হযরত উমার (রা) মৃত্যুবরণ করবার সময় একটা করুণ আর হুলস্থূল সংকটের মুখে ছিল মুসলিম বিশ্ব। সেই সময় যিনি এর হাল ধরেন তিনি হযরত উসমান জুন্নুরাইন (রা)। সাহাবীদের মধ্যে ধনীতম এ মহান মানুষটি ইসলামের প্রাথমিক যুগে এত দান করে গিয়েছিলেন যে ইসলামি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে সেসব কাহিনী। কিন্তু তবুও ভর দুপুরে দুষ্কৃতিদের এতটুকু হাত কাঁপেনি তাঁকে তাঁর স্ত্রীদের সরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করতে। আজকের প্রবন্ধে আমরা রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরব খলিফা হযরত উসমান (রা) এর শাসনামল আর কী পরিস্থিতির কারণে তাঁকে এই করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।
পূর্ববর্তী খলিফা হযরত উমার (রা) এর মৃত্যুর কারণ পাঠকরা নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন আমাদের পূর্বের পোস্ট থেকে। মৃত্যুশয্যায় তিনি ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করলেন যাদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচিত হবে। তারা ছিলেন হযরত আলী (রা), হযরত উসমান (রা), আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা), সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা), আল-জুবাইর (রা) ও তালহা (রা)। তাঁর মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় যেন তারা খলিফা নির্বাচিত করেন এমনটাই বলে যান উমার (রা)। তিনি তাদের জিজ্ঞেসও করলেন তারা কাকে ভোট দেবেন। আলী (রা) কোনো উত্তর না দিলেও উসমান (রা) জানালেন তিনি আলী (রা)-কে ভোট দেবেন। জুবাইর (রা) বললেন তিনি আলী (রা) বা উসমান (রা)-কে ভোট দেবেন। আর সাদ (রা) বললেন তিনিও উসমান (রা)-কে দেবেন।
এটা অবাক করা বিষয় ছিল না কারো কাছে যখন পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হলেন হযরত উসমান (রা)। তিনিও কুরাইশ বংশেরই মানুষ; কিন্তু নবীর গোত্রের নয়, বরং মক্কার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ধনী গোত্র উমাইয়াদের মাঝে তাঁর জন্ম। পিতার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের কিছু আগ পর্যন্ত এই উমাইয়ারা রাসুল (সা) এর চরম বিরোধী ছিল। কিন্তু তাদের মাঝে উসমান (রা) তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর (রা) এর পরামর্শে প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কার ধনী ব্যবসায়ী উসমান (রা) তাঁর সম্পদের বিশাল অংশ ইসলামের জন্য দিয়ে দেন। আবিসিনিয়াতে যখন তিনি সপরিবারে হিজরত করেছিলেন, তখন সেখানেও তিনি ব্যবসাতে সফল হন। আবার যখন মদিনার মতো কৃষিজীবী অঞ্চলে এলেন, সেখানে ইহুদী ব্যবসায়ীদের মাঝে একমাত্র মুসলিম ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। আর এই বিশাল ধনসম্পদ সর্বদা তিনি ব্যয় করেন ইসলামের স্বার্থেই।
খলিফা নির্বাচিত হবার পর তিনি রাজকোষ থেকে কোনো বেতন নিতেন না। কারণ তাঁর নিজেরই যথেষ্ট অর্থ ছিল, আর কোনো অর্থ তাঁর দরকার পড়ত না। তবে মানুষের দেয়া উপহার তিনি সাদরে গ্রহণ করতেন, যেমনটা করতেন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)।
উসমান (রা) এর স্ত্রী ছিলেন হযরত রুকাইয়া (রা) যিনি ছিলেন নবী (সা) এর কন্যা। কিন্তু তিনি যখন মারা যান, তখন নবী (সা) তাঁর আরেক কন্যা উম্ম কুলসুম (রা)-কেও উসমান (রা) এর কাছে বিয়ে দেন, এতটাই পছন্দ করতেন তিনি উসমান (রা)-কে। নবী বংশের দুজন আলো তাঁর স্ত্রী হয়ে ঘরে আসে। এজন্য উসমান (রা) এর এক উপাধি ছিল ‘জুন্নুরাইন’ যার অর্থ ‘দুই আলোর অধিকারী’। তিনি যেদিন খলিফা হন সেদিন ছিল ৬৪৪ সালের ৬ নভেম্বর। এ শাসনকাল চলেছিল ৬৫৬ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত। চলুন আমরা সংক্ষেপে জেনে নেই কেমন গিয়েছিল তাঁর শাসনকাল।
