পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু পেশার মাঝে জল্লাদগিরি অন্যতম। হ্যাঁ, অদ্ভুত শোনালেও মৃত্যুদন্ডের আসামীদের ফাঁসি দেওয়া কোনো কোনো মানুষের পেশা হতে পারে বটে। ঠিক সেরকম জল্লাদগিরি পেশা ছিল ইংল্যান্ডে বসবাসকারী এক পরিবারের। এই পরিবারেরই এক সদস্য ৫০০ লোকের ফাঁসি কার্যকর করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন।
ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে মৃত্যুদন্ডের বিধান স্থগিতের জন্য একটি বিল আনা হয়। সময়টা ছিল ১৯৬৫ সাল। তার ঠিক আগে বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডের বিধান কার্যকর ছিল। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের আদালতে প্রচুর মানুষকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল। আর সেসব মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ফাঁসি কার্যকর করতেন আলবার্ট পিয়েরেপয়েন্ট নামের এক জল্লাদ। অ্যালবার্ট পিয়েরেপয়েন্ট এমন একটি পরিবার থেকে এসেছেন যা ব্রিটিশ ন্যায়বিচারে একটি অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।
জন্ম ও শৈশব
আলবার্ট থমাস পিয়েরেপয়েন্টের জন্ম ১৯০৫ সালের ৩০ মার্চ। ব্রিটেনের ইয়র্কশায়ারের বেডফোর্ড জেলার ক্লেটন শহর ছিল তার আদি নিবাস। পরিবারে তার পিতা এবং চাচাও ছিলেন সেসময়ের সরকারি তালিকাভুক্ত জল্লাদ। তার বাবা হ্যারি ১০ বছর এবং তার চাচা থমাস ৪২ বছর ধরে এই পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বাবা-চাচার এই পেশা আলবার্টের জীবনেও প্রভাব বিরাজ করেছিল। আর তাই শৈশবে স্কুলে পড়ার সময় একবার স্কুলের শিক্ষক ছাত্রদেরকে তাদের জীবনের লক্ষ্য কী জানতে চাইলে শিশু আলবার্ট কিছুক্ষণ ভেবেই তার শিক্ষককে জানায় সরকারি জল্লাদ হওয়াই তার জীবনের লক্ষ্য। সেদিনের শিশু আলবার্টের সেই উত্তরে শিক্ষক কী ভেবেছিলেন তা জানা না গেলেও আলবার্ট কিন্তু যৌবনে এসেই তার উত্তরাধিকারের সেই পদাঙ্ক অনুসরণেই সচেষ্ট হয়েছিলেন।
শৈশব-কৈশোর
শৈশবে আলবার্ট তার গ্রীষ্মকালীন ছুটিগুলো তার চাচা থমাস ও চাচী লিজির সাথে তাদের ক্লেটন বাড়িতে কাটাতেন। যখন আলবার্টের পিতা হ্যারিকে সরকারি জল্লাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়, তখন পুরনো বাড়ি ছেড়ে তিনি হেডারস ফিল্ডের দিকে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু পড়াশোনার জন্য আলবার্টকে রেখে যাওয়া হয় তার চাচা-চাচীর সাথে। এ সময় আলবার্ট তার চাচার সাথে আরো ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন। স্কুলের এক ছুটির দিনে তার চাচা যখন ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন, সেদিন হঠাৎ আলবার্ট তার চাচার একটি ডায়েরি হাতে পেয়ে যান, ডায়েরিটি ছিল থমাসের জল্লাদ জীবনের নানা কাহিনী, যা পড়ে দারুণ প্রভাবিত হয়েছিল কৈশোরে পা দেয়া আলবার্টের জীবন।
প্রথম জীবনের চাকরি
১৯১৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ওলহ্যামের কাছে ফেলসওয়ার্থের মার্লবরো মিলসে সপ্তাহে ছয় শিলিং পারিশ্রমিকে কাজ নেন। ১৯২০ সালের শেষের দিকে তিনি তার ক্যারিয়ার পরিবর্তন করেন। এ সময় তিনি পাইকারী দোকান থেকে মালামাল এনে ভ্রাম্যমান দোকানগুলোতে মালামাল প্রদানের কাজ নেন। ঠিক তার কিছু পরেই ১৯২২ সালে আলবার্টের পিতা হ্যারির মৃত্যু হয়। আর তখন আলবার্টের হাতে আসে হ্যারির জল্লাদ জীবনের নানা কাগজপত্র। ১৯৩০ সালে তিনি কার-ট্রাক চালানোর প্রশিক্ষন নেন। ট্রাকের মাধ্যমে মালামাল পরিবহন করে তিনি সপ্তাহে ২ ডলার ২৫ শিলিং পেতেন। কিন্তু তার মনের মধ্যে সরকারি জল্লাদ হিসেবে যোগদানের নেশা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো।
সরকারী জল্লাদ হিসেবে তালিকাভুক্তি
১৯৩১ সালের ১৯ এপ্রিল আলবার্ট ব্রিটেনে সরকারের কারা কমিশনের কাছে তার চাচা কিংবা তার মতো কেউ অবসরে যাবেন এমন কারো শূন্য পদে সহকারী জল্লাদ হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়ার আবেদন জানিয়ে একখানা চিঠি লেখেন। তার কিছুদিন পর কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তার চিঠির উত্তর আসে। চিঠিতে জানানো হয় সেই মুহূর্তে কোনো শূন্য পদ না থাকায় আলবার্টকে বিবেচনা করা যাচ্ছে না।
১৯৩১ সালের শেষের দিকে লিয়নেল মান নামের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন সহকারী জল্লাদ চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে আলবার্টের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। আলবার্টকে ম্যানচেস্টারের স্ট্রঞ্জওয়েস কারাগারে সাক্ষাত দেয়ার জন্য এক সরকারি চিঠি প্রেরণ করা হয়। আলবার্টের মা মেরির কিন্তু এই জল্লাদ হিসেবে পেশা গ্রহণের ব্যাপারে একদমই মত ছিল না।
প্রাথমিক প্রশিক্ষণ
এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আলবার্ট পিয়েরেপয়েন্টকে সহকারী জল্লাদ হিসেবে সরকারি তালিকাভুক্ত করা হয়। এ সময় একজন সহকারী জল্লাদের বেতন ছিল প্রতি ফাঁসির বিপরীতে ৯৯ পাউন্ড এবং ফাঁসি কার্যকরের পর তার ব্যবহার ও আচরণ স্বাভাবিক ও সন্তোষজনক প্রতীয়মান হলে তাকে দুই সপ্তাহ পরে ৯৯ পাউন্ড প্রদান করা হতো।
প্রধান এবং সহকারী জল্লাদের তাদের কাজের বিষয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা মেনে চলা এবং প্রেস ও জনসমক্ষে এই বিষয়ে কোনোরূপ বক্তব্য প্রদান করা কঠোরভাবে নিষেধ ছিল। ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ডাবলিনের মাউন্টজো কারাগারে প্যাট্রিক ম্যাকডারমোট নামের এক তরুণ কৃষক তার ভাই হত্যার শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড সাজা প্রাপ্ত হয়েছিল। সেই মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ভার পরে আলবার্টের চাচার ওপর। আর আলবার্টের দায়িত্ব ছিল সেই ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করা।
প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট
আলবার্ট সহকারী জল্লাদ হিসেবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট পান ১৯৪১ সালের ১৭ অক্টোবর। তার তত্ত্বাবধানে মৃত্যুদন্ন্ডের আসামী বেবি মানচিনি নামের এক নাইটক্লাবের মালিক এবং এক কুখ্যাত সন্ত্রাসী দলের নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এ্যানি ফ্লেচারের সাথে প্রণয় ও বিয়ে
১৯৪৩ সালের ২৯ আগস্ট আলবার্ট এ্যানি ফ্লেচারকে বিয়ে করেন। এই এ্যানি ফ্লেচার তখন এক মিষ্টির দোকান চালাতেন আর সেই দোকানের পাশে এক মুদির দোকানে চাকরি করতেন আলবার্ট। এই নব দম্পতি সংসার পাতেন ম্যানচেস্টারের নিউটন হিথের ইস্ট স্ট্রিটের কাছে। প্রথম দিকে এ্যানি আলবার্টের এই দ্বিতীয় চাকরির কথা জানতেন না। এ ব্যাপারে তিনি জানতে পারেন আরো বেশ কিছুদিন পরে। প্রথম দিকে এ্যানি স্বামীর এই কাজে সম্মত না থাকলেও পরবর্তীতে তা মেনে নেন।
২০০ জন নাৎসি যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর
জল্লাদ হিসেবে আলবার্ট পিয়েরেপয়েন্টের বড় ধরনের দায়িত্ব বর্তায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ব্রিটেন সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দন্ডিত নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য তাকে নিয়োগ দেয়। প্রথমদিকে ১১ জন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের জন্য তাকে পাঠানো হয় জার্মানিতে। এরপর পরবর্তী চার বছরে আলবার্টকে ২৫ বার জার্মানি পাঠানো হয় ২০০ জন নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের জন্য। এই খবরে সারা ইংল্যান্ড জুড়ে পিয়েরেপয়েন্টের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি হয়ে যান বড় ধরনের সেলিব্রেটি।
চাকরী থেকে অবসর
আলবার্ট তার জল্লাদের পেশা ছাড়াও একটি মুদি ও মদের দোকান চালাতেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মর্যাদার সাথে তিনি তার এ সরকারি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু পারিশ্রমিক নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। আর কখনো ফিরে যাননি তিনি তার পুরনো পেশায়। বাকি জীবনটা তিনি তার মদের ব্যবসা চালিয়ে গেছেন।
পেশা ছাড়ার পর তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ‘এক্সিকিউশনার পিয়েরপয়েন্ট’ নামে একটি বই লেখেন। সেই বইয়ে মৃত্যুদন্ড বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল এমনঃ
“এতগুলো ফাঁসি কার্যকরের পর আমার এমন উপলব্ধি হয়েছে যে, মৃত্যুদণ্ড কোনো কিছুরই সমাধান দেয় না। শুধুমাত্র খুনের প্রতিশোধ হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়া একটি পুরাতন ও সহজ পদ্ধতি যা ভিক্টিমের পরিবারের পরিবর্তে সরকার প্রতিশোধের ভূমিকাটি নিয়ে থাকে। এটি বন্ধ করার জন্য জোরালো মতামত যেমন রয়েছে এর বিপক্ষের মতামতও তেমনি প্রবল। তবে আমি চাই আমাদের দেশে কারো শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়া না হোক।”
১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মৃত্যুদন্ডের বিধান বাতিলের জন্য আইন পাশ করা হয়। আইনটি কার্যকর হয় ১৯৬৯ সালে। আশ্চর্যের বিষয় ছিল আলবার্ট পিয়েরেপয়েন্টই ছিলেন এই আইনের প্রথম সমর্থক।
১৯৯২ সালের ১০ জুলাই ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ব্রিটেনের ইতিহাসে স্থান নেয়া এই সরকারি জল্লাদ।