Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ: সুরের জগতের এক ধ্রুবতারা

ষোড়শ এবং সপ্তাদশ শতক জুড়ে ‘বারোক’ (সঙ্গীতের একটি শ্রেণী) সঙ্গীত পৃথিবী শাসন করেছে। এসময় এক জার্মান সুরকার ছিলেন এই সঙ্গীতের একচ্ছত্র অধিপতি। তার তৈরি সুরে মাতোয়ারা হতো পুরো ইউরোপ। সঙ্গীত সম্বন্ধে যাদের সম্যক জ্ঞান আছে, তারা নিশ্চয়ই কালজয়ী কম্পোজিশন ‘ফিউগ ডি মাইনর’, ‘ব্রান্ডেনবার্গ কনসার্টরস’, ‘ম্যাস বি মাইনর’, ‘সেন্ট ম্যাথিউ প্যাসন’ ইত্যাদির কথা জেনে থাকবেন। তার এই কালজয়ী সৃষ্টিগুলো অবশ্য ক্লাসিক্যাল যুগে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু ১৯ শতকের শেষভাগে রূপকথার ফিনিক্সের মতো নিজের শিল্পের মাঝে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেন তিনি। তার এই পুনর্জীবন তাকে সঙ্গীতের আকাশে এক ধ্রুবতারা হিসেবে স্থাপন করেছে। তিনি জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ।

জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫-১৭৫০ সাল); Image Source: mattotto.org

১৬৮৫ সালের ৩১ মার্চ (ওল্ড স্টাইল বর্ষপঞ্জি অনুসারে ২১ মার্চ) জার্মানির আইজেনাখে জন্মগ্রহণ করেন জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ। তার কয়েক প্রজন্ম আগে থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে তার পরিবারে সঙ্গীতচর্চা হয়ে আসছিল। তার পিতা জোহান এমব্রোসিয়াস ছিলেন স্থানীয় নামকরা সঙ্গীতশিল্পী। এমব্রোসিয়াস বংশানুক্রমিক পরম্পরাকে ছেলের মাঝে পৌঁছে দেন শৈশবেই ভায়োলিন বাজানো শিখিয়ে। ঐতিহাসিকগণ বলেন, পড়ালেখায় হাতেখড়ির আগে সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়েছিল বাখের।

৮ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বাখ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বলতে ধর্মীয় শিক্ষাটাই ছিল সর্বাগ্রে। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ধর্মানুরাগী। লুথেরান মতবাদে বিশ্বাস ভবিষ্যৎ জীবনে তার সঙ্গীত চর্চায়ও প্রতিফলিত হয়েছিল। তবে ১০ বছরে পা রাখতে রাখতে পিতা-মাতা উভয়কে হারান তিনি। সঙ্গীত এবং পড়ালেখা, উভয়ই সাময়িক বিঘ্নিত হয়। কয়েকমাস নানার বাড়িতে থাকার পর তার বড় ভাই জোহান ক্রিস্টফ তাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। ক্রিস্টফ ছিলেন একটি চার্চের অর্গানবাদক। তিনি ছোট ভাইকেও অর্গান বাজানোর অল্প-বিস্তর ধারণা দিতে শুরু করেন। ভাইয়ের বাড়িতে ৫ বছর কাটিয়ে লিউনবার্গ শহরে চলে যান তিনি।

হার্পসিকর্ড; Image Source: kennedyharpsichords.com

কৈশোরে বাখের কণ্ঠ ছিল বেশ শ্রুতিমধুর এবং জোরালো। নিজেকে তখন ভবিষ্যৎ গায়ক হিসেবেই কল্পনা করতেন তিনি। কণ্ঠের কারণে বিনা বেতনে একটি সঙ্গীত স্কুলে পড়ার সুযোগও পেয়ে যান। তবে কয়েকবছরের মাঝে তার কণ্ঠে বড় রকমের পরিবর্তন আসে এবং তিনি গান গাওয়া ছেড়ে ভায়োলিন ও হার্পসিকর্ড (একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র) বাজানো শুরু করেন। বড় ভাইয়ের কাছে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং স্থানীয় এক অর্গানবাদকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অর্গানও বাজাতে শুরু করেন। ১৮ বছর বয়সে চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন। তার প্রথম চাকরিটি অবশ্য সঙ্গীত সংক্রান্তই ছিল। এলাকার ডিউকের দরবারে প্রধান সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন তিনি। সঙ্গীতজ্ঞ বলা হচ্ছে এজন্য যে সেখানে তিনি একাধারে ভায়োলিন, অর্গান, হার্পসিকর্ড বাজাতেন, প্রয়োজনে গান লিখতেন, সুর দিতেন, এমনকি গাইতেনও!