পাঠকদের হয়ত মনে আছে, হযরত উমার (রা) এর পুত্র উবাইদুল্লাহ ক্রোধ আর প্রতিশোধের বশে হত্যা করেন হরমুজান, জাফ্রিনা ও ফিরোজের কন্যা আর স্ত্রীকে। উমার (রা) দায়িত্ব দিয়ে যান পরবর্তী খলিফাকে কারাবন্দী উবাইদুল্লাহ-র ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। এটাই ছিল উসমান (রা) এর প্রথম মামলা ক্ষমতা গ্রহণের পর।
আবু বকর (রা) এর পুত্র আব্দুর রহমান ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করতেন না যে কোনো পারস্য ষড়যন্ত্র ছিল এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে। কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তাই এ চারজন নিরপরাধ নাগরিক হত্যার দায়ে উমার (রা) এর পুত্র উবাইদুল্লাহ-কে হয় মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে, নয়ত যদি মৃতের আত্মীয় রাজি থাকে তবে ব্লাডমানি প্রদান করতে হবে।
আলী (রা) বললেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু আমর ইবনে আস (রা) বললেন, আগের দিন আমরা উমার (রা)-কে হারিয়েছি, আর আজ হারাবো তাঁর পুত্রকে? উমার (রা) এর প্রতি সম্মান রেখে দ্বিতীয় অপশন বেছে নেয়া উচিৎ।
তাবারীর বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, নিহত হরমুজানের পুত্র ক্বামাজবান সাক্ষী হিসেবে খলিফার কাঠগড়ায় দাঁড়ান। তাঁর সাক্ষী থেকে বোঝা যায় হরমুজান ছিলেন নির্দোষ। ফিরোজ একাই এ কাজ করেছে, এর সাথে মদিনার আর কেউ জড়িত ছিল না। ক্বামাজবান প্রথমে উবাইদুল্লাহ-র মৃত্যু চাইলেন। কিন্তু পরে তিনি মত পরিবর্তন করলেন এবং আল্লাহ্র ওয়াস্তে তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন।
উবাইদুল্লাহ-কে যখন উসমান ব্লাডমানি পরিশোধ করতে বললেন, তখন দেখা গেল তাঁর কাছে টাকা নেই। তখন উসমান (রা) নিজের পকেট থেকে পুরো টাকা পরিশোধ করেন; প্রত্যেক নিহতের জন্য এক হাজার দিনার করে, যেমনটা তখন নির্ধারিত ছিল।
উসমান (রা) এর শাসনামলকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমে আমরা কথা বলব তাঁর আর্থসামাজিক অবদান, এরপর আসবে সামরিক অভিযানগুলো, এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণে তাঁকে স্মরণ করা হয় সেই কুরআন সংকলন আর সবশেষে আসবে যে ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিহত হন।
প্রথমেই আসা যাক আর্থসামাজিক অবদানে। উসমান (রা) ক্ষমতা নেবার পর জনগণের ভাতা ২৫% বৃদ্ধি করে দেন আগের তুলনায়। যেসব জায়গা বিজিত হবে, সেখানে জমি কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছিলেন উমার (রা)। এ নিষেধাজ্ঞা উসমান (রা) তুলে নেন এবং ব্যবসার সুযোগ বাড়িয়ে দেন। তাঁর আমলে অসাধারণ রকমের ভালো ছিল ইসলামি বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং জনগণ সমৃদ্ধিতে ছিল।
এরপর আমরা এখন আসি উসমান (রা) এর শাসনামলের সামরিক পরিস্থিতির দিকে। যে দিক দিয়ে উসমান (রা) সমালোচিত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি সেটি ছিল তাঁর স্বজনপ্রীতি। তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রধানত তাঁর উমাইয়া গোত্রীয় আত্মীয়দের। এমন না যে, যাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন তারা একদমই সক্ষম কেউ ছিলেন না। তবুও এ দিক দিয়ে নিরপেক্ষতা বজায় না রাখবার জন্য ব্যাপারটা অনেকেই ভালোভাবে নেননি। অবশ্য, পরবর্তীতে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ উসমান (রা) এর নিয়োগ দেওয়া মানুষদের ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন।
