ততদিনে মৃত্যুর হুমকির সাথে একপ্রকার শখ্যতা হয়ে গিয়েছিল ম্যালকম এক্সের। তাই হুমকিধামকিগুলোকে আর খুব একটা পরোয়া করতেন না তিনি। পরোয়া করেননি জীবনের শেষ দিনটিতেও। হ্যাঁ, পরোয়া করলে তো আর সেটি জীবনের শেষ দিন হতো না! দিনটি ছিল ১৯৬৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। কনকনে শীতের এক সকালে মৃত্যু হুমকির কথা মাথায় রেখেই ম্যানহাটনের অডুবন বলরুমে গিয়েছিলেন ম্যালকম এক্স। ‘অর্গানাইজেশন ফর আফ্রো-আমেরিকান ইউনিটি’র একটি সভায় বক্তৃতা দিতে যথাসময়েই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। সভাকক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন ৪০০ জন অতিথি।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। ম্যালকম এক্স প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার বক্তৃতা প্রদানের জন্য। এরকম সময় হঠাৎ অতিথিদের মাঝে কেউ একজন ‘নিগা’ (নিগ্রো) বলে চিৎকার করে উঠলো। শুরু হলো কিছু একটা গণ্ডগোল। তাদেরকে শান্ত করবার উদ্দেশ্যে ম্যালকম এক্স এবং তার নিজস্ব দেহরক্ষীরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ভিড় থেকে ছুটে এসে এক ব্যক্তি ম্যালকমের বুক বরাবর গুলি চালালো! প্রথম গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়বার পূর্বেই আরো দুই ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয় হ্যান্ডগানের গুলিতে রক্তাক্ত হলেন ম্যালকম। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করেন তিনি। বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশায় তাকে কলম্বিয়া প্রেসবিটেরিয়ান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঠিকই, তবে সেটি শেষতক তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করার আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়।
ম্যালকমের বুকে প্রথম গুলিটি ছুঁড়েছিলেন ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ বা তৎকালীন সময়ে সংক্ষেপে ন্যাশন নামে পরিচিত একটি আফ্রো-আমেরিকান রাজনৈতিক-ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী তালমাজ হেয়ার, যিনি থমাস হেগান নামেও পরিচিত। পুলিশ পৌঁছানোর পূর্বে জনতার রোষানলে পড়েছিলেন হেগান। অপর দুজনকে ঘিরে রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য, সন্দেহ আর অস্বচ্ছতা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবির উপর ভিত্তি করে ন্যাশনের আরো দুই কর্মী নরমান বাটলার আর থমাস জনসনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। বাটলার আর জনসন প্রথম থেকেই নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করেন। এমনকি থমাস হেগানও বাটলার আর নরমানের নির্দোষ হবার সাক্ষ্য দেন। তবুও বাটলার আর নরমানকে দীর্ঘদিন জেলে সাজা ভোগ করতে হয়েছিল।
ময়নাতদন্তে ম্যালকমের দেহে ২১টি বুলেটের ক্ষত চিহ্নিত হয়। অথচ এই ক্ষত যাদের হাতে সৃষ্টি হয়েছে, ম্যালকম একসময় তাদেরই লোক ছিলেন। ন্যাশন অব ইসলামের বেশ জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্বই ছিলেন তিনি। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, নিজের অতীত জীবন পেছনে ফেলে শুরু করেছিলেন নতুন করে। অথচ কী এমন ঘটেছিল যে সেই ন্যাশনই তাকে হত্যা করলো? এর জন্য একটু পেছন থেকে শুরু করতে হবে।
১৯৪৩ সালের কথা। আমেরিকার সবচেয়ে বড় আফ্রো-আমেরিকানদের পাড়া হারলেমে পা রাখলেন ম্যালকম এক্স। নানাবিধ অনিয়ম অনাচারে ভরপুর এই পাড়াটিই বেশ মনে ধরে গেল তার। কারণ, অনিয়ম অনাচারেই তো তার মন সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হতো! ধীরে ধীরে পাড়ার বখাটেদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন তিনি। প্রতিনিয়ত নানাবিধ অন্যায় কাজে নিজেকে আপাদমস্তক ডুবিয়ে ফেললেন। মাদক চোরাচালান, চুরি, ডাকাতি, জুয়া, কালোবাজারি, অর্থের বিনিময়ে মারামারি সহ এহেন অন্যায় কাজ নেই, যা ম্যালকম করেননি। এমনকি টাকার বিনিময়ে সমলিঙ্গের সাথে যৌনকর্মেও লিপ্ত হয়েছেন একাধিকবার।
