প্রেম মানুষকে ভালো পথে টেনে আনে। গল্প-সিনেমায় আমরা সাধারণত তাই দেখে থাকি। কত সিনেমাতেই তো গুন্ডা-বদমাশ নায়কও সুবোধ ছেলেটি হয়ে যায় প্রেমে পড়ে। তারপর নায়িকার সাথে নতুন জীবন রচনা করতে বেরিয়ে আসে সেই অন্ধকার জগৎ থেকে। কিন্তু অদ্ভুত এই পৃথিবীতে অন্তত এমন একটি জুটি আছে, প্রেম যাদেরকে ঠেলে দিয়েছিল অন্ধকার জগতের আরও গভীরে। দুজনের সব খল প্রতিভা যেন একে অপরের সংস্পর্শে এসে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। আর তার ফলে তারা হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ এক ভয়ঙ্কর জুটি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডেডলি ডুয়ো’। এই ভয়ঙ্কর রোমান্টিক জুটির হচ্ছে, বনি পার্কার এবং ক্লাইড ব্যারো।
ভয়ঙ্কর এই প্রেমিকযুগলের আবির্ভাব ঘটে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়টায়। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক ছিল সেটি। আমেরিকার ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের সিমেন্ট শহরে দেখা হয় এই জুটির। তবে দুজনের কারোরই জন্মস্থান নয় এই শহর। ক্লাইড ব্যারো জন্মেছিলেন টেক্সাসের এক কৃষক পরিবারে। ছোটকাল থেকেই তার মাঝে নিষ্ঠুরতার আভাস পাওয়া যায়। নানারকম নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডে সে পরিবার এবং প্রতিবেশীদের অতিষ্ঠ করে তোলে। আর তাই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সিমেন্ট শহরে। আর বনি পার্কারেরও জন্ম হয় টেক্সাসের একটি গ্রামে। তার বাবা ছিল যাজক। কিন্তু খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে অকূলে পড়ে যায় বনি। বনির মা আর বনিও ভাগ্যের অন্বেষণে চলে আসে সিমেন্ট শহরে।
ছোট্ট এই শহরটির জনসংখ্যা তখন ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই সংখ্যাটাও মাত্র সাড়ে এগারো’শ। বর্তমানে এই শহরের বাসিন্দা মাত্র ৫৫০ জন। মূলত সিমেন্ট শিল্পের জন্য বিখ্যাত হওয়া সেই ছোট্ট শহরে তাদের যখন দেখা হয় তখন বনির বয়স মাত্র উনিশ আর ক্লাইডের ২১। ক্লাইড দেখতে সুদর্শন ছিল। আর বনি ছিল অসাধারণ সুন্দরী। তার নীল চোখ যে কারো দৃষ্টি কেড়ে নিত।
প্রথম দেখাতেই বনি আর ক্লাইড দুজন দুজনকে পছন্দ করে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে পরিচয় হয় এবং কাছে আসতে শুরু করে তারা। এভাবেই দুজনে গভীর প্রেমে ডুবে যায়। ক্লাইডের মতো সুদর্শন যুবকের সঙ্গে বনির প্রেম হওয়াতে বনির মাও বেশ খুশি হয়। কারণ এর আগে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বনি আরেকটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে বিয়েও করেছিল। কিন্তু সেই ছেলে একটি খুনের দায়ে ৯৯ বছরের জেল হলে সেই বিয়ে ভেঙে যায়। তাই বনির মায়ের আশা ছিল, সুদর্শন ক্লাইড হয়তো পারবে বনির জীবনের অন্ধকার অতীতটা ঢেকে দিয়ে আলোর পথে এগিয়ে নিতে।
এগিয়ে তারা ঠিকই গিয়েছিল, তবে আলোর বিপরীত দিকেই। পরিচয়ের পরই এই জুটি বুঝতে পারে তাদের দুজনের ভেতরে রয়েছে অপরাধ করার সহজাত প্রবণতা। তাই তারা ধীরে ধীরে বিভিন্ন অপরাধে একে অপরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠে।
