স্ট্যালিন; শব্দটির অর্থ ম্যান অব স্টিল, বাংলায় যাকে বলে লৌহমানব। যদিও নামটি তিনি ছদ্মনাম হিসেবে নিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে বলশেভিকদের কাছে এই নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইতিহাস বলে— তিনি স্ট্যালিন নামটি সার্থক করে তুলেছিলেন। রুশ বিপ্লবের পুরোধা পুরুষ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মৃত্যুর পর, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি সুদৃঢ় কাঠামোর উপর দাঁড় করান স্ট্যালিন। তার ইস্পাত-কঠিন নেতৃত্বের কারণেই সোভিয়েতরা জার্মান নাৎসিদের পরাজিত করে। লৌহমানবের মতো স্ট্যালিনের নেতৃত্বই সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাশক্তি বানায়।
স্ট্যালিনের এসব গুণের পাশাপাশি দোষও কিন্তু কম নয়, বরং ঢের বেশি। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা সবচেয়ে বেশি মানুষের হত্যার জন্য দায়ী, তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিন। তার শাসনকালে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায়, ও শ্রমক্যাম্পে যে কত মানুষ মারা গেছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কিছু সোভিয়েত গোপন নথি ও গবেষণানুযায়ী, স্ট্যালিনযুগে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও শ্রমিক শিবিরে প্রায় ২ কোটি মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়াও অত্যাচারের শিকার হয়েছে প্রায় ৪ কোটি মানুষ। জারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে যে মানুষগুলো একসময় কমিউনিস্টদের সমর্থন দিয়েছিল, পরবর্তীতে তারাই স্ট্যালিনের আমলে জারের আমলের চেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে। তার নির্যাতনের হাত থেকে বাদ যায়নি কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শবাদী শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে বেসামরিক আমলা এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা পর্যন্ত।
রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জোসেফ স্ট্যালিন। জন্মেছেন মস্কো থেকে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরে, ককেশাসের (তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও বর্তমান জর্জিয়া) ক্ষুদ্র শহর গোরীর এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা বেসারিওন জুগাশভিলি ছিলেন চর্মকার, এবং মাতা একাতেরিন গেলাদজে একজন ধোপানী।
স্ট্যালিনের জন্মের সঠিক তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী, তিনি ১৮৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৬ ডিসেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু, স্ট্যালিন পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালের ২১ ডিসেম্বরকে নিজের আনুষ্ঠানিক জন্মদিন হিসেবে পালন করেন।
জন্মের পর পিতা-মাতা তার নাম রাখেন ইওসিফ। মা ডাকতেন সোসো বলে। স্ট্যালিন ছাড়া তার অন্যান্য ভাই-বোনেরা শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেন। দারিদ্র্যের মধ্যেই পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে সোসো। বাল্যকালে তিনি একবার গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন, সেই দাগ আজীবন তার মুখে ছিল। স্ট্যালিনের পিতা বেসারিওন ছিলেন অত্যন্ত মদ্যপায়ী। প্রায়ই মদ্যপ অবস্থায় তিনি স্ট্যালিন ও তার মায়ের উপর অত্যাচার করতেন। এমন অশান্ত এক পরিবেশেই বেড়ে উঠতে থাকে স্ট্যালিন। কে জানতো, চরম দারিদ্র্য ও বিশৃঙ্খল পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই সোসোই একদিন ককেশাসের উপত্যকা থেকে বের হয়ে ক্রেমলিনের অধীশ্বর হয়ে উঠবে!