ম্যালকমের এই বেপরোয়া আর সন্ত্রাসী জীবনে এসময় দুটি বাধা আসে। প্রথম বাধাটি বিশ্বযুদ্ধ। হারলেমের সকল যুবককে বাধ্যতামূলক যুদ্ধে যাবার নির্দেশ জারি করা হয়। কিন্তু ছলচাতুরির মাধ্যমে নিজেকে উন্মাদ প্রমাণ করে এ বাধা তিনি উতরে যান। ‘মানসিক রোগী’ হওয়ায় তাকে সেনাবাহিনীতে নেয়া হয়নি। বিশ্বযুদ্ধের তখন আর বেশিদিন বাকিও নেই। তাই যুদ্ধ শেষ হবার আগপর্যন্ত বোস্টনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। আর বোস্টনেই মুখোমুখি হন দ্বিতীয় বাধার। টানা কয়েকদিন শহরের ধনাঢ্য কিছু শ্বেতাঙ্গ পরিবারে ডাকাতি করেন। আর এর কিছুদিন পরই ডাকাতির একটি নষ্ট ঘড়ি ঠিক করা নিয়ে পুলিসের কাছে ধরা পড়েন। এ বাধা আর উতরে যেতে পারেননি ম্যালকম। ছেদ পড়ে তার জীবনের সবচেয়ে বেপরোয়া অধ্যায়ে। ১৯৪৬ সালের প্রথম দিকেই শুরু হয় তার আট বছরের জেলের সাজা।
সারাক্ষণ নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত থাকার পর হঠাৎ করে জেলের বদ্ধ পরিবেশে এসে ডাঙায় তোলা মাছের মতো অবস্থা হলো ম্যালকমের। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জেলের ভেতর তিনি সাক্ষাত পান জন বেম্ব্রি নামক এক শিক্ষিত ভদ্রলোকের। তার জীবনের বাঁক পরিবর্তন করে দেয়ার প্রথম ধাপটা সম্পন্ন করেছিলেন বেম্ব্রিই। বেম্ব্রির প্রভাবে সময় কাটানোর জন্য বই পড়তে শুরু করেন ম্যালকম। ধীরে ধীরে তার বই পড়ার উদ্যম, উৎসাহ আর গতি, সবই বাড়তে লাগলো। তিনি একের পর এক বই গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন। জ্ঞানের জগতের অফুরান গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে তিনি ভুলে গেলেন ফেলে আসা জীবনের কথা। অসম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার জেলে বসেই সম্পূর্ণ হয়ে গেল।
জন বেম্ব্রির সংক্ষিপ্ত অধ্যায় শেষ হলে শুরু হয় এলিজাহ মুহাম্মদের অধ্যায়। জেলে বসে ম্যালকম নিয়মিতই তার ভাইদের চিঠিতে এলিজাহর কথা শুনতেন, যিনি কি না আফ্রিকান মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এবং ভাবাদর্শগতভাবে অনন্য এক ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ নামে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা ধূমপান করে না, শূকর খায় না, মদ্যপান করে না। ম্যালকমের ভাইয়েরা ততদিনে ন্যাশনের সদস্য হয়ে গেছেন। ম্যালকমও দ্রুতই প্রভাবিত হয়ে গেলেন এবং এলিজাহর কাছে নিজের অতীত জীবন এবং বর্তমান অনুধাবন সম্পর্কে চিঠি লিখলেন। প্রত্যুত্তরে এলিজাহ তাকে অতীতের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন জীবন শুরু করার পরামর্শ দিলেন। এ সময় থেকেই ম্যালকম লিটল নিজেকে ম্যালকম এক্স বলে পরিচয় করাতে শুরু করেন। ‘এক্স’ ব্যবহারের কারণ পরবর্তীতে নিজের জীবনীতে উল্লেখ করেন তিনি। এক্স দিয়ে তিনি মূলত তার প্রকৃত আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের বুঝিয়েছেন, যারা বাস্তুচ্যুত ও দাস হয়ে শ্বেতাঙ্গদের দেয়া পদবী গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন।
ম্যালকম এক্স ছিলেন চমৎকার স্বচ্ছন্দ বক্তা। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এই সুদর্শন পুরুষের বাচনভঙ্গি, কথার মাঝে প্রত্যয়, গলার স্বরে অপরিমেয় সাহস আর উদ্যম তাকে এতটাই আকর্ষণীয় করে তুলেছিল যে তিনি ন্যাশনে যোগ দেয়ার পর এর জনপ্রিয়তা হঠাৎ আকাশ ছুঁয়ে গেল। ১৯৫২ সালে তিনি যখন প্যারোলে মুক্তি পেলেন, তার বাগ্মিতায় আকৃষ্ট হয়ে প্রতি মাসে শতাধিক আফ্রো-আমেরিকান ন্যাশনে যোগ দিতে শুরু করে তখন থেকে। এলিজাহ মুহাম্মদ তাকে ডেট্রয়েটে অবস্থিত ন্যাশনের প্রধান মসজিদের মন্ত্রী ঘোষণা করেন। দ্রুতই ম্যালকমের জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো, তিনি নতুন নতুন মসজিদের দায়িত্ব নিতে লাগলেন। ম্যাসাচুসেটস, কানেক্টিকাট আর আটলান্টায় নিজের চেষ্টায় নির্মাণ করে ফেলেন তিনটি মসজিদও।
