ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ, মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত এক নাম। তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কারাউনা নামক একটি তুর্কী উপজাতি থেকে আগত। কিছু ইতিহাসবিদ অভিমত দেন, ফখরউদ্দিন বর্তমান নোয়াখালী জেলার পূর্বাংশে অবস্থিত গ্রামের এক সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের সঠিক অবস্থান নিয়ে সন্দিহান থাকলেও ধারণা করা হয়, এটি নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলায় অবস্থিত। কীভাবে মধ্যযুগীয় বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন ফখরউদ্দিন? জানতে ফিরে যেতে হবে অতীতে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ। লখনৌতির গদিতে আছেন দিল্লির সুলতানেরা। কখনো সবল শাসক, কখনো দুর্বল শাসক; এমন ভাঙা-গড়ার খেলায় চলতে থাকত ক্ষমতার পালাবদল। বলে রাখা ভালো, লখনৌতির প্রাচীন নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। রাজা লক্ষ্মণসেনের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়া জয় করার পর পরই লক্ষ্মণাবতীতে এসে পৌঁছান এবং এখানেই তার রাজধানী স্থাপন করেন। মুসলিম শাসনামলে লক্ষ্মণাবতী থেকে এর নাম হয়ে যায় লখনৌতি।
যা-ই হোক, দিল্লির বলবন সুলতান, দৃঢ়চিত্তের খলজি, কিংবা চতুর তুঘলক সুলতানদের পক্ষ থেকে অনেককে লখনৌতির প্রশাসক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিদ্রোহের সুর তুললেও এতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। ওদিকে একের পর এক বিদ্রোহের খবর শুনে ত্যক্ত হচ্ছিলেন দিল্লির সুলতানেরা। তারা ওই অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনের জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হননি। সেজন্য, লখনৌতির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বলগাকপুর’, যার বাংলা অর্থ ‘বিদ্রোহ ভূমি’।
তুঘলক শাসনামলে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক এবং তার সন্তান মুহাম্মদ বিন তুঘলক লখনৌতির দিকে পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন। তারা আঁচ করতে পেরেছিলেন, একক রাজ্য হিসেবে লখনৌতিকে আলাদা রাখলে সেখানে স্ফুলিঙ্গ হিসেবে নিহিত থাকা বিদ্রোহের আগুন বার বার জ্বলে উঠবে। তাই নিজেদের সুবিধার জন্যই তারা লখনৌতিকে তিনটি প্রশাসনিক অংশে ভাগ করে নিলেন। প্রথম ভাগে কেন্দ্র হিসেবে দেওয়া হলো রাজধানী লখনৌতিকে, দ্বিতীয় অংশের কেন্দ্র ছিল সপ্তগ্রাম, এবং তৃতীয় অংশের কেন্দ্র ছিল সুবর্ণগ্রাম (বর্তমানে সোনারগাঁও)। আনুগত্যের উপহার হিসেবে মুহাম্মদ বিন তুঘলক তখন সুবর্ণগ্রামের শাসক হিসেবে বাহরাম খান নামে এক সেনাপতিকে নিযুক্ত করেন। এই বাহরাম খানের বহু দেহরক্ষীর মধ্যে একজন ছিলেন ফখর। ধীশক্তিসম্পন্ন অসম সাহসের অধিকারী এই ফখর ক্রমেই বাহরাম খানের কাছে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে মেলে ধরেন, আস্থার বলে হয়ে ওঠেন বিশ্বাসের পাত্র। ১৩৩৮ সালে মারা যান বাহরাম খান। সেই সুযোগে সুবর্ণগ্রামকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গদিতে বসে যান ফখর। তখন ফখর নামটি পরিবর্তন করে রাখেন ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ।
সামান্য একজন দেহরক্ষীর এহেন অহংকারপূর্ণ দুঃসাহস দেখে ‘থ’ হয়ে রইলেন অন্য এলাকার শাসকবর্গ। তখন ক্রোধের বশে মুহাম্মদ বিন তুঘলক লখনৌতির প্রশাসক কদর খানকে নির্দেশ দেন সুবর্ণগ্রাম আক্রমণের জন্য। এই যুদ্ধে তাদের পাশে মিত্রশক্তি হিসেবে এগিয়ে আসেন সপ্তগ্রামের প্রশাসক আজম-উল-মুলক। আগাম যুদ্ধের সকল ছক আগে থেকেই কষে রেখেছিলেন বিচক্ষণ ফখরউদ্দিন। সেজন্য তিনি নিজের এক নৌবহর তৈরি করে রেখেছিলেন। একপাক্ষিক সেই যুদ্ধে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবার আগেই পরাজয় স্বীকার করে তিনি নৌবহর নিয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে যান। সাথে নিয়ে যান বহন করার মতো কিছু পরিমাণ সম্পদ। কদর খান বা আজম-উল-মুলক; কারও সাথেই নৌবহর না থাকায় তারা কেউ ফখরউদ্দিনের পিছু নিতে পারলেন না। মেঘনার পূর্বতীরের গ্রামগুলোতে নিজ সেনা-সমেত আত্মগোপনে রইলেন ফখরউদ্দিন, অপেক্ষা করতে থাকলেন কখন আসবে বড় এক সুযোগ। সুবর্ণগ্রাম জয়ের পর নিজের ভাগের সম্পদ নিয়ে সপ্তগ্রামে ফিরে যান আজম-উল-মুলক।