স্ট্যালিনের পিতা-মাতা উভয়ই ছিলেন অর্থোডক্স খ্রিস্টান। মা সোসোকে পাদ্রি বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবার অমত ছিল এ ব্যাপারে। বেসারিওন স্ট্যালিনকে নিজের সাথে কাজে নিয়ে একজন দক্ষ চর্মকার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে, একাতেরিন পড়ালেখাকে অগ্রাধিকার দিতেন, এবং যেকোনো মূল্যে সোসোকে একজন পাদ্রি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
পিতার অনেকটা অমতেই, ১৮৮৮ সালে স্ট্যালিনকে গোরী চার্চ স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলে ভর্তির পর দেখা গেল, ছেলের মেধা ভালো। কয়েক বছর ভালোই চলছিল, কিন্তু এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বছর কয়েক যেতে না যেতেই, স্ট্যালিনের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তার পিতা বেসারিওন তাকে নিজের সঙ্গে টিফলিসে (জর্জিয়ার রাজধানী) নিয়ে যান, যেখানে তিনি একটি কারখানায় কাজ করতেন।
স্ট্যালিনকে একজন শিক্ষানবিশ মুচি হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে, তিনি যে কারখানায় কাজ করতেন, স্ট্যালিনকেও সেখানে নিয়ে যান। স্ট্যালিনের মা এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি শিক্ষকদের সহায়তায় স্ট্যালিনকে ফিরিয়ে আনেন এবং আবারও তাকে সেমিনারিতে নিয়ে যান। এই ঘটনার পরে বেসারিওন স্ট্যালিনের মায়ের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান, যদিও এর আগে থেকেই তারা মোটামুটি বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন শুরু করেছিলেন। তবে, হাল ছাড়েননি স্ট্যালিনের মা, তিনি ধোপানীর কাজ করে স্ট্যালিনের লালনপালন ও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকেন।
স্ট্যালিন শীঘ্রই শিক্ষকদের কাছে তার মেধার পরিচয় দেন। তিনি উত্তরোত্তর স্কুলের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ১৮৯৪ সালে টিফলিস থিওলজিক্যাল সেমিনারিতে পড়ার জন্য বৃত্তি অর্জন করেন। অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মশিক্ষার এই স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে স্ট্যালিনের পাদ্রি হওয়ার রাস্তা খুলে যায়। খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, পাদ্রি হতে চাওয়া এই ছেলেই তার পরবর্তী জীবনে পাদ্রিদের উপর চড়াও হন! যাই হোক, এই স্কুলে পড়া অবস্থায় স্ট্যালিনের হাতেখড়ি হয় কাব্য ও গদ্য রচনায়। বালক স্ট্যালিনের পড়ালেখার সাথে, সংস্কৃতি চর্চায়ও প্রতিভার আভাষ পাওয়া গেল। তিনি প্রায়ই গান গাইতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন, কবিতা লিখতেনও— বেশ কিছু আবার রোমান্টিক ঘরানার। স্কুলে পড়া অবস্থায়ই তার পাঁচটি কবিতা, এবং কয়েকটি গল্প একটি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
স্কুলে থাকাবস্থায় স্ট্যালিন প্রচুর নন-একাডেমিক বই পড়তেন। সেখানে তিনি একটি গোপন বইয়ের ক্লাব খুঁজে পান, যেটি ছিল নিষিদ্ধ। তিনি সেই ক্লাবে যোগ দেন, এরই মধ্য দিয়ে প্রথম পরিচয় ঘটে যায় কার্ল মার্ক্সের বইয়ের সাথে। মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ ও অন্যান্য বই পড়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন সমাজতন্ত্রের প্রতি। এছাড়া এ সময় স্ট্যালিন নিকোলাই চের্নিশেভস্কির বিপ্লবপন্থী উপন্যাস ‘হোয়াট টু বি ডান’, এবং আলেকজান্ডার কাজবেগির ‘দ্য প্যাট্রিসাইড’ বই দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হন।
এ সময় তিনি কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ পড়ে অত্যন্ত প্রভাবিত হন। স্ট্যালিন ক্রমশই মার্ক্সের সামাজিক-রাজনৈতিক তত্ত্ব বা মার্ক্সবাদে নিজেকে নিবেদিত করতে থাকেন। মার্ক্সবাদ তখন জর্জিয়ায় বিস্তার লাভ করছিল। তিনি স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক সংগঠনে যোগদান করেন। এ সময় রুশ সাম্রাজ্যের শাসক জার ও তার শাসনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। জারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগ্রহ স্ট্যালিনের মধ্যেও তীব্র হতে থাকে। তখন তিনি প্রায়ই গোপনে শ্রমিকদের সভায় যোগ দিতেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্ট্যালিন পাদ্রির পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। স্কুলে ক্রমশই তার ফলাফল খারাপ হতে থাকে। সেমিনারির জার্নালে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি প্রার্থনা থেকে বিরত থাকতেন, সেই সঙ্গে সন্ন্যাসীদের মতো মাথায় টুপি পরতেন না। শেষপর্যন্ত, ১৮৯৯ সালের এপ্রিল মাসে তার ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকমাস আগে, স্ট্যালিন টিফলিস স্পিরিচুয়াল সেমিনারি ছেড়ে দেন, এরপর আর কখনোই ফিরে যাননি। সেমিনারি ত্যাগ করার পর, টিফলিস অবজারভেটরিতে কিছুদিন কেরানির চাকরি করেন স্ট্যালিন। এ সময় তিনি সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বিভিন্ন গোপন মিটিংয়ে যোগ দিতেন।
