উপরে আগুনের মতো জ্বলছে সূর্য, আর নিচে উত্তপ্ত মরুভূমি। মরুর বুকে এক অদ্ভুত কিন্তু নির্মম দৃশ্য। এক ফোঁটা পানি নেই। জনাকয়েক লোক কবর খুঁড়ছে, কবরগুলো নিজেদের জন্যই! কবর খোড়া শেষ করে সবাই শুয়ে পড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো হেজাজ আর সিরিয়ার মাঝের জনবিরল এ মরুতে। অবিশ্বাস্য এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব, তখনো তাঁর সন্তান আব্দুল্লাহ পৃথিবীতে আসেনি। কিন্তু কী করে এই ঘটনার পর কালের স্রোতে জন্ম নেন আব্দুল্লাহর ঔরসে নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)? সেটাই জানতে চলুন ঘুরে আসা যাক ১,৫০০ বছর আগের আরব থেকে!
হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনী নিয়ে কিছু লিখবার চেষ্টা করা অনেক গভীর একটা বিষয়, পড়তে হয় অনেক অনেক বই। দেশে বিদেশে হাজার হাজার মানুষ তাঁর জীবনী লিখেছেন, মুসলিম অমুসলিম অনেকেই। বাংলাদেশে গোলাম মোস্তফা রচিত বইটি হয়ত সবচেয়ে জনপ্রিয়, এছাড়াও আছে শত শত বই। এমনকি হালের হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত লিখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এ হাজার হাজার বই থেকে প্রামাণ্য বইটি খুঁজে পাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাতে লেখা অনেক বইতেই উপমহাদেশে প্রচলিত কেচ্ছা কাহিনীকেই অনেকটা গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয় নাটকীয়তা আনবার জন্য। কিন্তু আপনি যদি একদম প্রথম দিককার প্রামাণ্য নির্ভুল বইগুলো পড়েন তবে খেয়াল করবেন, সেই কাহিনীগুলো নেই! এগুলো নিছক পরবর্তীতে উদ্ভাবিত লোককাহিনী, মনভঞ্জনার জন্য গড়া। আপনার হয়ত শুনতে ভালো লাগবে, কিন্তু সত্য কাহিনীটা পুরোই ভিন্ন। ব্যক্তিগতভাবে আমি একই বইয়ের আন্তর্জাতিক ইংরেজি অনুবাদ আর বাংলা অনুবাদ পাশাপাশি লাইনের পর লাইন মিলিয়ে দেখেছি যে, কখনো কখনো বাঙালি অনুবাদকেরা ইচ্ছে করেই আরবি থেকে কিছু জিনিস অনুবাদ করেন না। কারণ তাদের ধারণা এটা বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করতে পারবেন না। এ কারণে এ বিষয়গুলো অজানাই রয়ে যায়। তবে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য এগুলো উপেক্ষা করা হবে না। হয়ত কিছু বহুল প্রচলিত কাহিনীর গভীরে ঢোকা হবে না, কিন্তু সুখপাঠ্য কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নির্মম সত্য কিছু ঘটনাও তোলা হবে সিরিজ জুড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ পড়ছেন দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব আমরা শেষ করেছিলাম আব্রাহার হাতি দিয়ে মক্কা আক্রমণ পর্যন্ত, সাথে ছিল আব্দুল মুত্তালিবের কথাবার্তা। লেখাটি এখানে ক্লিক করে পড়ে নিতে পারেন। বরাবরের মতো এবারও লেখার প্রধান সূত্র হবে ইবনে হিশামের লিখা প্রামাণ্য ও প্রথম দিকের জীবনী সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা) এবং ইবনে ইসহাকের লেখা গ্রন্থটিও।
Year Of The Elephant অর্থাৎ আব্রাহার কাবা ধ্বংসের ঘটনার সময় আব্দুল মুত্তালিবের বয়স ছিল প্রায় ৭০ বা তারও বেশি। তাঁর ৬ স্ত্রী ছিল। তাঁর ১০ ছেলে আর ৬ মেয়ে ছিল।
তবে আব্দুল মুত্তালিবের কথাতে আসবার আগে কুরাইশদের নিয়ে কিছু বলা দরকার। কুরাইশ বংশের শুরু ফিহর ইবনে মালিককে দিয়ে। তবে তখনের কুরাইশ এত শক্তিশালী ছিল না। ফিহরের বংশধরদের একত্রিত করেন কুসাই নামের এক লোক। মক্কা দখলে এনে কুরাইশকে সেরা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। কাবা ছিল মক্কা গ্রামের কেন্দ্রে। যাদের বসবাস ছিল কাবার কাছে তাঁরা অপেক্ষাকৃত বেশি প্রভাবশালী। তাদের নাম ছিল ‘কুরাইশ আল বিতাহ’। আর কাবা থেকে দূরে কুরাইশ বংশের গোত্রগুলো থাকত। মোটামুটি ১৪টি গোত্রের কথা জানা যায়।
উপমহাদেশীয় একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, মক্কা সবসময়ই খুব জনপ্রিয় একটা শহর ছিল। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। মূলত ইসলামের বিজয়ের পর মক্কা বহির্বিশ্বে যত বিখ্যাত হয়ে যায় ততটা আগে ছিলই না একদম। এমনকি কুরাইশরা পরবর্তীতে বণিক হিসেবে পরিচিতি পেলেও, কুসাইয়ের সময় কিন্তু তারা ব্যবসা তখনও শুরু করেনি। তাদের অর্থ উপার্জিত হত একটা ব্যাপার থেকেই, আর সেটা হলো ধর্ম ব্যবসা।
ইবনে ইসহাকের বই থেকে আমরা জানতে পারি, কুসাইয়ের সময় কাবাতে তীর্থভ্রমণ করতে আসা লোকদের কাছ থেকে পাওয়া ট্যাক্সের টাকা দিয়েই তাদের বছর চলত। এটা পঞ্চম শতকের শেষার্ধের কথা। কুসাই তখন মারা গেলেন। একটা নেতাশূন্যতা শুরু হলো। কুরাইশের নেতা অনেকেই হতে চায়! আর এরকম একটা সময়েই কুরাইশ বংশ শুরু করল বাণিজ্য। ভিনদেশে গিয়ে ব্যবসা করা যাকে বলে।
নিষিদ্ধ মাস বলতে একটা কথা ছিল, যে চার মাসে কোনো যুদ্ধ নিষিদ্ধ। কিন্তু সেবার একটি কারণে ঐ সময়েই যুদ্ধ বেধে গেল, কুরাইশ ও কিনানা বংশ এক পক্ষে, মক্কার অদূরের তায়েফ আর অন্য কিছু বংশ আরেক পক্ষে। দুই পক্ষেই অনেকগুলো করে গোত্র। এটাই কুখ্যাত হারবুল ফিজার বা ফিজার যুদ্ধ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক Montgomery Watt এর মতে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য কাফেলার পথের অধিকার দখল করা।