হযরত আবু বকর (রা) সাহাবী ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ানকে রোমান সিরিয়া আক্রমণে প্রেরণ করেছিলেন। পরে তিনি দামেস্কের গভর্নর হন। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, উমার (রা) এর সময় একটি ভয়াবহ প্লেগ হয়েছিল। সেই প্লেগে সিরিয়ার আবু উবাইদা (রা) মারা যান। এরপর মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)-কে প্রেরণ করা হয় গভর্নর হিসেবে। তিনিও এ প্লেগে মারা যান। এরপর উমার (রা) ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ানকে প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনিও প্লেগে মারা যান। এরপর উমার (রা) সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানকে। উল্লেখ্য, মুয়াবিয়া ছিলেন উসমান (রা) এর চাচাতো ভাই। উসমান (রা) এর শাসনামলে মুয়াবিয়া বিশাল এক মুসলিম নৌবাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেই বাহিনীতে মুসলিম ছাড়াও মিসরীয় ও সিরীয় খ্রিস্টানরা যোগদান করেন। এই যুগান্তকারী নৌবাহিনী ৬৫৫ সালে দুর্দান্ত রোমান বাইজান্টিন নৌবাহিনীকে ভূমধ্যসাগরে পরাস্ত করে। এতে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রসারে নতুন এক পালক যুক্ত হয়। আর বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে।
৬৫১ সালে উসমান (রা) আব্দুল্লাহ ইবন জুবাইর ও আব্দুল্লাহ ইবনে সাদকে প্রেরণ করেন মাগ্রেবে। সেখানে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের আত্মীয় গ্রেগরির প্রায় ১ বা ২ লাখ সেনাসম্পন্ন বাহিনীর মুখোমুখি হয় মুসলিম বাহিনী। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ইতিহাসগ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, এই বিশাল বাহিনী মুসলিমদেরকে চারপাশ থেকে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলে, একদম পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় মুসলিম বাহিনী। তখন ইবন জুবাইর দেখতে পেলেন ঘোড়ার গাড়ির উপর গ্রেগরি বসে আছেন, তখন ইবনে সা’দকে তিনি ওদিকে যেতে বলেন। একটা ছোট গ্রুপ তখন ইবনে সা’দের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রেগরির উপর। গ্রেগরি মারা যেতেই বাইজান্টিন বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায় এবং তারা পরাজিত হয়ে প্রস্থান করে।
উমার (রা) এর আমলে যেখানে সব সেনা অভিযান উমার (রা) এর নিজস্ব কমান্ডে হতো, উসমান (রা) এর সময় তা ছিল না। বরং তিনি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কমান্ডারদের নিজস্ব স্টাইলে অভিযান এগিয়ে নিয়ে যাবার। এভাবে ইবনে সা’দ এর নেতৃত্বে উত্তর আফ্রিকা এবং ইস্পাহান বা স্পেনের কিছু অংশ জয় করে নেন। স্পেনের আন্দালুসে তারা অভিযান চালিয়েছিলেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক অবশ্য বলে থাকেন, ৭১১ সালের আগে এমনটা হয়নি।
