আর্কিমিডিস ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, ক্লাসিক্যাল যুগটা তারই ছিল। তিনি ছিলেন তার সময়ের আইনস্টাইন, অথবা আইনস্টাইন হচ্ছেন নিজের সময়ের আর্কিমিডিস। কেবল একটি শব্দ ‘বিজ্ঞানী’ দিয়ে তাকে বর্ণনা করা যায় না। তিনি কি ছিলেন তা প্রশ্ন না করে বরং প্রশ্ন করা উচিৎ তিনি কি ছিলেন না। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, পদার্থবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং রূপকার। তিনি ভুলক্রমেই হয়তবা এতো প্রাচীন সময়ে জন্মেছিলেন। কেননা তার সময়ের চেয়ে তিনি হাজার বছর এগিয়ে ছিলেন। মাঝে মাঝে আফসোস হয় যখন ভাবি, কেন যে আর্কিমিডিস আধুনিক যুগে জন্ম নিলেন না!
আর্কিমিডিস এবং প্রাচীন গ্রীক সমাজ
আর্কিমিডিস আনুমানিক ২৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রীসের বন্দর নগর সিরাকিউজের সিসিলি দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মসাল সম্বন্ধে নিশ্চিত নন ঐতিহাসিকগণ। তার বাবার নাম ফিডিয়াস বলে জানা যায়, যিনি একজন জোতির্বিদ ছিলেন। এই তথ্য আর্কিমিডিস নিজেই তার এক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ‘দ্য স্যান্ড রেকনার’ নামের বইটিতে আর্কিমিডিস উল্লেখ করেন যে, তিনি একজন জ্যোতির্বিদের বই পড়েছিলেন যার নাম ফিডিয়াস এবং যিনি তার বাবা।
প্রাচীন গ্রীক সমাজের মানুষেরাই প্রথম সত্যিকারের বিজ্ঞান চর্চা শুরু করে। অন্যান্য সভ্যতার লোকেরা বিজ্ঞান চর্চা করতো না এমনটাও নয়। তবে তারা কেবল সম্পূর্ণ রূপে প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা মেটাতে সেসব ব্যবহার করতো। যেমন- কিভাবে অধিক মজবুত করে ঘরবাড়ি, মন্দির বানানো যায়, শস্য চাষের জন্য সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় ইত্যাদি। কিন্তু গ্রীকরা ছিল অনেক অগ্রসর। তারা বিজ্ঞান চর্চা কেবল প্রয়োজনের স্বার্থে করতো না। তারা বিজ্ঞান চর্চা করতো মনের আনন্দে, জ্ঞান বৃদ্ধি করার নিমিত্তে।
গ্রীকরা জ্যামিতি নিয়ে গবেষণা করতো কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং এর সৌন্দর্যের জন্য, যেমনটি করেছিলেন ডেমোক্রিটাস। তিনি বলেছিলেন সকল বস্তুই অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত, যাকে আর বিভক্ত করা যায় না। এই তত্ত্বের পেছনে তিনি যে শ্রম দিয়েছিলেন, তা কোনো যশ-খ্যাতির উদ্দেশ্যে নয়, বরং নিছক মনের আনন্দে। সৌভাগ্যক্রমে আর্কিমিডিস গ্রীসের সেই বিজ্ঞান প্রিয় সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
আর্কিমিডিস তার জীবনের অধিকাংশ সময় সিরাকিউজে কাটিয়েছিলেন। কিশোর বয়সে তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে লেখাপড়া করেন। এই শহরেই বিখ্যাত দ্বিগ্বিজয়ী গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর উত্তরসূরি টলেমি লাগেদিজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার নির্মাণ করেছিলেন। ‘লাইব্রেরী অব আলেকজান্দ্রিয়া’ নামের লাইব্রেরীটিতে ছিল সভাকক্ষ এবং বড় বড় হল রুম, যেগুলো প্রাচীন পৃথিবীর পন্ডিতদের জন্য তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। এই লাইব্রেরীর দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলেন এরাটোস্থেইনস নামক একজন বিজ্ঞানী, যিনি আর্কিমিডিসের বন্ধু হয়ে ওঠেন। এরাটোস্থেইনসই প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর আকার সঠিকভাবে পরিমাপ করতে সক্ষম হন। দুর্ভাগ্যক্রমে আর্কিমিডিস সম্বন্ধে খুব একটা বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।
