১৯৫২ সালের গোথিক রোমানিয়ার দুর্গম চার্চ থেকে ১৯৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ব্রোকফিল্ড, দ্য কনজুরিং ইউনিভার্সের কল্যাণে পুরোটাই এখন দর্শকের চেনা। কনজুরিং ইউনিভার্স যেন ফিরিয়ে এনেছে ছেলেবেলার বৃষ্টিভেজা নির্জন রাতের ভৌতিক গল্পের বাস্তব অনুভূতি। এই ইউনিভার্সের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন বিখ্যাত দুই প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর এড ওয়ারেন (১৯২৬-২০০৬) এবং লরেন ওয়ারেন (১৯২৭-২০১৯)। সিনেমার পর্দায় তাদের চরিত্র সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্যাট্রিক উইলসন এবং ভেরা ফারমিগা। বাস্তব জীবনে তারা একসাথে প্রায় ১০ হাজার প্যারানরমাল কেস নিয়ে কাজ করেছেন। সেলুলয়েডের ফিতার দুই হরর পপ কালচার আইকনকে নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
ঈশ্বরে দৃঢ় বিশ্বাস
আধুনিক বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত আধিভৌতিক সত্তা যেমন, পিশাচ, অপদেবতা, ভূত-প্রেত ইত্যাদির অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও, এসবের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল ওয়ারেন দম্পতির। এমনকি তারা দাবি করেছিলেন যে, যারা ভূত-প্রেতে অবিশ্বাস করে, তাদের উপরেও এই অদৃশ্য শক্তি ভর করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। রোমান ক্যাথলিক ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও তারা বিশ্বাস করতেন, সকল ধর্মের ঈশ্বর বা দেবতারাই এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে লড়ার ক্ষমতা প্রদান করতে পারেন।
দ্য আইরিশ ইন্ডিপেনডেন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লরেন ওয়ারেন বলেন,
“আপনি কোনো ধর্ম পালন না করলে সেটা আপনার জন্য ভীষণ ভয়ংকর। ঈশ্বরই আপনার সুরক্ষা। আপনি কোন ধর্মের এতে কিছু যায় আসে না।”
প্রেত-বিশারদদের প্রশিক্ষণ
ওয়ারেন দম্পতি কিছু ডিমনোলজিস্ট বা প্রেত-বিশারদকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজের জন্য গড়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে ডেভ কনসিডিন অন্যতম। তাদের অধীনে প্রধান তদন্তকারী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, প্যারানরমাল রিয়েলিটি শো ‘History Channel’s Mystery Quest’ এর মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় কুড়িয়ে নিয়েছেন ডেভ। ঠিক একইভাবে ওয়ারেনদের ভাগ্নে পিশাচতত্ত্ববিৎ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার আগে ওয়ারেন দম্পতির কাছেই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
কৈশোরের প্রেম
‘দ্য কনজুরিং: দ্য ডেভিল মেড মি ডু ইট’ সিনেমায় দেখা গেছে, এড ওয়ারেন একটি থিয়েটারের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় লরেনের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তবে এই কথা সত্য যে, কিশোর বয়সেই তাদের একে-অপরের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে যখন প্রথমবার তাদের মোলাকাত হয়, দুজনের বয়সই তখন ১৬। এর এক বছর পর, এড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করতে চলে যান। নৌবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হন এড। উত্তর আটলান্টিকে তার জাহাজ ডুবে গেলে, তিনি আবারও আমেরিকায় ফিরে আসেন। ১৯৪৫ সালে দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে তাদের কোল আলো করে জুডি ওয়ারেন নামে এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়।
সাইকিক রিসার্চ সোসাইটি