ওদিকে আহনাফ ইবনে কায়েস (যিনি কিনা হরমুজানের বাহিনীকে শুস্থারে পরাজিত করেছিলেন উমার (রা) এর সময়) তুর্কমেনিস্তান, ফার্স, কারমান, সিস্তান, খোরাসান (আফগানিস্তান) জয় করে নেন। অনেকের কাছে মনে হতে পারে, কেন এভাবে রাজ্য বিজয় করতে হবে? ব্যাপারটা একবিংশ শতকে এসে অবাক লাগলেও তখন স্বাভাবিক ছিল। কারণ একটা রাজ্য যদি সম্প্রসারিত না হয়ে ক্ষমতাবান না হয়, তবে পাশের রাজ্য ক’দিন বাদে ঠিকই এই ছোট দুর্বল রাজ্যকে ছিনিয়ে নেবে। ‘ডু অর ডাই’ নীতিতে তখন চলতো সারা বিশ্ব।
লেখার এ পর্যায়ে আমরা একটা বহুল প্রচলিত প্রশ্নের উত্তর দেব, “কেন উসমান (রা) কুরআনের অনেক কপি পুড়িয়ে ফেলেন?” পশ্চিমাবিশ্বের অনেকেই ধারণা করে থাকে, কুরআন পুড়িয়ে ফেলা একটি গর্হিত কাজ। আসলে তা নয়; ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী কুরআনের একটি ভুল কপি বা ব্যবহারের অযোগ্য কপি যদি আপনি ‘ডিস্পোজ’ করতে চান, অর্থাৎ অপসারণ করতে চান যেন সেটা আর ব্যবহার করা না হয়, তবে সেটা আপনাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, এরকম কিছু উপায়ে ‘ডিস্পোজ’ করতে হবে।
এ বিষয়টি স্কলারদের জানা থাকলেও, সাধারণ অনেক মুসলিমেরই জানা নেই (বিশেষ করে বাংলাদেশে) যে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছিল সাতটি আহরুফে। বা সহজ করে বলতে গেলে সাতটি আরবি উপভাষায়, সাত রকমভাবে। যেমন, একবার উমার (রা) মসজিদে গিয়ে দেখলেন এক লোক সুরা ফুরকান তিলাওয়াত করছেন। উমার (রা) বুঝতে পারলেন লোকটি ফুরকান তিলাওয়াত করছেন। কিন্তু তারপরেও তিনি লক্ষ্য করলেন ঐ সাহাবী ভিন্নভাবে পড়ছেন; তাঁর কিছু কিছু শব্দ ভিন্ন, উচ্চারণ ভিন্ন। অথচ উমার (রা) জানতেন কুরআন এক ও অভিন্ন। তখন তিনি ঐ সাহাবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন; জিজ্ঞেস করলেন, এই তিলাওয়াত তুমি কার কাছ থেকে শিখেছো? তিনি জবাব দিলেন, আমি তো রাসুল (সা) এর কাছ থেকেই শিখেছি। উমার (রা) বললেন, আমিও তো তাঁর থেকেই শিখেছি; চলো তাঁর কাছে। যখন তারা বিষয়টি নিয়ে রাসুল (সা) এর কাছে উপস্থিত হলেন, তখন রাসুল (সা) বললেন, তারা দুজনেই সঠিক। কুরআন সাত রকম আরবি উপভাষায় নাজিল হয়েছে।
বিশুদ্ধ হাদিস থেকে আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) এর বর্ণনা থেকে পাই, রাসুল (সা) বলেছেন, “কুরআন নাজিল হয়েছে সাতটি আহরুফে। এ বিষয়ে তর্ক করা অবিশ্বাস; তোমরা যতটুকু জানো সেটাতেই আমল করবে, আর যে অংশ জানো না সেটা যে জানে তার জন্য রেখে দাও।“ এ বিষয়ে বুখারি ও মুসলিম শরীফে অনেকগুলো হাদিস রয়েছে।
কুরআন যে যুগে নাজিল হয়েছিল সে যুগে অধিকাংশ আরব ছিল নিরক্ষর, তার উপর বেদুইনরা তো ছিলই। যে কুরাইশি উপভাষায় কুরআন নাজিল হতো সে উপভাষায় দূর দূরান্তের বেদুইনরা কথা বলত না, তাদের ভঙ্গিমা ছিল ভিন্ন। সুতরাং এ আরবি তাদের জন্য কঠিন হতো। অথচ কুরআন আরবিতে সহজ করে নাজিল হবার কথা। বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, তখন নবী মুহাম্মাদ (সা) জিবরাঈল (আ)-কে অনুরোধ করেন ভিন্ন উপভাষায় কুরআন আনয়নের। তখন ক্রমান্বয়ে জিবরাঈল (আ) একে একে সাতটি উপভাষায় কুরআনের আয়াতগুলো আনয়ন করেন। এ সাতটি উপভাষাতেই রাসুল (সা) ব্যক্তিভেদে শিক্ষা দেন। যেমন উমার (রা) কুরাইশের মানুষ, এজন্য তাঁর অন্যটা শিক্ষা করা হয়নি।
