Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এরাটোস্থেনিস: প্রাচীন ভূগোলের জনক এবং অংকের চালনীর আবিষ্কারক

চলুন একটা সংখ্যার খেলা খেলি। তবে খেলা শুরুর আগে একটু জেনে নিতে হবে মৌলিক সংখ্যা কী। যে সংখ্যাকে কেবল ঐ সংখ্যাটি এবং ১ দ্বারা ভাগ করা যায়, তাই মৌলিক সংখ্যা। গণিতের মৌলিক সংখ্যা অনেকটা রসায়নের মৌলিক পদার্থের মতই, যাকে ভাঙলে আর কোনো পদার্থ পাওয়া যায় না। যা হোক, আমাদের সংখ্যার খেলাটি এই মৌলিক সংখ্যা নিয়েই। আপনাকে যদি বলা হয়, ১ থেকে ১০০ এর মধ্যে মৌলিক সংখ্যাগুলো বের করতে, চট করে বের করে ফেলতে পারবেন কি? অবশ্যই পারবেন না। তবে একটি বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে, চট করে না হোক, দ্রুত সময়ের মধ্যেই আপনি মৌলিক সংখ্যাগুলো নির্ণয় করে ফেলতে পারবেন। সেই পদ্ধতিটির নাম হচ্ছে ‘চালনী’ পদ্ধতি!

নামটা একটু অদ্ভুত তাই না? তবে অপ্রাসঙ্গিক নয় মোটেও। এই পদ্ধতিতে, আপনি চালনী দিয়ে ছেকে সব যৌগিক সংখ্যাগুলোকে তুলে ফেলতে পারবেন! কয়েকধাপে তুলে ফেলার পর এক সময় কেবল মৌলিক সংখ্যাগুলোই থেকে যাবে। কীভাবে তুলে ফেলবেন যৌগিক সংখ্যাগুলোকে? পদ্ধতি খুবই সহজ। নিচের ছবিটির দিকে লক্ষ্য করুন। ছবিটিতে ১ থেকে ১২০ পর্যন্ত সংখ্যার মধ্যে মৌলিক সংখ্যা নির্ণয় করে দেখানো হয়েছে।

এরাটোস্থেনিসের চালনী; source: algolist.net

এই পদ্ধতিতে যৌগিক সংখ্যাগুলোকে ধারাবাহিক মৌলিক সংখ্যার বিভাজ্যতা অনুসারে চালনী দিয়ে উঠিয়ে ফেলতে হবে। যেহেতু ১ মৌলিক সংখ্যা নয়, তাই ছকে ১ রাখা হয়নি। এবার মৌলিক সংখ্যা ২ দ্বারা বিভাজ্য সকল সংখ্যা উঠিয়ে ফেলুন (অবশ্যই ২ বাদে অন্য সংখ্যাগুলো)। ছবিতে একটি নির্দিষ্ট রঙে ২ দ্বারা বিভাজ্য সংখ্যাগুলো দেখানো হয়েছে। পরের ধাপে ২ এর পরবর্তী মৌলিক সংখ্যা ৩ দ্বারা বিভাজ্য সকল সংখ্যা (৩ বাদে) উঠিয়ে ফেলুন। এই প্রক্রিয়া চলবে, যতক্ষণ না কোনো মৌলিক সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য সংখ্যা, আপনার বাছাইকৃত সর্বোচ্চ সংখ্যার সীমার মধ্যে খুঁজে পাওয়া না যাবে।

এভাবে ৩ এর পরবর্তী মৌলিক সংখ্যা যথাক্রমে ৫, ৭, ১১, ১৩ এবং ১৭ দ্বারা বিভাজ্য সংখ্যাগুলো তুলে নিলে কেবল মৌলিক সংখ্যাগুলোই অবশিষ্ট থাকে। ছবিতে বিভিন্ন রঙে সেটি দেখানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অসীম পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব। যদিও এই পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বেই গ্রীকরা আবিষ্কার করেছিল যে, মৌলিক সংখ্যা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। তথাপি, সহজে মৌলিক সংখ্যা নির্ণয়ের কোনো পদ্ধতি তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। অবশ্য আমাদের আলোচনা এই চালনী পদ্ধতি নিয়ে নয়, যিনি এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, তাকে নিয়েই আমরা কথা বলবো। তিনি গণিতবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, জ্যোতির্বিদ এবং একাধারে একজন সফল কবি, এরাটোস্থেনিস অব সাইরেন।

এরাটোস্থেনিস সেই ব্যক্তি, যিনি ২৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বসে পৃথিবীকে গোলাকার কল্পনা করে এর আকার পরিমাপের চেষ্টা করেছিলেন। অথচ সে সময় পৃথিবীকে একটি সমতল থালা সদৃশ ভাবা হতো! তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি প্রাচীনকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক পিছিয়ে থাকা পৃথিবীতে বসে, পৃথিবীর বিষুব রেখার সাথে এর ঘূর্ণন অক্ষের ঢাল, মোটামুটি সঠিকভাবে নির্ণয় করেছিলেন, যদিও তার সেই সম্পর্কিত কাজ হারিয়ে গেছে! তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি প্রথম অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ সহ মানচিত্র এঁকেছিলেন। গ্রীক শব্দ ‘জিও’ অর্থ পৃথিবী এবং ‘গ্রাফি’ অর্থ ‘শাস্ত্র’ থেকে তিনি ‘জিওগ্রাফি’ শব্দের প্রচলন করেন, যা আজও বিজ্ঞানের একটি অনন্য শাখার নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাই তাকেই বলা হয় ভূগোলের জনক।