তবে এগুলো তার জনপ্রিয়তার প্রকৃত দিকটা তখনো পুরো আমেরিকার সামনে তুলে ধরতে পারেনি। তার জনপ্রিয়তা পূর্ণতা পায় ১৯৫৭ সালে হিল্টন জনসন ঘটনায়, যখন পুলিশ ও তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। দিনটি ছিল এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ। ন্যাশনের একজন কর্মী হিল্টন জনসন দেখলেন, নিউ ইয়র্কের রাস্তায় দুজন পুলিশ এক আফ্রিকান ব্যক্তিকে প্রহার করছে। জনসন মধ্যস্থতা করতে গেলে পুলিশ অফিসার দুজনেই তার উপর চড়াও হয় এবং হাতের নাইটস্টিক দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। উপরন্তু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
দ্রুতই এ খবর ম্যালকমের কানে গেল। তিনি ছুটে এলেন থানায়, সাথে নিয়ে এলেন ৪ শতাধিক মানুষ। থানার বাইরে উত্তেজিত মানুষের কলরবে পুলিশ জনসনের সাথে ম্যালকমের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে এবং চিকিৎসারও সুযোগ করে দেয়। তবে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষেই তাকে আবার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ম্যালকম জনসনকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানালেও পুলিশ তা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু দ্রুতই ম্যালকমের সমর্থকরা থানার সামনে ভিড় করতে লাগলো এবং ম্যালকমের নাম নিয়ে শ্লোগান দিতে থাকলো। অন্যদিকে পুলিশ পরিষ্কার জানিয়ে দিলো, পরদিন উকিল আসার আগপর্যন্ত জনসনকে ছাড়া হবে না। এরই মধ্যে বাইরে জড়ো হয়ে গেল হাজার চারেক মানুষ, যাদের শ্লোগানে কম্পিত হয়ে উঠছিল পুরো নিউ ইয়র্কই।
ম্যালকম দেখলেন, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি তাই থানার বাইরে গিয়ে কেবল হাত নেড়ে ইশারা করেছিলেন। আর তাতেই মিনিট পাঁচেকের মাঝে রাস্তা খালি! সেদিন প্রত্যক্ষদর্শী এক পুলিশ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছিল, “একজন মানুষের হাতের ইশারায় এত ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়!” এ ঘটনার পর থেকেই তার উপর নজরদারি করতে শুরু করে আমেরিকান পুলিশ।
ষাটের দশক শুরু হতে হতে ম্যালকম এক্সের জনপ্রিয়তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তার চলাফেরা, প্রতিটি কথা আর কাজই টিভি, রেডিও, পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেতে শুরু করে। নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। এসময় তিনি নিজেকে ম্যালক শাবাজ নামে পরিচয় করাতে চাইলেও ততদিনে ম্যালকম এক্সকেই চিনে নিয়েছে বিশ্ব। তবে শুভাকাঙ্ক্ষীর পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যক মানুষ তাকে ঘৃণাও করতো। কারণ, প্রাথমিকভাবে তার কথাবার্তা আর ভাবাদর্শ ছিল ঘৃণার আর চরমপন্থার। ন্যাশন অব ইসলামে তার প্রচার করা বিশ্বাস অনেকটা এরকম ছিল যে, কালোরাই হচ্ছে পৃথিবীর আদি মানুষ। কৃষ্ণাঙ্গরা প্রকৃত অর্থে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর, তাই শ্বেতাঙ্গদের ধ্বংস অনিবার্য। তিনি সর্বদা শ্বেতাঙ্গদের ‘শয়তান’ বলে অভিহিত করতেন। তিনি চাইতেন সকল আফ্রিকানদের একত্র করে পুনরায় আফ্রিকায় ফিরে গিয়ে স্বাধীন জাতিসত্ত্বা নিয়ে বাস করতে।
