মাসকারা টানা দু’রকম দুটি চোখ, তীব্র লাল রঙের চুল, বিদঘুটে পোশাক, ছিপছিপে গড়নে পৌরুষ এবং নারীত্বের এক অদ্ভুত মিশ্রণ- ‘৭০ এর দশকে ব্রিটিশ রকমঞ্চ এবং টেলিভিশন পর্দায় আবির্ভূত হয় এক রহস্যময় ব্যক্তিত্বের। গভীর কন্ঠের এ শিল্পীর গায়কী এবং আচরণ, সবই ছিল একেবারেই আলাদা। এতটাই আলাদা যে তাকে ভিনগ্রহের প্রাণী বললেও ভুল বলা হবে না। খোদ শিল্পীই তা অস্বীকার করেননি, বরং মঙ্গল গ্রহ থেকে আগত এলিয়েন হিসেবেই মঞ্চে নিজের পরিচয় দিতেন জিগি স্টারডাস্ট (Ziggy Stardust) হিসেবে।
জিগিকে দেখে হতভম্ব হয়েছিলো সকলে, তার শক্তিশালী উপস্থিতিকে রক্ষনশীলরা অশুভ, পথভ্রষ্টের তকমা দিলেও, তারুণ্য ঠিকই তাকে আপন করে নেয়।
আর আসার সাথে সাথেই জিগি নাড়িয়ে দিয়েছিল রকসঙ্গীতের ভিত।
মজার ব্যাপার হলো, জিগি কিন্তু আদতে কোনো মানুষ নয়, এক বহুরূপী শিল্পীর সৃষ্ট একটি চরিত্র মাত্র। আর এই শিল্পী হলেন ডেভিড বোয়ি, ইংরেজি রকসঙ্গীতজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার বলিষ্ঠ পদচারণায় প্রতিনিয়ত নতুন মোড় নেয় সঙ্গীত, শিল্পকলা, ফ্যাশন। এমনই এক মানুষ, যার এক স্পর্শেই বিপ্লব ঘটে যেত- তা সে যা-ই হোক না কেন৷
বহুরূপী, সাহসী ও রহস্যময়, ডেভিড বোয়ি- একজন সত্যিকারের রক এন্ড রোল আইকন।
ব্রিক্সটন-ব্রমলিতে সূচনা
লন্ডনের শান্ত এলাকা ব্রিক্সটন, ঝুটঝামেলাবিহীন আটপৌরে জীবনে অভ্যস্ত যার অধিবাসীরা- এমনই এক স্থানে যাত্রা শুরু হয়েছিলো ডেভিড বোয়ির।
জিগি স্টারডাস্টের স্রষ্টার জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ৮ জানুয়ারিতে, ডেভিড রবার্ট জোন্স হিসেবে।
সাদামাটা ব্রিক্সটনের বাসিন্দা হলেও ডেভিডের পরিবার কোন অংশেই সাধারণ ছিলো না। ডেভিডের বয়স যখন আট মাস, তখন বাবা হেইউড সেনটন “জন” জোন্স এবং মা মারগারেট ম্যারি “পেগি” বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বাবা-মা দুজনের সাথেই তখন আগের বিয়ের সন্তান। বড় ভাইবোনকে নিয়ে ডেভিডের বেড়ে ওঠা। ডেভিডের মা মার্গারেট পেগি ছিলেন একজন ওয়েট্রেস আর বাবা হেইউড একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন।
নম্র ও শান্ত বাবার আদর এবং বিচক্ষণ মায়ের শাসন আগলে রাখত জোন্স পরিবারকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক পরিচিত আতঙ্কের ছায়া প্রায়শই পীড়া দিত পরিবারটিকে- স্কিৎজোফ্রেনিয়া। ডেভিডের মায়ের দিকের পরিবারের বহু সদস্যই এই ভয়াবহ রোগের শিকার, যাদের অধিকাংশই হয় হাসপাতালে বন্দী নতুবা আত্মহত্যার শিকার। বিষয়টি চাপা স্বভাবের ডেভিডকে প্রায়ই ভাবাত, আর সেকারণে মানুষ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল সে।
এ সময়ে ছোট্ট, লাজুক ডেভিডের জীবনে একটা বড় প্রভাব ফেলে বড় ভাই টেরি, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে প্রতিনিয়ত ডেভিডকে সাহায্য করতো। নিজের খোলস থেকে বের হবার পেছনে বড় ভাই টেরির অবদানকে জীবনের পরবর্তী জীবনে কখনো ভোলেননি ডেভিড।