ওয়াটের মতে, মক্কা নামের সেই গ্রাম ধীরে ধীরে নগরী হয়ে উঠতে লাগলো, নব্য বণিক কুরাইশ বংশ ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। ৬০০ সালের দিকে তাদের ব্যবসা একদম রমরমা। শীতকালে যায় ইয়েমেনে, আর গ্রীষ্মে যায় গাজা, বসরা, দামেস্কে। সিরিয়ার এসব শহরে কুরাইশদের ঘাটি হয়ে গেল। আর এই মক্কার বাহিরের উত্তর আর মধ্য আরবের নানা যাযাবর বেদুইন গোত্রের সাথে মিত্রতা স্থাপন করল তারা, বিনিময়ে তাদের কাফেলার নিরাপত্তা বেদুইনরা দেবে ঐ স্থানগুলো দিয়ে যাবার সময়। একটা ছোট লভ্যাংশ তাদেরকে দিয়েও যেত কুরাইশ বণিকেরা, ফলে পুরো হেজাজ এলাকার নিয়ন্ত্রণ বলতে গেলে কুরাইশদের হাতেই ছিল। একসময়ের প্রায় গরিব কুরাইশ তখন কাঁচা পয়সা পেয়ে প্রচণ্ড ধনী। বিশেষ করে উমাইয়া গোত্র ছিল মারাত্মক ধনী। এ গোত্রেই ছিলেন হযরত উসমান (রা)।
ধনী হওয়াতে উমাইয়া গোত্র সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিল বটে, কিন্তু হজের দায়িত্ব দেখভাল করত বনু হাশিম বা হাশিম গোত্র। এজন্য তাদের জন্য ছিল আলাদা শ্রদ্ধা। এ গোত্রেই ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। এই তো, আমরা আবার ফিরে এলাম আব্দুল মুত্তালিবের কাছে।
কাবা চত্বরে শুয়ে থাকা অবস্থায় স্বপ্নে জমজম কূপের অবস্থানের সন্ধান পান তিনি একদিন। তিনি ছেলে হারিসকে নিয়ে সেখানে খনন করতে গেলেন। কূপের মুখে পাথর দেখে তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। কুরাইশরা তখন জড়ো হলো। তারা বলতে শুরু করল, এ তো আমাদের পূর্বপুরুষ ইসমাইলের কুয়া। আমাদেরও এতে অধিকার আছে খনন করবার। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব বললেন যে, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, তাই দায়িত্বটা তার একারই।
বাকি নেতারা বলল, তারা সকলে আব্দুল মুত্তালিবের উপর নাখোশ হবেন।
তাদের চিন্তাটা এরকম ছিল যে, যদি আব্দুল মুত্তালিব একা এই পবিত্র কুয়ার আবিষ্কারক হন তবে বনু হাশিম অনেক সম্মান পেয়ে যাবে, এটা অন্য গোত্রদের জন্য অপমানজনক।
তখন আব্দুল মুত্তালিব বললেন, “ঠিক আছে। আমরা তবে একজন সালিশকারীর সাহায্য নেই।”
নেতারা জানালো, সিরিয়ার কাছে সাদ হুযাইম গোত্রের একজন জ্বিন উপাসিকা আছেন, উনি নাকি জ্বিনদের সাহায্যে ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। আরবে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরকম জ্বিন উপাসিকা। কোনো এক অদ্ভুত কারণে জ্বিন-‘উপাসক’ কম ছিল। বেশিরভাগই ছিল মহিলা।
আব্দুল মুত্তালিব তখন নিজের গোত্রের কয়েকজন আর বাকি প্রত্যেক গোত্র থেকে কিছু মানুষ নিয়ে রওনা দিলেন সেই মহিলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারা যখন হেজাজ আর সিরিয়ার মাঝের এক জনশূন্য এলাকায় পৌঁছালেন তখন তাদের পানি শেষ হয়ে গেল। ‘তাদের’ বলতে আব্দুল মুত্তালিবের গোত্রের মানুষের। তারা অন্য গোত্রের কাছে পানি চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করল। বলল, এটা আব্দুল মুত্তালিবেরই দোষ যে, তারা এই মরুর বুকে ধুঁকে মরছে।
এক ফোঁটা পানি না পেয়ে আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুকেই বেছে নিলেন। তিনি সবাইকে বললেন নিজেদের কবর খুঁড়তে। এতে করে শেষ বেঁচে থাকা লোকটিকে কষ্ট করে বাকিদের কবর দিতে হবে না। নিজেদের কবরে নিজেরাই মরতে পারবে। কিন্তু কবরে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই আব্দুল মুত্তালিবের ধারণা পালটে গেল।
তিনি হঠাৎ উঠে সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা সকলে আবার উট নিয়ে রওনা দেবেন। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন। দূর থেকে বাকি গোত্র-সদস্যরা দেখতে থাকলেন তিনি কী করেন।
অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আব্দুল মুত্তালিবের উট হঠাৎ এক জায়গায় পা দিতেই খুড়ের আঘাতে সেখান থেকে পানি বেরুতে লাগলো! সকলে ‘আল্লাহ্ মহান’ চিৎকার করে উঠলেন। তখন বাকি গোত্রের সকলে মেনে নিলেন যে আব্দুল মুত্তালিবই একমাত্র জমজম কূপের আবিস্কারক হবার যোগ্য। সেই তখন থেকেই আর কখনো তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেনি কেউ। তিনি উমাইয়া না হয়েও ছিলেন মক্কার নেতা, হাশিম গোত্রের সদস্য।
তো আমরা কথা বলছিলাম তাঁর সন্তানদের নিয়ে, মূলত ছেলেদের নিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে কর্মঠ, সুদর্শন আর সবার প্রিয় ছিল তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ। অনেক মেয়েই তাই বিয়ে করতে চাইত আব্দুল্লাহকে। কিন্তু তিনি বাবার অমতে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাতেন।
আব্দুল মুত্তালিবের অনেকদিন ধরে কেবল একটাই ছেলে ছিল, হারেস। ইবনে হিশামের বই থেকে আমরা জানতে পারি যে, সেই কূপের ঘটনার পর তিনি মানত করেন যে, তাঁর যদি ১০ জন পুত্র সন্তান হয়, আর তাঁরা সকলে প্রাপ্তবয়স্ক হন তবে তাদের একজনকে তিনি কুরবানি দেবেন। উল্লেখ্য, তাঁর প্রিয়তম পুত্র ছিলেন আব্দুল্লাহ।
একদিন সবাইকে কাবার কাছে আব্দুল মুত্তালিব ডেকে পাঠালেন। তাঁর সন্তানেরা যখন বাবার ওয়াদার কথা শুনল তখন, তাঁরা রাজি হয়ে গেল তাদের মাঝে একজন কুরবান হবার জন্য। তখন আব্দুল মুত্তালিব বললেন, “প্রত্যেকে একটি করে কাঠের তীর নাও। ওটার উপর নিজের নাম লিখে আমার কাছে আসো।”