ম্যালকম আর এলিজাহর সম্পর্কের উষ্ণতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, শীতলতার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে লস এঞ্জেলসে ন্যাশনের একটি মসজিদের কয়েকজন মুসল্লিকে বিনা উসকানিতে প্রহার করে কয়েকজন পুলিশ অফিসার। এই ঘটনা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে রূপ নেয়। তবে, ক্ষতিটা হয় ন্যাশনেরই। একজন মুসলিম পুলিশের গুলিতে নিহত হন, আহত হন অর্ধ শতাধিক। পরদিন অন্তত আরো অর্ধ শতাধিক ন্যাশন কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের এরূপ অগণতান্ত্রিক আচরণে ক্ষুব্ধ ম্যালকম পুলিশকে উচিৎ শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ন্যাশনের সব শক্তিশালী কর্মীকে একত্র করেন। তবে এলিজাহ মুহাম্মদ অনুমতি না দেয়ায় তিনি আর সামনে এগোতে পারেননি। এলিজাহর প্রতিক্রিয়ায় হতাশ ম্যালকম বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করতে চাইলেন। কিন্তু রহস্যময় কোনো কারণে এখানেও এলিজাহর সম্মতি এলো না! সেই কারণটি হতে পারে ন্যাশনে তার চেয়ে বেশি ম্যালকমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া।
এরকম এক হতাশাময় পরিস্থিতিতে নভেম্বরের ২২ তারিখ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হলো। এলিজাহ মুহাম্মদ এবং ন্যাশন অব ইসলামের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হলেও ম্যালকম ভিন্ন কথাই বলে বসলেন। কেনেডি হত্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি তার সেই কুখ্যাত উক্তিটি করেন, “Chickens coming home to roost!” অর্থাৎ, পূর্বের অপকর্ম সমধিক নেতিবাচক উপায়েই ফিরে আসে! এই উক্তির পর তাকে ন্যাশন থেকে বের করে দেয়া না হলেও ৯০ দিনের জন্য মিডিয়ায় কথা বলা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। এরই মাঝে এলিজাহ মুহম্মদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং অবৈধ যৌনকর্মের অভিযোগ আসে, যেগুলোর কয়েকটি ম্যালকম নিজে যাচাই করে সত্যতা পান। আর তাতেই ন্যাশনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের চূড়ান্ত বন্দোবস্ত হয়ে যায়। ১৯৬৪ সালের ৮ মার্চ জনসম্মুখে ন্যাশন ত্যাগ করার ঘোষণা দেন ম্যালকম। ততদিনে ন্যাশনের প্রতি তার মোহ সম্পূর্ণরূপে কেটে গেছে। বরং ন্যাশনের নানা কার্যকলাপ নিয়ে তার মনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে শুরু করে। তিনি মিডিয়ায় বিভিন্ন সময়ে ন্যাশনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে শুরু করেন আর তারই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠা ন্যাশন তাকে হত্যার হুমকি প্রদান শুরু করে।
নিউ ইয়র্কের ফার্নক্লিফ সমাধিক্ষেত্রে ম্যালকমকে যথাযথ মর্যাদায় দাফন করা হয়। তার বন্ধুরা নিজেরা তার কবর খুঁড়েছিলেন। তার মৃত্যুতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল আমেরিকাতে। একাংশের মতে, একজন চরমপন্থীর জীবনাবসান হওয়াতে আমেরিকার লাভ হয়েছে তো অপর অংশ শোক প্রকাশ করেছে একজন সাহসী সমাজকর্মী হারিয়ে। এলিজাহ মুহম্মদ ম্যালকমের মৃত্যুতে কোনো শোক প্রকাশ করেননি এবং ন্যাশনের সম্পৃক্ততাও অস্বীকার করেন। আমেরিকান জাতীয় পত্রিকাগুলোতে তার জন্য কোনোরূপ সহমর্মিতা দেখানো হয়নি। নিউ ইয়র্ক টাইমস তো লিখেছিল, “হিংস্রতা আর অন্ধবিশ্বাসের একজন প্রচারকের মৃত্যু হলো!” তবে মার্টিন লুথার কিংসহ সেসময়কার প্রায় সকল নামকরা সমাজকর্মী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো ম্যালকমের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোর সম্পূর্ণ সহমর্মিতা ছিল ম্যালকমের জন্য।