একনজরে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে আর্কিমিডিসের বৈজ্ঞানিক যত কীর্তি
- বলবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং হাইড্রোস্ট্যাটিক আবিষ্কার করেন।
- লিভার এবং পুলির নীতি আবিষ্কার করেন।
- পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক বিষয় বস্তুর অভিকর্ষীয় কেন্দ্র নির্ণয় করেন।
- বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পাই এর মান নির্ণয় করেন। তিনি π = ২২/৭ নির্ণয় করেন যা বিংশ শতক পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহার করা হয়।
- গোলকের আয়তন এবং পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের সূত্র আবিষ্কার করেন।
- সূচক ব্যবহার করে বড় সংখ্যা লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
- সূচকীয় সংখ্যা গুণ করার ক্ষেত্রে সূচকদ্বয়কে যোগ করতে হবে, এই প্রক্রিয়া তিনি আবিষ্কার করেন।
- মাটির নিচ থেকে পানি তোলার জন্য তিনি আর্কিমিডিয়ান স্ক্রু আবিষ্কার করেন যা এখনও বিশ্বে ব্যবহৃত হয়।
- আঠারো শতকের দিকে অনেক গবেষকরা গবেষণা করে হতবুদ্ধি হয়ে যান যে, এত আগে আর্কিমিডিস কি করে তার গাণিতিক সমাধানগুলো করেছিলেন।
- গতি সম্বন্ধীয় আর্কিমিডিসের প্রায় সব কাজই হারিয়ে যায়। তবু যেগুলো বাকি ছিল, সেগুলোই প্রত্যক্ষভাবে গ্যালিলিও, নিউটনের মতো বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
- পদার্থবিদ্যার জগতে ফলিত গণিতের ব্যবহার করা প্রথম পদার্থবিদ ছিলেন আর্কিমিডিস।
- তিনি সিরাকিউজকে রোমানদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাজ করতে পারে এমন গুলতির মতো যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার করেন।
- তার সময়ে তিনি এতোটাই বিখ্যাত হন যে, তিনি যা-ই বলতেন, লোকে তা নির্দ্বিধায় মেনে নিত।
একজন বিচিত্র গণিতবিদ
আর্কিমিডিসের রেখে যাওয়া কাজ, যেগুলো অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে তার গাণিতিক সমাধানগুলো সত্যিই বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে যখন রেনেসাঁর বিজ্ঞানীরা আর্কিমিডিসের গাণিতিক সমাধানগুলো নিয়ে আবার গবেষণা করেন, তারা কিছুতে বুঝতে পারলেন না আর্কিমিডিস কিভাবে এসব কাজ করেছিলেন, যদিও এটা নিশ্চিত ছিল যে আর্কিমিডিসের দেয়া মানগুলো সঠিক ছিল। কেননা আর্কিমিডিস সেগুলোতে কেবল কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেননি।
বাস্তবিকভাবেও আর্কিমিডিস এরকম প্রকৃতির ছিলেন। তিনি নানা জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে তার ফলাফলটা তার সমসাময়িক গণিতবিদদের বলতেন, কিন্তু বের করার উপায় বলতেন না। এটা করে তিনি বেশ মজাই পেতেন বটে!
