১৯৪৫ সালে ফরাসি উপনিবেশবাদীরা ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেও দেশটির সাধারণ মানুষের মুক্তি মিলেছে প্রায় তিন যুগ পর। ফরাসিরা ভিয়েতনাম ছাড়লেও মার্কিন বাহিনীর সাথে দীর্ঘদিন লড়াই করতে হয়েছে দেশটির সাধারণ মানুষের। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সোজা হয়ে দাঁড়ানোই ছিল প্রায় অসাধ্য। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই পুরো দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে খাদ্য সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা ছিল প্রকট৷ তাছাড়া সেই সময় ভিয়েতনামে অবকাঠামো বলতে তেমন কিছুই ছিল না।
কিন্তু আজকের ভিয়েতনামের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দেশটির রাজধানী এশিয়ার প্রথম সারির শহরগুলোর একটি। দেশটির অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। এসব কিছুর পেছনে রয়েছে দেশটির বিপ্লবী এক নেতার নাম। যার সুদক্ষ নেতৃত্বে নাজুক অর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় টেকসই অর্থনীতিতে। ভিয়েতনামের সেই মহান নেতা হলেন ডো মোই।
২০১৮ সালের ১ অক্টোবর, ১০১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু দেশটির আনাচে কানাচে নিজের সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা ভাবনার ছাপ রেখে গেছেন। জীবনের ৭৮টি বসন্ত তিনি কাটিয়েছেন রাজনীতির মাঠে। কৈশোর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তিনি বিপ্লব চালিয়ে গেছেন। তিনি ফরাসি উপনিবেশবাদীদের হঠানোর জন্য লড়াই করেছেন। লড়াই করেছেন লাগামবিহীন মুদ্রাস্ফীতির বিপক্ষেও। সেইসাথে কাজ করেছেন দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য।
বিপ্লবী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
১৯১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ভিয়েতনামের বর্তমান রাজধানী হ্যানয়ের পাশে তান ত্রাইয়ের ডং ফুতে জন্মগ্রহণ করেন ডো মোই। বর্তমানে তিনি ডো মোই নামে পরিচিত হলেও তার পারিবারিক নাম ছিল ওয়েং ডাই কং। শৈশব থেকেই জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। তাই পড়াশোনার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাসাবাড়ির রংমিস্ত্রী হিসেবে। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। যার লক্ষ্য ছিল ফরাসি উপনিবেশবাদীদের দেশ ছাড়া করা। এরপর মাত্র ১৮ বছর বয়সে হ্যাং ফামকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন।
১৯ বছর বয়সে ফ্রেঞ্চ পপুলার ফ্রন্টে যোগ দেন। যারা ফরাসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। এরপর ১৯৩৯ সালে, ২২ বছর বয়সে হো চি মিনের ইন্দোচিন কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লেখান। এটি ছিল তার আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে যোগদানের প্রথম পদক্ষেপ৷ এর দু বছর পর তাকে ফরাসি উপনিবেশবাদী সরকার তাকে গ্রেফতার করে ১০ বছরের জন্য আটক রাখার আদেশ দেওয়া হয়৷ হ্যানয়ের হোয়া লো জেলখানায় চার বছর জেল খাটার পর জেলের নর্দমার ভেতর দিয়ে পালিয়ে আসেন মোই। এরপর তিনি ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিপ্লবী সংগ্রামে অংশ নেন।
পরবর্তী সময়ে মোই কমিউনিস্ট পার্টির হ্যা ডং ইউনিটে যোগদান করেন এবং সেখানকার একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৫ সালে পার্টির একজন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মোই ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি হ্যা ন্যাম ও ন্যাম দিং জেলা এবং নিং বিং প্রদেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷ পাশাপাশি তিনি উত্তরাঞ্চলে দলের একাধিক বিপ্লবী বাহিনীরও নেতৃত্ব দেন।
১৯৫৪ সালের মার্চে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। স্বাধীনতা ঘোষণার নয় বছর পর উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল থেকে আংশিক মুক্তি লাভ করে দেশটি। কিন্তু সে সময় ভিয়েতনাম দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উত্তর ভিয়েতনাম ছিল হো চি মিনের অধীনে। অন্যদিকে সায়গন চলে যায় ফরাসিদের মদদপুষ্ট একটি নেতৃত্বের অধীনে।
১৯৫৫ সালে মাসে ডো মোই বন্দর নগরী হেই ফোংয়ের দলীয় প্রধান ও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেখানকার দায়িত্ব নিয়েই তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করার উদ্যোগ নেন। একই বছরের মার্চে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির অতিরিক্ত সদস্য নির্বাচিত হন। এক বছর পর তিনি ভিয়েতনামের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। একইসাথে তাকে দল থেকে ভিয়েতনামের আইনসভা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে দলের জাতীয় সম্মেলনে ডো মোই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৬৯-১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ একইসাথে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ অর্থনৈতিক বিভাগের চেয়ারম্যানের সামলান। সে সময় ভিয়েতনাম আরো একবার যুদ্ধে লিপ্ত। এবার তাদের শত্রুপক্ষে ছিল মার্কিন সেনারা। ১৯৭৬-৮১ সাল পর্যন্ত তিনি আরো এক প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সালে মোই কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর অতিরিক্ত সদস্য নির্বাচিত হন। পলিটব্যুরো হলো দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী কমিটি। পরে ১৯৮৬ সালে তাকে এই কমিটির আনুষ্ঠানিক সদস্য পদ দেওয়া হয়। এর পাঁচ বছর পর তিনি দলের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯৯১-৯৭ সাল পর্যন্ত মোই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বেচ্ছায় তার পদ থেকে অবসর নেন। যদিও চীনের মতো ভিয়েতনামেও এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা। এবং সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক দেশের শাসন ব্যবস্থান অন্যতম শীর্ষ একটি পদ। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে মোই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি এই পদ থেকে অবসর নেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটান।