অর্গান; Image Source: en.wiktionary.org

নিজ শহরে রাতারাতি নামকরা সঙ্গীতবিদে পরিণত হন বাখ। তার প্রায়োগিক দক্ষতা অন্যদের চেয়ে তাকে এগিয়ে দিয়েছিল অনেকাংশে। আর্নস্টাডের প্রধান চার্চে প্রধান অর্গানবাদক হিসেবে যখন নিয়োগ পান, তখন সঙ্গীত শিক্ষাও দিতে শুরু করেছিলেন। তথাপি, অন্যদের চেয়ে ভালো জ্ঞান রেখেও তার শিক্ষার্থী ছিল কম। কারণ, স্বভাবে তিনি তখনো বেশ রগচটা, অনেকটা হুইপল্যাশ সিনেমার সঙ্গীত শিক্ষক ট্যারেন্স ফ্লেচারের মতোই! শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ ব্যবহারের জন্য প্রায়শই চার্চের ভর্ৎসনা শুনতে হতো। এর উপর করে বসলেন আরেক কাণ্ড, যে কারণে তার ভালো বেতনের চাকরিটি হারাতে হয়েছে। তৎকালীন বিখ্যাত অর্গানবাদক ডিয়েট্রিচের অর্গান শুনবার জন্য তিনি হঠাৎ চলে যান লুবেক শহরে এবং কাউকে না জানিয়ে সেখানে কাটিয়ে আসেন ২ বছর!

ফিরে এসে যখন জানলে চাকরি হারিয়েছেন, তখন অবশ্য খুশিই হয়েছিলেন বাখ। কেননা, আর্নস্টাডের চার্চ থেকে চাকরিতে অব্যহতি দেয়ার নিয়ম নেই। চাকরি হারিয়ে যেন মুক্ত হন তিনি! এরপর আবার ফিরে যান লুবেক শহরে এবং সেখানকার ‘চার্চ অব সেন্ট ব্লেইস’এ প্রধান অর্গানবাদক হিসেবে নিয়োগ পান। এই চার্চে জনসমাগম বেশি হতো বিধায় তিনি ভেবেছিলেন এখানে নিজেকে সহজে পরিচিত করতে পারবেন। তার কয়েকবছরের প্রচেষ্টায় তৈরি কম্পোজিশন ‘এক্টাস ট্রাগিসাস’ এই চার্চে তিনি বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন প্রথম দিনই। কিন্তু বিধিবাম, চার্চের যাজকদের পছন্দ হলো না তার বাজনা। বলা হয়েছিল, বাখের সঙ্গীত বেশ জটিল, যেখানে চার্চের সঙ্গীত সহজ সরল হওয়া উচিত!

বাখের কম্পোজিশন; Image Source: en.wiktionary.org

এখানে সুবিধা করতে না পেরে শীঘ্রই তিনি কোটহেনে পাড়ি জমান। সেখানেও এক চার্চে প্রধান অর্গানবাদক হিসেবে কাজে লাগেন। তবে এখানেই প্রথম ধর্মীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি লোকায়ত সঙ্গীতের দিকেও মনোযোগ দেন। তথাপি, তার সেকুলার সঙ্গীতচর্চাও পুরোপুরি ধর্মের প্রভাবমুক্ত ছিল না। সে প্রভাব অবশ্যই ইতিবাচকই হয়েছে। জীবনে যতগুলো কম্পোজিশন তিনি লিখেছেন, প্রতিটির শুরুতেই ল্যাটিন ভাষায় লিখেছেন ‘নোমিনি জেসু’, যার অর্থ, ‘যীশুর নামে শুরু করছি’। কোটহেনে থাকতেই নিজের সবচেয়ে চমৎকার ভায়োলিনের সুরগুলো রচনা করেন বাখ। তাছাড়া অর্কেস্ট্রার জন্য কম্পোজ করেন বিখ্যাত ‘কনসার্টস’। তিনি অসংখ্য কনসার্টস কম্পোজ করেছিলেন, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ‘ব্রান্ডেনবার্গ কনসার্টস’। কোটহেনের ডিউক ব্রান্ডেনবার্গের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে তিনি যে কনসার্টসগুলো তৈরি করেছিলেন, সেগুলোই ব্রান্ডেনবার্গ কনসার্টস হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে।

ব্রান্ডেনবার্গ কনসার্টস রচনার কিছুকাল পরই বাখ লিখে ফেলেন তার প্রথম বই ‘দ্য ওয়েল টেম্পার্ড ক্লেভিয়ার’। বইটি তিনি লিখেছিলেন সঙ্গীতের প্রাথমিক বিষয়াদি নিয়ে যেন সঙ্গীতজগতে নবীনরা সহজে গভীরে প্রবেশ করতে পারে। এই বইয়ের খ্যাতি তাকে লিপজিগে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ করে দেয়। উল্লেখ্য, তৎকালীন জার্মানির নামকরা সব সঙ্গীতবিদের আনাগোনা ছিল লিপজিগ শহরেই। লিপজিগের সর্বোচ্চ চার্চ সেন্ট থমাসে অর্গানবাদক এবং অর্গান শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এ কাজের পাশাপাশি অসংখ্য ‘ক্যানতাতা’ রচনা করেন তিনি। ক্যানতাতা হলো যান্ত্রিক সুরের সাথে কণ্ঠের সুরের সমন্বয়ে একপ্রকার কম্পোজিশন। আধুনিককালের ক্যানতাতাগুলো তারই ক্যানতাতাগুলোর উন্নত সংস্করণ মাত্র। তাই মৌলিকত্বের প্রশংসার তিনিই দাবীদার।