নীলনদের উপকূলে প্রাচীন সভ্যতা; source: ozono21.com

সে সময় প্রতিবছর নীলনদের বন্যায় উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হতো। এরাটোস্থেনিস প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই বন্যার প্রকৃত কারণ বের করেন। তিনি দেখান যে, প্রতিবছর নীলনদের উৎসের আশেপাশের অঞ্চলে ভারী মৌসুমী বৃষ্টির কারণে বন্যা হয়। অন্যদিকে, শুধুমাত্র বিজ্ঞানচর্চায় নিজেকে আবদ্ধ না রেখে তিনি জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে বিচরণের চেষ্টা করেন। আর তাই ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের বই লেখার পাশাপাশি, ইতিহাস, দর্শন এবং সাহিত্যেও তিনি পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন সমানতালে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সকল মানুষকে তার ভালো-মন্দ গুণের প্রেক্ষিতে বিচার করার দর্শন দাঁড় করিয়েছিলেন। অথচ তখন মানুষ দুই প্রজাতির বলে একটি ধারণা প্রচলিত ছিল। এক প্রজাতি গ্রীক, আর বাকি সব ‘বার্বারিয়ান’ বা বর্বর!

প্রাচীন পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান ছিল কোনটি? উত্তর নিঃসন্দেহে গ্রিস। আর যদি বলা হয়, প্রাচীন পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান কোনটি? এক্ষেত্রে উত্তর আরো সহজ, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। যথারীতি, সমসাময়িককালের সবচেয়ে সম্মানজনক পেশাও এই নামটির সাথেই জড়িত ছিল। সেটি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির পরিচালকের পদ। নিজের সময়ে এরাটোস্থেনিসের জ্ঞানের চর্চা ছিল পুরো গ্রিস জুড়েই। ফলে এই সম্মানজনক পদের জন্য তাকেই বাছাই করা হয়।

আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি; source: juliantrubin.com

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পদচারণার জন্য এরাটোস্থেনিসের সমালোচকও নিছক কম নয়। একাধিক বিষয়ে তিনি জানতেন ঠিকই, কিন্তু কোনো বিষয়েই পারদর্শী নন, এরকম একটি কথা প্রচলিত ছিল। আর এজন্য দুটি অপমানজনক ডাকনামও তার নামের পাশে জুড়ে দেয়া হয়! একটি হচ্ছে গ্রীক বর্ণমালার দ্বিতীয় অক্ষর ‘বিটা’। এই শব্দটি ব্যবহারের প্রকৃত কারণ জানা যায় না। তবে দ্বিতীয় নাম ‘পেন্টা-অ্যাথলেট’ অধিক প্রচলিত ছিল। পেন্টা-অ্যাথলেট শব্দের অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি পাঁচটি খেলা জানেন এবং খেলেন, কিন্তু কোনো খেলাতেই চ্যাম্পিয়ন নন! ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট। অবশ্য এই দুটি ডাকনামের বাইরেও এরাটোস্থেনিসের আরো একটি কম জনপ্রিয় নাম ছিল, ‘ফিললোগোস’। ফিললোগোস শব্দের অর্থ ‘যিনি শিখতে ভালোবাসেন’। এই নামটি কিন্তু এরাটোস্থেনিস নিজেই দিয়েছিলেন!

যা-ই হোক, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির পরিচালক হয়ে নিজের জ্ঞানভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ করেছিলেন এরাটোস্থেনিস। গ্রিস সহ বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার পীঠস্থান থেকে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতগণ, তাদের দর্শন প্যাপিরাস স্ক্রলে লিখে পাঠিয়ে দিতেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। এরাটোস্থেনিস সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তেন, তারপর লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখবার জন্য পাঠাতেন। আর্কিমিডিসের বিখ্যাত ‘দ্য মেথড’ সম্পাদনা করেছিলেন এরাটোস্থেনিস। আর এসব কাজের মধ্য দিয়েই তিনি নিজেও করেছিলেন বিখ্যাত কিছু কাজ। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেসবের অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। যা আমরা জানতে পারি, তা বিভিন্ন বিখ্যাত দার্শনিকের লেখায় পাওয়া এরাটোস্থেনিস সম্পর্কিত তথ্যাবলী থেকেই।