কিন্তু ফখরউদ্দিন এসে আবার যাতে এই এলাকা দখল করে ফেলতে না পারেন, সেই চিন্তায় সুবর্ণগ্রামে কিছুদিন থাকার মনস্থির করলেন কদর খান। দেখতে দেখতে বর্ষাকাল চলে এলো। অঝোর বৃষ্টি এবং বাড়তি পানির স্রোতে আবহাওয়া চলে গেলো কদর খানের প্রতিকূলে, তিনি পড়লেন বেকায়দায়। সম্পূর্ণ নতুন আবহাওয়ায় দেখা দিলো চরম খাদ্য সংকট। ক্ষুধার জ্বালায় সৈনিকরা হয়ে পড়ল অসন্তুষ্ট। সুযোগ বুঝে দ্বিধাবিভক্ত সৈন্যদের নিকট পারিতোষিক পাঠালেন ফখরউদ্দিন। পাশাপাশি নিজেও নৌবহর নিয়ে চালালেন অতর্কিত হামলা। সহজেই উদ্ধার করে নিলেন সুবর্ণগ্রাম।
পরিণামদর্শী ফখরউদ্দিন জানতেন, যেহেতু উত্তরাধিকারসূত্রে সিংহাসনের উপর তার কোনো অধিকার নেই, তাই লখনৌতি কিংবা সপ্তগ্রাম থেকে তার উপর আবার হামলা আসতে পারে। ভাবলেন, গদির ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে সাম্রাজ্যকে করতে আরও বিস্তৃত, বাড়াতে হবে নিজ শক্তি। তখন তিনি পূর্বদিকের সমতট জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের দিকে নজর দিলেন।
দুইশো বছর ধরে দেব রাজবংশ সমতট জনপদ একটানা শাসন করার পর তাদের ক্ষমতার দাপটও দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছিল। তৎকালীন সমতট ছিল আজকের যুগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, লক্ষ্মীপুর নিয়ে গঠিত। সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল রোহিতগিরি, যার বর্তমান নাম শালবনবিহার, এটি কুমিল্লা শহরে অবস্থিত। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে সমতট ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত পড়লে সবাই ত্রিপুরার রাজা প্রতাপ মাণিক্যের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সমতটের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরও ছিল ত্রিপুরা-রাজের অধীনে। ফখরউদ্দিন জানতেন, এই বন্দরকে আয়ত্তে আনতে পারলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাবে। কারণ, সিংহল, জাভা, সুমাত্রা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে নিয়মিত জাহাজ এসে এই বন্দরে নোঙর করে। আয় হয় বিপুল রাজস্ব।
পাহাড় পরিমাণ সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে এক বছরের প্রশিক্ষণে তিনি গড়ে তুললেন শক্তিশালী পদাতিক এবং নৌবাহিনী। ১৩৩৯ সালে তিনি কুমিল্লার কাছে ত্রিপুরা-রাজের বাহিনী আক্রমণ করে পরাস্ত করলেন। এরপর নোয়াখালী হয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে গেলেন। চট্টগ্রামের রক্ষী বাহিনী তাকে সর্বস্ব দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কারণ, ফখরউদ্দিনের কপালে লেখা আছে চট্টগ্রাম বিজয়ের উপাখ্যান। চট্টগ্রাম দখলের যুদ্ধে তার সাথে যোগ দেন শরিফউদ্দিন, বদর আলম, হাজি খলিলসহ মোট বারোজন মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং তাদের পরিচারকেরা যোগ দিয়েছিলেন ফখরউদ্দিনের বাহিনীতে। যুদ্ধজয়ের পর ওই বারোজন ধর্মপ্রচারক চট্টগ্রামেই নিজেদের খানকাহ স্থাপন করে শুরু করলেন ধর্মপ্রচার, এবং সেখান থেকেই ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ বাক্যের উৎপত্তি। চট্টগ্রাম বন্দরকে ফখর নিজের মতো সাজালেন। আরব বণিকদের যাতায়াত বাড়ল, বাড়ল সমুদ্র-বাণিজ্যের পরিমাণও।