কিন্তু এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে, এই সাতটি ভার্শনে (ভার্সন শব্দের মানে এই নয় যে পুরো ভিন্ন এক একটা) অনেক পার্থক্য আছে। যদি তাই হতো তবে উমার (রা) বুঝতে পারতেন না যে ঐ সাহাবী সুরা ফুরকান তিলাওয়াত করছেন। কিন্তু বিষয়টি এত গোপনীয় ছিল যে উমার (রা) এর মতো বড় সাহাবীও প্রথম দিকে জানতেন না ব্যাপারটা। পার্থক্য ছিল সামান্য কিছু উচ্চারণে, আর কিছু শব্দের প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল; অনেকটা ব্রিটিশ আর আমেরিকান ইংলিশের পার্থক্যের মতো। এক জায়গায় ফ্ল্যাট বললে আরেক জায়গায় এপার্টমেন্ট; এক জায়গায় এলিভেটর বললে আরেক জায়গায় এস্কেলেটর। তাঁর মানে কিন্তু এই না যে আমেরিকানরা ব্রিটিশ ইংলিশ বোঝেন না। তেমনই সকল আরবই সাত উপভাষার কুরআন বুঝতেন।
যা-ই হোক, নবী (সা) মারা যাবার প্রথম দু’বছরের মধ্যেই কুরাইশি ডায়ালেক্টে/উপভাষায় কুরআন এর প্রধান কপি বা মাস্টার কপি তৈরি করা হয়ে যায়, যা কালের বিবর্তনে হাফসা (রা) এর কাছে ছিল। কিন্তু ঐ যে বলছিলাম উপভাষার কথা। কুরাইশি, সাকিফি, হাওয়াজিনি, কিনানাই, তামিমি, হুজাইলি আর ইয়েমেনি- অন্তত এই সাত আরবি উপভাষায় কুরআন নাজিল হয়েছিল। কিন্তু প্রথম এবং নবী (সা) এর নিজের উপভাষাতে নাজিল হয়েছিল সেই কুরাইশি ভার্শনটিই এবং মাস্টারকপি ছিল সেটাই। যখন উসমান (রা) এর শাসন চলছে, তখন হযরত মুহাম্মাদ (সা) মারা যাবার অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। দূর দূরান্তে সাম্রাজ্য বিস্তার হয়ে গেছে। নতুন অনেকেই মুসলিম হয়ে গেছে। এমন না যে সকলে কুরাইশি উপভাষায় কথা বলে। তাই তারা তাদের পছন্দের ভার্শন বা আহরুফেই তিলাওয়াত করত। কিন্তু যেহেতু অনেকেই এই সাত ভার্শনের বৈধতার কথা জানতেন না, কেউ কেউ দাবি করতে লাগলেন তাদেরটা সঠিক, অন্যেরটা ভুল। আবার অনেকদিন পার হয়ে যাবার কারণে যারা নিজেরা নিজেদের উপভাষায় কুরআন লিখিয়ে নিচ্ছিলেন সেখানে ভুল ত্রুটি ধরা পড়ছিল, মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহাবীও তাদের নিজেদের কপিতে দেখা যেতো, আয়াতের পাশে পাশে সাইডনোট লিখে রাখছিলেন, সেটা দেখে কেউ কেউ আবার সাইডনোটকেও কুরআনের আয়াতের অংশ ভেবে বসলে সমস্যা।
কুরআন নিয়ে এত মতবিভেদ দেখবার পর উসমান (রা) সিদ্ধান্ত নিলেন কেবল কুরাইশি মাস্টার কপি রেখে বাকিগুলো সরিয়ে ফেলবেন, যেন পুরো মুসলিম বিশ্ব জুড়ে কোনো তর্ক না থাকে এসব নিয়ে। অসংখ্য হাফিজ সাহাবী উপস্থিত থাকতেই যে কপি লিখিত হয়েছিল রাসুল (সা) এর নিজের মাতৃভাষায় সেটাই হবে আসল কপি। এজন্য তিনি আহ্বান করেন সকলে যেন অন্যান্য কপিগুলো দিয়ে যায়। সেগুলো শরিয়ত মোতাবেক তিনি পুড়িয়ে ফেলেন, এবং পুরো বিশ্ব জুড়ে এক ও অভিন্ন কুরাইশি আহরুফের কুরআন প্রচলিত করেন। সেই কপিটি তিনি অনেকগুলো কপি করিয়ে সকল প্রদেশে একটি করে পাঠিয়ে দেন। যার যার দরকার হবে সেই কপি থেকে যেন লিখিয়ে নেয়।
তবে কয়েকজন সাহাবী নিজের লেখা কুরআনের কপি হস্তান্তর করতে চাননি। না চাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ এতদিন ধরে তিনি এটা পড়ে এসেছেন, এখন এটাকে বিদায় দিতে হবে- এটাতে খারাপ লাগবারই কথা। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) ছিলেন এমন একজন, যিনি চাননি নিজের পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিতে। তবে উসমান (রা)-কে তিনি ছোটোখাটো ব্যাপারেও খুব মান্য করতেন। তাই তাঁর সাথে এ ব্যাপারে বড় কোনো দ্বন্দ্ব হবার কাহিনীগুলো বানোয়াট বলেই মনে করেন সুন্নি স্কলাররা। কোনো কোনো সাহাবীর পাণ্ডুলিপিতে ১১৪টি সুরার চেয়ে কম সুরা ছিল। অর্থাৎ তারা সবগুলো সংগ্রহ করেননি বা লিখেননি। আবার যেমন উবাই ইবনে কা’ব (রা) অতিরিক্ত দুটো দুয়াকে তাঁর কুরআনের পাণ্ডুলিপির শেষে লিখে রেখেছিলেন। অনেকে ভুলবশত সেটা কুরআনের সুরা মনে করে থাকতে পারে। কিন্তু প্রচুর সংখ্যক কুরআনে হাফিজ থাকবার কারণে এসব ভুল পাত্তা পায়নি।