সেটা করবার পর তাদের নিয়ে আব্দুল মুত্তালিব গেলেন হুবাল দেবতার কাছে। কাবার এক কুয়ার উপর সেটার মূর্তি ছিল। হুবাল দেবতার কাছেই লটারির ব্যাপারগুলো মীমাংসা করা হতো। লটারি আর ভবিষ্যৎকথনের দেবতা ছিলেন হুবাল।
যে লোকটি লটারি পরিচালনা করত তার হাতে সবগুলো তীর দেয়া হলো। এরপর লোকটি সেগুলো শাফল করল। ওদিকে কাবা প্রাঙ্গণে হুবালের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব, যেন ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ বেঁচে যায়। তাঁর নাম না ওঠে। কিন্তু লটারিতে নাম এলো আব্দুল্লাহর। তখন তিনি ছুরি নিয়ে দেবতা ইসাফ আর নাইলাহ এর কাছে উৎসর্গ করতে নিলেন আবদুল্লাহকে।
ছুরি উঠাতেই বড় ছেলে হারেস এসে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দিলেন। সবাই যখন শুনল, তখন এসে আব্দুল মুত্তালিবকে বাধা দিতে লাগল। কেউই চাইত না, আব্দুল্লাহ কুরবান হন। কারণ সবাই ছিল আব্দুল্লাহর প্রতি মুগ্ধ। বোনেরা ভাইয়ের কুরবানির কথা শুনে কেঁদে উঠল। আর কোন কোন ভাই তো বলেই বসলেন, “আব্দুল্লাহর জায়গায় আমাকে কুরবানি করুন। তবু তাঁকে করবেন না!” অনেক বড় বড় সর্দার বললেন, “এভাবে সন্তান কুরবান করা শুরু করলে দেখা যাবে সবার ঘরেই এরকম মানব বলি প্রথা শুরু হয়ে গেছে। বাদ দিন এসব। আমরা টাকা দেব দরকার হলে মানতের ক্ষতিপূরণ হিসেবে।”
সকলে তাঁকে উপদেশ দিল এক জ্বিন-উপাসিকার কাছে যেতে, যদি উনি বলেন কুরবান করতেই হবে তবে সকলে মেনে নিবে। সেই বিখ্যাত জিন উপাসিকার বাড়ি ছিল ইয়াসরিব বা মদিনাতে। কিন্তু ওখানে তাঁকে পাওয়া গেল না। তিনি নাকি গিয়েছেন খায়বারে। তখন তাঁরা খায়বারেই গেলেন। সেখানে গিয়ে আব্দুল মুত্তালিব তাঁকে খুঁজে পেলেন।
ঘটনা খুলে বলবার পর মহিলা বললেন পরদিন আসতে, তাঁর কাছে জ্বিন এসে জানাবে উত্তর। পরদিন, মহিলা উত্তর দিলেন, “তোমাদের মাঝে ক্ষতিপূরণ কত রক্তের বিনিময়ে?”
তাঁরা বললেন, “দশটি উট।”
তখন তিনি বললেন, “ফিরে গিয়ে আবার লটারি কর। যতবার আব্দুল্লাহর নাম উঠতে থাকবে ততবার ১০টি করে উট কুরবান করতে থাকবে।”
আব্দুল মুত্তালিব মক্কায় ফিরলেন।
এরপর লটারির ব্যবস্থা করলেন। লটারি করা হয় আজলান তীরের দ্বারা। অনুষ্ঠিত হয় কাবার ভিতরে।
প্রথম বারেই উঠল আব্দুল্লাহর নাম।
২য় বারেও উঠল আব্দুল্লাহর নাম।
৩য় বারেও।
এভাবে একাদশ বারে গিয়ে দেখা গেল উঠেছে রক্তের ক্ষতিপূরণ।
তাই আব্দুল মুত্তালিব ১০x১০=১০০টি উট কুরবানি দিলেন আর মানতমুক্ত হলেন। নিশ্চিত হবার জন্য আরো তিনবার তিনি তীর ছোঁড়েন এবং তিনবারই ক্ষতিপূরণ ওঠে। তিনি আরো ত্রিশটি উট কুরবানি দিলেন। কুরবানি করা উটগুলো ওখানেই ফেলে আসলেন সবাই, যে কেউ সেই মাংস খেতে পারত। আব্দুল্লাহর বংশে আরও এক পূর্বপুরুষ কুরবানি থেকে রক্ষা পান। তিনি ছিলেন হযরত ইসমাইল (আ)। তাঁর পরিবর্তে কুরবানি হয় একটা দুম্বা। কুরবানির ঘটনাটির একটু ভিন্ন বিবরণও আছে। তবে সেটাতে আমরা না গেলাম, অন্য বিবরণে একজন ইহুদি আলেমের উল্লেখ আছে।
আব্দুল্লাহর বয়স যখন ২৪ বছর, তখন সুরা ফিলের (আব্রাহার) ঘটনা ঘটে। সে বছরের শুরুতেই আব্দুল মুত্তালিব ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি সম্ভ্রান্ত জুহরাহ গোত্রের ওয়াহব এর মেয়ে আমিনাকে পছন্দ করলেন পুত্রবধূ হিসেবে।
আব্দুল মুত্তালিব ছেলেকে নিয়ে কাফেলা সহ রওনা হলেন জুহরাহ গোত্রের এলাকায় যাবার জন্য।
বলা হয়, যাওয়ার পথে কাফেলা এক জায়গায় থামে। সেখানে আব্দুল্লাহকে দেখে আসাদ গোত্রের ওয়ারাকা ইবনে নাওফেলের বোন। আব্দুল্লাহকে দেখে তাঁর মধ্যে কামনা জেগে উঠে। অসংখ্যবার অনুরোধ করে তাঁকে, যেন আব্দুল্লাহ তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু রাজি হন না আব্দুল্লাহ, পিতার কথা বলে এড়িয়ে যান। তখন সেই মেয়ে তাঁকে ১০০ উট উপহার দেয়ার কথা বলে, তারপরও যেন তাকে বিয়ে করে। কিন্তু আব্দুল্লাহ প্রত্যাখ্যান করেন। নিরুপায় হয়ে, সে অনুরোধ করে, অন্তত একবারের জন্য হলেও যেন তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হন আব্দুল্লাহ। এবং এক্ষেত্রেও প্রত্যাখ্যাত হয় সে।
কাফেলা আবার রওনা হল আর তারা যথাসময়ে জুহরাহ-দের এলাকায় পৌঁছালেন।
বিয়ে হয়ে গেল আমিনা আর আব্দুল্লাহর। আমিনার বয়স তখন ১৪।
বর্ণিত আছে, একইসাথে আব্দুল মুত্তালিব নিজেও আমিনার এক চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন, যার নাম ছিল হালাহ। অবশ্য, তখনকার আরব সমাজে এটাতে অবাক হবার মতো কিছুই ছিল না। হালাহ এর গর্ভে জন্ম নেন হামজা (রা)। এজন্যই চাচা হামজার বয়স মুহাম্মাদ (স) এর এত কাছাকাছি। কোনো কোনো জায়গায় বলা আছে যে, হামজা (রা) মুহাম্মাদ (সা) এর চেয়ে চার বছরের বড়। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কারণ ইবনে সায়িদ বলেছেন, নির্ভরযোগ্য হাদিস মতে, হামজা (রা) আর মুহাম্মাদ (সা) দুজনকে একইসাথে সুয়ায়বা ধাত্রী লালন করেন।
আরব রীতি অনুযায়ী, তিন দিন শ্বশুরবারিতে থাকলেন আব্দুল্লাহ। এরপর কাফেলা ফিরতি যাত্রা শুরু করল। পথে আবার সেই মেয়ের সাথে দেখা হল আব্দুল্লাহর। কিন্তু, অবাক ব্যাপার, এবার আর মেয়ের মধ্যে সেই ব্যাকুলতা দেখা গেল না। আব্দুল্লাহ এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার?”
