‘বেঁচে আছি কিন্তু নিজেকে জীবিত মনে হয় না,
দশ হাত দূরে মানুষ থাকলেও কেউ কথা বলে না।
কিন্তু কদাচ যদি তারা মুখ খোলে,
স্মরণ করে যেন ক্রেমলিনের সেই ককেশীয়কে।’
ওসিপ মেন্ডেলস্তাম নামের এক কবির লেখা এই কবিতাকে যেনতেন কাব্য ভেবে ফেলে দেবেন না। এখানে এক শক্তিধর নেতাকে নির্দেশ করা হয়েছে। ক্রেমলিনের সেই ককেশীয় নেতার নাম জোসেফ ভিসারিওনোভিচ ইভানভ ওরফে লোসেব জুগোশভিলি। ছদ্মনাম নিয়েছিলেন ‘স্তালিন’। অনেকে বলে, লেনিন তাকে এই নামটি দিয়েছিলেন, যার অর্থ ইস্পাত। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার এক মানুষ, মুখময় বসন্তের দাগ, বাম হাতটা আবার মাঝে মধ্যেই কাবু হয়ে পড়ে, সেই তিনিই হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর সবথেকে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
দুই সংখ্যার এই লেখার প্রথম অংশে থাকছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগপর্যন্ত স্তালিনের জীবন। পরের অংশে থাকবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাপঞ্জী।
জন্ম ও শুরুর দিনগুলো
১৮৭৮ সালের শীতকালে জর্জিয়ার গোরি শহরে এক মুচির ঘরে স্তালিনের জন্ম হয়। ডাকনাম ছিল সোসো। মদ্যপ বাবার ব্যবসা ভাল চলছিল না। বেধড়ক মার খেতেন মায়ে-ছেলে। শেষমেষ উপায় না পেয়ে মা তাকে ভর্তি করে দিলেন পাদ্রীদের স্কুলে। লোসেব পরিবারে এহেনতর ঘটনা আগে ঘটেনি। সবাই ছিল নিরক্ষর।
তা স্কুলে ভর্তির পর দেখা গেল, সোসোর মাথা আছে। দিব্যি ছবি আঁকে, খাসা গান গায়, কবিতাও লেখে। কিন্তু সমস্যা হল ছোকরা মারামারিতেও বেজায় ওস্তাদ। তবে ভালো ফলাফল তাকে ঠেলে তুলে দিল তিফলিসের এক বিখ্যাত সেমিনারি স্কুলে। এখানে এসে কিন্তু সোসোর মতিগতি পাল্টে গেল। নিজেকে ঘোষণা করলো নাস্তিক। গোপন এক পাঠক সমিতিতে যোগ দিয়ে পড়লো নিকোলাই চেরনিসভস্কির ‘কী করিতে হইবে‘ এবং কার্ল মার্ক্সের ‘দাস ক্যাপিটাল’ সহ অসংখ্য বই। মার্ক্সবাদ জেঁকে বসলো তার মাথায়। ১৮৯৯ সালে সেমিনারি ছেড়ে স্তালিন রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি নামের একটি বাম দলে যোগ দিলেন। আত্মজীবনীতে স্তালিনের দাবি, তিনি পনেরো বছর বয়সেই সমাজতান্ত্রিক হয়ে যান।
ততদিনে জারের গুপ্ত পুলিশ ওখরানার কর্তাব্যক্তিদের নেক নজর পড়েছে তার ওপরে। স্তালিন আন্ডারগ্রাউন্ডে মিলিয়ে গেলেন। সেখান থেকেই একের পর এক হরতাল, বিক্ষোভ আয়োজন করে অতিষ্ঠ করে তুললেন কর্তৃপক্ষকে। তবে পালিয়ে আর কয়দিন! ১৯০২ সালে ওখরানা তাকে পাকড়াও করে সাইবেরিয়াতে চালান করে দিল। সে আমলে রাশিয়ায় এটাই ছিল দস্তুর।
১৯০৫ সালে রাশিয়ার বামেরা একটা ব্যর্থ বিপ্লব করে। স্তালিন সে সময়ে সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে বিপ্লবে যোগদান করেন। জর্জিয়াতে তিনি বলশেভিকদের সংগঠিত করে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলেন, দলবল নিয়ে চড়াও হন সরকারি সেনাদের ওপরে। এর কিছুদিন পরে লেনিনের সাথে তার দেখা হয়। স্তালিন হয়ে ওঠেন জর্জিয়ার এক নম্বর বলশেভিক নেতা। টাকা জাল, ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করে সেই টাকায় তার দলবল অস্ত্র সংগ্রহ করতো। তারপরে হামলা চালাতো জারের সেনাদের ওপরে। স্তালিন ঘন ঘন গ্রেফতার হতেন, তাকে নির্বাসনে পাঠানো হত আর কিছুদিন পরেই দেখা যেত আবার তিনি হাজির! জেল পালানোতে এই তরুণ বলশেভিকের বিশেষ দক্ষতা ছিল। জীবনে তিনি মোট বারো বার এই ভেলকি দেখিয়েছেন।
প্রথম মহাযুদ্ধ, বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ
প্রথম মহাযুদ্ধ বাধলে রাশিয়ার জার জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন এবং এক কোটি লোকের বিরাট রুশ সেনাদল পালে পালে কচুকাটা হয়ে গেল। জার্মানদের তাড়া খেয়ে তখন রুশ জনগণের বেহাল অবস্থা। ওদিকে দুই হাত ভরে কামিয়ে নিচ্ছে মুনাফাখোরেরা। স্তালিন তখন যথারীতি জেলে এবং ১৯১৬ সালে তিনি আবার জেল পালালেন। এমনি অস্থির পরিস্থিতিতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব হয়ে গেল। পতন ঘটলো জারের। কেরেনস্কি নামের এক উকিল ক্ষমতা দখল করলেন। দীর্ঘদিনের আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন ছেড়ে স্তালিন প্রকাশ্যে এলেন। যোগ দিলেন পেত্রোগাদ সোভিয়েতে। হয়ে উঠলেন বলশেভিকদের তৃতীয় প্রধান নেতা। প্রাভদার সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি পার্টি এবং মেনশেভিকদের সাথে বলশেভিকদের বিরোধ প্রকট হয়ে উঠলে আবার অস্থিরতা দেখা দেয়। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে, পেত্রোগাদের বিখ্যাত শীতকালীন প্রাসাদে কেরেনস্কির দলের মিটিং চলছে। হঠাৎ বলশেভিক যুদ্ধজাহাজ অরোরা থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হল। মন্ত্রীরা কে কোথায় পালালেন কে জানে। বলশেভিকেরা ক্ষমতা দখল করলো রাশিয়ায়। এ সময়ে পার্টিতে লেনিনের পরেই স্তালিন আর ট্রটস্কি শীর্ষে উঠেন। যদিও স্তালিনের ক্ষমতাটা প্রকাশ্যে বোঝা যেত না। তিনি অনেকটা আড়ালেই থাকতে ভালবাসতেন। ১৯১৮ সালে রাশিয়ার সাথে জার্মানির শান্তিচুক্তি হয়।
জার্মানিকে সামাল দিতে না দিতেই দেশের এস আর, জারপন্থী আর বিচ্ছিন্নতাবাদী নানা দল রাশিয়ায় মহা হাঙ্গামা শুরু করে দিল। বেধে গেল গৃহযুদ্ধ। এরই মধ্যে ১৯২০ সালে বাধলো পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ। স্তালিন এ সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দলবল নিয়ে লড়াই করেছেন। শত্রু বা দলত্যাগীদের নির্বিচারে খতম করে দেওয়া হত। খোদ বলশেভিক নেতারাই মাঝে মধ্যে ‘কেন, কিন্তু’ জাতীয় প্রশ্ন তুললেও বেয়াড়া স্তালিন পাত্তা দিতেন না। শেষমেষ ১৯২২ সালে যুদ্ধ থামলো। স্তালিন নির্বাচিত হলেন জেনারেল সেক্রেটারি। ততদিনে লেনিন আর স্তালিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা পরিকল্পনা নিয়ে মন কষাকষি শুরু হয়ে গিয়েছে। স্তালিন লেনিনের ‘নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা‘ মেনে নিতে পারলেন না। লেনিন নিজেও ক্রমেই স্তালিনের আচরণ আর ক্ষমতায় বিরক্ত হতে শুরু করেন। ১৯২৪ সালের শীতে লেনিনের মৃত্যু হয়।
ককেশীয় লৌহমানব
বলশেভিকদের মধ্যে তখন দুই পক্ষ। একদিকে স্তালিন, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ। অন্যদিকে লিও ট্রটস্কি। কেউ কারো পরিকল্পনা দেখতে পারেন না। স্তালিনের বক্তব্য হল আগে নিজের দেশটা শক্তিশালী করতে হবে। ওদিকে ট্রটস্কি চাচ্ছেন বিশ্বব্যাপী বিপ্লব। ১৯২৬ সালে জিনোভিয়েভ আর কামেনেভ ট্রটস্কির দলে যোগ দিলেন। তবে স্তালিনের ক্ষমতারোহণ তারা ঠেকাতে পারলেন না। ১৯২৭ সালে ট্রটস্কিকে নির্বাসন দেওয়া হয়। স্তালিন হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা।
স্তালিন ক্ষমতা পেয়েই লেনিনের নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাতিল করে কলখোজ আর সোভখোজ এর মত কালেক্টিভ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করলেন। ধনী চাষী তথা কুলাকদের পিষে ফেললো লাল ফৌজ আর এনকেভিডি এর লোকেরা।