আধিভৌতিক জিনিস নিয়ে গবেষণার সুবিধার্থে ১৯৫২ সালে এড ও লরেন ওয়ারেন ‘New England Society for Psychic Research (NESPR)’ নামে এক সংগঠন দাঁড় করান। যেহেতু ওয়ারেন দম্পতি এখন আর ডিমনোলজিস্ট হিসেবে কাজ করেন না, তাই এই বর্তমানে এই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তাদের জামাতা টনি স্পেরা। ওখানে সহ-পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন এড ও লরেন ওয়ারেনের কন্যা জুডি স্পেরা। এছাড়াও, NESPR বিভিন্ন তদন্তকারী, ধর্মীয় উপদেষ্টা এবং আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতাদের এই সংঘে নিয়োগ দিয়ে থাকে। ভিন্ন-জগতের অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-ই হলো এই সংস্থার মূল প্রতিপাদ্য।
অ্যামিটিভিলের প্রেতাত্মা
নিউ ইয়র্কের অ্যামিটিভিলেতে অবস্থিত একটি বাড়িতে, ২৩ বছর বয়সী রোনাল্ড ডিফিও জুনিয়র নামে এক যুবকের হাতে তার পুরো পরিবার নির্মমভাবে খুন হয়। ঘটনার এক বছর পর, ১৯৭৫ সালে, জর্জ এবং ক্যাথরিন লুটজ নামে এক দম্পতি ওই বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু, এক মাসের মধ্যেই তারা বাড়িটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তাদের দাবি, ওই বাড়িতে এক অশরীরী আত্মার সরব উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল। গণমাধ্যমের বরাতে এই খবর চাউর হলে, অন্য প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটরদের সাথে ওয়ারেন দম্পতিও রহস্য উদঘাটনের অনুসন্ধানে নামেন। ওখানের সিঁড়ির নিচে যুবকের অবয়বে এক অশরীরী আত্মার ছবি তুলেছেন বলেও তারা জানান। NESPR ওয়েবসাইটের দাবি অনুসারে, ওয়ারেনদের তোলা ছবিটি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য। কিন্তু তা নিয়ে এখনও তর্ক-বিতর্ক বিদ্যমান। এই কাহিনি নিয়ে কনজুরিং ইউনিভার্সের মুভি ‘The Conjuring 2 (2016)’ এবং হরর সিনেমা ‘The Amityville Murders (2018)’ মুক্তি পেয়েছে।
ওয়ারেন কাল্ট মিউজিয়াম
সিনেমার মতোই ওয়ারেন দম্পতি অভিশপ্ত সকল বস্তু দিয়ে আমেরিকার সেন্ট মনরোতে ‘The Warren’s Occult Museum’ নামে এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। মনরো হলো লরেনের হোমটাউন। জামাতার সাহায্য নিয়ে তিনি এই সংগ্রহশালাটি গড়েন। সিনেমায় দেখানো প্রায় সকল জিনিসই ওই সংগ্রহশালায় মজুদ ছিল। এমনকি ওই ভূতুড়ে অ্যানাবেল ডল কিংবা ভ্যাম্পায়ারের কফিনেরও দেখা মিলবে ওখানে। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৯ সালে সকল দর্শনার্থীর জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ভুতুড়ে সংগ্রহশালাটি। কারণ, এর অবস্থান ছিল একটি আবাসিক এলাকায়, যেখানে মানুষের অতিরিক্ত আনাগোনায় প্রতিবেশীরা যারপরনাই বিরক্ত হতো।
চিত্রশিল্পের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
এড ওয়ারেনের বেজায় শখ ছিল তিনি তুখোড় মাপের একজন চিত্রশিল্পী হবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি পেরি আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। তার মূল বিষয়বস্তু ছিল অভিশপ্ত ভূতুড়ে বাড়িসমূহ রং-তুলি সমেত সাদা কাগজে ফুটিয়ে তোলা। ১৯৫২ সালে ওই স্কুল ত্যাগের পর তিনি তার আঁকা চিত্রকর্মগুলো বিক্রি করে দিতে থাকেন। দ্য কনজুরিং ২ চলচ্চিত্রে গির্জার পিশাচ ভ্যালাককে আঁকতে দেখা গিয়েছিল এড ওয়ারেনকে।
রূপালি পর্দায় লরেন ওয়ারেন
কনজুরিং সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, ওয়ারেনের দেওয়া প্রেজেন্টেশন শুনছিলেন হলভর্তি মানুষ। সামনের সারিতেই বসেছিলেন এক বৃদ্ধা, যিনি মূলত আসল লরেন ওয়ারেন। তবে এটাই প্রথম নয়, এর আগেও ১৯৮২ সালে তিনি ‘Amityville II: The Possession’ এ ডিমনোলজি অ্যাডভাইজর হিসেবে পর্দায় দেখা দিয়েছেন। এছাড়াও ১৯৯১ সালের মুভি ‘Haunted’ এর অন্যতম একজন লেখক ছিলেন তিনি।
এছাড়াও এই দম্পতি অনেক বই লিখেছেন। এগুলো হলো,