সেই মেয়ে উত্তর দিল, “এখন আর তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই।”
এখানে বলে রাখা ভাল, এ মেয়ের ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল ছিলেন খুবই বিদ্বান। ওয়ারাকাই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি নিশ্চিত করেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (স) একজন নবী। খ্রিস্টান ওয়ারাকা তাওরাত আর ইঞ্জিল এর উপর ছিলেন বিশেষ দক্ষ। তাই মুহাম্মাদ (স) এর আগমন বিষয়ে জানাটা তাঁর জন্য কঠিন কিছু ছিল না। ওয়ারাকাই নিশ্চিত করেন, যিনি ওহী নিয়ে এসেছেন ইনি আসলে শয়তান না, বরং জিবরাঈল (আ)। ওয়ারাকাই ভবিষ্যৎবাণী করেন, মক্কাবাসীরা মুহাম্মাদ (সা)-কে বের করে দেবে।
সেই মেয়েটার নাম ছিল রুকিইয়া বিনতে নাওফেল, অন্য এক বর্ণনায় কুতাইলা। তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ রহস্যের আড়ালেই আছে। কোনো কোনো জায়গায় আব্দুল্লাহর ললাটে আলোর কথা লেখা আছে, যদিও ইবনে হিশামের গ্রন্থে এটা নেই।
ভাই ওয়ারাকা ছিলেন খ্রিস্টান। কিন্তু বোন রুকিইয়া ছিলেন জিন-উপাসিকা বা জিন-ভক্ত।
গোত্রভিত্তিক প্রধান দেবতার ব্যাপার নিয়ে কিছুটা জানা দরকার। একেক অঞ্চল একেক দেবতাকে প্রাধান্য দিত। কারোরই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, আল্লাহ্ হলেন স্রষ্টা। তিনি সবার উপরে। সর্বময় ক্ষমতার মালিক। কিন্তু, তাঁরা একই সাথে অন্য দেবদেবীতেও বিশ্বাস রাখত। তাদের মতে, ছোটোখাটো কাজগুলো দেখভাল করতেন এই দেবদেবীরাই। যেমন মক্কার দেব দেবী অমুক হলে তায়েফের দেবদেবী তমুক। সকল গোত্রই বিশ্বাস করত, আল-লাত, উজ্জাহ ও মানাত নামের তিন দেবী নাকি আল্লাহ্র কন্যা! লাত দেবীকে কোনো কোনো অঞ্চলে আবার তাঁর স্ত্রীও ভাবা হতো! এ দেবীরা কিন্তু পুরোপুরি আরবীয় আবিষ্কার নয়। বিদেশি দেবীদের প্রভাবে তাদের চরিত্র তাঁরা বানিয়ে নিয়েছিল। যেমন, সুমেরীয় দেবী আশেরাহ আর আসিরাত থেকে আল-লাত দেবী, মেসোপটেমিয়ান দেবী ইশ্তার থেকে দেবী উজ্জাহ, আর গ্রিক দেবী নেমেসিস থেকে কোনোভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে আসে দেবী মানাত।
তবে কাবার ৩৬০ দেবদেবীর মাঝে প্রধান ছিল দেবতা হুবাল (هبل)। ইবনে ইসহাক বলেন, হুবালের মূর্তি যখন কুরাইশরা পেয়েছিল তখন তার এক হাত ভাঙা ছিল। তখন তাঁরা সেই হাত সোনা দিয়ে তৈরি করে দেয়।
আরেকজন জনপ্রিয় দেবতা ছিল সূর্যদেবতা ‘মানাফ’ (مناف)। ঋতুবতী নারীদের জন্য এই দেবতার কাছে ঘেঁষা ছিল নিষেধ। ‘আব্দে মানাফ’ বা ‘মানাফের দাস’ নামটা মক্কায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর নিজের কোনো প্রপিতামহের নামই ছিল আব্দে মানাফ। উত্তরের পেট্রা নগরীর তৎকালীন দেবতাদের নিয়ে কথা হবে অন্য কোনো দিন।
এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে, আব্দুল মুত্তালিব দেবদেবীর পূজা করতেন না। একেশ্বর ছিলেন। আল্লাহ্ ভালো জানেন। তবে, নবীজীর (সা) প্রথম বিশ্বস্ত এবং প্রামাণ্য মূল জীবনীগুলো (যেমন ইবনে হিশাম) এ ধারণার বিরোধিতা করে। ছেলে আব্দুল্লাহকে কুরবানি দেয়ার যে মানত করেছিলেন সেটা তিনি আল্লাহ্র কাছে করেন নি, করেছিলেন দেবতা হুবালের কাছে। আরো জানা যায়, ইসাফ আর নায়িলাহ ছিল দুজন জিনপূজারী। মক্কার তৎকালীন এক জনপ্রিয় লোককাহিনী মতে, ওরা দুজন কাবার ভিতরেই যৌনমিলনে আবদ্ধ হয়। শাস্তি হিসেবে দেবতারা তাদেরকে পাথর বানিয়ে দেয়। ঐ পাথরদুটো রাখা হয় জমজম কূপের উপর। জমজম কূপের খননকারী ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন এ দুই পাথরের মূর্তির উপাসক, কিন্তু কোনো অভিশপ্ত যুগল কেন উপাস্য হবে সেটা বোধগম্য নয়। দেবতাদের পাশাপাশি জিন উপাসনাতে যে তাঁর ভক্তি ছিল সেটা সবার জানা ছিল, এজন্য প্রায়ই তিনি জ্বিন-উপাসিকার পরামর্শ নিতে যেতেন। অবশ্য এটা প্রায় আরবের মাঝেই দেখা যেত। জ্বিন উপাসনা বলতে আসলে বোঝানো হয় মূল দেবতাদের পাশাপাশি অতিপ্রাকৃত জ্বিনকে খুশি করে তাদের থেকে তথ্য উদ্ঘাটন করা। ইবনে হিশাম লিখে গেছেন, দেবতা ইসাফ আর নাইলাহ-এর কাছে আব্দুল্লাহকে কুরবানি দেয়া হচ্ছিল।
রুকিইয়া মেয়েটির কথা লেখা হলো একটু আগে। সে কিন্তু অজানা অচেনা কেউ নয়। রুকিকে অনেক আগে থেকেই চিনতেন আব্দুল মুত্তালিব। মেয়েটি একজন জিন উপাসিকা বা জিন ভক্ত ছিলেন। এজন্য আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
আমিনা ছিলেন মক্কার জিন উপাসিকা বা জিন ভক্ত সোদা বিনতে জেহরার ভাতিজি। এমনটা হতে পারে যে, বিশ্বাসের দিক থেকে পরিচিত থাকার কারণে এ পরিবারে বিয়ে দেন আব্দুল মুত্তালিব।
অবশ্য নিচের দুটো বিশুদ্ধ হাদিস ততকালীন আরবের সর্বজনীন পৌত্তলিকতা প্রমাণ করে দেয়।
#সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) এর বর্ণনায়- একবার, মুলায়কার দুই ছেলে মুহাম্মাদ (স) এর কাছে আসলো। এসে বলল, “আমাদের মা স্বামীকে শ্রদ্ধা করতেন আর সন্তানদের আদর করতেন [অতিথি নিয়েও কিছু বলল]… কিন্তু, তিনি জাহিলিয়ার সময় এক অনাথ কন্যাকে জীবিত দাফন করেন।” মুহাম্মাদ (স) বললেন, “তোমার মা দোযখে।” তারা ঘুরে চলে গেল। তাদের চেহারায় বেদনার স্পষ্ট ছাপ। মুহাম্মাদ (স) তাদেরকে আবার ডাকলেন। ওরা ফিরে আসল। তাদের চেহারায় খুশির ছাপ। ওরা আশা করছে, এবার হয়ত নবীজী (স) ভাল কোন সংবাদ দেবেন তাদের মা সম্পর্কে। [কিন্তু] মুহাম্মাদ (স) বললেন, “আমার মা তোমাদের মায়ের সাথেই [দোযখে]।” 2017-11-16 09:12:03
কথাটা বলতে তাঁর খুব খারাপ লাগছিল না?
# আরেকটি ঘটনা, হযরত আনাস (রা) এর বর্ণনায়- এক লোক রাসুল (স) এর কাছে এল আর জিজ্ঞেস করল, “আমার বাবা কোথায়?”রাসুল (স) বললেন, “দোযখে।” লোকটি (কষ্ট পেয়ে) ফিরে যেতে লাগল। তখন মুহাম্মাদ (স) তাঁকে ডাকলেন আর বললেন, “আমি সত্যি কথা বলছি, আমার বাবা আর তোমার বাবা দুজনই দোযখে।” 2017-11-16 09:12:03
ইব্রাহীম (আ) এর পিতার জাহান্নামবাসী হওয়া নিয়েও ইসলামে কথা আছে। নবী হয়েও পৌত্তলিক মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা নিষেধ ছিল। হয়ত মৃত বাবা মা-র কথা তাঁকে কষ্ট দিত বলেই তিনি খুব একটা নিজের পিতামাতার কথা বলতেন না। আসলেই হাদিস শরীফে নবী (সা) বাবা-মাকে হাদিস বিরল। মুসলিম শরিফের হাদিস অনুযায়ী, রাসুল (সা) বলেন, “আমি আল্লাহ্র কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম আমার মাকে মাফ করে দেবার দোয়া করবার জন্য, কিন্তু তিনি দেননি। এরপর আমি তাঁর কবর জিয়ারতের অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেন।”
উপমহাদেশীয় বইগুলোতে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই এই ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া হয়, যেন পাঠকগণ গ্রহণ করতেই পারবেন না। পরবর্তীতে আমরা মূল বইয়ের সাথে বাংলা বইয়ের পার্থক্য সচিত্রভাবে দেখাবো, যেখানে কিছু লাইন স্বেচ্ছায় বাদ দেয়া হয়েছে! নবীর পিতামাতার পৌত্তলিক পরিচয় ঢাকবার জন্য পরবর্তীতে এরকম কাহিনী প্রচলন করা হয় যে, মুহাম্মাদ (সা) ক্ষমতাবলে নাকি তাঁর বাবা-মাকে জীবিত করে ফেলেন, এবং এরপর তাঁর উপর ঈমান আনেন (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করেন) তাঁর পিতামাতা। তারপর তিনি আবার তাদের মৃত করে কবরে পাঠিয়ে দেন। এ কাহিনী এক সময় এতই জনপ্রিয় হয় যে এমনকি সুয়ুতি পর্যন্ত এটাতে বিশ্বাস করে ফেলেন, অবশ্য পরে আলেমগণ তাঁর এ বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত করেছেন। তবে, এখনো এই ধারণায় বিশ্বাস রাখা মানুষের অভাব নেই।
আচ্ছা যা-ই হোক, নবদম্পতি আমিনা আর আব্দুল্লাহ মক্কায় ফিরে এলেন। কিন্তু, শীঘ্রই সিরিয়া আর ফিলিস্তিনে ব্যবসার ডাক পড়ল আব্দুল্লাহর। আব্দুল্লাহ যখন চলে গেলেন, তখন আমিনা গর্ভবতী।
আব্দুল্লাহ বেশ কয়েক মাস ফিলিস্তিনের গাজায় থাকলেন। এরপর আবার নিজ দেশে ফেরা শুরু করলেন। কাছাকাছি আসার পর তাঁর ইচ্ছে হল মামার বাড়ি মদিনাতে কিছুদিন থেকে যাবার। সেটাই করলেন তিনি।
এরপর যখন যাবার সময় হয়ে এলো, তখন তিনি একটা মক্কাগামী কাফেলা ঠিক করলেন, তাদের সাথে তিনি মক্কায় ফিরে যাবেন। প্রস্তুতি যখন সব সম্পন্ন তখনই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাই মদিনায় রয়ে গেলেন। কাফেলা তাঁকে ছেড়েই চলে গেল মক্কায়।
পরে যখন মক্কায় খবর পৌঁছালো, তখন আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল মুত্তালিব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি সাথে সাথে তাঁর বড় ছেলে হারেসকে মদিনায় রওনা করিয়ে দিলেন যেন আব্দুল্লাহ যখন মক্কায় ফিরবেন সুস্থ হয়ে, তখন হারিস তাঁকে সঙ্গ দিতে পারেন, দেখে রাখতে পারেন।
কিন্তু মদিনায় পৌঁছেই হারেস শুনলেন, তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ আগেই মারা গেছেন। যে কাফেলাতে করে মক্কায় যাবার কথা ছিল আব্দুল্লাহর, সেটা মদিনা ত্যাগ করার এক মাস পরেই মারা যান আব্দুল্লাহ। সেখানেই কবর হয় তাঁর। বয়স হয়েছিল ২৫ বছর।
নিচে যে কবরস্থানের ছবি দেখা যাচ্ছে, এখানেই আছে হযরত মুহাম্মাদ (স) এর বাবা আব্দুল্লাহর কবর। এটাই জান্নাতুল বাকী।
এ বিখ্যাত কবরস্থানে আরও অনেক সাহাবী বা সাহাবার কবর আছে। আছে খাদিজা (রা) বাদে হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর অন্যান্য স্ত্রীর কবর, তাঁর ছেলে ইব্রাহিমের কবর এবং সম্ভবত মেয়ে ফাতিমা তুজ জোহরা (রা) ও দুধমাতা হালিমার কবরও।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হারেস ফিরে গেলেন মক্কায়। বাবাকে আর সদ্যবিধবা আমিনাকে জানালেন আব্দুল্লাহর মৃত্যুর খবর। শোকের কালো ছায়া নেমে এলো মক্কায়। ভবিষ্যৎ অন্ধকার আমিনার, কী হবে তাঁর অনাগত সন্তানের? দুনিয়াতে আসার আগেই বাবাকে হারিয়ে ফেলল সে।