ম্যালকম লিটল, পরবর্তী জীবনে যিনি ম্যালকম এক্স নামে পরিচিত হন, ১৯২৫ সালের ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যের ওমাহা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আর্ল লিটল একজন কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিস্টান ছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে নানাবিধ তৎপরতা চালাতে একটি অখ্যাত সংগঠনও পরিচালনা করতেন তিনি। সেসব করতে গিয়ে ‘কু ক্লাক্স ক্লান’ এবং উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী সংগঠন ‘ব্ল্যাক লিজিয়ন’ এর রোষানলে পড়ে পরিবার নিয়ে শহর ছাড়তে হয় তাকে। একবার তো তার বাড়িই পুড়িয়ে দিয়েছিল ব্ল্যাক লিজিয়ন। শৈশব থেকে শ্বেতাঙ্গদের নানারূপ ঘৃণা আর বিদ্বেষের মুখে বড় হতে হতে শ্বেতাঙ্গদের প্রতি তার মনেও তীব্র বিদ্বেষ জন্মায়। মোটাদাগে, তার শ্বেতাঙ্গবিদ্বেষী হবার কিছু কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
- শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারে নিজ শহর ছেড়ে উইসকনসিনে যেতে বাধ্য হওয়া।
- তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া।
- উইসকনসিনে যাবার কয়েক মাসের মাথায় তার বাবার মৃত্যু হয়। তার মায়ের এবং তার বাবার সমর্থক, সকলেরই বিশ্বাস ছিল শ্বেতাঙ্গরাই তাকে হত্যা করেছে, যদিও সেটিকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখানো হয়।
- কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় জীবিকার্জনে তার মায়ের পদে পদে বিপর্যস্ত হওয়া। তাছাড়া ম্যালকমের মা একজন শ্বেতাঙ্গের সাথে প্রেমও করেছেন এক বছর, যিনি এই বিধবা নারীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে তার গর্ভে সন্তান এলে ঐ ব্যক্তি বিয়ে না করে পালিয়ে যায় এবং তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ২৪ বছর পর তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন ম্যালকম।
- মাধ্যমিক স্কুলে সকলের চেয়ে ভালো ফলাফল করেও স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন সহপাঠী এবং শিক্ষকদের অসহযোগিতায়। তার স্বপ্ন ছিল তিনি একজন উকিল হবেন, অথচ তার শিক্ষকরা বরাবরই “নিগ্রোদের উকিল হবার স্বপ্ন অবাস্তব” বলে তাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। স্কুল ছেড়ে দেয়ার পরই তিনি উপলব্ধি করলেন যে, বর্ণবিদ্বেষী এই সমাজ তাকে বেশিদূর এগোতে দেবে না।
ম্যালকমের যখন ১৪ বছর, তখন তিনি বোস্টনে চলে আসেন জীবিকার জন্য, এখানে তিনি নানারকম বৈধ-অবৈধ কাজ করেছেন। চুরি ডাকাতি এখানেই তার শেখা। আর সেসব দক্ষ হয়ে ওঠেন হারলেমে গিয়ে। হারলেমে তার ন্যাশন অব ইসলাম অধ্যায়ের কথা তো আগেই জেনেছি। ন্যাশনে থাকাকালীনই ১৯৫৫ সালে তিনি বেটি স্যান্ডার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর বেটি তার নাম পরিবর্তন করে বেটি এক্স রাখেন। এই দম্পতির ঘরে ৬ কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
ম্যালকম এক্সের দর্শন এবং ভাবাদর্শ নিয়ে ইতোমধ্যেই কিছুটা ধারণা পেয়েছেন পাঠক। ন্যাশন অব ইসলামে আসার পূর্বে এবং এই আন্দোলনে থাকাকালীন সময়েও তিনি কিছুটা চরমপন্থী বিশ্বাসে নিমজ্জিত ছিলেন। তবে ন্যাশন থেকে বেরিয়ে যাবার প্রাক্বালে তার ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে শুরু করে। তিনি আফ্রিকানদের আফ্রিকায় ফিরে যাওয়া উচিৎ, এরূপ চিন্তার বদলে আফ্রিকান জাতীয়বাদে গুরুত্ব দেন। এর বড় কারণ হচ্ছে, ন্যাশন থেকে বেরিয়ে যাবার পর তিনি মূলত বড় পরিসরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, কেবল আফ্রো-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন না করে যদি কৃষ্ণাঙ্গদের মানবিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেন, তাহলে সেটা অনেকটাই বৈশ্বিক রূপ পাবে এবং মানবতার আন্দোলনে পরিণত হবে। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে শ্বেতাঙ্গদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যেতে হবে, এরূপ মনোভাবও তার ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকে।