তখন সমগ্র রাশিয়ান সাম্রাজ্যে সমাজতন্ত্রীদের সমর্থন বেড়েই চলেছে। আর তা দেখে জার আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। জারের সিক্রেট পুলিশ বাহিনী সমগ্র রাশিয়ান সাম্রাজ্যে সমাজতন্ত্রীদের তন্নতন্ন করে খুঁজছে। ১৯০১ সালে টিফলিসে এক গোপন মিটিংয়ের সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেখানে ধাওয়া করে। স্ট্যালিনও ছিলেন সেই মিটিংয়ে। স্ট্যালিনের কয়েকজন কমরেডকে গ্রেফতারও করে পুলিশ, তবে তিনি দিব্যি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এই ঘটনার পর স্ট্যালিনের উপলধ্বি হয়— তাদের কার্যক্রমের গোপনীয়তা আরো বৃদ্ধি করতে হবে।
এরপর তিনি ‘কোবা’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে আত্মগোপনে চলে যান। কোবা নামটি তিনি আলেকজান্ডার কাজবেগির ‘দ্য প্যাট্রিসাইড’ বই থেকে নেন। আত্মগোপনে থেকেই তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। একের পর এক হরতাল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে তিনি কর্তৃপক্ষকে অতিষ্ঠ করে তুললেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জর্জিয়ার সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মধ্যে বেশ পরিচিতি পান তিনি। ১৯০১ সালে ‘রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির’ (১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) টিফলিস শাখার কমিটিতে জায়গা লাভ করেন স্ট্যালিন।
১৯০১ সালের নভেম্বরে স্ট্যালিন টিফলিস থেকে জর্জিয়ার বন্দরনগরী বাটুমিতে চলে যান। সেখানে তিনি রথসচাইল্ড পরিবারের মালিকানাধীন একটি তেল শোধনাগারে চাকরি করতে শুরু করেন। এসময় জারবিরোধী কয়েকটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। গোপনে থাকার পরও জারের সিক্রেট পুলিশ বাহিনী ১৯০২ সালের এপ্রিলে স্ট্যালিনকে গ্রেফতার করে। কয়েকমাস বিভিন্ন আঞ্চলিক কারাগারে রাখার পর, ১৯০৩ সালে তাকে প্রথমবারের মতো সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়।
স্ট্যালিন যখন সাইবেরিয়ায় কারাভোগ করছেন, তখন রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি দুটি উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। ভ্লাদিমির লেনিন বলশেভিকদের এবং জুলিয়াস মারটভ ম্যানশেভিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সাইবেরিয়ার চরম শীত ও বরফে থাকাকালীন তিনি এই খবর জানতে পারেন এবং লেনিনের বলশেভিক পার্টিতে যোগদানের অভিপ্রায়ে, দুবার পালানোর চেষ্টা করেন। প্রথমবার পালানোর চেষ্টা করলে ফ্রস্টবাইটের কারণে শেষপর্যন্ত পালাতে পারেননি।
পরবর্তীতে ১৯০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি পুনরায় পালানোর চেষ্টা করেন, এবার তিনি সফল হন। সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে তিনি টিফলিসে চলে আসেন। এবার তিনি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় স্ট্যালিন এক জর্জিয়ান মার্ক্সবাদী পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। জর্জিয়ায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি বিপ্লবের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে থাকেন। এসময় তিনি বিপ্লবী রাজনীতি, এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
কিছুদিন পর ১৯০৫ সালের জানুয়ারিতে, সেইন্ট পিটার্সবার্গে বিক্ষোভরত জনতার উপর গণহত্যা চালায় জারের বাহিনী। আন্দোলন শীঘ্রই রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সব জায়গায় পৌঁছে যায়। বিপ্লবের অভিপ্রায়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এটি ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব নামে পরিচিত। যদিও এই বিপ্লব পুরোপুরি সফল হয়নি তবে এর ফলে অনেকগুলো সাংবিধানিক সংস্কার করা হয়।