কিন্তু ১৯৫৬ সালে যখন ১৮ বছরের টেরি ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সে যোগ দেয়, ভাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হারায় ডেভিড।
এর কিছুকাল আগে ১৯৫৩ সালে জোন্স পরিবার ব্রমলিতে চলে আসে। ভদ্র ও শান্ত ডেভিড খুব তাড়াতাড়ি পাড়ার মানুষের মন কেড়ে নেয়। কাব স্কাউটে ভর্তি হবার পর নতুন বন্ধুও জুটে ডেভিডের। তাকে ভর্তি করানো হয় ব্রিটিশ বার্নট অ্যাশ স্কুলে। স্কুলে ন’বছরের ডেভিড তার সংগীত প্রতিভা দেখাতে শুরু করে।
এসময় ডেভিডের সংগীতের উপর আগ্রহ জন্ম নেয়। শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে উৎসাহ জোন্স পরিবারে বহু আগে থেকেই ছিল। তবে ডেভিড এবং তার বন্ধুরা ঝুঁকে পড়ে এলভিস প্রিসলি, লিটল রিচার্ডের মত শিল্পীদের প্রতি- এমন ধরনের গান যা তাদের আগের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ভালো চোখে দেখতো না। এদের মধ্যে লিটল রিচার্ড ডেভিডকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিলো।
“আমি আসলে সাদা চামড়ার রিচার্ড হতে চাইতাম”, ডেভিড এক ইন্টারভিউতে বলেন।
নিজ উৎসাহে ডেভিড এসময়ে ইউকেলেলে আর পিয়ানো বাজানো রপ্ত করে, কাব স্কাউটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজের প্রিয় শিল্পীদের গানও গাইতেন তিনি। আশপাশের মানুষও তখন বুঝতে শুরু করেছিল যে, এই শান্ত স্বভাবের ছেলেটি হয়তো সাধারণ কোনো মানুষ নয়।
১৯৫৮ সালে ডেভিড ভর্তি হয় ব্রমলি টেকনিকাল স্কুলে, যেখানে আর্ট ছিল তার প্রিয় বিষয়।
ছুটিতে ভাই টেরি বাড়ি ফিরে আসলে তার সাথে ডেভিডকে নিয়ে ঘুরে দেখাতেন গোটা লন্ডন শহর। লন্ডনের বিভিন্ন ক্লাবে জ্যাজ, রিদম আর ব্লুজ ঘরানার সংগীতের সাথে ডেভিডকে পরিচয় করিয়ে দেন তার বড় ভাই।
এবার গিটার এবং স্যাক্সোফোন রপ্ত করে ডেভিড নিজেও টুকটাক গান লেখা শুরু করেন। সেই সাথে নিজের বেশভূষা নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট করা শুরু করেন কিশোর ডেভিড। চুলের বিভিন্ন স্টাইল কিংবা পোশাকের স্টাইলের কারণে ক্লাসের অন্য সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে তাকে আলাদা ভাবে চোখে পড়তো।
অন্য সবকিছুর বেলাতে একটু অন্যরকম হলেও বিপরীত লিঙ্গের ক্ষেত্রে ডেভিড আর দশটা ১৫ বছরের ছেলের মতোই ছিলো।
ক্লারা নামের এক মেয়েকে পছন্দ করার দ্বন্দ্বে বন্ধু জর্জ আন্ডারউডের সাথে হাতাহাতি বাধে ডেভিডের। এ সময় জর্জের একটা ঘুসি ডেভিডের বাম চোখে আঘাত করলে বেশ গুরুতরভাবে আহত হয় ডেভিড।
হাসপাতালের ডাক্তাররা ডেভিডের বাম চোখ অন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কাও করতে শুরু করেন। তিনটি অপারেশনের মাধ্যমে ডেভিডের এক চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো গেলেও একটা সমস্যা রয়েই গেলো।
