Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বেয়ার গ্রিলস: অপরাজেয় অভিযাত্রীর উপাখ্যান

ভূমি থেকে ষোল হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটি উড়োজাহাজ। জাম্বিয়ার বিশাল প্রান্তরে প্লেনটাকে একটা ছোট বিন্দুর মতোই দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে খুলে গেল প্লেনের দরজাটা। লাফ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সুদর্শন চেহারার এক যুবক। শেষবারের মতো প্রার্থনা করে লাফ দিলো সে। লাফ দেওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ফুরফুরে মেজাজেই ছিলো। জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটা উপভোগ করতে যাচ্ছে এসএসআর-এর সর্বশেষ ট্রেইনি।

প্লেন থেকে নামছেন এক অভিযাত্রী; Source: Youtube

প্যারাস্যুটের দড়িটা ধরে টান দিতেই সে বুঝতে পারলো, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। প্যারাস্যুট যে খুলছেই না! আবারও চেষ্টা করল, নাহ এবারেও হলো না। প্যারাস্যুটের রিজার্ভ প্যাকটা ব্যবহার করা উচিৎ হবে কিনা, তা ভাবতেই ভাবতেই মাটি আরও কিছুটা কাছে চলে এসেছে… নাহ, পৈতৃক প্রাণটা এত সহজে খোয়ানো উচিৎ হবে না। শেষবারের মতো হ্যাঁচকা টান দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো পলিথিনের তৈরি বস্তুটা। তারপর হঠাৎ করেই খুলে গেলো জীবন রক্ষাকারী প্যারাস্যুট। কিন্তু বিধি বাম, শেষ রক্ষা হলো না তার। মাটি ছোঁয়ার আগে যতটুকু কম গতি প্রয়োজন ছিল, তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি সে। সোজা গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লো ছয় ফুটের দীর্ঘ দেহটা। সোজা বললে ভুল হবে, পিঠটা ছিলো নিচের দিকে। পিঠে থাকা নরম প্যারাস্যুটের রিজার্ভ প্যাকটা যেন হঠাৎ করেই শক্ত পাথর হয়ে গেল। শরীরের হাড় যেন একেবারে গুড়ো হয়ে গিয়েছে! মৃত্যুপথযাত্রীর খাতায় কি নতুন কোনো নাম উঠতে যাচ্ছে?

তার দিকে ছুটে গেলো সবাই। স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। যা ভাবা হয়েছিল, বলা যায় তার চেয়ে বেশ কম ক্ষতিই হয়েছে। মেরুদণ্ড দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে, ভেঙে গিয়েছে ৩টি কশেরুকা। মৃত্যু থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে বেঁচে ফিরে আসলো সে, স্পাইনাল কর্ডে আঘাত লাগলে সেখানেই তার ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতে পারত! বয়স আর ফিটনেস দেখে ডাক্তার আর অপারেশন করার ঝুঁকির মধ্যে গেলেন না, তার পরিবর্তে তাকে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে সময় কাটাতে হবে ফিজিওথেরাপি আর আলট্রা-সাউন্ড ট্রিটমেন্টের মধ্যে।

যে দুর্ঘটনার পর ভাবা হয়েছিল সে হাঁটতেই পারবে না, ঠিক সেই দুর্ঘটনাই যেন জীবনের মোড় পালটে দিলো তার। ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছার জোরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ার দেড় বছরের মাথায় এভারেস্টের চূড়ায় উঠল সে, সর্বকনিষ্ঠ ব্রিটিশ হিসেবে! যদিও গত বিশ বছরে রেকর্ডটি আরও চার বার ভাঙা হয়েছে।

এভারেস্ট জয় করার পর; Source: beargrylls.com

এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন, কার কথা বলা হচ্ছে। সেই অদম্য বেয়ার গ্রিলস, যিনি ঘুরে দেখেছেন পৃথিবীর প্রতিটি কোণা, মুখোমুখি হয়েছেন অসাধারণ সব চ্যালেঞ্জের এবং লাঞ্চবক্সের লিস্টে যোগ করেছেন অদ্ভুত সব রেসিপি! দুনিয়ার বুকের অন্যতম সেরা এই অভিযাত্রীর গল্পগুলোই শুনে নেওয়া যাক।

অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পড়া যেভাবে

আটলান্টিকের গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা আয়ারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডোনাদিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এডওয়ার্ড মাইকেল গ্রিলস। তারপর সেখানেই নানীর কাছে চার বছর কাটিয়ে পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডের দক্ষিণে, আইল অফ উইটে। সাগরের চারপাশে থাকার ফলেই হয়তো সাগরের প্রতি আলাদা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল তার। তাছাড়া বাবা মাইকেল গ্রিলসও রয়্যাল ইয়ট স্কোয়াড্রনের একজন সদস্য; তাই অ্যাডভেঞ্চারের নেশার হাতেখড়িটাও পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকেই।

বাবার ইয়টে বেয়ার গ্রিলস; Source: beargrylls.com

একদিকে নানী প্যাট্রিশিয়া ফোর্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের প্রথম নারী এমপি, অন্যদিকে বাবা স্যার মাইকেলও যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ; তাই স্বভাবতই রাজনীতির হালকা আঁচড় তার মাঝে থাকাটা স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পাওয়া এই কারাতের ব্ল্যাকবেল্টকে এসব আটকে রাখতে পারেনি। কলেজে থাকতে থাকতেই গঠন করেছেন পর্বতারোহীদের ক্লাব। কিশোর বয়সেই নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের স্কাউট দলকে। পড়াশোনা শেষ করার পর ছুটে গিয়েছিলেন ভারতে। কারণ? ভারতের আর্মড ফোর্সের সৈন্যদের অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ জীবন তার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলেই মনে হয়েছিলো। সিকিম আর দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো বেয়ার গ্রিলস ভারতের নাগরিক না হওয়ার কারণে আর্মড ফোর্সে সুযোগ না পেয়ে শেষমেশ ঢুকে পড়লেন ব্রিটিশ আর্মিতে। তারপর ব্রিটিশ আর্মির স্পেশাল এয়ার সার্ভিসের ৩ বছরের জীবন তাকে পরিণত করলো ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্কাইডাইভারে।

আর সেই স্কাইডাইভিং করতে গিয়েই জাম্বিয়ায় প্যারাস্যুট অ্যাক্সিডেন্ট, অতঃপর ব্রিটিশ আর্মি থেকে অবসর। এই অকাল অবসরের কারণেই হয়তো জীবনের মোড় ঘুরে গেলো তার। শুরু হলো নতুন অভিযানের গল্প।

এসএএস-এর ট্রেনিংয়ে বেয়ার গ্রিলস; Source: Mpora

অভিযাত্রীর ডায়েরি

২৩ বছর বয়সে এভারেস্ট বিজয়ের মাধ্যমেই বেয়ার গ্রিলসের বড় ধরনের অভিযানের সূচনা হয়। তারপর একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছেন শুধু। বলা যায়, জীবনে যত ধরনের অ্যাডভেঞ্চার করা সম্ভব, তার সবকিছুই কিছুটা হলেও করে ফেলেছেন। এভারেস্টে ওঠার পরপরই পুরো বিশ্বে, বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেনে তাকে নিয়ে ব্যাপক হইচই শুরু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রয়্যাল লাইফবোট ইনিস্টিটিউশনের তহবিল গঠনের জন্য জেট স্কি নিয়ে তিনি চক্কর দিয়েছেন ব্রিটিশ আইলের এ মাথা থেকে ও’ মাথা। দুর্ঘটনায় পা হারানো বন্ধুর সাহায্যের জন্য নগ্ন হয়ে নেমে গিয়েছেন শীতল টেমস নদীতে! পানি আর তার শরীরের মাঝখানে বাধা হয়ে ছিল শুধু একটা বাথটাব।

প্রথম চিত্র: বাথটাব নিয়েই টেমস নদীতে নগ্ন অবস্থায় রোয়িং করছেন বেয়ার গ্রিলস, দ্বিতীয় চিত্র: জেট স্কি নিয়ে ব্রিটিশ ইজেলস চক্কর দেওয়ার সময়; Source: beargrylls.com

সাগরের নীল পানিকে আপন করেই তিনি ছোট্ট বাতাস ভরা নৌকা দিয়ে উত্তর মেরুর বরফ কেটে বেরিয়ে এসেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি অ্যান্টার্কটিকা পাড়ি দিয়েছেন জেট স্কি দিয়ে, এমনকি বরফশীতল হিমালয়ের উপর সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্যারাগ্লাইডিং করার রেকর্ডটাও তার দখলে। এভারেস্টের উপর দিয়েই হয়তো গ্লাইডার নিয়ে ভেসে যেতেন, কিন্তু চীন সীমান্তে অনধিকার প্রবেশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তা আর হয়ে ওঠেনি।

উত্তর মেরু অভিযান শেষে উদযাপনরত বেয়ার গ্রিলস; Source: beargrylls.com

পৃথিবীর বুকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় ডান হাতের কাজ সেরে ফেলার রেকর্ডটাও দখলে রেখেছেন ‘দ্য বেয়ার’। ইংল্যান্ডের এক দাতব্য সংস্থার অর্থ তহবিলের জন্য অক্সিজেন মাস্ক নিয়েই বেলুনে চড়ে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় ডিনার করেছিলেন তিনি!