আব্দুল্লাহ রেখে যান ৫টি উট, কিছু ভেড়া আর ছাগল, কিছু গৃহস্থালি দ্রব্য আর একজন দাসী, যার নাম ছিল উম্মে আয়মান, অনাগত শিশুর পরিচর্যা করার কথা ছিল তাঁর। এ সম্পদ তখনকার সময়ের জন্য মোটেও বেশি ছিল না, কম বলা যায়; তবে মারা যাবার আগে আব্দুল্লাহ সবে মাত্র ব্যবসায় উন্নতি শুরু করেছিলেন। তাই তখনও দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। আর উত্তরাধিকারসূত্রেও তখনও কিছু পাননি, কারণ বাবা বেঁচে ছিলেন। কারণ তখন প্রথা ছিল যে, নিজের কামাই নিজেকেই আনতে হবে।
আব্দুল্লাহ মারা যাবার পর পুত্রবধূ আমিনার দায়িত্ব নিলেন আব্দুল মুত্তালিব। একটা বড় ‘কিন্তু’ সেখানে রয়ে যায়। তৎকালীন আরবে বিধবাদের সুযোগ সুবিধা মোটেও ভালো ছিল না, যদি না তাঁর আবার বিবাহ হয়ে থাকে। অনেকটা অবহেলাতেই কাটে তাদের জীবন। আইয়ামে জাহিলিয়ার এরকম অনেক প্রথাই পরে দূর হয়, কিন্তু সেটা ইসলামের আবির্ভাবের পরের কাহিনী। প্রচলিত বেশ কিছু ঘটনা শুনে বা পড়ে অনেকের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, আব্দুল মুত্তালিবের কল্যাণে আমিনা বা পিতৃহীন মুহাম্মাদ (সা) এর খুবই আরাম আয়েশের জীবন কেটেছিল। কিন্তু আমরা পরের পর্বে দেখব বাস্তবতাটা আসলে কেমন ছিল, আর প্রচলিত কোন ঘটনা আসলে কেবল শোনা কথাই মাত্র।
৫৭০ সাল; রবিউল আওয়াল মাস, ১২ তারিখ, সোমবার। প্রায় ভোর বেলা। অধিকাংশ সূত্রমতে, এ সময়টাতেই আমিনা সন্তান প্রসব করলেন। জন্ম নিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা)। খুবই সাধারণভাবে জন্ম নিলেন তিনি। কিছু কিছু বর্ণনায় অতিপ্রাকৃত ঘটনার উল্লেখ থাকলেও, অধিকাংশ বর্ণনা মতেই, হযরত মুহাম্মাদ (স) এর জন্মটা হয়েছিল খুবই সাদামাটা।
যীশুর জন্মকথন নিয়ে বাইবেলে রয়েছে নাটকীয় কাহিনী। যেমন, বাইবেল মতে মেরি কোনো প্রসব বেদনা ছাড়াই যীশুর জন্ম দেন। কিন্তু ইসলাম অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর ঠিক আগের নবী হযরত ঈসা (আ) বা যীশুর জন্মের সময় তাঁর মা মেরি বা মারিয়াম (রা) খুবই বেদনায় ছিলেন। প্রাথমিক বর্ণনাতে নাটকীয়তার লেশমাত্র না থাকা সত্ত্বেও পরে খ্রিস্টানদের কাহিনীর সাথে পাল্লা দিতে একে একে জুড়ে দিতে থাকা হয় অনেক লোককাহিনী। এমনকি পরে এক সময় এটাও প্রচলিত হয়ে যায় যে, আমিনার প্রসব বেদনাই হয়নি। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত মাজিদ মাজিদির ‘মেসেঞ্জার অফ গড’ মুভিতে যে ভয়ানকভাবে এ ঘটনার বিকৃতি করা হয়েছে তা লজ্জাজনক।
এটা সত্য এবং ইবনে হিশামেও আছে যে, আমিনা স্বপ্নে দেখেন, তাঁর ভেতর থেকে একটি আলো বেরিয়ে সিরিয়ার বসরার প্রাসাদ আলোকিত করে দিচ্ছে। তিনি প্রায়ই গর্ভবতী অবস্থায় স্বপ্নে দেখতেন, তাঁকে কেউ বলছে, “তোমার গর্ভে এ জাতির নেতা। তাঁর জন্মের সময় সকল ঈর্ষা করা ব্যক্তির নষ্টামি থেকে আশ্রয় চাবে তাঁর জন্য। তাঁর নাম রাখবে মুহাম্মাদ।”
ইবনে হিশাম নিশ্চিত করে লিখেছেন যে, মুহাম্মাদ (সা) এর আগে মাত্র তিনজন ছিলেন যাদের নাম ছিল মুহাম্মাদ। মুহাম্মাদ ইবনে সুফিয়ান, মুহাম্মাদ ইবনে উহায়হাহ এবং মুহাম্মাদ ইবনে হিমরান। মজার বিষয়, এ তিনজনের বাবারা এক অঞ্চলের ধার্মিক রাজার কাছ থেকে শুনেছিলেন যে, সেই রাজা আগের কিতাবে পড়েছেন হিজাজ থেকে নাকি ‘মুহাম্মাদ’ নামের একজন নবী আসবেন। তাঁরা তিনজনই তখন ওয়াদা করলেন যে, যদি তাদের স্ত্রীদের পুত্র সন্তান হয় তবে সুফিয়ান, উহায়হাহ এবং হিমরান তিনজনই তাদের পুত্রদের নাম রাখবেন মুহাম্মাদ। এবং তাঁরা সেটাই রেখেছিলেন। তবে মুহাম্মাদ (সা) এর জন্ম, ৫৬৯, ৫৭০ নাকি ৫৭১ সেটা সন্দেহের বিষয়, তবে হাতির ঘটনা যে বছর হয়েছিল সে বছরই তাঁর জন্ম। হাসান ইবনে সাবিত (রা) বলেছিলেন, “আমার বয়স তখন সবে সাত কি আট। সেদিন ইয়াসরিবের দুর্গ থেকে এক ইহুদীকে এত জোরে চিৎকার করতে শুনেছিলাম। সে বলছিল, আজ রাতে তো আহমাদের তারকা উঠে গেছে! তাঁর জন্ম হয়েছে!” আহমাদ মুহাম্মাদ (সা) এর আরেক নাম।
আমিনা তাঁর পুত্রের জন্ম দিলেন, কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব কিন্তু তখন আশেপাশে ছিলেন না। তিনি খবর পাঠালেন এই বলে যে, উনার এক নাতি হয়েছে। তাঁকে যেন তিনি দেখতে আসেন। আব্দুল মুত্তালিব এলেন নাতিকে দেখতে। কথিত আছে, তিনি দৌড়ে কাবা ঘরে নিয়ে গেলেন তাঁকে; তাঁর মঙ্গলের জন্য দোয়া করলেন। সেই ভোরবেলা তেমন কেউ ছিল না সেখানে। তবে এ ঘটনা আসলেই ঘটেছিল কিনা সেটার ব্যাপারে ইবনে হিশাম নিশ্চয়তা দেননি। হয়ত নিজের প্রিয় পুত্র হারাবার বেদনা যেন ভুলতে চাইলেন নাতিকে জড়িয়ে ধরে। তবে এসব কিছুই উল্লেখ নেই। তবে এটা নিশ্চিত করে লেখা আছে যে, আমিনা তাঁকে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন।
পরদিন সকাল।
কাবা প্রাঙ্গণে কুরাইশ সরদাররা সবাই জমায়েত হয়ে আছেন। তখন ভবিষ্যত সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন এক ইহুদী ছুটে এলো সেখানে, “আচ্ছা, তোমাদের কারও ঘরে কি আজকে সন্তান জন্মেছে?”