জর্জের ঘুসিতে ডেভিডের চোখের আইরিস (বর্ণিল অংশ) সংকোচন-প্রসারণ করার পেশিগুলো চিরদিনের জন্য অবশ হয়ে গেছে। এজন্য ডেভিডের বাম চোখের মণি চিরদিনের মতো বিস্তৃত হয়ে থাকবে। এই চোখে আর আগের মতো দেখতে পারবে না ডেভিড।
দু’চোখের মনির আকার ভিন্নরকম হওয়াকে অ্যানিসোকোরিয়া বলে। দু’চোখে দুরকম মনি থাকার কারনে ডেভিডকে দেখে এখন মনে হচ্ছে যেন তার এখন দু’রঙের চোখ আছে।
বন্ধুর এ অবস্থার জন্য দায়ী জর্জ প্রচন্ড অপরাধবোধে ভুগলেও ডেভিড তা সহজভাবে মেনে নেয়। তাদের বন্ধুত্বেও কোনো ভাটা পড়েনি, পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে একসাথে কাজও করেন তারা।
নিজের চেহারাকে আরো অন্যরকম করে তোলার জন্য পরে উল্টো ধন্যবাদ দিয়ে বসে ডেভিড।
ডান চোখের হালকা নীল, আর বাম চোখে মনির কারণে গাঢ় রঙা ডেভিডকে দেখে এখন আসলেই অন্য কোনো জগতের মানুষ মনে হচ্ছে।
ডেভি জোন্স থেকে ডেভিড বোয়ি
অপারেশনের কারণে ডেভিডকে তিন মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল, তখন বিচ্ছিন্নতাবোধ তাকে জেঁকে বসলে ডেভিড তার কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাসপাতাল থেকে বের হবার পরপরই ডেভিড বিভিন্ন ব্যান্ডের সাথে অংশ নেয়া শুরু করেন; প্রথমে কনর্যাডস, এরপর ‘কিং বিজ’, তারপর দ্য ম্যানিশ বয়েজ, তারপর দ্য লোয়ার থার্ড- কিন্তু কিছুতে ডেভিড তার মন মতো কাজ করতে পারছিলেন না। খ্যাতি না পাওয়ার কারণে ব্যান্ডের সদস্যরা হাল ছেড়ে দেয়ায় ডেভিড আরো হতাশ হয়ে যান। এ সময়ে ডেভিড তার নাম ‘ডেভি জোন্স’ হিসেবে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে ডেভি জোন্স নামের আরেক শিল্পীর সাথে নিজের নাম মিলিয়ে ফেলা ঠেকাতে ডেভিড নতুন স্টেজ নাম নেবার সিদ্ধান্ত নেন। আমেরিকান বিপ্লবী জেমস বোয়ি আর তার বিখ্যাত বোয়ি ছুরি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮ বছর বয়সী ডেভিড তার নতুন নাম নেন ‘ডেভিড বোয়ি’।
কিন্তু ক্যারিয়ারের হতাশার চেয়েও বড় এক দুঃসংবাদ সে সময় ডেভিড পায়- বড় ভাই টেরি স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আর এসব কিছুর মধ্যে ডেভিড তার প্রথম ম্যানেজার কেন পিটের সাথে পরিচিত হন।
১৯৬৭ সালে ডেভিড তার প্রথম অ্যালবাম ‘ডেভিড বোয়ি’ প্রকাশ করেন। সাইকাডেলিয়া, পপের মিশ্রণে বানানো এই অ্যালবামটি খ্যাতি পেতে ব্যর্থ হয়।
মেজর টম এবং স্পেস অডিটি
নিজের প্রথম অ্যালবাম মুখ থুবড়ে পড়াতে কিছুটা হতাশ ডেভিড লন্ডন ড্যান্স সেন্টারে লিন্ডসে কেম্পের অধীনে নাচ শেখা শুরু করেন। অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার পথ ডেভিড খুঁজে পান নাচের মাধ্যমে। এ সময় নৃত্যশিল্পী এবং প্রেমিকা হারমায়োনি ফারদিঙ্গেল এবং গিটারিস্ট জন হাচিস্টোনকে নিয়ে ‘দ্য ফেদারস’ নামের একটি সাংস্কৃতিক দল গঠন করেন ডেভিড। ইংল্যান্ডের নানা অঞ্চলে মাইম, আবৃত্তি এবং গানের অনুষ্ঠান করে বেড়ায় এই দলটি। ‘৬৯ সালে ফারদিঙ্গেলের সাথে সম্পর্কের অবসান হওয়ার পর ফেদার্সের যাত্রা শেষ হয়। এরপর ডেভিড কিছুদিন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে এবং মাইম অ্যাক্টে অভিনয় করেন।
