সাইরাসের জন্ম ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। আগ্রাদেতেস নামে রাখালের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠছিল। সত্যিকার ঘর থেকে বহু দূরে। শিকারি বেড়াল নাকি গোঁফ দেখলেই চেনা যায়। ৫৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সেই কথাই প্রমাণিত হলো আরো একবার। চাউর হয়ে গেল সাইরাসের সত্যিকার পরিচয়।
আগ্রাদেতেসের বয়স তখন দশ বছর। সমবয়সীদের সাথে রাজা-উজির খেলছিল আঙিনায়। সবাই মিলে রাজা বানালো তাকে। সেও সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলো নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী। কাউকে নিযুক্ত করলো দারোয়ান, কাউকে দেহরক্ষী, কাউকে দূত এবং কাউকে গৃহ নির্মাতা। একবাটানার দরবারের আদলে আগ্রাদেতেসের খেলনা দরবার। সবাই হুকুম তামিল করছে; বিপত্তি ঘটালো এক সিদিয়ান বালক। রাজার আদেশের তোয়াক্কা করলো না সে। রাজকীয় নির্দেশনায় অবাধ্যতা গুরুতর অপরাধ। বালকটাকে তাই গ্রেপ্তার এবং বেত্রাঘাত করা হলো।
সত্যিকার প্রহারে বেচারা বালক ইস্তফা দেয় খেলায়। আগ্রাদেতেসের বিরুদ্ধে কেঁদে নালিশ করে পিতার কাছে। পিতা আর্তেমবারেস দরবারে বেশ প্রভাবশালী। সামান্য রাখালপুত্রের স্পর্ধা তাকে ক্রোধান্বিত করে। পুত্র সমেত গিয়ে হাজির হন অস্তাইজেসের সামনে। একটা বিহিত করতেই হবে।
সায়াক্সারেস তখন পশ্চিমের রাজ্য লিডিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে ব্যস্ত। পিতার অনুপস্থিতিতে অস্তাইজেসই একবাটানার অধিনায়ক। আর্তেমবারেস এসে পুত্রের পিঠে আঘাতের দাগ দেখান। ব্যথিত অস্তাইজেস সিদ্ধান্ত নেন বিচার করার। হাজার হোক, সম্ভ্রান্ত বংশের অপমানের প্রশ্ন। খবর পাঠানো হয় অভিযুক্ত বালক আর তার পিতার কাছে। মিত্রাদেতেস ঘটনার পর থেকেই ভীত হয়ে পড়েছিল। তলব আসা মাত্রই আগ্রাদেতেসকে নিয়ে হাজির হয় দরবারে। অপেক্ষা করে ভয়াবহ পরিণতির। অভিযুক্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন অস্তাইজেস।
_গোলামের বাচ্চা, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়, জানিস না?
_হুজুর, গ্রামের ছেলেরা মিলে খেলছিলাম। তারাই আমাকে রাজা নির্বাচিত করেছে। চিন্তা করেছে; আমি তাদের শাসন করার যোগ্য। নালিশকারী নিজেও তখন তাদের একজন হয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। অথচ পরবর্তীতে সবাই আমার কথা মানলেও সে অমান্য করলো। প্রহার করার আগে অব্দি রাজার আদেশে তেমন গুরুত্বই দেয়নি। এখন বলুন আমার অপরাধ। এরজন্য যদি শাস্তি পেতে হয়; আমি প্রস্তুত।
সামান্য বালকের এমন পরিণত আর কৌশলি জবাবে অস্তাইজেসের সন্দেহ জাগে। আর যাই-ই হোক, সে রাখালের পুত্র হতে পারে না। তাছাড়া দেহের গড়ন আর মুখের ছাপেও আভিজাত্যে পূর্ণ। মান্দানার ছেলে বেঁচে থাকলে এই বয়সই হতো এতোদিনে। আর্তেমবারেস আর তার ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বিদায় করলেন অস্তাইজেস। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থেকে মিত্রাদেতেসকে ডেকে নিলেন এক কোণে।
_এই ছেলে তুমি কোথায় পেলে?’