কুরাইশি আহরুফকেও যে অনেকে ভিন্নভাবে তিলাওয়াত করেননি তা নয়। এবার আর কোনো শব্দগত পার্থক্য ছিল না। পার্থক্য ছিল তিলাওয়াতে আর অ্যাক্সেন্টে। একে আমরা বলি কিরাত। মোটামুটি দশ রকম কিরাত পরবর্তীতে মানসম্পন্ন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। হযরত উসমান (রা) চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন কুরআনকে ঠিকভাবে সংকলন করে মুসলিম জাতির ঐক্য ধরে রাখার কারণে। এ কারণে ১৪০০ বছর ধরে মুসলিমরা সেই কুরাইশি ম্যানুস্ক্রিপ্ট এক ও অভিন্নভাবে পড়ে আসছে নবী (সা) এর মাতৃভাষায়। স্কলারদের গবেষণার জন্য ভিন্নতাগুলো জন্য রেখে দেয়া আছে এবং সেটা উচ্চতর শিক্ষার বিষয়।
যদি কেউ আরো জানতে চান, তবে এ ভিডিও লেকচার দুটো দেখতে পারেন।
বুখারি শরীফের ৩৬৯৫ নং হাদিসে আমরা পাই, রাসুল (সা) বলেছিলেন, “উসমানকে বেহেশতের সুসংবাদ দাও, তাঁর উপর এক দুরবস্থা নেমে আসবে।“
এখন আমরা এ পোস্টের শেষ টপিক অর্থাৎ কী দুরবস্থা নেমে এসেছিল এবং কীভাবে উসমান (রা) মারা গেলেন সে ঘটনায় যাব।
মোটামুটি প্রথম ছয় বছর তাঁর শাসনের ব্যাপারে কারো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু পরের ছয় বছরে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। মূলত, ইসলামি প্রদেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে আত্মীয়দের বসানোর মাধ্যমে অনেককে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা ছিল মূল কারণ, তার উপর উসমান (রা) এর কোমল মনোভাবের সুযোগ নিয়ে অনেকের করা দুর্নীতির অত্যাধিকতার অভিযোগ তো ছিলই। ৬৫৪ সালের দিকে উসমান (রা) এর শাসনের বিরোধিতা গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা সম্পর্কে জানবার জন্য তিনি ১২ প্রদেশ থেকে গভর্নরদের মদিনায় ডেকে পাঠান। তদন্ত থেকে দেখা যায়, বেশিরভাগই শাসন নিয়ে খুব সন্তুষ্ট। ৬৫৫ সালে উসমান (রা) মক্কায় তাদেরকে হজ্বে আহ্বান করেন যারা তাঁর শাসনে অসন্তুষ্ট। দেখা গেলো অনেক শহর থেকেই অনেকে এসে উপস্থিত হয়েছে। মক্কাতে হাজির হয়ে তারা দেখলো মক্কার মানুষ উসমান (রা) এর বিরোধী না। তাদের দাবি উপস্থাপন বা আদায়ের জন্য এ পরিস্থিতি অনুকূল না। তখনও পরিস্থিতি খারাপ হয়নি, কিন্তু খারাপের পথে ছিল।
সাহাবী মুয়াবিয়া এ ব্যাপারটা টের পেয়ে উসমান (রা)-কে পরামর্শ দিলেন সিরিয়া ভ্রমণ করে যেতে তাঁর সাথে, কারণ সিরিয়ার পরিস্থিতি অনেক শান্ত। (মুয়াবিয়া সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন) উসমান (রা) এ পরামর্শ কানে তুললেন না। তিনি বললেন তিনি নবীর শহর (মদিনা) ত্যাগ করবেন না। উসমান (রা) এর নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন মুয়াবিয়া পরামর্শ দিলেন এবার। তিনি তাঁকে পাহারা দেবার জন্য সিরিয়া থেকে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী দেবেন কিনা। উসমান (রা) না করলেন, বললেন সিরিয়ান সেনা দেখলে মানুষ ক্ষেপতে পারে। পরে গৃহযুদ্ধ হয়ে যাবে।
মিসরের রাজনীতির কারণেই মূলত উসমানি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছিল। উসমান (রা) তখন মিসরের গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ-কে মদিনাতে ডেকে পাঠালেন। ওদিকে যেই না ইবনে সা’দ মিসর ত্যাগ করলেন, সাথে সাথে মুহাম্মাদ ইবনে আবু হুজাইফা এক মিলিটারি ক্যু করে মিসরের ক্ষমতা দখল করে ফেললেন। এই মুহাম্মাদ ইবনে আবু হুজাইফা তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন ইয়ামামার যুদ্ধে, এরপর উসমান (রা) তাঁকে বড় করে তোলেন। কিন্তু কেন তিনি তাঁকে কোনো প্রদেশের গভর্নর করলেন না, সেই রাগ থেকে তিনি বিদ্রোহ করে বসলেন উসমান (রা) এর বিরুদ্ধে। অনেকটা যেন দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা।