ফখরউদ্দিনের দূরদর্শী যুদ্ধবিদ্যার কৌশল, এবং নৌবহরের একচেটিয়া ব্যবহারই তার যুদ্ধগুলোতে জয় এনে দেওয়ার অন্যতম নিয়ামক। নৌবহরের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তিনি এই ক্ষেত্রে নিজের শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করলেন। সমুদ্র-বাণিজ্য থেকে অধিক মুনাফা লাভের জন্য জাহাজ-নির্মাণ শিল্পকেও বাড়িয়ে তুললেন বহুগুণে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, নোয়াখালী হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত বিরাট এক রাজপথ তৈরি করেছিলেন তিনি। নোয়াখালীর বাসিন্দারা একে হদ্দিনের ফত (ফখরউদ্দিনের পথ) বলেও সম্বোধন করত। বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিনি জনকল্যাণের জন্য বহু মসজিদ, সরাইখানা, এবং দিঘি স্থাপন করেছিলেন। যার মধ্যে ফেনীর ফখরউদ্দিনের মসজিদ, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ফখরউদ্দিনের দিঘি এখনও সগৌরবে টিকে আছে।
ওদিকে, ইয়েমেন থেকে আসা বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক হজরত শাহজালাল (র.) পূর্বেই শ্রীহট্টে (বর্তমান সিলেটে) নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেলেছিলেন। তাই, চট্টগ্রামের পর ফখরউদ্দিন শ্রীহট্টে অভিযান চালালে শাহজালাল (র.) তার প্রতি হাত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ফলে, জয়ন্তিয়া ও লাউড় অঞ্চলে নিজের ক্ষমতার প্রসার ঘটান ফখরউদ্দিন। হজরত শাহজালাল (র.) এর সান্নিধ্যে এসে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, রাজ্য পরিচালনা ও ক্ষমতা বিস্তারের জন্য ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের সহযোগিতা প্রয়োজন। সেজন্য, তিনি ধর্মসাধক এবং দরবেশদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় নিয়ে আসেন। সুবর্ণগ্রামের উপর দিয়ে যাতায়াতের সময় তাদের অতিথিশালায় বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো।
ফখরউদ্দিনের প্রশংসায় ভেসেছিলেন জগদ্বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। ১৩৪৬ সালে তিনি ফখরউদ্দিনের রাজধানীতে পা রেখেছিলেন। ভ্রমণের সময় তার তো থাকা-খাওয়ার জন্য নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয়নি, উল্টো তাকে সরকারি কোষাগার থেকে দৈনিক আধা দিনার হাতখরচ দেওয়া হোক, আজকের যুগে যা প্রায় দুই হাজার টাকার সমমূল্যের। বাংলার শস্য-ফসল, সম্পদ, মাছ-মাংসের প্রাচুর্য, বাণিজ্য এবং নৌবহর দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলেন ইবনে বতুতা। তার ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে পাওয়া যায়,
“নিঃসন্দেহে ফখরউদ্দিন চমৎকার ও জনপ্রিয় একজন শাসক, আগন্তুক দরবেশ ও সুফিদের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা।”
পূর্বদিক জয়ের পর পশ্চিমদিকেও রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বার বার সপ্তগ্রাম এবং লখনৌতি আক্রমণের পর দখল করলেও, ওই অঞ্চলের ক্ষমতা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। উল্লেখ্য, ফখরউদ্দিনের সাথে লখনৌতির শাসনকর্তা আলাউদ্দিন আলী শাহের সবসময় যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। শুকনো মৌসুমে আলাউদ্দিন সুবর্ণগ্রামে সেনা নিয়ে আক্রমণ করতেন, আর বর্ষা মৌসুমে আক্রমণের সুযোগ কাজে লাগাতেন ফখরউদ্দিন। একসময় ক্রমশ নিস্তেজ আসছিল তার শরীর, বার্ধক্যের ভারে ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়ছিলেন তিনি। যখন বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে তার দিন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, তখন নিজ ছেলেকে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজিকে সিংহাসনে বসান তিনি। তবে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজি বেশি দিন সেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
জীবদ্দশায় দীর্ঘ এগারো বছর শাসন করেছিলেন ফখরউদ্দিন। এক দশকের এই শাসনামলে বাংলার সীমান্তের পূর্ব-রেখা চিরদিনের জন্য অঙ্কিত হয়ে যায়। সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা স্থায়ীভাবে হয়ে যায় বাংলার অংশ, যা ত্রিপুরা রাজ্য এবং আরাকান রাজ্য কর্তৃক পুনর্দখলের চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় হাল ছেড়ে দেয় তারা।