এরাটোস্থেনিসের মানচিত্র; source: etc.usf.edu

পৃথিবী আনুমানিক কত বড়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই এরাটোস্থেনিস তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণাটি করে ফেলেন এবং লিখে ফেলেন ‘অন দ্য মেজারম্যান্ট অব দ্য আর্থ’ বইটি। তিনি লক্ষ্য করেন যে, বছরের দীর্ঘতম দিনে, সূর্য সরাসরি মাথার উপরে থাকার কারণে সায়েন শহরের দেয়ালগুলো কোনো ছায়া ফেলে না। অথচ আলেকজান্দ্রিয়ার দেয়ালগুলো ঠিকই অল্পবিস্তর ছায়া সৃষ্টি করে! সায়েন ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার ঠিক দক্ষিণে। ফলে উভয় শহরের ছায়ার মধ্যে যে কোণ বিরাজমান, তা নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবে! এই তথ্য বের করার জন্য প্রথমেই কিছু বিষয় অনুমান করে নিলেন এরাটোস্থেনিস।

  • ধরা যাক, পৃথিবী গোলক আকৃতির।
  • ধরা যাক, সূর্যরশ্মিগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পরস্পর সমান্তরালভাবে পতিত হয়।
  • সায়েন শহরে কোনো ছায়া না পড়লেও, আলেকজান্দ্রিয়ায় ছায়া পড়ে। এই ছায়ার কোণ পরিমাপ করতে হবে।
  • আলেকজান্দ্রিয়া এবং সায়েন শহরের মধ্যকার দূরত্ব নির্ণয় করতে হবে।

source: juliantrubin.com

প্রয়োজনীয় অনুমান এবং তথ্যাদি সংগ্রহ করেই অংক কষতে বসে পড়লেন এরাটোস্থেনিস। প্রথমে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় দেয়ালের ছায়া Z নির্ণয় করলেন। Z এর পরিমাণ ছিল ৭° যা একটি পূর্ণাঙ্গ বৃত্তের ৫০ ভাগের এক ভাগ। এবার ইউক্লিডীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি, আলেকজান্দ্রিয়া এবং সায়েনের দেয়াল থেকে নীচের দিকে রেখা টানেন। এই রেখা, পৃথিবীর কেন্দ্রে ছেদবিন্দুতে যে কোণ উৎপন্ন করে, তার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই Z এর সমান। অর্থাৎ আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সায়েন শহরের দূরত্ব, পৃথিবীর পরিধির ৫০ ভাগের এক ভাগ (যেহেতু পৃথিবীকে গোলক ধরা হয়েছে)। এবার হিসাব সহজ। সায়েন থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার দূরত্বকে ৫০ দিয়ে গুণ করলেই পৃথিবীর পরিধি বেরিয়ে আসবে।

সে সময়ের প্রচলিত মানচিত্রে এই দূরত্ব ৫ হাজার স্টাডিয়া ছিল। তাই এরাটোস্থেনিসের হিসেবে, পৃথিবীর পরিধি ৫০০০ × ৫০ = ২,৫০,০০০ স্টাডিয়া। তবে কিছুকাল পরে তিনি এই হিসাব পরিবর্তন করে আরো ২ হাজার স্টাডিয়া যোগ করেন। কোন পদ্ধতিতে তিনি এই বাড়তি ২ হাজার স্টাডিয়া যোগ করেছিলেন, তা জানা যায় না। আরো হতাশ হতে হয়, যখন তিনি স্টাডিয়ার কোন মানটিকে আদর্শ ধরে কাজ করেছিলেন তা-ও জানা যায় না! কারণ স্টাডিয়ার একাধিক মান প্রচলিত ছিল। বর্তমানে আমরা জানি, পৃথিবীর প্রকৃত পরিধি ৪০,০৭৫.১৬ কিলোমিটার। প্রাচীন স্টাডিয়ার বিভিন্ন মান হিসাব করে, এরাটোস্থেনিসের হিসাবের সাথে ১ থেকে শুরু করে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য পাওয়া যায়। তাই বলতেই হয়, দৈবক্রমে যদি এরাটোস্থেনিসের হিসাবটি ১ শতাংশ ভুল হয়ে থাকে, তাহলে প্রাচীনকালে বিজ্ঞানের অনগ্রসরতা বিবেচনায় রেখে, পৃথিবীর প্রকৃত পরিমাপ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন এরাটোস্থেনিস!

১৭ শতকে আঁকা এরাটোস্থেনিসের ছবি; source: martenings.com

এরাটোস্থেনিস, প্রাচীন সিরিয়ার সাইরেন শহরে ২৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শহরটি বর্তমানে লিবিয়ার অন্তর্গত। শৈশবেই, দর্শন এবং গণিত শিক্ষার জন্য, জন্মস্থান ছেড়ে এথেন্স পাড়ি জমিয়েছিলেন। ১৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সম্বন্ধে একটি মজার কাহিনী প্রচলিত আছে। তিনি নাকি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে স্বেচ্ছায় পানাহার ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন! তার যে ছবি পাঠ্যপুস্তক আর ইন্টারনেটে দেখা যায়, সেগুলো ১৬৩৫ সালে বার্নার্ডো স্ট্রোজ্জির আঁকা। অর্থাৎ তার জন্মের প্রায় উনিশশত বছর পর! নিশ্চিতভাবেই, আমরা প্রকৃত এরাটোস্থেনিসকে দেখিনি!

ফিচার ছবি: gizzardstone.com

Related Articles