অতীতের সময় থেকে পৃথিবীর আধুনিকতার দিকে এগিয়ে চলার পথ ছিলো অনেক বিচিত্র। অনেকটা টলমলে সমাজ তখন পথ খুঁজে ফিরছিলো কখনো পূর্বের বিশ্বাসের দিকে, কখনো সামনের যুক্তিময় ভবিষ্যতের দিকে। দুটো সময়ের সন্ধিক্ষণে পৃথিবীতে তখন বয়ে যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তনের এক জোরালো হাওয়া। আগের ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে বিজ্ঞান নিত্যনতুন তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের নানান নতুন আবিষ্কারের সাথে সংঘর্ষ লাগছে ধর্মীয় বিশ্বাসের। মানুষের শান্ত জীবনে প্রযুক্তি আনছে গতি আর সেই সাথে বিভিন্ন যন্ত্রের উদ্ভাবন ধীরে ধীরে উৎপাদন ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করছে।
এসব কি কেবল আশীর্বাদ? নাকি আশীর্বাদের মোড়কে মানুষ এক আশাহীন অভিশপ্ত পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো? বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের, নতুন ও পুরাতনের মাঝে সামঞ্জস্যের অভাব মানুষকে করে দিচ্ছিলো দিকভ্রান্ত। আর জীবনের অসামঞ্জস্যতা সাহিত্যের চেয়ে ভালোভাবে, নিখুঁত ও স্পষ্টভাবে আর কে-ই বা তুলে ধরতে পারে?
আজ ইংল্যান্ডের এমনই এক কবির কথা শুনবো, যিনি অবিশ্বাস, অস্থিরতা আর দিকনির্দেশনার অভাবে সৃষ্ট আধুনিকতার পথে হাঁটা সেই সমাজের হতাশা আর ব্যর্থতার কথা বলেছিলেন, যখন অন্যান্য অনেক নামকরা কবি-সাহিত্যিকেরা এ চরম সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ম্যাথু আর্নল্ড।
আর্নল্ডের সময়টা ছিল ইংল্যান্ডের ইতিহাসেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনামল; ইংল্যান্ডের সর্বত্র তখন পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, আধুনিকতা পুরাতনকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিজ্ঞানের প্রদত্ত নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য তখন মানুষের দীর্ঘদিনের পুরাতন ধারণা ভেঙে দিচ্ছে। ডারউইনের দেয়া মানুষের রূপান্তরের তত্ত্ব, মহাবিশ্বের নানা নতুন তথ্যের আবিষ্কার ইংল্যান্ডের ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে সজোরে আঘাত করে যাচ্ছিলো। নিউম্যানের মতো ইংল্যান্ডের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই পুরাতন গোঁড়া ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে হয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান হচ্ছেন, নয়তো নাস্তিকতার দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন। সমাজে চারিদিকে শুরু হচ্ছে শিল্প বিপ্লব এবং অক্সফোর্ড আন্দোলনের মতো বিভিন্ন বিপ্লব ও আন্দোলন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তখন চলছে অনেক ওঠানামা। এমনই টলমলে এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন ম্যাথু আর্নল্ড। আর এই সময়টাই যেন তাকে প্রভাবিত করে প্রতিভার যথার্থ বিকাশ ঘটায়, বর্তমানকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার দূরদর্শিতাকে আরো তীক্ষ্ণ করে তোলে। তাই তো অন্যান্য কবি- সাহিত্যিকরা যখন সেই সময়ের ইংল্যান্ডে ঘটে যাওয়া সমস্ত উত্থান- পতন, আধুনিকতা ও নাস্তিকতাকে একচেটিয়া সমর্থন করে যাচ্ছিলো, তিনি তখন এর গভীরে থাকা শূন্যতা দেখতে পেয়েছিলেন স্পষ্টভাবে। তার লেখা কবিতাগুলো যেন সেই গভীর দর্শনেরই একেকটি জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত।