অর্থনৈতিক বিপ্লবের নায়ক
হেই ফোংয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেও ডো মোই পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যুদ্ধের ময়দানে তার ভূমিকা কী ছিল, সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। মূলত যুদ্ধের ময়দানে তার কোনো অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ ১৯৭১ সালের পর তিনি দীর্ঘদিন আড়ালে থেকে যান। ধারণা করা হয়, সে সময় তিনি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলেন। যার চিকিৎসা নেওয়ার জন্য তিনি চীনে গিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষে সায়গন রেজিমের পতন ঘটে। ফলে ভিয়েতনাম পুনরায় আবার একীভূত হয়। ঠিক সেই সময় ডো মোই আবার দৃশ্যপটে হাজির হন। তিনি সায়গন শহরের কেন্দ্রে একটি যুব বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। যারা শহরের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় হামলা করে সেখানকার সম্পদ লুট করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে ডাকাতি করেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের পেছনের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদ এবং কমিউনিস্ট আদর্শ। তিনি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো গুড়িয়ে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় দেশ পরিচালনায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনামে জাতীয়তাবাদী আদর্শ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। এবং সেখানে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কিন্তু, এরপরও তিনি থেমে যাননি।
১৯৭৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর ভিয়েতনামে প্রথম সমস্যা ছিল খাদ্য সংকট। কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের জনগণের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল খুবই কম। সেই সাথে বড় অঙ্কের লোকসানের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। তখন মুদ্রাস্ফীতিও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সেসময় ভিয়েতনামের লোকজনকে কুপনের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী কিনতে হতো।
যারা সরকার সংশ্লিষ্ট তারা অতিরিক্ত কুপন পেতেন এবং সহজেই বিভিন্ন দোকানে প্রবেশ করে মালামাল ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু সাধারণ জনগণ কখনো কখনো দিনভর অপেক্ষা করতে হতো। খাদ্যের এই চরম সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য সরকার সম্ভাব্য সকল স্থান থেকে খাদ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে থাকে। এমনকি যারা বিদেশে যেতেন, তাদেরকে খাদ্য সামগ্রী আনার জন্য অনুরোধ করা হতো। যারা বিদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী আনতেন, তাদের জন্য শুল্ক মওকুফ ছিল।
কিন্তু বাড়তি মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির ফলে সাধারণ জনগণ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আস্থাহীন হতে শুরু করে। ফলে, দলটি নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। ১৯৮৮ সালে কমরেড ডো মোই কাউন্সিল অভ মিনিস্টারস-এর চেয়ারম্যান হওয়ার পর পলিটব্যুরো প্রধান ওয়েং ভ্যান লিংকে সাথে নিয়ে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের সংগ্রাম শুরু করেন। যে সংগ্রাম ‘ডোই মোই’ নামে পরিচিত। মোইয়ের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা অনেকগুলো সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে করে দেশের মুদ্রাস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়৷
অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য সরকার নিয়মিত বাজার তদারকি করার পাশাপাশি ভর্তুকি তুলে নেওয়া এবং পণ্য ও সেবা গ্রহণের জন্য কুপন ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ১৯৮৮ সালে মোইয়ের কিছু সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে মুদ্রাস্ফীতি ৭০০ কমে ৩০০ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু পরের বছর জানুয়ারি থেকে আবার প্রতি মাসে ৮ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে। এর জন্য অবশ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা দায়ী ছিল।
সে সময় আইএমএফের তথ্য মতে, ভিয়েতনামের মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহ অবস্থা কাটানোর জন্য তিন বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এত টাকা তারা পাবে কোথায়? তখন মোই দেশের মধ্য থেকেই কোনো উপায় বের করার চেষ্টা করেন। তখন তিনি লক্ষ করেন, ব্যাংক সুদের হার অনেক কম। সেইসাথে ব্যাংক তখনো ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ বেতন পাওয়ার সাথে সাথে খাদ্য দ্রব্য কিনে বাড়িতে মজুদ করে রাখছিল। কারণ, সুদ হার কম থাকার কারণে তারা ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে উৎসাহ পায়নি। ফলে, শিল্প প্রতিষ্ঠানকে মূলধন দেওয়ার জন্য ব্যাংকের কাছে কোনো অর্থ ছিল না।
