১৯৪৫ সালের এপ্রিলে স্ট্যালিনের রেড আর্মি জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ঢুকে পড়ে। তিনি রেড আর্মিকে নির্দেশ দেন, নাৎসি নেতা হিটলারকে জীবিত বন্দী করতে। ৩০ এপ্রিল রেড আর্মির হাতে ধরা পড়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেন হিটলার। ২ মে রেড আর্মির হাতে বার্লিনের পতন ঘটে। এরপর নাৎসি বাহিনী শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে। এরই মাধ্যমে ইউরোপে রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধের সমাপ্তি হয়। তবে, যুদ্ধের পর আর কোনোকিছু অবশিষ্ট নেই, প্রায় সবকিছুই এখন ধ্বংসাবশেষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের এমন কোনো পরিবার নেই যার অন্তত একজন সদস্য মারা যায়নি।
স্ট্যালিন এই বিজয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান। তার অসাধারণ নেতৃত্বে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানদের পরাজিত করে। সোভিয়েতদের এই বিজয়ের পেছনে রয়েছে তার ত্যাগ, কঠিন হৃদয়ের সিদ্ধান্ত, কূটনৈতিক চাল, রাজনৈতিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব। ১৯৪৫ সালের ২৪ জুন রেড স্কয়ারে লেনিনের সমাধিস্তম্ভের সামনে রেড আর্মির বিজয় প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। প্যারেডে অভিবাদন গ্রহণ করেন স্ট্যালিন। ২৬ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সুপ্রিম সোভিয়েত’ তাকে ‘অর্ডার অব ভিক্টরি’ সম্মানে ভূষিত করে। সোভিয়েত সরকার, সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে অনেকগুলো সম্মানে ভূষিত করা হয়।
ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হলো। এবার যুদ্ধোত্তর জার্মানি তথা ইউরোপের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য মিত্রশক্তির নেতারা আবারও সম্মেলনের আহ্বান জানান। ১৯৪৫ সালের জুলাইয়ে বার্লিনের অদূরে, পটসড্যাম শহরের সিসিলিয়েনহফ প্রাসাদে মিত্রশক্তির নেতারা একত্রিত হন। ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত চলে ‘পটসড্যাম সম্মেলন’। পটসড্যাম সম্মেলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি তেহরান কিংবা ইয়াল্টা সম্মেলনের চেয়েও অধিক তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই সম্মেলনের কয়েকমাস পূর্বেই (১২ এপ্রিল) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট মারা যান। ফলে তার স্থলাভিষিক্ত হন ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান।
ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থগত উত্তেজনা তৈরি হয়। স্ট্যালিন বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধের পর তার প্রধান শত্রু হবে যুক্তরাষ্ট্র। তাই তিনি আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেন। স্ট্যালিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রচুর পরিমাণে গোয়েন্দা তৎপরতা চালান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রজেক্টেও তিনি গোয়েন্দা নিয়োগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্ট্যালিনের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, পটসড্যাম সম্মেলনের একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্কোরণ ঘটায়। এর মাধ্যমে বিশ্ব পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করে।
পটসড্যাম সম্মেলন চলাকালে ট্রুম্যান যখন স্ট্যালিনকে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার বিষয়টি অবহিত করেন, তখন স্ট্যালিন খুব নির্ভীক ছিলেন, যেন কিছুই হয়নি! অথচ ট্রুম্যান ভেবেছিলেন খবরটি শুনে স্ট্যালিন হতচকিত হয়ে যাবেন। প্রকৃতপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বিস্ফোরণের সব খবর স্ট্যালিন ম্যানহাটন প্রজেক্টের অভ্যন্তরে থাকা তার স্পাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আগে থেকেই জানতেন।
পটসড্যাম সম্মেলন চলাকালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে ঘোষণা হয় এবং চার্চিল পরাজিত হন। চার্চিলের স্থলে ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেন নতুন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি। পটসড্যাম সম্মেলনে স্ট্যালিনের দাবির প্রেক্ষিতে বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী পূর্ব প্রুশিয়াকে ভেঙে এর একাংশ (কনিগসবার্গ) সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেওয়া হয়। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের নিয়ন্ত্রিত জার্মানির পূর্বাঞ্চল থেকে বাজেয়াপ্ত করা শিল্পদ্রব্য, খাদ্যদ্রব্য ও খনিজ সম্পদের সবকিছুই পায়, সেই সঙ্গে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাজেয়াপ্ত করা সমস্ত শিল্প সরঞ্জামের ১০ শতাংশ পায়।
