শুরুর আগে
২০ মার্চ, ২০২০। শুক্রবার। ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটখাটো মানুষটি। ৭৯ বছর বয়স। দেখে অবশ্য তা মনে হয় না। এখনো শক্তপোক্ত দেখায়। ট্রাম্প করোনাভাইরাসের ওষুধের কথা বললেন। আশার কথা শোনালেন। বললেন, শিগগিরই আমরা ভালো কিছু পেতে যাচ্ছি। সাংবাদিকরা সবই শুনল। মানুষটিও শুনলেন। বোঝা যাচ্ছে, উসখুস করছেন।
একটু পরেই উঠে এলেন পোডিয়ামে। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট গলায় বললেন, “না, কোনো ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যেহেতু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও অনুমোদন পাওয়ার পর্যায়ে যায়নি কোনো ভ্যাকসিন, তারমানে, ‘তথাকথিত’ এই ভ্যাকসিন যে কাজ করে, তার কোনো প্রমাণ নেই। আমাদের ধৈর্য ধরে আরো অপেক্ষা করতে হবে।” প্রেসিডেন্টের কথার পিঠে কয়জন এভাবে সঠিক কথাটা বলে? তিনি বলেন। কারণ, তিনি একজন খাঁটি বিজ্ঞানী।
গত প্রায় ৫৪ বছর ধরে একই কাজ করে আসছেন তিনি। ছুটছেন সংক্রামক ব্যাধির পেছনে। গবেষণা করছেন, সেই সঙ্গে দুঃসময়ে মানুষকে জানাচ্ছেন সঠিক তথ্য। আজও তা-ই করে যাচ্ছেন। প্রথমটি তাকে বিজ্ঞানী হিসেবে অভিজ্ঞ করে তুলেছে, দ্বিতীয়টি তাকে এনে দিয়েছে প্রবাদপ্রতিম বিশ্বাসযোগ্যতা। তিনি ড. অ্যান্থনি ফাউচি। এনআইএআইডির পরিচালক।
সেই এইচআইভি থেকে শুরু করেছেন। সার্স, মার্স, ইবোলা হয়ে এখন করোনাভাইরাস রোধে ও জনসচেতনতা বাড়াতে তিনি আজও কাজ করে যাচ্ছেন, একটানা।
১
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৪০। ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক। স্টিফেন এ. ফাউচি ও ইউজিনিয়া এ. ফাউচির ঘরে জন্ম নিল এক শিশু। নাম রাখা হলো অ্যান্থনি ফাউচি।
বাবা ছিলেন ফার্মাসিস্ট। মা আর বোন সেই ফার্মেসির রেজিস্টারে কাজ করত। আর, প্রেসক্রিপশন ডেলিভারি করার কাজে সাহায্য করত ফাউচি। সাথে অন্যান্য টুকটাক কাজও করে দিত। পরবর্তী জীবনে বাবা ও মাকে অশেষ ধন্যবাদ দেবে এই কৃতী সন্তান। বলবে, বাবার দোকানে কাজ করতে গিয়েই তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।
নিউ ইয়র্কের রেজিস হাইস্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন ফাউচি। তারপর ভর্তি হন কলেজ অফ হলি ক্রস-এ। ১৯৬২ সালে সেখান থেকে ব্যাচেলর্স অফ সায়েন্স (BS) ডিগ্রি নেন। মজার ব্যাপার হলো, এ সময় তার পড়াশোনার বিষয় ছিল ক্লাসিকস। মানে প্রাচীন রোম ও গ্রীসের ইতিহাস, ঐতিহ্য, দর্শন, সভ্যতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনার্স সম্পন্ন করেন তিনি।
তারপর ভর্তি হয়ে যান কর্নেল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে ডক্টর অফ মেডিসিন (MD) শেষ করেন ১৯৬৬ সালে। তারপর নিউ ইয়র্ক হসপিটাল-করনেল মেডিকেল সেন্টারে ইন্টার্নি করেন। এর মাধ্যমে পড়াশোনার পালা চুকে গেল। ফাউচি চিন্তা করলেন, কাজে যোগ দেবেন। কিন্তু কী করবেন?
ভেবে-চিন্তে ১৯৬৮ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH)-এর অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (NIAID)-এর অধীনে থাকা দ্য ল্যাবোরেটরি অফ ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন-এ ক্লিনিক্যাল অ্যাসোশিয়েট হিসেবে যোগ দিলেন অ্যান্থনি ফাউচি। তখনো কেউ জানত না, এই মানুষটি আগামী ৫৪ বছর এখানেই থেকে যাবেন। পদোন্নতি হবে, দায়িত্ব বাড়বে, ৭৯ বছরের বেশি বয়সেও কাজ করবেন ১৬ ঘণ্টারও বেশি। এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ-এর মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যোগ দেয়ার অনুরোধও তাকে নড়াতে পারবে না।
২
ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফাউচির মূল যুদ্ধটা শুরু হয় এইচআইভির সাথে লড়াইয়ের মাধ্যমে। এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের এইডস হয়। আমরা সবা জানি, এইডস এখন আর কোনো মহামারী না। কিন্তু এক সময় এই এইডসের তাণ্ডবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮১ সালে। সে গল্পে যাব, তার আগে একটু পেছনে ফিরে যাই।
৭০ দশকের শুরুর দিকের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন ফাউচি। দুই বছরের রেসিডেন্সি (গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী প্রশিক্ষণ বলা যায়) শেষ করে সদ্য গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সে সময়কার কথা। এখানে একটা জিনিস বোঝা প্রয়োজন। গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ণ করার জন্য মূল পড়াশোনা শেষে ডাক্তাররা ইন্টার্ন (Intern) হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। আর, ইন্টার্নি শেষ করে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার জন্য করেন রেসিডেন্সি (Residency)। একজন রেসিডেন্টের অধীনে আবার বেশ কয়েকজন ইন্টার্ন প্রশিক্ষণ নেন। আর, রেসিডেন্সি শেষে গবেষণা করতে চাইলে রিসার্চ ফেলো বা গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করা যায়। আবার, ডাক্তার হিসেবে রোগী দেখাও শুরু করা যায়।
ফাউচি চাইলে দারুণ একজন চিকিৎসক হতে পারতেন। কেন, সেটা অবশ্য এই ঘটনার শেষেই বোঝা যাবে। কিন্তু তিনি পা বাড়ালেন গবেষণার দিকে। গবেষণার জন্য একজন সুপারভাইজার লাগে। ফাউচির সুপারভাইজার ছিলেন শেলডন উলফ। এনআইএইচের প্রধান কার্যালয় বেথেসডায়। সেখানেই, উলফের ল্যাবে কাজ নিলেন। উলফ তখন এনআইএআইডির ল্যাবরেটরি অফ ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশনের প্রধান হিসেবে কর্মরত। সে সময় প্রথমবারের মতো বিচিত্র এক রোগের সামনে পড়লেন ফাউচি।
আক্রান্ত রোগীদের কারো ইমিউনোডেফিসিয়ন্সি আছে, আবার কারো আছে ভাস্কুলিটি। ইমিউনোডেফিসিয়ন্সি মানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকভাবে কাজ করছে না। আর, ভাস্কুলিটি মানে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই রক্তনালীগুলোকে আক্রমণ করছে। ফলে রক্তনালীতে প্রদাহ, মানে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। রক্তপ্রবাহ হচ্ছে বিঘ্নিত। এরফলে আক্রান্তদের প্রচণ্ড জ্বর হচ্ছে। দ্রুত চিকিৎসা না করলে মারাও যাচ্ছে অনেকে। কিন্তু চিকিৎসা কীভাবে দেবেন? চিকিৎসা কী, তাই তো জানেন না তারা। আর, উলফের দলের কাজই এটা। নতুন কোনো রোগের চিকিৎসা খুঁজে বের করা।
একই বিল্ডিংয়ের ওপরের তলায় কাজ করেন ডক্টর ভিনসেন্ট ডেভিটা। তিনি তখন প্রেডনিসন ও সাইক্লোফসফামাইড নামের দুটি ড্রাগ নিয়ে কাজ করছেন। এরা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এ ধরনের ড্রাগকে বলে ইমিউনোসাপ্রেসর। ভিনসেন্ট বুঝতে চাইছিলেন, এই ড্রাগ দুটো কাজে লাগিয়ে কোনোভাবে লিম্ফোমা ও লিউকোমিয়া রোগের চিকিৎসা করা যায় কি না।
ফাউচি তার কাজের কথা জানলেন। ভাবলেন, রোগীদের রক্তনালীতে যেহেতু দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই আক্রমণ করছে, এর কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিলে কেমন হয়? তবে ড্রাগের মাত্রা হতে হবে খুবই নিয়ন্ত্রিত। বেশি মাত্রার ইমিউনোসাপ্রেসর রোগীর মেরুদণ্ড ধ্বংস করে দিতে পারে। অনেক বুঝে-শুনে মাত্রা নির্ধারণ করা হলো। অল্প কয়েকজন রোগীর ওপরে প্রথম ট্রায়াল চালানো হলো। দেখা গেল, ম্যাজিকের মতো কাজ হচ্ছে। মুমূর্ষু সব রোগী সেরে উঠছেন দ্রুত। তারা তখন যত সম্ভব, এ রোগে আক্রান্তদের ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে শুরু করল। প্রথমবারের মতো উলফের তত্ত্বাবধানে, ফাউচির হাত ধরে সারল এক জটিল ও ভয়ংকর রোগ।
এক দশক পর থেকে যিনি একের পর এক মহামারীর সাথে লড়াই করে যাবেন, তার শুরুটা যে এমনই হবে, তা আর বলতে!
৩
দ্রুত পদোন্নতি হচ্ছিল ফাউচির। কারণ তার দক্ষতা ও গবেষণা কাজ। ১৯৭৭ সালের মধ্যেই ফাউচি এনআইএআইডির ডেপুটি ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর হয়ে যান। ১৯৮০ সালে হন চিফ অব দ্য ল্যাবোরেটোরি অব ইমিউনোরেগুলেশন। আজো তিনি এই পদে আছেন। আগেই বলেছি, এনআইএআইডির পূর্ণরূপ হচ্ছে, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ। মানে, তার কাজই হলো সংক্রামক ব্যধি নিয়ে। আর, সহজ করে বললে, সংক্রামক ব্যধি যখন বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন হয়ে ওঠে মহামারী।
১৯৮১ সালে প্রথম ধাক্কাটা এলো। ৫ জন মানুষের নতুন এক ধরনের নিউমোনিয়া ধরা পড়ল। সহকর্মীদের অনেকেই এটাকে তেমন পাত্তা দিতে চায়নি। ফাউচি কিন্তু তার ল্যাবকে নতুন এই রোগের জন্য প্রস্তুত করে ফেললেন। শুরু করলেন গবেষণা। ততদিনে বিজ্ঞানীরা রোগটির একটি নাম দিয়েছেন। অ্যাকোয়ার্ড ইমিউন ডেফিশিয়েন্সি সিনড্রোম। সংক্ষেপে এইডস (AIDS)।
১৯৮৩ সালে ফাউচি একটি গবেষণাপত্র বা পেপার প্রকাশ করলেন। ততদিনে আক্রান্ত হয়েছে ৩০০রও বেশি মানুষ। কেউ কোনো কিনারা পাচ্ছে না। ফাউচির পেপার থেকেই প্রথম জানা গেল, মানুষের যে কোষগুলো ইনফেকশনের মোকাবেলার করার জন্য এন্টিবডি তৈরি করে, তারা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এই কোষগুলোকে বলে বি-সেল (B cell)। তখনো এর পেছনে দায়ী ভাইরাসের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। ফাউচি ও তার দল এই সমস্যাটির নাম দেয় ‘ডায়াবলিক্যাল প্যারাডক্স’। মানে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে এই ভাইরাসের যেখানে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে সে তর তর করে বেড়ে উঠছে। পরের বছর এই ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। নাম দেওয়া হয়, হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস। মানে, এইচআইভি (HIV)।
মনে রাখতে হবে, চিকিৎসাবিজ্ঞান তখনো আজকের মতো উন্নত ছিল না। মানুষ তখন প্রচণ্ড ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কারণ, অজানার আতঙ্ক। কীভাবে ছড়াচ্ছে, কেউ জানে না। কীভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে, জানে না কেউই। সবাই মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে, এমন অবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সামাজিক জীবণযাত্রার জন্য এটা কতটা সমস্যার, আজ তা আমরা ভালোই বুঝতে পারছি।
ফাউচি তখন প্রথম গবেষণার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। টিভি, রেডিও, সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষকে অভয় দিলেন। জানালেন, এটি সাধারণ মেলামেশার ফলে ছড়ায় না। রক্ত ও যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়।
একের পর এক বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২৫ হাজার। আক্রান্ত হওয়ার পরেও বছর খানেকের বেশি বেঁচে থাকে রোগী। মারা যায় ভুগে। এদিকে, যত যাই হোক, এইডস রোগীদেরকে মানুষ কিছুটা হলেও ভয় পায়। আতঙ্কিত চোখে তাকায়, এড়িয়ে যেতে চায়। সবমিলে দুর্বিষহ অবস্থা।
১৯৮৮ সাল। এইডস এক্টিভিস্টরা ততদিনে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ওপরে প্রচণ্ডভাবে ক্ষোভ ঝাড়ছেন। দায়িত্বশীল হিসেবে ফাউচিকেও গালি দেয়া হচ্ছে সমানতালে। ঠিক এ রকম সময়, একদল একটিভিস্ট এনআইএইচ ক্যাম্পাসে এসে বিক্ষোভ শুরু করলেন। তারা জবাবদিহিতা চান, কেন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ড্রাগগুলো আক্রান্তদের দেয়া হচ্ছে না? ফাউচি কিন্তু সিকিউরিটি বা পুলিশ ডেকে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেননি। তিনি বিক্ষোভকারীদের দলনেতাকে আমন্ত্রণ করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তার কথা শুনলেন। তাকে নিজের দিক থেকে বুঝিয়েও বললেন। ইচ্ছে হলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নতুন ড্রাগ কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না।
এর কিছুদিন পরে ফাউচি গেলেন প্রজেক্ট ইনফর্ম দেখতে। যদিও সরাসরি কোনো প্রতিষেধক নেই, তবু এইডস রোগীদের যথাসম্ভব চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করে তারা। ফাউচি দেখলেন, অনেক রোগীই চিকিৎসার অভাবে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে প্রচণ্ড যন্ত্রণা পেয়ে। তিনি ভাবলেন, নির্ধারিত মানদণ্ডে উৎরে যেতে পারেনি বলে এরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ড্রাগ পাচ্ছে না। কিন্তু ড্রাগ পেলে এরা সর্বোচ্চ মারা যাবে, ড্রাগ না পেয়েও সেই ভুগে মারা যাচ্ছে। তাহলে কেন তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে?
এফডিএ প্রথমে মানতে পারেনি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো আক্রান্তদের নির্দিষ্ট পরিসরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ড্রাগ দেয়া। এর নাম ‘প্যারালাল ট্র্যাক’। ১৯৯০ সালে এর এটি অনুমতিও পেয়ে গেল। এখন হর-হামেশা এই প্যারালাল ট্র্যাক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
একেবারে নিশ্চিহ্ন না হলেও, এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আছে এইডস। ইংরেজিতে মহামারীকে বলে প্যান্ডেমিক (pandemic)। আর, এরকম নিয়ন্ত্রণাধীন রোগকে বলে এন্ডেমিক (endemic)। এইডসের এন্ডেমিকে পরিণত হওয়ার পেছনে ফাউচির অবদান অনেক।
৪
ছয়জন প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছেন ফাউচি। রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ বুশ সিনিয়র, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা হয়ে বর্তমানে কাজ করছেন ট্রাম্পের অধীনে। প্রত্যেকের মতাদর্শ আলাদা। এদের কেউ ডেমোক্রেটিক, আবার কেউ রিপাব্লিকান। আর, সবাই জানে, রাস্ট্রের অধীনে থাকা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরের পদে কারো থাকা-না থাকার পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ফাউচি কখনোই প্রেসিডেন্টের মত ভুল হলে তার সঙ্গে আপোষ করেননি। সংক্রামক রোগ নিয়ে তার কাজের জন্যই তিনি আজো আছেন সেই একই পদে।
এইডস সমস্যার সমাধানে তার কাজের পরে ফাউচি হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা ও নির্ভরতার নাম। এরপর একে একে আরো অনেকগুলো মহামারী এসেছে। ২০০১ এ অ্যানথ্রাক্স, ২০০২ এর শেষের দিকে সার্স, ২০১৪তে ইবোলা (যদিও এর শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে) এবং ২০১৫ সালের মার্স আউটব্রেক—প্রতিবারেই সবার আগে ফাউচির ডাক পড়েছে। সেই ডাকে তিনি সাড়া দিয়েছেন। নতুন করে কোমর বেঁধে নেমে গেছেন যুদ্ধে।
আমেরিকার জনগণ প্রতিটা সংক্রামক মহামারীর সময় নির্ভরতার জন্য ফাউচির দিকে তাকিয়েছিল। তিনি টেলিভিশনে এসেছেন, মানুষকে সাহস দিয়েছেন। সাধারণত দেখা যায়, যারা গবেষক, তারা নিরবে গবেষণা করে যান। আর যারা গণযোগাযোগ নিয়ে কাজ করেন, মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করেন, তাদের গবেষণায় ভাটা পড়ে। ফাউচির ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
একজন গবেষকের গবেষণার মাপাকাঠি হলো তার প্রকাশিত পেপার। একটা গবেষণাপত্র বা পেপার আসলেই প্রকাশের যোগ্য কিনা, সেটা একই বিষয়ের অন্যান্য বিশেষজ্ঞ গবেষকরা যাচাই করে দেখেন। এই প্রক্রিয়াটিকে বলে পিয়ার রিভিউ। পিয়ার রিভিউ ছাড়াও অনেক জার্নালে পেপার প্রকাশিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। ড. ফাউচির এরকম পিয়ার রিভিউড পেপার ও বিভিন্ন কনফারেন্সে প্রকাশিত গবেষণাপত্র এবং বইয়ের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি! এক কথায় যাকে বলা যায়, অবিশ্বাস্য। এছাড়াও, কোনো পেপার অন্যান্য গবেষকরা বিভিন্ন যায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছেন কি না, তার ওপরে নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়, পেপারটি কতটা গ্রহণযোগ্য বা শক্তিশালী। এই মাপকাঠিটাকে বলে সাইটেশন। ১৯৮১-১৯৮৮ সালে ফাউচির পেপারগুলোর সাইটেশন সংখ্যা ছিল দশ ১০ হাজারেরও বেশি। দিনে দিনে তা প্রবল গতিতে বেড়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ফাউচির একটি বইয়ের সাইটেশন হয়েছে ১২,৭০০+। প্রতিদিনই সেটা আরো বাড়ছে।
৫
তার প্রশংসনীয় কাজের জন্য ফাউচি অনেকগুলো স্বীকৃতি ও সম্মানসূচক ডক্টরেট (ডি.লিট) ডিগ্রি পেয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হলো আর্থার সি ফ্লেমিং অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৯) এবং ন্যাশনাল মেডাল অব সায়েন্স (২০০৫)। ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের এই পুরষ্কারটি হাতে তুলে দেন স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডাল অব ফ্রিডমও (২০০৮) পেয়েছেন ফাউচি।
এই ৭৯ বছর বয়সেও ফাউচির কাজের চাপ একটুও কমেনি। নতুন মহামারী, করোনাভাইরাসের প্রথম সারির যোদ্ধাদের একজন হিসেবে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। সেই সঙ্গে সাহস দিচ্ছেন মানুষকে। হোয়াইট হাউসের করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে মিটিং করতে হচ্ছে, সামলাতে হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও। এসবের পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (NIAID) হচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের (NIH) অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সাল থেকে অনেক অনেকবার ফাউচিকে NIAID ছেড়ে NIH এর প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফাউচি যাননি। সংক্রামক রোগের সঙ্গে তার যুদ্ধ শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন বারবার।
তার সেই যুদ্ধ আজও চলছে। করোনাভাইরাসের সমস্যা হয়তো সমাধান হবে। যদি অবসরে না যান, ফাউচির যুদ্ধ কিন্তু থামবে না। তিনি কাজ করে যাবেন পরবর্তী বিপর্যয় যথাসম্ভব এড়াতে। থাকবেন মানুষের, মানবতার পাশে।
সুপারম্যানের ‘S’ আশা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ফাউচিকে সুপারম্যান বললে কি খুব বেশি বলা হয়ে যায়? সে প্রশ্নের জবাব নাহয় পাঠকের জন্যই তোলা থাকুক!