বিপ্লব চলাকালে স্ট্যালিন জর্জিয়াতে বলশেভিকদের সংগঠিত করে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলেন, চড়াও হন সরকারি সেনাদের ওপরে। এই বিপ্লবে জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে পদচ্যুত করার জন্য স্ট্যালিন তার মিলিশিয়া বাহিনী নিয়ে অনেকগুলো গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ সময় স্ট্যালিনের সাংগঠনিক দক্ষতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিপ্লবে স্ট্যালিনের অবদান তাকে জর্জিয়ান বলশেভিকদের মধ্যে পরিচিত করে তোলে। তিনি হয়ে ওঠেন জর্জিয়ার অন্যতম শীর্ষ বলশেভিক নেতা।
১৯০৫ সালে ফিনল্যান্ডের ট্যাম্পেরেতে বলশেভিকদের সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সম্মেলনে জর্জিয়ান বলশেভিকদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয় স্ট্যালিনকে। এই সম্মেলনেই তিনি প্রথমবারের মতো লেনিনের সাক্ষাত পান। সম্মেলনে লেনিনের প্রতি সম্মান রেখেই স্ট্যালিন কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি ছিলেন লেনিনের ভক্ত, তবে অন্ধভক্ত না। স্ট্যালিন সবসময় লেনিনের যেসব সিদ্ধান্ত সঠিক মনে করতেন না, তা যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে সরাসরি বলতেন। স্ট্যালিনের চরিত্রের এই দিকটি লেনিন বেশ পছন্দ করেন।
এই সম্মেলনের পর লেনিন স্ট্যালিনের সাংগঠনিক দক্ষতা, তার মেধা ও সাহস এবং অন্যান্য কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তিনি বেশ কিছু দিকনির্দেশনামূলক কথাবার্তা বলেন স্ট্যালিনকে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, লেনিন এ সময় স্ট্যালিনকে সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের নির্দেশ দেন। এরপর, ১৯০৬ সালে রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির স্টকহোম সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেন স্ট্যালিন। পরবর্তীতে তিনি লন্ডন ও স্টুটগার্টসহ পার্টির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯০৬ সালে তিনি সাতাশ বছর বয়সে পা দিলেন। যুবক স্ট্যালিন বিয়ে করে সংসার পাতলেন কেতেভান সানিদজের সাথে। এক বছর পর, ১৯০৭ সালে তাদের প্রথম সন্তান ইয়াকভের জন্ম হয়।
প্রায় সমকালেই সংগঠনের তহবিলের জন্য ব্যাংক থেকে ২,৫০,০০০ রুবল চুরি করেন স্ট্যালিন। ব্যাংক ডাকাতির পর তিনি পালিয়ে বাকুতে (আজারবাইজানের রাজধানী) চলে যান। বাকুতে তখন ম্যানশেভিকদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। তিনি সেখানে বলশেভিকদের প্রভাব বাড়াতে থাকেন এবং দুটি সংবাদপত্রের সম্পাদনা শুরু করেন। দুর্ভাগ্যবশত, কিছুদিন পর তার স্ত্রী টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সঙ্গিনীহারা স্ট্যালিন ছেলে ইয়াকভকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে সাংগঠনিক কাজের প্রতি মনোযোগ দেন।
সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় স্ট্যালিন এসময় পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে চলে আসেন। কয়েকবার গ্রেফতারও হন, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই জেল থেকে পালিয়ে আসেন। পলায়নবিদ্যায় স্ট্যালিন ছিলেন বেশ পারদর্শী! জীবনে অনেকবার তিনি জেল থেকে পালিয়েছেন, সেই সংখ্যা ১২। শুধুমাত্র ১৯০২-১৩ সালের মধ্যে স্ট্যালিনকে সাতবার গ্রেফতার করে নির্বাসিত করা হয়, যার মধ্যে তিনি ছয়বারই জেল থেকে পালিয়ে আসেন।
১৯১২ সালে প্রাগ সম্মেলনে বলশেভিক পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই সময় স্ট্যালিন জেলে ছিলেন। কারাগারে থাকাবস্থায় তাকে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়। কিছুদিন পর তিনি আবারও জেল থেকে পালিয়ে সেইন্ট পিটার্সবার্গে চলে যান। সেখানে তিনি গোপনে বলশেভিক পার্টির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রাভদার সম্পাদনা করতে থাকেন। প্রাভদা রাশিয়ায় বলশেভিকদের প্রভাব বিস্তারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিছুদিন পর, ১৯১২ সালের মে মাসে, স্ট্যালিনকে আবারো গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কয়েকমাস পর তিনি আরেক বলশেভিক কর্মীর সাথে মিলে আবারও সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি পুনরায় সেইন্ট পিটার্সবার্গে গিয়ে প্রাভদার জন্য আর্টিকেল লেখা ও সম্পাদনা করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এসে তিনি নিজের গোপনীয়তা আরো বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই পর্যায়েই নিজের নিরাপত্তার জন্য ‘স্ট্যালিন’ ছদ্মনামের সূচনা, তিনি চলে যান আত্মগোপনে।