরপূর্বক সে কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। শাহের ভাই রাশিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় রাশিয়া সুযোগ পেয়ে ইরানে তাদের সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে এবং পারস্যের সরকারের কাছ থেকে ক্ষমা ও সুস্টারের পদত্যাগ দাবি করে। ব্রিটিশ ও রাশিয়ানদের লাগাতার চাপে ইরানের ভাইস রিজেন্ট সাংসদদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুস্টারকে ইরান থেকে বহিষ্কার করে।
সুস্টার যখন ইরানে এসেছিলেন তখন ইরান তার ইতিহাসের সবচেয়ে অস্থিতিশীল সময়গুলোর মধ্যে একটি পার করছিল। তার হাতে পুরো একটি দেশের অর্থনীতি ঠিক করার মতো একটি গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সুস্টার তার দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন। দায়িত্ব পালন শেষে সুস্টার তার নিজ দেশে ফেরত গিয়ে তার আত্মজীবনী ও পারস্যের ঘটনাবলী নিয়ে ‘The Strangling of Persia’ নামে একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি একটি ‘Century’ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থার প্রেসিডেন্ট হন। পরবর্তীতে সেটি প্রকাশনা সংস্থা ‘Century-Appleton-Crofts’ নামে পরিচিত হয়। আজীবন তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ইরানের ইতিহাসের একটি মুহূর্ত নির্মাণের কারিগর এই আমেরিকান।
ফিচার ইমেজ: IranWire