- ঘোস্ট হান্টার্স: ট্রু স্টোরিজ ফ্রম দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ফেমাস ডেমনোলজিস্টস (এড ওয়ারেন),
- ঘোস্ট ট্র্যাকস (ওয়ারেন দম্পতি এবং চেরিল এ. উইকস),
- গ্রেভইয়ার্ড: ট্রু হন্টিংস ফ্রম অ্যান ওল্ড নিউ ইংল্যান্ড সেমিটারি (এড ওয়ারেন),
- দ্য হন্টেড: দ্য ট্রু স্টোরি অব ওয়ান ফ্যামিলি’জ নাইটমেয়ার (জ্যাক স্মার্ল, জ্যানেট স্মার্ল, ওয়ারেন দম্পতি, রবার্ট কারেন),
- স্যাটান’স হার্ভেস্ট (ওয়ারেন দম্পতি, মিচেল লাসালান্দ্রা, কার্ম মেরেন্ডা),
- ওয়ারউল্ফ: অ্যা ট্রু স্টোরি অব ডেমনিক পসেশন (এড ওয়ারেন)
বাল্যকালের তিক্ত অভিজ্ঞতা
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে কানেক্টিকাট ম্যাগাজিনে এড ওয়ারেনকে নিয়ে এক আর্টিকেল ছাপা হয়। ওখানে ওয়ারেন দাবি করেন, তিনি অশরীরী কোনো সত্তার অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন সেই পাঁচ বছর বয়সেই। তারা ব্রিজপোর্টের এক ভূতুড়ে বাড়িতে যাওয়ার পরই নাকি এড আধিদৈবিক কোনোকিছুর অস্তিত্ব অনুধাবন করেন। এ বিষয় তিনি তার বাবা এবং স্থানীয় একজন পুলিশ অফিসারকে জানালে, তারা অভিযান চালিয়ে কোনোকিছুর খোঁজ পাননি। আর লরেন ওয়ারেনের দাবি, তিনি তার অলোকদৃষ্টিসম্পন্ন ক্ষমতা আবিষ্কার করেন বারো বছর বয়সে, যা বর্ণনা করা আছে গেরাল্ড ব্রিটলের নন-ফিকশন বই ‘দ্য ডিমনোলজিস্ট’-এ।
উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধান
ওয়ারেন দম্পতির কিছু আধিভৌতিক অনুসন্ধান ইতিহাস-বিখ্যাত হয়ে আছে। বলা যায়, এই ভৌতিক জগত নিয়ে নাড়াচাড়া করা সকলেই এর সম্বন্ধে কিছু না কিছু না জানেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো,
- অ্যানাবেল: র্যাগেডি অ্যান নামে সাধারণ এক পুতুলে অ্যানাবেল হিগিনস নামের এক কমবয়সী মেয়ের আত্মা ভর করা নিয়ে এই কাহিনি। এই পুতুলটি ওয়ারেনদের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় মজুদ রয়েছে।
- পেরন পরিবার: রোড আইল্যান্ডের ফার্ম হাউজে প্রতিশোধপরায়ণা এক প্রেতাত্মা বাথশেবা শ্যারমানের কাহিনি উঠে এসেছে এখানে। ধারণা করা হয়, ১৯৮২ সালে জন্ম নেওয়া এই মহিলা ডাকিনীবিদ্যা, এবং কালোজাদু চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
- এনফিল্ডের উৎপাত: ১৯৭৭ সালে লন্ডনের উপকণ্ঠের এক বাড়িতে উপদ্রবকারী এক ভূতের অনুসন্ধান নিয়ে এই কাহিনি বর্ণিত। এই অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করেই দ্য কনজুরিং ২ সিনেমা নির্মিত।
- আর্ন জনসন: ওয়ারেন দম্পতি আর্ন জনসন নামের এক লোকের বাগ্দত্তার ছোট ভাইয়ের ওপর থেকে শয়তানী কু-প্রভাব দূর করার জন্য তাকে এক্সরসিজম করেছিলেন। এই কাহিনির সূত্র ধরেই ‘দ্য কনজুরিং: দ্য ডেভিল মেড মি ডু ইট’ মুভিটি বানানো হয়েছে।
- স্মার্ল পরিবার: পেনসিলভানিয়ায় বাস করা স্মার্ল পরিবার দাবি করে, তাদের বাড়িতে অদ্ভুত সব শব্দ, গন্ধ ও ছায়ামূর্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ওখানে অনুসন্ধানে যান ওয়ারেন দম্পতি।
এই অনুসন্ধানকারীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিংবা জলঘোলা কম হয়নি। কারও কারও কাছে তারা ত্রাণকর্তা কিংবা রহস্যের খোরাক হিসেবে আবির্ভূত হলেও, কারও কারও কাছে তারা নিতান্তই ধাপ্পাবাজ। অনেকে বলে থাকেন, তাদের সকল ঘটনাই সাজানো, শুধুমাত্র খ্যাতি অর্জনের লক্ষ্যেই তারা মানুষের সরল বিশ্বাস ব্যবহার করে কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন। যা-ই হোক, তারা ভুল নাকি সঠিক, সেই প্রসঙ্গ তোলা থাক। জেমস গান এই দম্পতির বিখ্যাত কিছু তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে রূপালি পর্দায় উপহার দিয়েছে ‘দ্য কনজুরিং ইউনিভার্স’ নামে দুর্দান্ত এক হরর ফ্র্যাঞ্চাইজি।