কড়া প্রধান শিক্ষক হিসেবে বেশ নামডাক ছিলো থমাস আর্নল্ডের। থমাসের দ্বিতীয় সন্তান ম্যাথু ছিলেন পুত্রদের মধ্যে সবার বড়। ১৮২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের লালহাম নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ম্যাথু আর্নল্ড। মা মেরী পেনরোজ আর্নল্ড ছিলেন একজন দেশীয় যাজকের কন্যা। শৈশব থেকেই বাবার নৈতিকতা, ইতিহাসের বিশ্লেষণমূলক জ্ঞান, ধর্মীয় গভীর অনুধাবন ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ড ম্যাথুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে বাবার চেয়ে মায়ের সাথেই বেশি সময় কাটিয়েছেন তিনি, এমনকি ছোটবেলায় মায়ের বেশ গা-ঘেঁষা থাকার কথাও প্রচলিত তার ব্যাপারে।
ছেলেবেলায় পায়ের ত্রুটির জন্য ম্যাথুকে বেশ খারাপ একটা সময় পার করতে হয়। এসময় তিনি সর্বক্ষণ পাশে পান তার মাকে। মাকে তিনি পেয়েছিলেন সহানুভূতিশীল কিন্তু বুদ্ধিমান বন্ধু হিসেবে। মায়ের কাছ থেকেই ধীরে ধীরে চারপাশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষণ করার অভ্যাস ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে গড়ে ওঠে। বড় বোনের সঙ্গও তার মানসিক বিকাশে অনেক অবদান রাখে।
শিক্ষাজীবনের প্রথম কয়েক বছর বাবার স্কুলে পড়লেও পরবর্তীতে ছাত্র হিসেবে তেমন ভালো করতে না পারার জন্য তাকে ১৮৩১ সালে তারই এক কাকার স্কুলে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই স্কুলের নিয়মকানুন অত্যন্ত কড়া হওয়াতে এবং বেশ অল্প বয়সে পরিবার থেকে দূরে থাকা তার জন্য কষ্টকর হয়ে যাওয়াতে দ্রুতই আবার বাবার স্কুলে ও নিজের গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ফিরে আসেন তিনি। তখন থেকেই কবিতার প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। ১৮৩৬ সালে ম্যাথু বিখ্যাত উইনচেস্টার কলেজে যাত্রা করেন। ১৮৪১ সালে তিনি অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ পান। সেখানে পড়ার সময় ইংল্যান্ডের তখনকার অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদ, জ্ঞানী ও সংস্কারক হেনরি নিউম্যানের চিন্তাধারা ও মতবাদ আর্নল্ডকে বেশ প্রভাবিত করে, যদিও তা ছিল আর্নল্ডের পিতার চিন্তাধারার বিপরীত। থমাস আর্নল্ডও তখন অক্সফোর্ডের ইতিহাসের শিক্ষকদের মধ্যে একজন। অবশ্য ১৮৪২ সালের জুন মাসে বাবার মারা যাওয়ার পর ম্যাথু বাবার মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে যান বলে জানা যায়।
পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ডে বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় ও জানাশোনার সুযোগ ম্যাথুর জ্ঞানের পরিধিকে আরো বাড়িয়ে তোলে। সেই সাথে তার লেখা কবিতাগুলো সাহিত্য বিশারদদের কাছেও বেশ প্রশংসিত হতে থাকে। ১৮৪৩ সালে ম্যাথিউ তার কবিতা ‘ক্রোমওয়েল‘ এর জন্য সম্মানজনক নিউডিগেট পুরষ্কার পান। এই পুরষ্কার কবিতা লেখার প্রতি তার আগ্রহকে আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় এবং আর্নল্ড একজন পুরোদস্তুর কবি হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৪৭ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘দ্য স্ট্রেইড রেভেলার এন্ড আদার পোয়েমস‘ নামে প্রকাশিত হয়। ১৮৫২ সালে ‘এম্পেডোকেলস অন এটনা এন্ড আদার পোয়েমস ‘ নামে তার দ্বিতীয় কবিতার বই প্রকাশিত হয়। প্রথমে বইগুলো তেমন বাজার দখলে সফল না হলেও ‘ডোভার বিচ’, ‘ দ্য স্কলার জিপসি’, ‘ট্যু মার্গারিট কন্টিনিউড’, ‘শেক্সপিয়ার’ এর মতো অসাধারণ কবিতাগুলো সহজেই অক্সফোর্ডের সাহিত্যবোদ্ধাদের নজর কাড়ে।