সবাই বলল, “জানি না তো!”
তখন ইহুদী বিস্ময়ের সাথে বললেন, “হায় হায়! তোমরা কোন খবরই রাখ না! আজকে রাতে এক শিশু জন্ম নিয়েছে, যিনি হবেন শেষ নবী, তাঁর কাঁধে নবুয়তের নিদর্শন থাকবে। দুদিন পর্যন্ত তিনি দুধ পান করবেন না।”
সবাই শুনে অবাক হয়ে গেল। তবে পৌত্তলিক আরবদের কাছে কোন নবীর জন্ম ব্যাপারটা তেমন আহামরি কোন কিছু না। তাই এটা কোন গুরুত্ব পেল না। পাত্তাই দিল না কেউ। কিন্তু খোঁজ নিতে ভুললো না তারা নতুন শিশুটা কে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছেলে আব্দুল্লাহর ঔরসে এক শিশু জন্মেছে। কিছু লোক গিয়ে সেই ইহুদীকে নিয়ে আসতে গেল। ইহুদী এলেন।
সদ্যজাত শিশুর কাছে গিয়ে তিনি কাঁধ পরীক্ষা করলেন, দেখলেন, কাঁধে লোমে আবৃত কয়েকটা তিল এক জায়গায় হয়ে জমে আছে, ঠিক যেমনটা ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী হবার কথা। এটা দেখে সাথে সাথে ইহুদী অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে তিনি পরিতাপ করে বললেন, “হায় হায়! বনী ইসরাইল থেকে নবুয়ত বিদায় নিল! কুরাইশরা! তোমরা এর জন্মে আনন্দ করছ? খবরদার! আল্লাহ্র কসম করে বলছি, এই ছেলে তোমাদের একদিন আক্রমণ করবে!”
সেই ইহুদি হয়ত তাঁর তাওরাতের এক আয়াতের কথা বলছিল যেখানে লেখা ছিল, ১০,০০০ মানুষ নিয়ে মক্কায় ফিরবেন নবী। আর, কাঁধের যে তিলগুচ্ছের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আজীবন ছিল তাঁর। এটার কথা পরে কোন এক পর্বে আবার লাগবে। এটাকে বলা হত “মোহরে নবুয়ত”।
বরাবরের মতো, এটাও পাত্তা পেল না কুরাইশদের কাছে। প্রলাপ হিসেবে এড়িয়ে গেল তারা ঐ ইহুদির কথাগুলো।
নিচে যে সাদা বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন, ওটার আশপাশেই কোথাও নবী (সা) এর জন্ম হয়েছিল।
পরবর্তী জীবনে নবীর বড় শত্রু হবেন যিনি, সেই চাচা আবু লাহাব পর্যন্ত ভাতিজার জন্মের খবর শুনে পরম আনন্দে তাঁর দাসীকে মুক্ত করে দিলেন। সেই দাসীর নাম ছিল সুওয়াইবা। আর তিনি ছিলেন নবীর একজন দুধমা। তিনি সপ্তাহকাল দুধ খাওয়ান নবীকে।
জন্মের দিনই দাদা আব্দুল মুত্তালিব শিশুর নাম রেখে দিলেন “মুহাম্মাদ” (প্রশংসিত)। কিন্তু, মা আমিনা শিশুর আরেকটি নাম রাখলেন “আহমাদ” [প্রশংসাকারী]। এ দুটোই ছিল তাঁর নাম।
হযরত মুহাম্মাদ (স) এর জন্মের সাত দিন পর আব্দুল মুত্তালিব এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন নবজাতকের সম্মানে। অনেক গণ্যমান্য লোকেরা আসলেন সেখানে। একটা প্রশ্ন করলেন তারা, “নাতির নাম মুহাম্মাদ রাখলেন কেন?” এ প্রশ্নটা স্বাভাবিক ছিল। কারণ এ নামটা তখনকার সময় ছিল বিরল।
আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নের কথা বললেন না, ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন, “কারণ আমি চাই, আমার নাতি সবার কাছে প্রশংসিত হোক, দুনিয়াতে মানুষদের কাছে, আর উপরে আল্লাহ্র কাছে।”
এরপর আর কোন প্রশ্ন করেননি তারা। নবজাতককে দোয়া করে চলে গেলেন। এ সময়ই সম্ভবত মুহাম্মাদ (স) এর খৎনা করা হয়, আরবি রীতি অনুযায়ী।
এরপর অপেক্ষা করতে লাগলেন আমিনা আর আব্দুল মুত্তালিব। ধাত্রীরা আসবে মক্কায়। তখন তো ছিলই, এমনকি এখনও আরবে কোন কোন জায়গায় এমন ঐতিহ্য আছে যে, জন্মের পর পর সম্ভ্রান্ত বংশের শিশুদেরকে গ্রামে ধাত্রীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তারা প্রকৃতির সংস্পর্শে বড় হবে। আর বিশুদ্ধ আরবি শিখবে।
মক্কা থেকে ৭০ মাইল দূরে তায়েফের পাশের এক গ্রাম। সেখানের বেদুইন সাদ গোত্রের নারীরা ধাত্রীর কাজ করত।
যা-ই হোক, তারা মক্কায় গিয়ে হাজির হল। তারা সবাই শহরে প্রবেশ করেই দ্রুত বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকে শিশু সংগ্রহের জন্য। যে যত ধনী লোকের সন্তান নিতে পারে সে তত লাভবান। বলতে গেলে সবাই নিজ নিজ পছন্দ মতো সন্তান পেয়ে গেল। কিন্তু আমিনার ঘরে যেতেই কেউ শিশু মুহাম্মাদকে নিতে চাইল না, কারণ এতে লাভের মুখ দেখা যাবে না। শিশুর বাবাই তো বেঁচে নেই! তাই অবহেলিত ধরে নিয়েই কোনো ধাত্রী তাঁকে গ্রহণ করল না।