মিত্রশক্তির অন্য দেশগুলো অনেকদিন ধরেই স্ট্যালিনকে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য চাপ দিচ্ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর স্ট্যালিন জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে মনোনিবেশ করেন। তিনি কয়েক লক্ষ সোভিয়েত সেনা পূর্বাঞ্চলে জাপানের দিকে স্থানান্তর করেন। জাপান ততদিনে অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিল এবং পরাজয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। স্ট্যালিন জাপানের ডানা ছেঁটে ফেলার একটি সুযোগ দেখতে পান। জাপান যেন ভবিষ্যতে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে, এজন্য তিনি জাপান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনি জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন।
১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট, সোভিয়েত সেনাবাহিনী জাপান অধিকৃত মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে দখল করে নেয়। মাঞ্চুরিয়া ছিল মূলত জাপানের পুতুল রাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া বিজয়ের পর সোভিয়েত বাহিনী কোরিয়ান উপদ্বীপে নজর দেয়। পরবর্তীতে দক্ষিণ সাখালিন, উত্তর কোরিয়া, ও কুরিল দ্বীপপুঞ্জ সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীন আসে। এশিয়ায় সোভিয়েত বাহিনীর এই সম্প্রসারণ নীতি যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। স্ট্যালিন ও রুজভেল্টের মধ্যে যে উষ্ণ সম্পর্ক ছিল, ট্রুম্যানের আমলে তা শীতল হতে শুরু করে।
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীন দেশগুলোতে স্ট্যালিনের প্রভাব ক্রমেই বাড়তে থাকে। ইয়াল্টা সম্মেলনে স্ট্যালিন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে অবাধ নির্বাচনের অনুমতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি আসলে পূর্ব ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে একটি বাফার জোনে (নিরাপদ অঞ্চল) পরিণত করতে শুরু করেন। স্ট্যালিনের আশঙ্কা ছিল পূর্ব ইউরোপের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণ করতে পারে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো। স্ট্যালিনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, যুদ্ধের পর এই দেশগুলোতে সোভিয়েত প্রভাবিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এগুলো সোভিয়েত স্যাটেলাইট রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে যুদ্ধে বিধ্বস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনর্গঠনের কাজে নেমে পড়েন স্ট্যালিন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশ্বযুদ্ধের ফলে অন্যসব রাষ্ট্রের চেয়ে তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূলধনের মোটামুটি এক-চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং ১৯৪৫ সালে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন যুদ্ধপূর্ব সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল।
যুদ্ধোত্তর অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার লক্ষ্যে স্ট্যালিন শিল্পের আধুনিকায়ন এবং ভারী শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করেন। যুদ্ধোত্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভোগ্যপণ্য ও কৃষি দ্রব্যের চেয়ে অস্ত্র শিল্প এবং ভারী শিল্পের উপর বেশি দৃষ্টি দেওয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার উৎপাদিত যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল পূর্ব ইউরোপে স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোতে রপ্তানি শুরু করে। এছাড়া যুদ্ধের ফলে কৃষিজমিসহ কৃষিকাজের বিভিন্ন অবকাঠামো অত্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল এবং যুদ্ধকালীন অস্ত্র তৈরিতে জোর দেওয়ায় কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় শিল্পসামগ্রীও উৎপাদিত হয়নি। এই সমস্ত কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত একটি বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খাদ্যদ্রব্য বিতরণের পরিবর্তে খাদ্য মজুদ ও রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই দুর্ভিক্ষে আনুমানিক এক থেকে দুই মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টি, খাদ্যাভাব, ও বিভিন্ন রোগের কারণে মারা যায়। দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। দুর্ভিক্ষের সময় যখন কৃষি উৎপাদন স্থবির ছিল, স্ট্যালিন তখনও জলবায়ু প্লান্ট, খাল এবং রেললাইন নির্মাণসহ বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পের উপর মনোনিবেশ করেন। এসব কাজও সেই যুদ্ধপূর্ব সময়ের মতোই গুলাগের শ্রমিকদের মাধ্যমে জোরপূর্বক করানো হয়।