সমস্যার সমাধান
১৯০৬ সালের আগে পর্যন্ত আর্কিমিডিসের গাণিতিক ব্যাপারটির কোনো সমাধা করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেই বছর অধ্যাপক জোহান হেইবার্গ তৎকালীন কনস্টান্টিনোপল বা বর্তমানে তুরস্কের ইস্তানবুলে একটি বই খুঁজে পান, যেটি এই সমস্যায় আলোর সন্ধান দেয়। বইটি ছিল ১৩ শতকে লিখিত একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় বই। বইটি যখন লিখিত হয়েছিল, তখন রোমান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ স্বাধীন ঘাঁটি ছিল কনস্টান্টিনোপল, যার পতনের সাথে সাথে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং গ্রীকদের অনেক প্রাচীন বিখ্যাত কাজ কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই বইটি পরবর্তীতে আর্কিমিডিসের একটি প্যালিম্পসেট নামে পরিচিত হয়।
হেইবার্গ আবিষ্কার করেন যে, বইটির ধর্মীয় বাণীগুলো লিখিত হয়েছে গাণিতিক তত্ত্বের ওপর। যে সন্ন্যাসী বইটি লিখেছিলেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন আর্কিমিডিসের লেখাগুলোকে মুছে ফেলে তার উপর ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ লিখতে। আর্কিমিডিসের মূল বইটি খ্রিস্টীয় দশম শতকে ছাপা হয়েছিল।
বইটিতে আর্কিমিডিসের সাতটি কাজের বিষয় পাওয়া যায়, যেগুলোর মধ্যে শত শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ‘দ্য মেথড’ পাওয়া যায়। আর্কিমিডিস দ্য মেথড লিখেছিলেন তার বন্ধু এরাটোস্থেইনসকে পাঠাবার জন্য, যা তিনি চেয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করবার জন্য। বইটিতে তিনি কিভাবে তার গাণিতিক সমাধানগুলো করতেন তার ব্যাখ্যা লিখে যান।
দ্য মেথড প্রকাশ পাবার পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন আর্কিমিডিস যে নিজের সময় থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন। তিনি ক্রম সংখ্যা যোগ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, পদার্থবিদ্যায় তারই আবিষ্কার লিভার পুলির নীতি গণিতে ব্যবহার করেন নতুন নতুন উপপাদ্য আবিষ্কারের জন্য, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককের ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন যা প্রায় ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের নিকটবর্তী।১৮০০ বছর পরে নিউটন এই ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন!
এই মহান বিজ্ঞানীর কিছু চিরস্মরণীয় আবিষ্কারের কথা আলোচনা না করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই সেগুলো কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
দ্য আর্কিমিডিস স্ক্রু
আর্কিমিডিসের অত্যাশ্চর্য একটি উদ্ভাবন হচ্ছে ‘আর্কিমিডিয়ান স্ক্রু’। তার যন্ত্রটি একটি শুন্য ফাঁপা পাইপের ভেতরে অবস্থিত কর্কস্ক্রুর মতো। যখন স্ক্রুটি ঘোরানো হয়, তখন পানি স্ক্রুর প্যাঁচের মধ্য দিয়ে উপরে চলে আসে। এভাবে নদী, পুকুর কিংবা কুয়া থেকে পানি তোলা যায়। সেই প্রাচীন গ্রীসে তিনি এই যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা আজ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে জমিতে সেচের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু পানিই নয়, এটি মিহি হালকা বস্তু; যেমন- শুকনো বালু, ছাই ইত্যাদি উত্তোলনের জন্যও ব্যবহৃত হয়।
আর্কিমিডিস, মুকুট, ইউরেকা এবং অন্যান্য
আর্কিমিডিসের সময়কার রাজা হিয়েরো-২ একবার কারিগরদের কাছে তার জন্য একটি মুকুট তৈরী করার জন্য কিছু পরিমাণ স্বর্ণ তাদের দেন। যথাসময়ে তার মুকুট তৈরী হলেও তিনি সন্দেহ করেন যে, কারিগররা এতে খাদ যুক্ত করেছে। সন্দেহ দূর করতে তিনি আর্কিমিডিসের শরণাপন্ন হন। তিনি আর্কিমিডিসকে মুকুটটি পাঠিয়ে দেন এবং সমস্যার সমাধান করতে বলেন।
এদিকে আর্কিমিডিস পড়ে যান গভীর চিন্তায়। তার জানা ছিল যে, সোনার ঘনত্ব রূপার চেয়ে বেশি। তাই এক ঘন সেন্টিমিটার সোনার ওজন সমপরিমাণ রূপার চেয়ে বেশি হবে। কিন্তু মুকুটটির আকৃতি সুষম ছিল না। ফলে এর আয়তন নির্ণয় করাও সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে একটি কথিত গল্প আছে যে, আর্কিমিডিস একটি চৌবাচ্চায় গোসল করার সময় পানি উপচে পড়তে দেখে পানির প্লবতা এবং মুকুটের খাদ নির্ণয়ের উপায় বের করেন। তখন তিনি ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে চিৎকার করতে করতে রাজপ্রাসাদের দিকে ছোটেন।
তিনি তার আবিষ্কারে এতটাই চমৎকৃত হন যে, বিবস্ত্র অবস্থায় দৌঁড়াতে শুরু করেন। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক এই গল্প অস্বীকার করেন। সে যা-ই হোক। আর্কিমিডিসের মাথায় খেলে গেল সেই যুগান্তকারী বুদ্ধি। তিনি একটি পানিপূর্ণ চৌবাচ্চায় এক কেজি সোনা ডুবিয়ে কি পরিমাণ পানি উপচে পড়ে তার সাথে একই পরিমাণ রুপা ডুবিয়ে কি পরিমাণ পানি উপচে পড়ে তার তুলনা করেন। দেখা যায় রুপা ডুবালে পানি অধিক উপচে পড়ছে। তখন তিনি মুকুটের সমপরিমাণ সোনা এবং মুকুটটি আলাদা আলাদা করে পানিতে ডোবান। দেখা যায় মুকুট ডোবালে অধিক পানি পড়ছে। এতে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, মুকুটে খাদ ছিল।
পাই এর মান নির্ণয়
জীবনে যারা কিছুটা হলেও গণিত এবং জ্যামিতিক শাস্ত্রের সাথে পরিচিত, তারা অবশ্যই পাইয়ের মান জানেন। পাই ব্যাতীত জ্যামিতিক বা ত্রিকোণমিতিক সূত্রগুলো অচল। সিলিন্ডার, কোণক কিংবা গোলকের আয়তন, ব্যাস, পরিধি ইত্যাদি নির্ণয় করতে হলে পাই ছাড়া উপায় নেই। আর আর্কিমিডিসও এসব নির্ণয়ের জন্য বেশ উদগ্রীব ছিলেন। তিনি তাই ঠিক করলেন পাইয়ের মান নির্ণয় করবেন।
পাইয়ের সাধারণ একটি মান আমাদের সকলেরই মোটামুটি জানা আর তা হচ্ছে ৩.১৪১৬। কিন্তু এটা আসলে পাইয়ের নির্ভুল মান নয়। প্রকৃতপক্ষে পাইয়ের নির্ভুল মান নির্ণয় করা অসম্ভব, কেননা দশমিকের পর অঙ্কগুলো অনন্তকাল চলতে থাকে।
আর্কিমিডিস জানতেন বৃত্তের পরিধি নির্ণয়ের সূত্র 2rπ, যেখানে r হচ্ছে বৃত্তের ব্যাসার্ধ। তিনি মূলত ব্যাসার্ধ জানা বৃত্তের পরিধি নির্ণয় করতে গিয়ে পাইয়ের মান নির্ণয় করে ফেলেন।
তিনি প্রথমে একটি বৃত্ত কল্পনা করেন। এর ভেতরে তিনি একটি সমবাহু ত্রিভুজ কল্পনা করেন, যার প্রতিটি কৌণিক বিন্দু বৃত্তের পরিধিকে স্পর্শ করে। বৃত্তের বাইরে আরেকটি সমবাহু ত্রিভুজ কল্পনা করেন যার প্রতিটি বাহুর কেবল একটি বিন্দু বৃত্তের একটি বিন্দুকে ছুঁয়ে যায়। এতে করে তিনি ত্রিভুজগুলোর পরিসীমা নির্ণয় করতে সক্ষম হন এবং ভেতরের ত্রিভুজটির পরিসীমা বৃত্তের পরিধি অপেক্ষা ছোট এবং বাইরেরটির বড় তা বুঝতে পারেন।
এরপর তিনি একই কাজ করেন। তবে এবার বৃত্তের ভেতরে বাইরে সুষম ষড়ভুজ ব্যবহার করেন। এই উপায়ে তিনি বৃত্তের সর্বোচ্চ এনং সর্বনিম্ন পরিধির একটা অনুমান করেন। একই কাজ তিনি পর্যায়ক্রমে ১২, ২৪, ৪৮ এবং ৯৬ বাহুবিশিষ্ট বহুভুজের ক্ষেত্রে কল্পনা করেন এবং পরিমাপ করেন। ৯৬ বাহু বিশিষ্ট একটি বহুভুজ বিবর্ধন কাঁচে না দেখলে প্রায় বৃত্তের মতোই দেখায়। এর থেকে তিনি পাইয়ের মান 25344⁄8069 এবং 29376⁄ 9347 মধ্যে নির্ণয় করেন। এই দুটি ভগ্নাংশকে খুব সহজেই 310⁄71 এবং 3 1⁄7 তে রূপান্তর করেন। শেষতক 3 1⁄7 কেই পাইয়ের মান হিসেবে গণ্য করা হয় যাকে ২২/৭ আকারে লেখা হয়। এই মান পাইয়ের মানের একেবারেই কাছাকাছি। আধুনিক ইলেকট্রিক ক্যালকুলেটরের আবির্ভাব হবার আগে পর্যন্ত এই মানই ব্যবহৃত হয় সকল ক্ষেত্রে।
গোলকের আয়তন নির্ণয়
গোলকের আয়তন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আর্কিমিডিসের কাজ বিস্ময়কর। তার নির্ণয় করার পদ্ধতি অনেকটা ক্যালকুলাসের মতোই। তিনি এই আবিষ্কারকে নিজের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হিসেবে গণ্য করেন। এমনকি এর কথা নিজের সমাধিতে খোদাই করে দিতে বলেছিলেন তিনি।
মৃত্যু এবং কিছু কথা
আর্কিমিডিস ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক রোমান সৈন্যের হাতে নিহত হন। তখন রোমানরা গ্রীক সাম্রাজ্য বিজয় করছিল। কথিত আছে, রোমান সৈন্যরা যখন আর্কিমিডিসকে বন্দী করে নিতে আসে, তখন আর্কিমিডিস তার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তাদের সাথে যেতে না চাইলে রাগের মাথায় এক সৈন্য তার মুন্ডুচ্ছেদ করে। আর এভাবেই মৃত্যু হয় ইতিহাসের মহানতম এক বিজ্ঞানীর।
তাকে যে সমাধিতে সমাহিত করা হয় তার মধ্যে একটি সিলিন্ডারের ভেতর একটি গোলকের ছবি খোদাই করা ছিল তার ইচ্ছা মতো। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, গোলকের আয়তন নির্ণয়ই ছিল তার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
অনেক বছর পর এক রোমান গভর্নর সিসেরো আর্কিমিডিসের সমাধি দেখতে যান। তিনি সমাধিটিকে আগাছামুক্ত করে পরিচ্ছন্ন করার আদেশ দেন। বর্তমানে আমরা জানি না কোথায় ঘুমিয়ে আছেন এই মহান বিজ্ঞানী, হয়তবা কোনোদিনই জানবো না। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই যে, তার কাজের অধিকাংশই চিরতরে হারিয়ে গেছে। একবার ভাবুন তো, যে সামান্য বাকি আছে, তাতেই তিনি আজ কোন পর্যায়ে! আর যদি তার সব কাজ পাওয়া যেত, তাহলে?
তার মৃত্যুর তিনশো বছর পর গ্রীক ঐতিহাসিক প্লুটার্ক বলেন, “আর্কিমিডিসের অধিকাংশ চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা আর কাজ ছিল তার কৌতুহলের ফলাফল, জীবনের কোনো বিশেষ প্রয়োজনের কথা তিনি কখনো ভাবেননি।”
তার সমাধির উপর একটি সিলিন্ডারের মধ্যে একটি বৃত্তের যে খোদাই করা চিত্র আছে তাতে মধ্যগগনের সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে গ্রীক ভাষায় লেখা তার নাম-
ΑΡΧΙΜΗΔΗΣ