স্তালিন ভারী শিল্প গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দিলেন। সোভিয়েত দেশকে যেকোনো মূল্যে, দ্রুততম সময়ে ইউরোপের সমকক্ষ করে তুলতে উঠে পড়ে লাগলেন জর্জীয় নেতা। তিরিশের দশকের মধ্যে অনেকগুলো সফল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সুফল পাওয়া গেল। তবে পয়সার উল্টো পিঠটাও দেখতে হবে। স্তালিনের পরিকল্পিত অর্থনীতিতে অনেক ভুলভ্রান্তি ছিল। ইউক্রেনে দেখা দিলো ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হলোদমোর। অন্যান্য অনেক অঞ্চলেও অসন্তোষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তবে একা স্তালিনকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। যুদ্ধপরবর্তী সোভিয়েত ব্যবস্থার অদক্ষতাও সংকটগুলোর জন্য বহুলাংশে দায়ী। সোভিয়েত নেতাদের অনেকেই এসবের বিরোধিতা করলেও স্তালিনের সামনে তাদের দাঁড়াবার জো ছিল না।
‘গণশত্রু’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
প্রাথমিক সাফল্যে আটখানা হয়ে স্তালিন বিরোধীদের ওপরে চড়াও হলেন। ১৯৩৩ থেকে শুরু হয়ে গেল এনকেভিডি এর দমন পীড়ন। ১৯৩৬-৩৮ সালের মধ্যে কেবল গুলিই করা হয়েছিলো সাত লক্ষ মানুষকে। আর কত লক্ষকে যে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিলো, পথে যে কতজন মারা গিয়েছিলো আর এনকেভিডি এর প্রধান নিকোলাই ইয়াজভ যে কতজনকে বেমালুম গায়েব করে দিয়েছিলেন তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ১৯৩৯ সালে অবশ্য খোদ নিকোলাই ইয়াজভই সাবাড় হয়ে গেলেন।
স্তালিনের লক্ষ্যবস্তু ছিল দুর্নীতিবাজ, সুযোগ সন্ধানী গণশত্রু থেকে শুরু করে পার্টি বা পার্টির বাইরের তার মতাদর্শের বিরোধীরা। স্তালিনিজম নামের এই মতাদর্শ ততদিনে লেনিনের পথ থেকে সরে এসেছে অনেকটা। পুরনো ঝানু নেতা থেকে শুরু করে কোনো বিরোধীই রক্ষা পায়নি। জিনোভিয়েভ আর কামেনেভের মতো নেতাদেরকেও ১৯৩৬ সালে গুলি খেয়ে মরতে হল। ট্রটস্কি মেক্সিকোতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে জনৈক এনকেভিডি এজেন্ট আলোচনার ছলে ঘরে ঢুকে তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খুন করে।
স্তালিন পশ্চিমা বিশ্ব এবং পুঁজিবাদীদেরকে ভয় পেতেন। তার ধারণা ছিল সোভিয়েত দেশটা অন্তর্ঘাতকে কিলবিল করছে। কাজেই তিনি কড়া নজরদারি এবং সেই মাফিক শত্রু নিধনে বিশ্বাসী ছিলেন। দীর্ঘদিনের সংগ্রামী জীবন এবং গৃহযুদ্ধ সম্ভবত তার মধ্যে এই অতি সাবধানতার জন্ম দেয়। দোষীকে তার পরিবারসুদ্ধ গুলাগে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শিশু রাষ্ট্রটিকে শক্তিশালী করবার জন্য যেকোনো কিছুতেই তিনি রাজি ছিলেন। তবে অদ্ভূতভাবে সাহিত্যিকদের ব্যাপারে প্রচুর ছাড় ছিল। ম্যাক্সিম গোর্কী বা বুলগাকভদের মতো অনেক লেখক তার সমালোচনা করলেও তাদেরকে রেয়াত করেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিকভাবে এ সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের সমাজতান্ত্রিকদেরকে সাহায্য করা শুরু করে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রী সেনাদের সমর্থনে তিনি বহু অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্য এবং সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছিলেন। নানা সমালোচনা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে স্তালিনের একরোখা নেতৃত্ব অনুন্নত রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়। প্রযুক্তিগত গবেষণার উপরে রাষ্ট্রীয় সমর্থন বহুগুণে বাড়তে থাকায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেই রাশিয়া বিশ্বের চতুর্থ বা পঞ্চম শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠে। স্তালিনের শাসনামলেই রঁম্যা রঁল্যা, রবীন্দ্রনাথ বা রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো গুণী ব্যক্তি সোভিয়েত দেশ ভ্রমণ করে অনেক ভাল ভাল কথা লেখেন। তবে স্তালিনের নিষ্ঠুরতার কথা সবাই কম-বেশী লিখে গিয়েছেন।