১৮৪৪ সালে বাবার মতো স্কুলশিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে তিনি লর্ড ল্যান্সডোনের অধীনে ব্যক্তিগত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে সরকারের অধীনে সচিবের দায়িত্বও অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। ১৮৫১ সালের এপ্রিলে ম্যাথু লর্ড ল্যান্সডোনের সহায়তায় স্কুল পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এই কাজের সূত্র ধরে তাকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে ইংল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, অনেক সময় পার করতে হয়েছে স্টেশনের অপেক্ষাগারে এবং সাধারণ স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দাবি ও সমস্যার কথা শুনে। ম্যাথিউয়ের সামনে ফুটে ওঠে সাধারণ মানুষের ইংল্যান্ডের সত্যিকার চিত্র। এই অনন্য অভিজ্ঞতা তার সাহিত্য ও জীবনবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ইংরেজির পাশাপাশি জার্মান ও ফরাসি সাহিত্যেও তাঁর চমৎকার দখল ছিলো।
ম্যাথু আর্নল্ডের ব্যক্তিজীবনের কথা বলতে গেলে স্ত্রীর সাথে দারুণ বোঝাপড়া ও আজীবন মধুর সম্পর্কের কথা যেন না বললেই নয়। তবে স্ত্রী ফ্রান্সিস লুসি কবির জীবনে আসার আগে এক ফরাসি নারীর প্রেমে পড়েন তিনি। নীল নয়না, বাদামী চুলের সেই নারীর স্পষ্ট কোনো পরিচয় পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন কবিতায় কবি তাকে ‘মার্গারিট’ বলে সম্বোধন করেছেন। লুসির সাথে অবশ্য তাই বলে ভালোবাসার কোনো কমতি কখনও ছিলো না। বিচারক স্যার উইলিয়াম হুইটম্যানের কন্যাকে বিয়ে করতে যদিও একটু বেগ পেতে হয়, কিন্তু তাদের আজীবন প্রেমময় বিবাহিত জীবন ম্যাথুর জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে।
শুধু কবিতায় না, আর্নল্ডের জ্ঞান ও গভীর চিন্তাশক্তির ছাপ দেখা যায় তার লিখে যাওয়া গদ্যগুলোতেও। ১৮৬১ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত তার ‘অন ট্রান্সলেটিং হোমার’ এরকমই একটি রচনা। অক্সফোর্ডে দেওয়া কবির অনুবাদ বিষয়ে পাঠমূলক বক্তৃতাগুলোর সমন্বয়ে প্রকাশিত হয় এটি। এছাড়াও তার এ জাতীয় লেখাগুলোর মধ্যে আছে ‘দ্য পপুলার এডুকেশন অফ ফ্রান্স’, ‘কালচার এন্ড এনার্কি’, ‘লিটারেচার এন্ড ডগমা’, ধর্মীয় রচনা ‘দ্য চার্চ অফ ইংল্যান্ড’, ‘লাস্ট এসেজ অন চার্চ এন্ড রিলিজিয়ন’ ইত্যাদি। ১৮৮৬ সালে বুকে ব্যথার কারণে আর্নল্ড বাইরের ব্যস্ত জীবন থেকে অবসর নিয়ে নিজের পোষা বিড়ালগুলোর সাথে গৃহকোণে বেশ ভালোই জীবন কাটাতে থাকেন। ১৮৮৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লিভারপুলে আসেন মেয়ে ও নাতনিকে অভ্যর্থনা জানাতে। সেখানেই ১৫ এপ্রিল ট্রামে যাত্রা করার সময়ে বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের এই দিকপাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
যদিও তার সাহিত্যজীবনের প্রথম দিকে তিনি খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি, কিন্তু জীবনকালেই একসময় তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যের এক প্রবাদতুল্য ব্যক্তিত্ব ও পন্ডিত। সমাজ ও সাহিত্যে চলমান অসঙ্গতি ও ভন্ডামির বিরুদ্ধে সেইসময় ইংরেজি সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ছিলেন একলা সাহসী যোদ্ধা। দেরিতে হলেও স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। অক্সফোর্ডে তার নাম নেওয়া হতো সম্মানের সাথে, জীবনকালে আমেরিকা থেকেও পেয়েছেন যথার্থ স্বীকৃতি। তার জীবনের গল্পই বলে দেয় মেধা, ধৈর্য্য ও চেষ্টার সমন্বয় সফলতা আনবেই।
ফিচার ইমেজ: steemit.com