এর অল্প কিছুদিন পরে ১১ জুলাই, ১৯৬৯ এ ডেভিড বোয়ির ‘স্পেস অডিটি’ (Space Oddity) গানটি প্রকাশ পায়। হিপি ফোক ঘরানার এই গানটি ছিলো মেজর টম নামের এক নভোচারীকে নিয়ে। পুরো গানটি ছিলো গ্রাউন্ড কন্ট্রোল এবং স্পেসশিপে থাকা টমের কথোপকথন নিয়ে। সব স্বাভাবিক মনে হলেও গানের একপর্যায়ে আপনি বুঝবেন যে কোনো বড় একটি সমস্যা হয়েছে।
“Ground Control to Major Tom
Your circuit’s dead, there’s something wrong
Can you hear me, Major Tom?Can you hear me, Major Tom?
Can you hear me, Major Tom?
Can you…”
যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে মহাশূন্যে একসময়ে হারিয়ে যায় মেজর টম, চিরদিনের জন্য। স্পেস অডিটি বের হবার পাত্র ৫ দিন পর অ্যাপোলো ১১ মহাশূন্যে যায়। চাঁদে প্রথমবারের মতো মানুষের পায়ের ছাপ ফেলার সাথে সাথে ব্রিটিশ রেডিওতে প্রচার পেতে থাকে স্পেস অডিটি। ডেভিড বোয়ি প্রথমবারের মতো তার কাজের স্বীকৃতি পান, যদিও তার অ্যালবামটি ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি।
এ সময় ডেভিডের সাথে পরিচয় হয় অ্যাঞ্জেলা বারনেটের। উদ্যমী এই অভিনেত্রী বোয়ির জীবনে এক বিশাল প্রভাব ফেলেন। অ্যাঞ্জির বলিষ্ঠ, বাধনছাড়া জীবনযাত্রা ডেভিডকে উৎসাহিত করে। অ্যাঞ্জিই প্রথমবারের মতো ডেভিডকে তার বেশভূষায় লিঙ্গের ছাপকে উপেক্ষা করতে অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজিনোস বেশ নিতে অনুপ্রেরণা দেয়। পরের বছরই দুজনের বিয়ে হয়।
অ্যাঞ্জির উৎসাহে ডেভিড তার পরবর্তী অ্যালবাম ‘দ্য ম্যান হু সোল্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর প্রচ্ছদে আসেন একটি কারুকাজ করা গাউন পরে। লম্বা চুল, গাউন এবং ডেভিডের দেহভঙ্গি- সবকিছু মিলিয়ে তাকে মনে হচ্ছিল ভিক্টোরিয়ান যুগের কোনো এক অভিজাত নারী।
এ প্রচ্ছদের কারণে তুমুল বিতর্ক এবং আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ান বোয়ি। ভারী কন্ঠের এই গায়ক পুরুষ না নারী, তিনি চান কী- এরকম প্রশ্ন ছিল সকলের। এ সময় বোয়ি গিটারিস্ট মিক রনসন, বেসিস্ট টনি ভিস্কন্টিকে নিয়ে তৈরি করেন দ্য হাইপ। সুপারহিরো হিসেবে পারফর্ম করা এই ব্যান্ড শ্রোতাদের সমর্থন না পেলেও বোয়ি দমে যাননি। এরপর মুক্তি পায় তার পরবর্তী অ্যালবাম হাংকি ডরি। এ সময় তার ম্যানেজার বদলে হন টনি ডিফরিজ।
এ সময়ে গঠিত হয় ‘স্পাইডার্স ফ্রম মার্স’। ব্যান্ডটির সদস্য ছিল দ্য হাইপের ড্রামার বাদে বাকি সবাই। নতুন ড্রামার হিসেবে যোগ দেন মিক উডম্যান্সি।