ন্যাশন অব ইসলাম থেকে বের হয়ে গেলেও ম্যালকম এক্স ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেননি। বরং, ন্যাশন ত্যাগ করার পর তিনি সুন্নি মতবাদের অনুসারী হন। কিছুকালের মধ্যেই তিনি দুটি সুন্নি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ‘অর্গানাইজেশন ফর আফ্রো-আমেরিকান ইউনিটি’ গঠন করেন। তার এই সংগঠনের বিশেষত্ব ছিল এই যে, এটি সমস্ত আফ্রিকানদের অধিকার নিয়েই কথা বলতো, যেখান ন্যাশন কেবল আফ্রিকান মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছে। তার এই সংগঠনটি ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন।
১৯৬৪ সালে ম্যালকম এক্স মক্কায় পবিত্র হজ্বব্রত পালন করতে যান। এটি ছিল তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ এখানে তার দর্শনে আমূল পরিবর্তন আসে। আজন্ম শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষ পোষণ করা ম্যালকম এক্স সবসময় চাইতেন শ্বেতাঙ্গদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে। কিন্তু সৌদি যুবরাজ ফয়সালের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে হজ্ব পালন করে আসার পর তার এই ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তিনি দেখলেন, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, নীল চোখ আর কালো চোখে, সোনালী চুল কিংবা সাদা চুল, সারা বিশ্ব থেকে আগত সকল বর্ণের, গোত্রের আর মতের মানুষ কেবল এক মুসলমান পরিচয়ে হজ্ব পালন করছেন। এরকম সম্প্রীতি দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন ম্যালকম। তিনি উপলব্ধি করলেন, শ্বেতাঙ্গদের কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষের মতোই তার শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষ কখনো শান্তি আনতে পারবে না। বরং সকলকে একত্রে নিয়েই শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব।
গুপ্তঘাতকের গুলিতে ম্যালকম এক্স মৃত্যুবরণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার প্রভাব মুছে যায়নি আজও। বিশেষ করে আমেরিকার আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলো ম্যালকম এক্সকে তাদের প্রকৃত পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার কারিগর হিসেবে মনে রেখেছে। তাকে বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী আফ্রো-আমেরিকান ব্যক্তিত্ব। বিশ্বজুড়ে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের স্বকীয়তা, আদি আফ্রিকান ঐতিহ্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা ও সাহস প্রথম তিনিই যুগিয়েছিলেন। ‘ব্ল্যাক পাওয়ার মুভমেন্ট’, ‘ব্ল্যাক আর্টস মুভমেন্ট’ এর মতো শক্তিশালী আন্দোলন কিংবা ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ এর মতো তুমুল জনপ্রিয় শ্লোগানের মূলে রয়েছেন তিনি।
তার জীবন নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হলেও তার জীবদ্দশায় অ্যালেক্স হ্যালির লেখা ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব ম্যালকম এক্স’ বইটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং তথ্যবহুল। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্রও। তবে, সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছিল ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন অভিনীত ১৯৯২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘ম্যালকম এক্স’। মৃত্যুর এত বছর পরও জনপ্রিয় এই নেতা পৃথিবীর মানবাধিকার কর্মী আর কৃষ্ণাঙ্গদের নিকট, সর্বোপরি সকলের মনেই শ্রদ্ধার আসনে উপনীত হয়ে আছেন।