বেলুনে চড়ে মেঘের দেশে; Source: Squad Up

দুই মেরু পাড়ি দেওয়া, এভারেস্ট জয় করা এই ব্যক্তি হয়তো শুধু পানির নিচে ডুব দেওয়ার রেকর্ডগুলোই বাকি রেখেছেন।

হিমালয়ে স্কাইডাইভিং-এর সময়; Source: beargrylls.com

ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড

এভারেস্ট জয় কিংবা মেরু অভিযান, এর কোনোটিই বেয়ার গ্রিলসকে ততটা খ্যাতি এনে দিতে পারেনি যতটা এনে দিয়েছে ডিসকাভারি চ্যানেলের ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানটি। প্রতিকূল পরিবেশ কিংবা দুর্গম অঞ্চল থেকে কীভাবে বেঁচে ফেরা যায় তার চিত্রায়ন করতেই বেয়ার গ্রিলস ছুটে গিয়েছেন গ্রেট ক্যানিয়নে, পুড়েছেন উতাহর তীব্র রোদে, খাবি খেয়েছেন আল্পসের বরফগলা পানিতে, তাড়া খেয়েছেন আফ্রিকার সাভানায় হাতি-সিংহের কাছ থেকে, মশার কামড় খেয়েছেন কোস্টা রিকার রেইনফরেস্টে, রাত কাটিয়েছেন আইসল্যান্ডের বরফের গুহায়, মানুষখেকো বুশম্যানদের পাল্লায় পড়েছেন নামিবিয়ায়, নগ্ন হয়ে সাঁতার কেটেছেন সাইবেরিয়ার -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, সাপ খেয়েছেন সিয়েরা নেভাডার প্রান্তরে, প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ পার করেছেন সামান্য ভেলার সাহায্য নিয়ে, এমনকি সাহারার তীব্র রোদে পানিশূন্যতার কারণে পান করেছেন নিজের মূত্রও!

নরওয়ের গিরিখাতে ঝোলার সময়; Source: BBC America

কিন্তু ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের প্রতিটি ঘটনাই কি সত্য? একে পুরোপুরি সত্যও বলা যাবে না, আবার মিথ্যা বলে একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির রিপোর্টে জানা যায়, ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের একেকটি পর্ব তৈরি করতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়, যেখানে টিভিতে দেখানো হয় মাত্র দুই দিনের বেঁচে থাকার কৌশল।

ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের পিছনের দৃশ্য; Source: NBC

বিবিসির রিপোর্টে দেখা যায়, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে থাকা অবস্থায় ভেলা বানাতে তাকে দলের অন্য সদস্যরা সহযোগিতা করেছে। হাওয়াই দ্বীপের রবিনসন ক্রুশো জঙ্গলে না থেকে তিনি রাত কাটিয়েছিলেন এক হোটেলে! পরবর্তীতে বেয়ার গ্রিলস অনুষ্ঠানের এ ধরনের ত্রুটির জন্য ক্ষমা চান দর্শকদের কাছে।

তবে একটি অনুষ্ঠানের এমন অসামঞ্জস্যতা তার যাবতীয় অর্জনকে ঢেকে দেয় না। তার দুঃসাহসকে বাহবা না দিয়ে উপায় নেই। প্যারাগ্লাইডার নিয়ে খরস্রোতা আমাজন নদে ঝাঁপিয়ে পড়া কেবল মুখের কথা নয়। পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়েও প্রকৃতির একেবারে গভীরে মিশে যাওয়া বেয়ার গ্রিলসকে টেলিভিশনের পর্দায় যে মুগ্ধতা নিয়ে আমরা দেখি, সেই মুগ্ধতা মিথ্যে নয়। জীবনের মোড় পালটে দেওয়া ভয়াবহ প্যারাস্যুট অ্যাকসিডেন্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটি কথাই বলেছিলেন তিনি,

“IF YOU RISK NOTHING, YOU WILL GAIN NOTHING”

ফিচার ইমেজ- tvdaily.com

Related Articles