উসমান (রা) এর হাতে যথেষ্ট সেনা ছিল না যে তিনি ইবনে সাদ-কে দিয়ে সাহায্য করবেন। তাই ইবনে সাদ পারলেন না ক্ষমতা পুনরায় নিজের হাতে নিতে।
মিসর থেকে ১০০০ বিদ্রোহী মদিনায় এসে হাজির হলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল উসমান (রা)-কে খুন করে সরকার উৎখাত করা। দেখা গেলো ইরাকের কুফা ও বসরা থেকেও বিদ্রোহী এলো মদিনাতে। মিসর থেকে আসা বিদ্রোহীরা এসে আলী (রা)-কে খলিফা হবার প্রস্তাব দিলো। যেখানে প্রথম থেকেই হযরত আলী (রা) এর খলিফা হবার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু হতে পারেননি। তিনি নিজেই সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন এই প্রস্তাব। কুফা থেকে যারা এসেছিল, তারা জুবাইর (রা)-কে প্রস্তাব দিলেন খলিফা হবার। আর বসরা থেকে আসা বিদ্রোহীরা প্রস্তাব দিলো তালহা (রা)-কে। তারা দুজনেই অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করলেন। একমাত্র উমাইয়ারা তখন জানপ্রাণ দিয়ে সমর্থন দিয়ে এসেছে উসমান (রা)-কে, আর হাতে গোনা কিছু মানুষ- তারাই কেবল উসমান (রা) এর পক্ষে ছিল। বাকিদের মতামত দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয় বিদ্রোহীরা।
আলী (রা) তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজেদের প্রদেশে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন মদিনা থেকে পাঠানো এক পত্রবাহককে বিদ্রোহীরা আটক করে। পত্রে গভর্নরকে লেখা ছিল, পৌঁছা মাত্রই বিদ্রোহীদের নেতাদেরকে শাস্তি দিতে। পত্রে খলিফার সীল ছিল। তারা এ চিঠি দেখে ক্ষেপে আবার মদিনা ফেরত আসলো। উসমান (রা) চিঠির ব্যাপারে কিছু জানতেন না বলে জানালেন। কিন্তু এবার আর বিদ্রোহীদের শান্ত করার কোনো উপায় থাকলো না। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ ধারণা করেন, চিঠিটি মারওয়ান লিখে পাঠিয়েছিলেন, উসমান (রা) এর সেক্রেটারি। তবে আসল ব্যাপার আমরা জানতে পারবো না নিশ্চিত হয়ে।
উসমান (রা) গৃহবন্দী হয়ে পড়লেন। ঘরের চারপাশে বিদ্রোহীরা। যত দিন যেতে লাগলো, তত বিদ্রোহী জড়ো হতে লাগলো বাহিরে, আগুনও ধরিয়ে দিল। মদিনা থেকে অনেক স্থানীয় মানুষ মক্কায় হজ্ব করতে গিয়েছে আগেই। তাই কাছের মানুষও কম উসমান (রা) এর। বিদ্রোহীরা বুঝতে পারলো, হজ্ব শেষ হয়ে গেলেই পুরো সাম্রাজ্য থেকে আসা হাজিরা উসমান (রা) এর পক্ষে মদিনা ছুটে আসবে, এর আগেই যা করবার তা করতে হবে। উসমান (রা) এর অনুসারীরা তাদের বিরুদ্ধে লড়ার অনুমতি চাইলো। কিন্তু তিনি মানা করলেন। এক মুসলিম আরেক মুসলিমের রক্ত ঝরাতে পারে না। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) এবং আলী (রা) এর দুই পুত্র হাসান (রা) ও হুসাইন (রা) গেট বন্ধ করে পাহারা দিতে লাগলেন।