একইসঙ্গে স্ট্যালিন তার দমনমূলক ব্যবস্থাও চালু রাখেন। যুদ্ধোত্তর পুনর্নির্মাণের সময়ে, স্ট্যালিন অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কঠোর করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে পশ্চিমা প্রভাব কমাতে উঠে-পড়ে লাগেন তিনি। তার নির্দেশে সর্বক্ষেত্রে ধনতন্ত্রের উপর সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করে প্রচারণা চালানো হয়। এ সময় চলচ্চিত্র ও নাটকের মাধ্যমে পশ্চিমা বিরোধী প্রচারণা চালানো হয়।
লেখক, সাহিত্যিক, সুরকার, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক এবং বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের কাজেই পাশ্চাত্য প্রভাব দেখা গিয়েছে, তাদের উপরই নিপীড়ন চালানো হয়েছে। যুদ্ধকালীন গির্জা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া সীমিত স্বাধীনতাও বাতিল করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের যে অঞ্চলগুলো সোভিয়েত শাসন মানতে চাইত না, সেখানে চরম অত্যাচার চালানো হয়। সেখানকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে গুলাগে পাঠানো হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্ট্যালিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালে তার নির্দেশে নতুন নামে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের যাত্রা শুরু হয়। যুদ্ধের পরপরই মঙ্গোলিয়ায় কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতেও একের পর এক কমিউনিস্ট শাসন চালু হতে থাকে। স্ট্যালিন চীনের কমিউনিস্টদের সহায়তা প্রদান করেন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। তার এই পররাষ্ট্রনীতি স্নায়ুযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের এমন বিস্তারের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সোভিয়েত ইউনিয়নের লাগাম টেনে ধরতে ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়ে যায় স্নায়ুযুদ্ধের। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিকভাবে মোকাবিলা করতে ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মিলে ‘ন্যাটো’ ‘North Atlantic Treaty Organisation’ (NATO) গঠন করে।
পশ্চিমাদের ভয়ে স্ট্যালিন দমে যাননি। স্ট্যালিনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট শাসন শুরু হয়। একই সময় উত্তর কোরিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন চালু হয়। এছাড়াও এসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টদের উত্থান ঘটতে থাকে। ১৯৪৯ ও ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সাং স্ট্যালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার নির্দেশে কিম ইল সাংয়ের উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে এবং কোরিয়ান যুদ্ধের সূচনা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে কয়েকধাপ এগিয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্ট্যালিন পারমাণবিক অস্ত্র লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে ম্যানহাটন প্রজেক্টের অনেকগুলো নথি হাতিয়ে নেয় সোভিয়েতরা। এই নথিগুলোর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমার গবেষণা বেশ বেগবান হয়। পরমাণু বোমা তৈরির অভিপ্রায়ে স্ট্যালিন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সোভিয়েত গোপন গবেষণা জোরদার করার নির্দেশ দেন। শেষপর্যন্ত, ১৯৪৯ সালের আগস্টে, কাজাখস্তানের মরুভূমিতে সোভিয়েতরা সফলভাবে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্কোরণ ঘটায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৮ সালে নবনির্মিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনেও স্ট্যালিনের অবদান রয়েছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ফলে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তার নির্দেশে সোভিয়েত গণমাধ্যমগুলো জায়নবাদ ও ইহুদি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমণে লিপ্ত হয়। ইহুদি প্রশ্নে স্ট্যালিনের অবস্থান কী ছিল, তা স্পষ্ট নয়। অনেকেই স্ট্যালিনকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে মনে করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের অধিকাংশই ছিলেন ইহুদি। ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ প্রমুখ ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত। তিনি ইহুদিদের প্রতিবিপ্লবী জাতি বলে বিবেচনা করতেন।