বনির বাড়িতে প্রথম ডিনারের দাওয়াত খেতে যেদিন যায় ক্লাইড সেদিনই সে গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে। সাতটি ছিনতাই ও একটি গাড়ি চুরির দায়ে দু’বছর জেল হয়। কিন্তু সে জেল ভেঙে পালায়। এখানেও তার সহযোগী হয় বনি। প্রেমিকা বনি ক্লাইডের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কৌশলে তার কাছে একটি বন্দুক পাচার করে যার সাহায্যে জেল থেকে পালায় ক্লাইড। এরপর দুজনে মিলে করে ব্যাংক ডাকাতি। সেখানেও কপাল মন্দ। আবার ধরা পড়ে হয় ১৪ বছরের জেল। কিন্তু এবার জেল পালাতে না পেরে পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলে ক্লাইড। ফলে তার চিকিৎসা করায় জেল কর্তৃপক্ষ এবং মুক্তি পায় সে।
মুক্তি পেয়ে কিছুদিন বনির মায়ের কথামতো সৎ জীবন-যাপনের চেষ্টাও করে ক্লাইড। চাকরি নেয় ম্যাসাচুসেটস শহরে। কিন্তু অল্পদিনেই হাঁপিয়ে উঠে শেষে চাকরি ছেড়ে ডালাসে গিয়ে আবারও বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হয় সে। আর বনিও মাকে ছেড়ে ডালাসে চলে আসে ক্লাইডের সঙ্গে যুক্ত হতে। এরপরই শুরু হয় এই জুটির ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার আসল যাত্রা।
ডালাসে এই জুটি কাজ শুরুর পর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় রে হ্যামিলটন, রিকি এবং জোনস নামের তিনজন। তারা বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, গাড়ি চুড়ি আর ব্যাংক ডাকাতি করতে থাকে। এর মধ্যে তারা মাত্র চল্লিশ ডলারের জন্য এক স্বর্ণকারকে গুলি করে মেরে ফেলে। আরেকটি ঘটনায় ১৬ বছরের এক কিশোরকে খুন করে এই খুনে প্রেমিক যুগল। এই ভয়ঙ্কর ডাকাত দলটি ১৯৩২ সালে ডালাসের একটি বিখ্যাত পাব্লিক প্লেসে একজন শেরিফ এবং তার দুই সহযোগীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। গাড়ি চুরি করতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে মালিকের ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে সেখান থেকে পালায় দলটি। একবার বনি পার্কার একাই এক কসাইয়ের পেটে তিনটি গুলি চালিয়ে তার দোকান লুট করে। এই খুনে দলটি খুব সামান্য পরিমাণ অর্থের জন্যও অবলীলায় মানুষ খুন করত।
একবার এভাবে ছিনতাই আর ডাকাতি করেই তারা নিজেদের গাড়িতে করে মিসৌরি, ক্যানসাস, মিশিগান প্রভৃতি বড় বড় শহরগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। সেখানে ভালো ভালো সব হোটেলে থাকা, দামী রেঁস্তোরায় খাওয়া, রোমান্টিক জুটিদের মতোই শহরময় ঘুরে বেড়ানো- সবই করে বনি আর ক্লাইড। তাদের দেখে কেউই ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তারা কত ভয়ঙ্কর এক খুনে যুগল। সবাই ধরে নিত তারা সদ্য প্রেমে পড়া ধনীর দুলাল, শহরে শহরে ঘুরে রোমাঞ্চ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তারা জানতো পুলিশ তাদের খুঁজছে এবং এভাবে তারা বেশিদিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে না। আর তাই আরো বেশি করে নিজেদের সময়টুকু উপভোগ করতে থাকলো।