ধাত্রীদের দলেই ছিলেন হালিমা বিনতে আবু জুয়াব। কিন্তু তাঁর আবার উল্টো কাহিনী। তিনি এত রোগা ছিলেন, যে কেউই তাঁকে সন্তান দিতে চাচ্ছিল না। কারণ তিনি তো পর্যাপ্ত দুধ খাওয়াতে পারবেন না।
অন্য সবার মতো আমিনার বাসাতেও গেলেন হালিমা। কিন্তু যখনই শুনলেন, শিশুর বাবা নেই, তখনই তিনি বেরিয়ে আসলেন। আরও কয়েকটা বাড়ি ঘুরে খালি হাতে ফিরে আসলেন নিজের তাঁবুতে। তিনি হতাশ। কোন শিশুই পেলেন না।
পরদিন ভোর বেলা যখন কাফেলা গ্রামে ফিরে যাবার জন্য রওনা হচ্ছিল তখন, হঠাৎ করে হালিমার মনে হল খালি হাতে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, শিশু মুহাম্মাদ (স)-কেই তিনি গ্রহণ করবেন। এই ভেবেই তিনি ছুটে গেলেন শহরে। আমিনার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। কোলে তুলে নিলেন শিশুকে। সাথে সাথে তাঁর মনে হল, কী যেন এক পরিবর্তন তাঁর মধ্যে আসলো। অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলেন, তাঁর রোগা দেহের শূন্য স্তন দুধে ভরে উঠেছে। তিনি ডান স্তন মুখে পুরে দিতেই পান করা শুরু করে দিল শিশু।
শিশু মুহাম্মাদ (সা)-কে নিয়ে রওনা দিলেন হালিমা। এ দু’সপ্তাহ মুহাম্মাদ (স) পান করেছেন আমিনা আর সুওয়াইবার দুধ। আর এরপর দু’বছর পান করবেন মা হালিমার দুধ। তখনই নাটকীয়ভাবে ঘুরে গেল হালিমার পরিবারের ভাগ্য। এ কাহিনীগুলো বেশ পরিচিত বিধায় একটু ভিন্ন ব্যাপারে কথা বলা যাক।
মুহাম্মাদ (স) এর পালক বাবা ছিলেন হারিস ইবনে আব্দুল উজ্জা। নাম থেকেই বোঝা যায়, তাঁরা উজ্জাহ দেবতার উপাসনা করতেন প্রধানত।
মহানবী (সা) এর দুধভাই ছিল আব্দুল্লাহ। মুহাম্মাদ (স) কখনও হালিমার বাম স্তন থেকে দুধ পান করতেন না। বাম স্তন মুখে পুরে দিলেও খেতেন না, মুখ সরিয়ে নিতেন। তাই হালিমা নিয়ম করে নিয়েছিলেন, ডান স্তন মুহাম্মাদ (স) আর বাম স্তন আব্দুল্লাহর জন্য। আব্দুল্লাহ পরে সাহাবী হন এবং তাঁর বর্ণিত অনেক হাদিস আছে বুখারি শরিফে। হযরত মুহাম্মাদ (স) এর দুধবোন ছিল দুজন, আনিসা এবং সাইমা।
এই লেখাতে ওয়ারাকা আর রুকিইয়ার কথা বলা হয়েছে। রুকিইয়া কীভাবে আব্দুল্লাহকে নিজের করে নিতে চেয়েছিলেন সে ঘটনা বলা হয়েছে। কিন্তু রুকিইয়া কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন যে, ভবিষ্যতে তাঁরই চাচাতো বোন খাদিজা হবেন এই আব্দুল্লারই পুত্র মুহাম্মাদ (সা) এর স্ত্রী? তখন রুকিইয়া কোথায় কী করছিলেন, সে খবর কিন্তু ইতিহাস আমাদের দেয় না।
ওয়ারাকা খ্রিস্টান আর রুকিইয়া জিন-ভক্ত হলেও খাদিজা দুটোর কোনোটাই ছিলেন না, পৌত্তলিকও ছিলেন না, ছিলেন হানিফ।হানিফ বলতে বোঝায় তাদেরকে যারা ইব্রাহিম (আ) এর ধর্ম পালন করতেন এবং একেশ্বরবাদী ছিলেন, কোনো দেবদেবীতে বিশ্বাস রাখতেন না। আর ওহী আসার আগ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (স) নিজেও হানিফ ছিলেন। মক্কায় হানিফ খুবই কম ছিল। মুহাম্মাদ (সা) প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে তো আরো কম। সত্যি বলতে, মক্কায় চারজন স্বঘোষিত হানিফ ছিলেন যার মাঝে তিনজন মক্কা ছেড়ে চলে যান। আর একজন, অত্যাচারিত হয়ে মক্কার অদূরে পাহাড়ে গিয়ে একা বাস করতেন। তিনি জোর গলায় বলতেন, তিনি মক্কার একমাত্র হানিফ। বাকি সবাই বিপথগামী। একদম শিশু বয়সে হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল। পরে ডাকাতের হাতে তিনি খুন হয়ে যান। এ সম্পর্কে কাহিনী পরে বলা হবে। ধাত্রী হালিমার বাড়ি থেকে নবুয়ত পর্যন্ত নানা ঘটনা থাকবে পরের পর্বে! যতটা বিস্তারিতভাবে তাঁর চল্লিশ বছরের পরের ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয়, তার আগের ঘটনাগুলো কিন্তু সেভাবে বলা হয় না। তাই অনেকের কাছেই হয়তবা অজানা থাকবে পরের পর্বের বেশ কিছু ঘটনা! আজকের পর্ব আর আগের পর্ব পড়ে যদি আপনার কাছে ভালো লেগে থাকে, তবে এটুকু বলা যায়, তৃতীয় পর্ব থাকবে আরো চমকে ভরা, এবং আরো বেশি তথ্যে ভরপুর। ইনশাআল্লাহ।
পর্ব-৩: আসছে…
পর্ব-১: হাতিবাহিনীর ইতিবৃত্ত: হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনীর অজানা দিক