বোয়ি এই সময়ে আবিষ্কার করেন, স্টেজে আরেকজন ব্যক্তি হিসেবে পারফর্ম করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সমসাময়িক শিল্পী ইগি পপ আর লু রিডের উপর ভিত্তি করে ডেভিড বোয়ি এই সময়ে তৈরি করতে থাকেন তার সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র ‘জিগি স্টারডাস্ট’।
লাল চুলের জিগি আর মঙ্গলগ্রহের মাকড়শা
১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, রকমঞ্চে তীব্র লাল চুল আর অতিপ্রাকৃতিক রূপ নিয়ে হাজির হয় জিগি, সাথে দ্য স্পাইডার্স ফ্রম মার্স। আসার সাথে সাথে জিগি তার গান ‘স্টারম্যান’ এবং আচরণ দিয়ে নজর কাড়েন সবার। অভিনব গানের পাশাপাশি জিগির যৌনতা নিয়ে বিতর্ক, বেশভূষা- সবকিছুই বোয়িকে রেখেছিল আলোচনার কেন্দ্রে।
জিগির জন্মের সাথে সাথে জন্ম নেয় গ্ল্যাম রক। তার ‘আলাদিন সেইন’ অ্যালবাম প্রথমবারের মতো চার্টের শীর্ষে উঠে। একদিকে জিগিকে নিয়ে বিতর্ক, অন্যদিকে জিগির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা- ডেভিড বোয়ি তখন তার ক্যারিয়ারের শীর্ষে।
কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে ডেভিড আবিষ্কার করলেন, মানুষ তাকে ডেভিড বোয়ি হিসেবে নয়, বরং জিগি স্টারডাস্ট হিসেবেই দেখছে। অভিনেতা বোয়ির ব্যক্তিগত জীবনেও জিগি চলে আসছে। তিনি বুঝতে পারলেন, নিজের থেকে জিগিকে আলাদা না করতে পারলে তিনি হারিয়ে যাবেন। তাই ডেভিড বোয়ি তার খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যাওয়া জিগিকে নিজ হাতে হত্যা করলেন।
১৯৭৩ সালে তার ‘রাইজ এন্ড ফল অফ জিগি স্টারডাস্ট’ অ্যালবামের ‘জিগি স্টারডাস্ট’ (Ziggy Stardust) গানে তিনি বলেন,
“When the kids had killed a man
I had to break up the band”
ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসে এমন সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু নিজের সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ডেভিড বোয়ি কখনোই কোনো ছাড় দেননি।
থিন হোয়াইট ডিউক এবং কোকেইন
জিগির পর বোয়ি আরো কতগুলো হিট অ্যালবাম বের করেন, যার গানগুলোর মাঝে ‘Rebel rebel’, ‘Diamond Dogs’ অন্যতম।
১৯৭৫ সালে বোয়ির Young Americans অ্যালবামটি বের হয়, এতে ছিলো জন লেননের সাথে তৈরি ‘Fame’ গানটি।
ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসে ডেভিড আবিষ্কার করেন, খ্যাতি পাওয়া সত্ত্বেও তার আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গেলে তিনি জানতে পারলেন, তার কনসার্ট আয়োজনের পেছনে তার নিজের আয় ব্যয় করা হয়েছিল, তার অজান্তেই। উল্লেখ্য, ডেভিড বোয়ির প্রতিটি কনসার্ট ছিলো সঙ্গীত, অভিনয় এবং নৃত্যের মিশ্রণের একেকটি বর্ণাঢ্য আয়োজন। স্বাভাবিকভাবে এর পেছনের খরচ ছিল অনেক বেশি। ম্যানেজারের সাথে আর্থিক বিবাদের জের ধরে তাকে ছাটাই করেন বোয়ি।
খ্যাতি এবং আর্থিক সংকটের এক পরস্পরবিরোধী অবস্থায় পড়ে যান ডেভিড বোয়ি। হতাশায় ভুগতে থাকা বোয়ি এ সময় কোকেইন সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েন। দুধ এবং কোকেইনে বেঁচে থাকা বোয়ি আরো শীর্ণ, আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। লস অ্যাঞ্জেলসে বসে এ সময় তা-ও গান লিখতে থাকেন বোয়ি। সৃষ্টি হয় এক নতুন চরিত্র- ‘দ্য থিন হোয়াইট ডিউক’।
কিন্তু জিগির চেয়ে ডিউক ছিল একেবারেই আলাদা, জিগি ছিলো বর্ণিল, আর ডিউক ছিল ধূসর। ব্যাকব্রাশ করা চুল, পরিপাটি কোটে আসা শীর্ণকায় ডিউকের গানও ছিল খুব বিষণ্ন ও মলিন।
জিগির মতো ডিউকও বোয়ির বাস্তবজীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ডিউকের ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারা বিতর্কের ঝড় তোলে, যদিও বোয়ি নিজে বরাবরই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে।
ডিউকের মাঝে নিজেকে প্রায় হারাতে বসেন বোয়ি। এর পেছনে অবশ্য তার কোকেইন আসক্তি একটা বড় প্রভাব ফেলেছিলো।
‘বার্লিন যুগ’ এবং অতঃপর
নিজের মাদকাসক্তি থেকে বের হবার জন্য বোয়ি এরপর সুইজারল্যান্ড, পরে জার্মানিতে চলে আসেন। এ সময়ে তিনি পেইন্টিং এবং গান লেখার পেছনে সময় কাটাতে থাকেন। এর পাশাপাশি তিনি অন্যান্য শিল্পীদের জন্য, যেমন- ইগি পপ প্রমুখের জন্য গান রচনা শুরু করেন। এ সময়ে তার বিখ্যাত ‘বার্লিন ট্রিলজি’- ১৯৭৭ সালের ‘লো’, ‘হিরোজ’ এবং ১৯৭৯ সালের ‘লজার’ প্রকাশ পায়। যন্ত্রসংগীতকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত দেখা যায় এই অ্যালবামগুলোতে। এর মধ্যে ‘হিরোজ’ গানটি আজও বেশ জনপ্রিয়।
এ সময়ে বিবাহবিচ্ছেদ এবং সন্তান জোকে নিজের কাছে নেয়ার পর বোয়ি একজন ভালো বাবা হবার লক্ষ্যে নিজের আসক্তি থেকে পুরোপুরিভাবে বের হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এবং তিনি সফল হন।
ব্যক্তিগত জীবনে ডেভিড আবার শান্তি ফেরত পেতে শুরু করেন। ‘৮০ এর দশকে তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো মেইনস্ট্রিম গান রচনা শুরু করেন। এ সময়ে তার ‘লেটস ড্যান্স’, ‘চায়না গার্ল’ ভীষণ জনপ্রিয় হয়। বিখ্যাত ব্যান্ড ‘কুইন’ এর সাথে ১৯৮১ সালে সৃষ্টি করেন অন্যতম বিখ্যাত গান ‘আন্ডার প্রেশার’।
মেইনস্ট্রিম ঘরানার সঙ্গীত রচনা করে বোয়ি আরো দ্রুত সাফল্য লাভ করলেও তিনি কোথাও একটা ঘাটতি অনুভব করতে শুরু করেন।
তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি একটি কাঠামোর ভিতর বন্দী হতে চলেছেন। এ সময়ে তিনি জানতে পারলেন, তার প্রিয় ভাই টেরি হাসপাতালের জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
শোকাহত ডেভিড তার বহু গানেই টেরিকে স্মরণ করেছেন, এর মধ্যে ‘আলাদিন সেইন’ এবং ‘জাম্প দে সেই’ অন্যতম।
মেইনস্ট্রিম গানের পাট চুকিয়ে ডেভিড আবার ফেরত যান তার ভিন্নধর্মী, নতুন গানের স্টাইলে। তার ব্যান্ড টিন মেশিন আর্থিকভাবে ব্যর্থ হলেও ডেভিড দমে যাননি। ‘ব্ল্যাক টাই হোয়াইট নয়েজ’ দিয়ে আবার চার্টে ফিরে আসেন এই আপোসহীন শিল্পী।
১৯৯০ সালে বোয়ি পরিচিত হন সোমালি বংশোদ্ভূত সুপারমডেল ইমানের সাথে। এর দু’বছর পরই বিয়ে করেন তারা। ইমানের সান্নিধ্যে বহু বছর পর বোয়ি নিজের একাকিত্বের ছায়া থেকে মুক্তি পান। বোয়ির মৃত্যুর আগপর্যন্ত সুখী দাম্পত্যজীবন কাটান তারা।
১৯৯৬ সালে ডেভিড বোয়িকে ‘রক এন্ড রোল হল অফ ফেইম’ এ স্থান দেয়া হয়। গ্র্যামির আজীবন সম্মাননা পান ২০০৬ সালে। এরপর কয়েক বছর অবসরে থাকার পর ২০১৩ সালে ‘দ্য নেক্সট ডে’ অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়।
ভক্তদের অজান্তে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত বোয়ি ২০১৬ সালে তার ৬৯ তম জন্মদিনে প্রকাশ করেন তার পরবর্তী এবং শেষ অ্যালবাম ‘ব্ল্যাকস্টার’। এতে ফিরে আসে মেজর টম, ফিরে আসে তার আগের কর্মের নানা চিহ্ন।
ব্ল্যাকস্টার বের হবার দুদিন পরই, ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারিতে না ফেরার দেশে চলে যান এই প্রখ্যাত শিল্পী।
ডেভিড বোয়ি একজন সংগীতশিল্পী ছাড়াও ছিলেন একজন অভিনেতা ও আঁকিয়ে। নাটকের মঞ্চ থেকে রূপালী পর্দা, বোয়ির বিচরণ ছিলো প্রায় সবক্ষেত্রেই। মঞ্চে কখনো এলিফ্যান্ট ম্যান, সিনেমায় নিকোলা টেসলা (দ্যা প্রেস্টিজ) , ভিনগ্রহ থেকে আসা জেমস থমাস নিউটন (ম্যান হু ফেল ইন টু দ্য আর্থ), কিংবা গবলিন রাজা জ্যারেথ (লেবরিন্থ) এর রূপে- ডেভিড বোয়ি নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন। একজন আঁকিয়ে হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। ১৯৯৮ সালে আর্ট ম্যাগাজিন ‘মডার্ন পেইন্টার্স’ এর এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাকে।
ডেভিড বোয়ি তার পরবর্তী প্রজন্মের বহু শিল্পীকেই প্রভাবিত করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছেন ম্যাডনা, আর্কটিক মাংকিজ, ইউটু, দ্য কিলারস সহ আরো অনেকে।
শুধু তা-ই নয়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বোয়ি সময়ের বহু আগেই ইন্টারনেটের গুরুত্ব বুঝতে পারেন। আসন্ন ভবিষ্যতে ইন্টারনেট যে শিল্পসংস্কৃতির প্রচার আর প্রসারে একটা অভাবনীয় ভূমিকা রাখতে পারে তা তিনি অনুভব করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে তৈরি করলেন নিজস্ব ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার ‘বোয়িনেট’। অনলাইনে তার ‘টেলিং লাইজ’ গানটি প্রকাশের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম শিল্পী হিসেবে ইন্টারনেটকে শিল্প প্রচারে ব্যবহার করেন ডেভিড বোয়ি।
গান, অভিনয়, ফ্যাশন, চারুকলা- সকল ক্ষেত্রেই যে মানুষটির বিচরণ ছিলো, তার বর্ণাঢ্য জীবনে কিন্তু ছিল বহু বাধা, বহু দুঃখ। কিন্তু সকল চড়াই উৎরাই পার হয়ে জয়ী হবার পেছনে এই অসম্ভব জেদি মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল একটিই- পরিবর্তন। আপোসহীন, সাহসী, প্রতিভাবান এই মানুষটি যে প্রতিনিয়তই রূপান্তরিত হতেন এবং পরিবর্তন আনতে প্রভাবিত করতেন!