_হুজুর, এ আমার নিজের সন্তান। ওর মা এখনো জীবিত।
মিত্রাদেতেস এমনিতেই আতঙ্কিত। এমন প্রশ্ন ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দেয়। বিশ্বাস করানোর মতো ভাষা পায় না। অস্তাইজেস নিজেও ভুলভালে আশ্বস্ত হবার লোক নন। প্রহরী ডাকা হলো। সোজা কথায় কাজ না হলে আঙুল বাঁকা করতে অসুবিধা নেই। প্রহরী টেনে হিঁচড়ে নিতে উদ্যত হতেই মুখ খুলতে রাজি হয় মিত্রাদেতেস। প্রাণের ভয়ে তুলে ধরে ঘটনার আগাগোড়া। কেবল মুখ বুজে শুনেন অস্তাইজেস। আর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে হারপাগাসের উপর। তারপরও যথাসম্ভব স্থির রাখলেন নিজেকে। সত্যিকার শিকারি কখনো বুঝতে দেয় না নিজের গতিবিধি। পূর্ব প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা প্রমাণিত হওয়ায় অস্তাইজেসের দানবসত্তা তেঁতে উঠেছিল। খবর পাঠানো হলো হারপাগাসের নিকট। সবকিছু ফেলে এক্ষুনি চলে আসুক। হারপাগাস নির্বোধ না। দরবারে ঢুকে পরিস্থিতি বুঝে নিতে বেগ পেতে হয়নি। শান্ত আর গম্ভীরভাবে মুখ খুললেন অস্তাইজেস।
_মান্দানার শিশুটাকে কীভাবে হত্যা করেছিলে?
_হুজুর, তাকে নেবার সময়েই ভেবেছি আপনার আদেশ পালন করতে। সেই সাথে চেয়েছি নাতি হত্যার পাপ থেকে বাঁচাতে। রাখাল মিত্রাদেতেসকে ডেকে শিশু হত্যার জন্য নিয়োগ দেই। আপনার আদেশ ছিলো হত্যার। আমিও আদেশ দেই, যেনো পাহাড়ের নির্জন স্থানে ফেলে মৃত্যু অব্দি নজর রাখা হয়। সতর্ক করেছিলাম, অন্যথা হলে ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। সে আমার হুকুম তামিল করেছে। পরবর্তীতে বিশ্বস্ত দূত পাঠিয়ে লাশের খবর নিয়েছি। -মিথ্যা বলার চেষ্টা করলো না হারপাগাস।
_যাহোক, ছেলেটা এখনো জীবিত।– দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন অস্তাইজেস। ‘ওর পরিণতি আর মেয়ের বিষাদে বিব্রত ছিলাম। এখন বেশ ভারমুক্ত লাগছে। তুমি বরং নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। তোমার ছেলেটাকে পাঠিয়ে দাও। নাতির সাথে সময় কাটানোর জন্য। ওর নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশু জবাই হবে। রাতের ভোজে থাকবে কিন্তু’।
অস্তাইজেসের কণ্ঠস্বর নাটকীয়ভাবে ঘুরে গেলো। সমস্ত আতঙ্ক উবে যায় হারপাগাসের। এতো সহজে পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে, এ তার প্রত্যাশার বাইরে। বাসায় গিয়েই তেরো বছর বয়সী পুত্রকে পাঠিয়ে দেয় রাজপ্রাসাদে। নির্দেশনা দিলো অস্তাইজেসের আদেশ পালনের। মন থেকে নেমে গেলো বহু বছর ধরে বয়ে বেড়ানো পাথর। স্ত্রীর কাছে উজার করে দেয় সমস্ত কথা। সে কি আর জানতো; তার উল্লাসের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে ভয়াবহ পথে? রাতে প্রাসাদের দাওয়াতে আসলো হারপাগাস। বেশ ঝলমলে আয়োজন। অনেকক্ষণ ধরে চললো নাচ গান আর হাসি-তামাশা। সবার শেষে প্রত্যাশিত ভোজপর্ব। খাওয়া সমাপ্ত হবার দিকে অস্তাইজেস এগিয়ে এলেন সামনে।
_কেমন উপভোগ করলে, হারপাগাস?
_অসাধারণ, হুজুর।
কিছু একটা ইশারা করলেন অস্তাইজেস। আর ঢেকে রাখা বাক্স হাতে এগিয়ে এলো ভৃত্য। রাখলো হারপাগাসের সামনে। ‘তোমার যা খুশি উঠিয়ে নাও’- বললেন তিনি। হারপাগাস কৃতজ্ঞতায় অবনত হয়। কিন্তু বাক্স উঠাতেই অবশ হয়ে আসে সারা শরীর। নিজ পুত্রের কাটা হাত, পা আর মাথা। যখন পুত্রকে প্রাসাদে পাঠিয়েছিল; তখনই কুচক্রী অস্তাইজেস তাকে হত্যা করে। কেটে টুকরো টুকরো করে রান্না করা হয়। সবাই যখন খাসির গোশত খাচ্ছে; হারপাগাসের প্লেটে তুলে দেয়া হয় তার-ই পুত্রের গোশত। অস্তাইজেস তারপরও প্রশ্ন করেছিল;
_জানো হারপাগাস, তুমি কিসের গোশত খেয়েছো?
_জানি হুজুর, আপনার ইচ্ছা পূরণ হোক।
এর বেশি কোনো কথা বলতে পারলো না হারপাগাস। অথচ ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে যেন। বেঁচে যাওয়া গোশতটুকু কোনোরকমে সাথে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। কবর দেয় একটা স্থান খুঁজে বের করে। বমি করে অনেক ক্ষণ। পিতার হাতে পুত্রের গোশত; অথচ কতটা নিস্তব্ধভাবে হজম করলো সে! মুখ দেখে কেউ বুঝতেও পারলো না; কতো বড় ঝড় গিলে ফেললো হারপাগাস। আর কোনো সন্তান ছিল না তার। তারপরেও অস্তাইজেসের সাথে এমন ব্যবহার করলো, যেনো একটা উচিত শিক্ষা হয়েছে। যেনো এই শিক্ষাটা তার প্রয়োজন ছিল। যেন সে আর কখনো অবাধ্য হবে না। এইজন্যই আর জল গড়ালো না আপাতত। হারপাগাস টিকে থাকলো অস্তাইজেসের দরবারে।
ঘরে ফেরা বালক আগ্রাদেতেস এখন সেই হারিয়ে যাওয়া নাতি সাইরাস বলে প্রমাণিত। কিন্তু অস্তাইজেসের মনের ভেতর খুঁতখুতি কমেনি। কয়েক বছর আগে যে জ্যোতিষী স্বপ্নের তর্জমা করেছিল; তাকেই তলব করা হলো ফের। স্বপ্নগুলো উপস্থাপন করে হাকিকত জানতে চাইলেন নতুন করে। জবাবে জ্যোতিষী আগের মতোই হিসাব শোনায়।
_ছেলেটি অবশ্যই রাজা হবে। অবশ্য যদি না অকালমৃত্যু ঘটে।
_কিন্তু সে তো জীবিত এবং নিরাপদ। -রাজার আতঙ্ক ঘনীভূত হয়। এক এক করে খুলে বলে গ্রামে রাখালপুত্র হয়ে বসবাস, বালকদের সাথে রাজা-উজির খেলা এবং দরবারে বিচারের ঘটনাও।
_তাহলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, হুজুর। সে যদি সত্যিই বেঁচে থাকে এবং খেলাচ্ছলেই রাজা হয়ে থাকে, তাহলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। মাঝে মাঝে কঠিন ভবিষ্যদ্বাণীও ছোট্ট বিষয় দিয়ে বাস্তবায়িত হয়। শক্ত স্বপ্ন সত্যতা পায় তুচ্ছ বিষয়ের মধ্য দিয়ে।
_সেটাই ভাবছি। -শুনে আশ্বস্ত হন অস্তাইজেস। ‘তার রাজা হওয়ার মধ্য দিয়েই আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। এখন সে মোটেই বিপজ্জনক না। তারপরও সতর্কতা জরুরি। আমার পরিবার এবং তোমাদের জন্য কল্যাণকর কোনো উপায় বাতলে দাও।’
_আপনার স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধিই আমাদের কাম্য, হুজুর। ছেলেটি পারসিক এবং বিদেশি। তার হাতে ক্ষমতা গেলে আমরা মিদিয়াবাসী পরাধীন হয়ে যাব। হারাব ক্ষমতার পাশে নিজেদের অবস্থান এবং মর্যাদা। আপনি থাকা অবস্থায় যা পাচ্ছি; তাও। আপনাকে সমর্থন দেয়ার জন্য এতোটুকুই তো যথেষ্ট। এই মুহূর্তে কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না। তবু সতর্কতার জন্য আপনি বরং নাতিকে দূর পারস্যে মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিন।
পরামর্শটা পছন্দ হলো অস্তাইজেসের। সবাইকে বিদায় করে দিয়ে সাইরাসকে কাছে ডাকলেন। ‘একটা ভুল স্বপ্নের কারণে তোমার প্রতি জুলুম করেছি। ভাগ্য বাঁচিয়ে দিয়েছে। এখন একজন বিশ্বস্ত প্রহরী দিয়ে দিচ্ছি; আনশান চলে যাও। সেখানে নিজের মা ও বাবাকে দেখেতে পাবে। মিত্রাদেতেস আর তার স্ত্রী থেকে তারা ভিন্ন।’
আনশান ফিরলো সাইরাস। ক্যামবিসেস আর মান্দানার আনন্দ তখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। যেন বহু বছর আগে মরে যাওয়া ছেলেটি ফিরে আসলো ঘরে। যেন শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণা হঠাৎ ছলকে উঠল। নতুন মায়ের কাছে সাইরাস স্পাকো আর মিত্রাদেতেসের স্নেহ তুলে ধরতে ভুলল না। বরং স্পাকোর প্রশংসায় এতোটাই পঞ্চমুখ ছিল যে; মান্দানার ভেতর ঈর্ষা জেগে উঠে। প্রথমে তারা সাইরাসকে স্পাকোর নাম মুখে আনতে নিষেধ করে। তবু বন্ধ করতে না পেরে উদ্ভাবন করে এক উপকথার। মানুষকে বুঝায় স্পাকো আসলে একটা কুকুরী মাত্র। মিদিয়ান ভাষায় স্পাকো শব্দের অর্থ কুকুরী। অন্যদিকে মিথ্রাস প্রাচীন পারস্যের অন্যতম দেবতা; যার থেকেই মিত্রাদেতেস নামের উদ্ভব। সাইরাসকে জঙ্গলে রেখে আসা হলে দেবতা মিথ্রাসের সহায়তায় একটা কুকুরী তাকে অলৌকিকভাবে লালনপালন করেছে। অর্থাৎ সাইরাসের বেঁচে থাকাটা স্বর্গীয় ইচ্ছারই প্রকাশ। সাইরাস বেড়ে উঠবে খোদার বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। খোদাই হেফাজত করবেন তাকে।
জন্মের পেছনে কিংবদন্তি প্রচলিত থাকার নজির ঢের। রোমান সাম্রাজ্যের স্থপতি রোমিওলাস এবং রিমাসকে দুধ খাইয়ে বড় করেছে নেকড়ে। গ্রিক পুরাণে ঈদিপাসের জন্ম এবং বেড়ে উঠাও কাছাকাছি। বনি ইসরাইলের নবি মুসাকেও হত্যাচেষ্টা করা হয়। হিন্দুধর্মে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনীও এখানে প্রাসঙ্গিক। সাইরাসের জন্মবৃত্তান্ত যেন ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠার ইশারা। ইশারা মাতামহের দুঃস্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার। পদানত করার আভাস তৎকালীন পৃথিবীকে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের স্থান অব্দি। ইতোপূর্বে পৃথিবীতে যে নজির স্থাপিত হয়নি। কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন।
আরো পড়ুন-