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বনি পার্কার ভালো কবিতাও লিখতো। তাদের মৃত্যুর পর পাওয়া যায় বনির রচিত একটি কবিতা। পরে “দ্য স্টোরি অব বনি অ্যান্ড ক্লাইড” শিরোনামের এই কবিতাটি প্রকাশিত হলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় সেটি। এতে বনি লিখেছে, তারা দুজনেই তাদের বাবা-মাকে কত ভালোবাসে। তাদের খুব বড় আফসোস ছিল মৃত্যুর আগে তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। এই কবিতাটি এবং বনির ডায়রি থেকে আরো কিছু লেখা পুলিশ উদ্ধার করেছিল বনি আর ক্লাইডের ধ্বংস হওয়া গাড়ি থেকে। সেখান থেকেই পুলিশ তাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য পায়। তারপরই পুলিশ আরো তৎপর হয়।
তবে পুলিশ তৎপর হলেও ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকেও তাদের ছিনতাই, ডাকাতি, খুন থেমে থাকেনি। এই সময় তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অঙ্ক- তিন হাজার ডলার ডাকাতি করে। এই ঘটনার পর টেক্সাসে একবার গাড়ি দুর্ঘটনায় বনি আহত হয়। কিছুটা সুস্থ হলে তারা আবার মিসৌরি ফিরে আসে। এরপর পুলিশ বেশ কয়েক দফা তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালালেও প্রতিবারই এই জুটি কেমন করে যেন বেঁচে যায়। তবে এর মাঝেই পুলিশের সঙ্গে এক গোলাগুলিতে তাদের দুই সহযোগী নিহত হয়ে আর আরেকজন ধরা পড়ে। কিন্তু সেই গোলাগুলির পরও আরও তিনমাস পালিয়ে বেড়ায় এবং ছিনতাই, খুন অব্যাহত রাখে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাদের নাগাল পেয়ে যায়। ১৯৩৪ সালের ২ মে তারিখে খুব সুন্দর একটি সকালে তারা দুজনে মিলে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো লুইজিয়ানার বেইনভিলে। সালিম শহরের কাছে হঠাৎ ছয়জন পুলিশের একটি দল তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৮৭ টি বুলেটে বিদ্ধ হয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাদের গাড়ি এবং দেহ। ভয়ঙ্কর রোমান্টিক এই জুটির শেষটাও হয় তাদের কল্পনার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, বনি পার্কার আর ক্লাইড ব্যারো নৃশংস খুনে জুটির এই রোমাঞ্চকর প্রেমকাহিনী তাদের মৃত্যুর পর রূপকথার মতো লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের বিভিন্ন কীর্তিকলাপ নিয়ে এতটাই আলোচনা হয়েছিল যে মনে হতো তারা বুঝি কোনো তারকা জুটি। পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত্যুর পর তাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল ডালাসে। সেখানেও জনতার ঢল নেমেছিল। অনেকেই তাদের কফিন থেকে ফুল তুলে নিয়ে গিয়েছিল সুভ্যেনির হিসেবে রেখে দেয়ার জন্য। সময়ের স্রোতেও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি তাদের প্রেমকাহিনী। যদিও বনি-ক্লাইড মানুষকে তাদের নিষ্ঠুর কার্যকলাপ এবং একের পর এক খুনের কারণে ভীত করে রেখেছিল, তবুও তাদের দুজনার প্রেমকে মানুষ মনে রেখেছে।
অনেকেই তাদেরকে দেখেন এক দারুণ প্রেমিক জুটি হিসেবে। নিষ্ঠুরতা এবং ঘৃণার মাঝেও এই প্রেমকাহিনী তাদের অমর করে রেখেছে। পরবর্তী সময়ে তাদের জীবন নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন আমেরিকার পপ লোকসাহিত্যিক আর্থার পেন। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পুনর্জাগরিত হয় তাদের প্রেমকাহিনী, যা সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের আজকের দিনেও মুগ্ধ বিস্ময়ে শিহরিত করে।