বাখের রচিত ক্যানতাতা; Image Source: en.wikipedia.org

সেন্ট থমাস চার্চে থাকাকালীনই বাইবেল নিয়ে কাজ শুরু করেন বাখ। বাইবেলের বিভিন্ন অধ্যায়ের জন্য উপযোগী গীতি কিংবা কোরাসের জন্য যন্ত্রসঙ্গীত তৈরি করেন তিনি। তার এই কাজগুলো পরিচিত হয় ‘প্যাসন’ হিসেবে। প্যাসনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শিল্পগুণে সেরা প্যাসনটি হলো ‘সেন্ট ম্যাথিউ প্যাসন’, যা বাইবেলের ‘গসপেল অব ম্যাথিউ’ এর কোরাস। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় ‘ম্যাস বি মাইনর’। এই যান্ত্রিক সুরটি কম্পোজ করতে তিনি ৫ বছর সময় নিয়েছিলেন। এটি নিয়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষারও কমতি ছিল না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তিনি বেঁচে থাকতে এই কম্পোজিশনটি কখনো দর্শকের সামনে পরিবেশিত হয়নি।

১৭৪০ এর দিকেই দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাবার কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে আসে বাখের। তথাপি ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েই তিনি প্রতিনিয়ত যান্ত্রিক সুর তৈরি করে চলেন। একবার প্রুসিয়ার রাজা ‘ফ্রেডরিখ দ্য গ্রেট’ তাকে নিজের দরবারে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর আমন্ত্রণ জানান। বাখ একটি কম্পোজিশন লিখে রওনা দিলেও পথিমধ্যে তা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু রাজার দরবারে যেদিন যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনে বসলেন, সেদিন যন্ত্রের টুংটাঙয়ের মধ্য দিয়ে কেবলই তার প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছিল। কেননা, কোনোরূপ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তিনি সেদিন রাজার দরবারে নতুন একটি সুর তৈরি করে ফেলেন, যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিল পুরো রাজদরবার। রাজদরবারের এই তাৎক্ষণিক আবিষ্কার নিজ দেশে ফিরে কিছুতেই আর পুনঃনির্মাণ করতে পারলেন না বাখ।

বাখের ম্যাস বি মাইনরের একাংশ; Image Source: omifacsimiles.com

এই না পারা অবশ্য একদিক থেকে মঙ্গলজনক ছিল। কেননা, সেই সুরটি পুনরায় তৈরি করার প্রয়াসে আরেকটি নতুন সুরেরই আবির্ভাব ঘটান এই সুর প্রতিভা। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য আর্ট অব ফিউগ’। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি এটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। চোখের সমস্যা এত প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে তিনি অস্ত্রোপচারে বাধ্য হন। অস্ত্রোপচারের পর আলো ফিরে পাওয়া দূরে থাক, পুরোপুরি অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছিল তার। এরপর আর সঙ্গীতে ফেরা হয়নি তার। অন্ধত্বের একবছর পর ১৭৫০ সালের ২৮ জুলাই লিপজিগে মৃত্যুবরণ করেন বাখ।

বাখের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য সংরক্ষিত নেই ইতিহাসে। তিনি দুবার বিয়ে করেছিলেন এবং দুবারে ২০ সন্তানের বাবা হন! প্রথমবার চাচাত বোন মারিয়াকে বিয়ে করেন, যার গর্ভে আসে বাখের ৭ সন্তান। বিয়ের ১৩ বছর পর মারিয়া মৃত্যুবরণ করলে অ্যান মাগদালিনকে বিয়ে করেন বাখ। মাগদালিনের ঘরে জন্ম নেয় আরো ১৩ সন্তান। মোট ২০ সন্তানের ৯ জনই শৈশবে মারা যায়। বাকিদের মধ্যে ৪ জনই বাবার মতো সঙ্গীতে বিখ্যাত হন। কেউই অবশ্য বাখের সমপর্যায়ে পৌঁছুতে পারেননি।

বাখের দ্বিতীয় পত্নী মাগদালিন; Image Source: telegraph.co.uk

জীবদ্দশায় সুরকারের চেয়ে বেশি অর্গানিস্ট হিসেবেই পরিচিত ছিলেন জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ। তিনি কেবল সুর সৃষ্টিই করতেন না, সে সুরকে প্রবাহিত করতেন গল্পের সাথে তাল মিলিয়ে। যান্ত্রিক সুরের মাধ্যমে গল্প বলার ধারা তো তার হাতেই সমৃদ্ধ হয়েছে। একবার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে গেলে শ্রোতার আবেগ নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করতেন তিনি। তার সঙ্গীত চর্চা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত সঙ্গীতবিদ মোজার্ট আর বিটোফেন। মধ্যযুগের শিল্পী হলেও তার শিল্পকর্ম আধুনিক যুগের চেয়েও যেন আধুনিক। সঙ্গীতের জগতে তাই বাখ এক অমর নাম।

This article is written in Bangla language. It's about one of the most famous composer ever, Johann Sebastian Bach.
Necessary references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: wqxr.org

Related Articles