সে সময় সরকার মুদ্রা ছাপানোর নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি আরো বেড়ে যায়। অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ভিয়েতনামের সাথে ব্যবসা করতে অনীহা প্রকাশ করে। তখন ডো মোই সকল মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের নিয়ে বৈঠক করে তিনি চারটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রতিটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১০ জন করে চারটি দল গঠন করেন।
তবে চারটি পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যাংক সুদ বাড়ানো। এই বিষয়টি জানার পর তখনকার অনেক অর্থনীতিবিদ অবাক হন। কিন্তু মোইয়ের সামনে তখন এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। তখন তিনি প্রতি মাসে ব্যাংক সুদ ২-৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করেন। আর যারা তিনমাস মেয়াদে টাকা রাখবেন, তাদের জন্য করা হয় ১২ শতাংশ। একই সাথে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের সাথে সুদের হার বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ডো মোইয়ের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে মুদ্রাস্ফীতি নেমে দাঁড়ায় ৩৫-৪০ শতাংশ। সেইসাথে সাধারণ মানুষ টাকা দিয়ে পণ্য কিনে জমা রাখার বিপরীতে ব্যাংক অর্থ সঞ্চয় করতে শুরু করে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাংক থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে শুরু করে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আবার চালু হতে শুরু করে। ফলে ৬ লাখ চাকরি হারানো মানুষ আবার চাকরি পেতে শুরু করে।
খাদ্য সংকটকে পাশ কাটিয়ে দেশটি ৫ লাখ টন চাল মজুদ করে। এরপরও তারা একবারে আরো ২ লাখ টন চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরও অনেকেই বলেছে, ভিয়েতনাম তাদের মুদ্রাস্ফীতির অবনমন ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু ডো মোইয়ের হার না মানা যুদ্ধের পর ১৯৯২ সালে মুদ্রাস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। পরবর্তী বছরগুলোতে তা আরো কমে দাঁড়ায়।
বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন
১৯৯১ সালে ডো মোই যখন দলের সাধারণ সম্পাদক হন, ঠিক তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আরো বেশ কিছু দেশ ভেঙে পড়ে। ফলে ভিয়েতনামের নেতারা নিজের সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দেশ পরিচালনা করার ভবিষ্যত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। সেখানেও ত্রাতা হিসেবে হাজির হন ডো মোই।
নিজ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও শাসন ব্যবস্থার স্থায়িত্বশীলতার জন্য তিনি বিদেশি রাষ্ট্র সমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন৷ প্রথমেই তিনি চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালান৷ তার বেশ কিছু পদক্ষেপের পর ১৯৯১ সালের ৫-১০ নভেম্বর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আমন্ত্রণে তিনি চীন সফরে যান। সফর শেষে উভয় পক্ষ থেকে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের সম্পর্ক জোরদার করার ঘোষণা দেওয়া হয়, যা এখনো অটুট রয়েছে।
চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পর মোই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নজর দেন। অতীতের তিক্ত ইতিহাস ভুলে সামনের দিকে একসাথে পথচলার কথা ভাবেন। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পাশাপাশি দেশটির বিরুদ্ধে নেওয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। ডো মোই বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কূটনীতিক পথ ছাড়াও সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার পথও বেছে। আসিয়ানে যোগদানের মাধ্যমে ভিয়েতনামে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে সক্ষম হয়।
আদর্শে অবিচল, দেশপ্রেমিক ও ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ এক নেতা
ডো মোই তার জীবনের প্রায় ৮০ বছর উৎসর্গ করেছেন দেশ ও সাধারণ জনগণের জন্য। দেশের স্বাধীনতা অর্জন, দুই ভিয়েতনামকে একীভূতকরণ, অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে তার অবদান অপরিসীম। হো চি মিনের মনোযোগী ছাত্র হিসেবে মোই তার পুরো জীবনই ব্যয় করেছেন বিপ্লব ও মানুষের কল্যাণের জন্য।
ব্যক্তি হিসেবে ডো মোই ছিলেন লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। চাইলে তিনি সারাজীবন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং যখন তিনি বুঝতে পেরেছেন, তার দেবার আর কিছুই নেই, তখন তিনি নিজে থেকে সরে গেছেন। মোই বিপদের মুহূর্তে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কোনো ভুল হলে দলের আগে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। কমরেড ডো মোই চিরকাল তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করে গেছেন। সমর্থন করে গেছেন এক দলীয় শাসন। ভিয়েতনামের জন্য তার অবদান অবিস্মরণীয়। এবং বিশ্বের সকল রাজনৈতিক নেতাদের জন্য অনুকরণীয় এক ব্যক্তিত্ব।