৬৫৬ সালের ১৭ জুন। যখন বিদ্রোহীরা দেখলো গেটে ভালোই পাহারা আছে, তখন মিসরীয় বিদ্রোহীরা প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে ভেতরে নেমে পড়ল। গেটের পাহারা দেয়া সাহাবীরা জানলেনও না কী হলো। বিদ্রোহীরা উসমান (রা) এর কক্ষে চুপে চুপে ঢুকে পড়ল। তখন রোজা রাখা উসমান (রা) কুরআন পড়ছিলেন (উপরে সে কুরআনের ছবি আছে), তিনি যখন সুরা বাকারার ১৩৭ নং আয়াতে পৌঁছালেন, তখন বিদ্রোহীরা সজোরে মাথায় আঘাত করল। উসমান (রা) এর স্ত্রী নাইলা নিজের দেহ দিয়ে উসমান (রা)-কে রক্ষা করতে গেলেন, হাত উঁচু করে তরবারির আঘাত ঠেকাতে গেলেন। নাইলা-র আঙুলগুলো কেটে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এরপরের আঘাতেই শহিদ হলেন উসমান (রা)। তাঁর দাসেরা তাঁকে বাঁচাতে গেলে একজন নিহত হয়, আর আরেকজন এক বিদ্রোহীকে মারতে সক্ষম হয়। [কথিত আছে, উসমান (রা) এর রক্তে ভেজা কুরআন তাশখন্দের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।]
বিদ্রোহীরা উসমান (রা) এর লাশ বিকৃত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নাইলা আর উম্ম আলবানিন লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতে চাইলেন, তারা চিৎকার করতে থাকলেন। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যাবার সময় ধনী উসমান (রা) এর বাসা লুট করে যায়, এমনকি মেয়েদের নেকাব পর্যন্ত নিয়ে যায়। যখন গেট থেকে সাহাবীরা এসে পৌঁছালেন ততক্ষণে সব শেষ, তারা কিছু করতে পারলেন না। মাঝখান দিয়ে হাসান (রা) ও মারওয়ান আহত হন।
টানা তিন দিন উসমান (রা) এর লাশ পড়ে ছিল বাসায়। নাইলা তখন কয়েকজন সমর্থকের সহায়তায় তাঁর দাফন দেবার চেষ্টা করলেন। মাত্র ১২ জন কাছের মানুষ পাওয়া গেল। গোধূলির সময় লাশ নিয়ে যাওয়া হলো, কোনো কফিন বা খাটিয়া পাওয়া যায়নি। তাঁকে কোনো গোসল দেয়া হয়নি, কারণ ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী শহীদদের কোনো গোসল নেই। কাফনের কাপড়ও পরানো হয়নি। যে কাপড়ে তিনি মারা যান, সে কাপড়েই তাঁকে কবরে নিয়ে যাওয়া হয়।
আলী (রা), হাসান (রা), হুসাইন (রা) ও অন্যরা লাশ বহন করলেন। রাতের আঁধারে নাইলা পেছন পেছন আসছিলেন একটি কুপিবাতি নিয়ে। কিন্তু সেটাও নিভিয়ে দিতে হলো যেন বিদ্রোহীরা টের না পায়। নাইলার সাথে একমাত্র অন্য যে নারী ছিলেন তিনি আয়িশা (রা)।
মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে পৌঁছানোর পর দেখা গেলো বিদ্রোহীরা টের পেয়ে সেখানে হাজির। তারা মুসলিম কবরস্থানে উসমান (রা)-কে দাফন করতে দেবে না। নিরুপায় হয়ে তাঁকে দাফন করা হলো পেছনের ইহুদী কবরস্থানে। [পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফারা এই দুই কবরস্থানের প্রাচীর ভেঙে দুই কবরস্থান এক করে ফেলেন, যেন উসমান (রা) মুসলিম কবরস্থানে শায়িত হতে পারেন।]
জানাজা পড়ালেন জাবির (রা)। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া লাশ কবরে নামানো হলো। দাফনের পর আইশা (রা) ও নাইলা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু নীরবতা বজায়ে রাখবার জন্য তাদের চুপ থাকতে হলো। নীরবেই চলে গেলেন উসমান (রা)।
কিন্তু পরবর্তী খলিফা যিনি হবেন, সেই আলী (রা) কী পদক্ষেপ নিবেন এই বিদ্রোহীদের ব্যাপারে? তিনি কি এই জঘন্য ঘটনার ন্যায্য প্রতিশোধ নিয়ে মুসলিমদের ও উসমান (রা) প্রিয়জনদের সন্তুষ্ট করবেন? নাকি গৃহযুদ্ধ এড়াবার জন্য তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বিরাগভাজন হবেন?
এক বিশাল সিদ্ধান্ত নেবার দায়ভার মাথায় নিয়ে শুরু হলো আলী (রা) এর খেলাফত। পরের পর্বে আমরা জানবো কেমন গিয়েছিল আলী (রা) এর শাসন এবং কেনই বা তিনি উমার (রা) এর মতোই ফজরের ওয়াক্তে এক আততায়ীর তরবারির আঘাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
পড়ুন পরের পর্বঃ হযরত আলী (রা)।
পূর্বের পর্বঃ হযরত উমার (রা)।
প্রথম পর্বঃ হযরত আবু বাকর (রা)।