স্ট্যালিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করেন, সেখানে অভিযুক্ত অধিকাংশ ডাক্তার ছিল ইহুদি। এমনই নানা কারণে অনেকে স্ট্যালিনকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে মনে করেন। অপরদিকে, যখন জায়নিজমের উত্থান ঘটছিল, তখন ইহুদিদের জন্য সাইবেরিয়ায় একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বরাদ্দ দিয়েছিলেন স্ট্যালিন, যেটি ‘জুইশ অটোনমাস অবলাস্ট’ নামে পরিচিত। তার যেসব কর্মকাণ্ড ইহুদিদের বিরুদ্ধে গিয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক। তাই অনেকেই স্ট্যালিনকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে মানতে চান না।
জার্মানির প্রশ্নে স্ট্যালিন চেয়েছিলেন একটি অসামরিকীকৃত কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে, সেই সঙ্গে আশা করেন যে, এটি হয় সোভিয়েত প্রভাবের অধীনে আসবে অথবা নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এর বিরোধিতা করে। ফলে, স্ট্যালিন ১৯৪৮ সালের জুন মাসে বার্লিন অবরোধ করেন, যদিও ১৯৪৯ সালের মে মাসে অবরোধ তুলে নেন। কিন্তু, ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমা শক্তি পশ্চিম জার্মানিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় স্ট্যালিন অক্টোবর মাসে জার্মানির পূর্বাঞ্চলকে সোভিয়েত প্রভাবিত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই স্ট্যালিনের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। ১৯৫০ সালের পর থেকে তিনি প্রায়ই লম্বা লম্বা ছুটিতে যেতেন। তার স্বাস্থ্যের যখন খারাপ অবস্থা, তখনও তিনি তার ডাক্তারদের বিশ্বাস করতেন না। স্ট্যালিন ভাবতেন, পশ্চিমাদের যোগসাজশে ডাক্তাররা হয়তো তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তার এই সন্দেহ একেবারে অমূলক ছিল না, এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্টবিরোধীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫২ সালে স্ট্যালিন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তার এই অভিযান ইতিহাসে ‘ডক্টরস প্লট’ নামে পরিচিত।
স্ট্যালিনের স্বাস্থ্য ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। ১৯৫৩ সালের ১ মার্চ তিনি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হন। এরপর কয়েকদিন তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারেননি।“নেতারা আসেন এবং যান, কিন্তু জনগণ থেকে যায়। শুধুমাত্র জনসমাজই মৃত্যুহীন।” বিখ্যাত এই উক্তিটি যে নেতার, তারও এবার যাওয়ার সময় হলো। নশ্বর এই পৃথিবীতে, যেখানে মৃত্যুই সবচেয়ে বড় সত্য, সেখানে চিরকাল বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী কালজয়ী নেতা স্ট্যালিনকেও মরতে হলো। ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্রেমলিনের অধীশ্বর।
স্ট্যালিন ছিলেন একজন স্বৈরশাসক, তিনি ছিলেন একনায়ক, তিনি সর্বাত্মকবাদী ছিলেন, তিনি নিষ্ঠুরও ছিলেন। বিপরীতে তিনি ছিলেন সোভিয়েত জনগণের ত্রাণকর্তা, ছিলেন মহান সোভিয়েত নেতা। পৃথিবীতে যে গুটিকয়েক মানুষের জন্ম হয়েছে, যাদের স্বরূপ মূল্যায়ন করা কঠিন, যাদের সম্পূর্ণভাবে খারাপ কিংবা ভালো বলে বিচার করা যায় না, তাদের মধ্যে স্ট্যালিন একজন। একজন নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হলেও, তার সময়কার অন্যান্য স্বৈরশাসকদের মতো শেষ পরিণতিও তার হয়নি।
স্ট্যালিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেছেন, নাৎসি আগ্রাসন থেকে মুক্ত করেছেন, সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নকে এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন। রুশ বিপ্লবের নায়ক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির লেনিন হলেও, জোসেফ স্ট্যালিন হলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর এত বছর পরও অধিকাংশ রুশ জনগণ স্ট্যালিনের অত্যাচার ও অনাচারের চেয়ে, তার ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মৃত্যুর পর, একমাত্র ক্রুশ্চেভ ছাড়া আর কোনো সোভিয়েত নেতা তার বিরোধিতা করেননি, বরং তার গুণগান গেয়েছেন। অনেক রুশ এখনও মনে করেন, স্ট্যালিন দেশের স্বার্থেই কঠোর হয়েছিলেন। তার অত্যাচার ও অনাচার যেমন সত্য, রুশ দেশ তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের উন্নয়নে তার অবদানও সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান ও পরাশক্তি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে স্ট্যালিনের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত।