প্রাচীনকাল থেকে কুষ্ঠরোগ একটি ঘৃণিত রোগ হিসেবে সমাজে প্রচলিত। কুষ্ঠরোগীকে পরিবার, সমাজ সবাই ঘর থেকে বের করে মানবেতর জীবনে ঠেলে দিত একশ বছর আগেও। ১৯৪০ সালে প্রথম এ রোগের ওষুধ আবিষ্কার হলেও সমাজ সহজে কুষ্ঠরোগীকে এখনও সহজে মেনে নেয় না। আফ্রিকার দরিদ্রপীড়িত দেশগুলো এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এ রোগের প্রকোপ পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি দেখা যায়। পাকিস্তান সেরকমই একটি দেশ, পারমাণবিক শক্তিধর এই দেশটিতে একসময় ছিল কুষ্ঠরোগের প্রকোপ। ১৯৬০ সালে ৩১ বছর বয়সী এক ডাক্তার ভারতে যাবার পথে ভিসা সমস্যার কারণে পাকিস্তানের করাচিতে আটকে যান কিছুদিনের জন্য। আর এ আটকে যাওয়াই বদলে দেয় তার জীবন, সেই সাথে তিনি বদলে দেন আরো হাজার হাজার মানুষের জীবন।
রুথ ফাও ছিলেন আজ থেকে ৫৭ বছর আগে করাচিতে আটকে যাওয়া সেই ডাক্তার। ১৯২৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জার্মানিতে জন্ম নেয়া রুথ বড় হয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে। মিত্রবাহিনীর বোমা হামলায় ধ্বংস হয় তার শহর, তার বাড়ি। যুদ্ধের শেষে পরিবারসহ তার স্থান হয় সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানিতে। তার সামনেই তার ছোট ভাই মারা যায়, বাসা গরম রাখার জন্য কাঠ-কয়লা চুরি পর্যন্ত করতে হয়েছে তাকে একসময়। সুযোগ সুবিধার অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৪৯ সালে তিনি পালিয়ে যান পশ্চিম জার্মানিতে এবং সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়াশোনা শুরু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি প্রেমে পড়েন এক ছেলের। একদিন সেই ছেলে তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয়, কিন্তু রুথ তাকে না করে দেন। প্রস্তাবের কিছুদিন আগে তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে ডাক পেয়েছিলেন বলে জানান তিনি। তাই তিনি নিজেকে ঈশ্বরের জন্য নিবেদিত করতে চেয়েছিলেন! চিকিৎসকের পাশাপাশি তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন একজন নান হিসেবেও। একসময় তিনি যোগ দেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মহিলাদের সংঘ ‘Daughters of the Heart of Marry’-তে। এ সংঘই ১৯৬০ সালে তাকে দক্ষিণ ভারতে পাঠায় কাজের জন্য, কিন্তু তিনি আটকা পড়েন করাচিতে।
করাচিতে থাকার সময় তিনি তৎকালীন ম্যাকলয়েড রোডে হঠাৎ কুষ্ঠরোগীদের একটি কলোনি খুঁজে পান। এ কলোনিটি ছিল এক কথায় অমানবিক এবং মানুষের বসবাসের অযোগ্য। বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে তিনি সেদিনের অভিজ্ঞতা বলেছেন। কলোনিটি ছিল একটি সুয়ারেজের পাশে, ময়লা-আবর্জনায় ভরা। যেখানে সেখানে ইঁদুর দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। ২০১০ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “প্রথমবার দেখাতেই যদি তাদের অবস্থা আপনাকে আঘাত না করে তাহলে আমি মনে করি, আর কোনোদিনই করবে না।”
পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কুষ্ঠরোগীদের অমানবিক অবস্থা দেখে তিনি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন বাকি জীবন পাকিস্তানেই কাটিয়ে দেবেন, কুষ্ঠরোগীদের সেবা করে। ২০১৪ সালে এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ১৯৬০ সালে রোগীদের সেই কলোনী তাকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিতে সাহায্য করেছিল।
তার হাত ধরে পাকিস্তানের করাচিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘Marie Adelaide Leprosy Centre’, পাকিস্তানে এটি প্রথম হাসপাতাল, যা কুষ্ঠরোগের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রোগী এবং রোগীর পরিবারকে নানা রকম সাহায্য শুরু করে এই হাসপাতাল। পাকিস্তান ছাড়িয়ে পাশের দেশ আফগানিস্তানেও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এই হাসপাতালের। ১৯৬১ সালে ফাউ দক্ষিণ ভারতের ভেলরে যান কুষ্ঠরোগী ব্যবস্থাপনার উপরে প্রশিক্ষণ নিতে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি করাচি ফিরে যান এবং নিজেকে নিয়োজিত করেন কুষ্ঠরোগীদের সেবায়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি চর্মবিশেষজ্ঞ ডাক্তার জরিনা ফাজেলভয়ের সাথে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসার জন্য প্যারামেডিকেল কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।
ষাটের দশকে পাকিস্তানের মতো দেশে তিনি যে খুব সহজে কাজ করতে পরেছেন তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কুষ্ঠরোগীদের ঐতিহাসিকভাবেই ঘৃণা করা হতো, পরিবার এবং সমাজ থেকে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়া হতো। কুষ্ঠরোগকে শুধু রোগ হিসেবেই না, বরং বড় কোনো পাপের শাস্তি হিসেবে দেখা হতো সমাজে। তাদের সাহায্য কিংবা চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসত না কেউ। এ কারণে ডক্টর রুথ প্রথমদিকে সবচেয়ে বেশি যে কাজটি করেছেন তা হলো ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা। তিনি প্রতিটি রোগীর বাসায় গিয়েছেন, তাদের পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলেছেন, কুষ্ঠরোগ নিরাময়যোগ্য এ কথা তাদের বুঝিয়েছেন। ঘরে বন্দী করে রাখা রোগীদের নিয়ে এসেছেন তার হাসপাতালে। তার এই সচেতনতা তৈরির কারণেই পরবর্তীতে মানুষ সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে।
তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং চেষ্টার ফলে সরকারও তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে সরকারের সহায়তায় কুষ্ঠরোগের প্রকোপ থাকা প্রদেশগুলোতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। বেলুচিস্তান, সিন্ধ, উত্তর পাকিস্তান, স্বাধীন কাশ্মীর, এমনকি আফগানিস্তান পর্যন্ত গিয়েছেন কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা দেবার জন্য। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে রোগীদের তার হাসপাতালে নিয়ে আসতেন। সেখানে তাদের শুধু চিকিৎসাই না, বরং খাবার, ভালো থাকার জায়গা এবং শিক্ষার ব্যবস্থাও করতেন।
১৯৭৯ সালে ডক্টর রুথ পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্য এবং জনকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। সে বছরই তিনি পাকিস্তানের হেলাল-ই-ইমতিয়াজ সম্মাননা পান। এর আগে ১৯৬৮ সালে জার্মানির দ্য অর্ডার অব দ্য ক্রস এবং ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকারের সিতারা-এ-কায়েদ এ আজম সম্মাননা পান।
ডক্টর রুথের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা কমতে থাকে, তাদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যও করে তোলেন তিনি। তার চেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৯৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পাকিস্তানের কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পৌঁছেছে বলে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারতে তখনো কুষ্ঠরোগের প্রকোপ কমেনি, সেখানে ডক্টর রুথ কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানকে এশিয়ার প্রথম দেশগুলোর একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত ম্যারি অ্যাডিলেড কুষ্ঠরোগের পাশাপাশি যক্ষ্মা এবং অন্ধত্বের চিকিৎসাও শুরু করে। এর ফলে কুষ্ঠরোগীদের পাশাপাশি অন্যান্য রোগীরাও সেবা পেতে থাকেন ডক্টর রুথের হাসপাতালে।
রুথের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানে কুষ্ঠরোগ এবং এর কারণে মৃত্যুর হার একেবারেই কমে গিয়েছে পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়। ১৯৮০ সালে পাকিস্তানে ১৯,৩৯৮ জন কুষ্ঠরোগের জন্য চিকিৎসাধীন ছিল, সেখানে ২০১৬ সালে সে সংখ্যা কমে হয়েছে মাত্র ৫৩১! কুষ্ঠরোগের কারণে মৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের পর কমেছে প্রায় ৪০%, কুষ্ঠরোগের কারণে পাকিস্তানে বর্তমানে এক লক্ষ লোকের মাঝে মাত্র ০.১ জন মারা যান।
রোগীদের পাশাপাশি মানবতার জন্যও কাজ করে গেছেন ডক্টর রুথ। ২০০০ সালে বেলুচিস্তানের খরা, ২০০৫ সালে কাশ্মীরের ভূমিকম্প কিংবা ২০১০ সালে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা- প্রতিটিতেই দাঁড়িয়েছেন আক্রান্তদের পাশে। ২০১০ সালের বন্যার পর ৮১ বছর বয়সেও নিজে গিয়ে ঘরহারা মানুষের সাথে দেখা করেছেন ডক্টর রুথ, কথা বলেছেন তাদের সাথে, শুনেছেন তাদের প্রয়োজনের কথা। নিজে যেমন তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন, তেমনি অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এগিয়ে আসতে।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অসংখ্য পুরষ্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন ডক্টর রুথ ফাউ। এর আগে তিনটি সম্মাননার কথা বলা হয়েছে, এরপরে তিনি ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন হিলাল-ই-পাকিস্তান সম্মাননা। এটি পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। ১৯৯১ সালে তিনি ড্যামিয়েন-ড্যাটন পুরষ্কার পান, যা ১৯৫৩ সাল থেকে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য দেয়া হয়। ২০০২ সালে তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরষ্কার লাভ করেন। ২০০৬ সালে ডক্টর রুফকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার দেয়া হয়। ২০১১ সালে তিনি পান পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা নিশান-ই-কায়েদ এ আজম। তাকে পাকিস্তানের মাদার তেরেসা নামেও ডাকা হয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানারকম রোগে ভুগতে শুরু করেন রুথ। বেশ কয়েক বছর ধরেই হৃদরোগসহ বার্ধ্যকজনিত বিভিন্ন রোগের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। গত ৪ আগস্ট অসুস্থ অবস্থায় ডক্টর রুথকে করাচির আগা খান হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে দুদিন পর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় তাকে। ১০ আগস্ট, ২০১৭ ভোর চারটায় হাসপাতালেই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান হাজারো মানুষের জীবন পাল্টে দেয়া এ নারী। করাচিতে এক কুষ্ঠরোগীর নষ্ট হয়ে যাওয়া পা ইঁদুরে খেতে দেখে তাদের সেবায় উদ্বুদ্ধ হওয়া সেদিনের তরুণীটি সেই করাচিতেই শেষ শয্যায় শায়িত হবেন সেইন্ট প্যাট্রিক চার্চে।
পাকিস্তানসহ পুরো পৃথিবী ডক্টর রুথের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ আব্বাস বলেছেন, “ডক্টর রুথ জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করলেও তার হৃদয়ে সবসময় পাকিস্তান ছিল।” তিনি ডক্টর রুথের জন্য আগামী ১৯ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করা মানুষটি যর্থাথই বলেছিলেন,
“আমরা সবাই যুদ্ধ থামাতে পারব না, কিন্তু আমাদের অনেকেই পারে কষ্ট কমাতে- শরীরের এবং মনের।”