Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এভারিস্ত গ্যালোয়া: এক রাতের গণিতবিদ

“এক রাতে আর কী-ইবা করা যায়!” কাজের চাপে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমনই কোনো একটি বাক্য মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেননি, এরকম মানুষ পাওয়া দুষ্কর। এক রাতে কতটুকুই বা করা যায় কাজ! তবে কথাটা যদি কোনোভাবে এক দুর্ভাগা ফরাসি গণিতবিদের কানে পৌঁছুতো, নির্ঘাত কানটি ধরে টেনে দিয়ে বলতেন, “আমি এক রাতের কাজ দিয়ে গোটা গণিত ইতিহাসে অমর হয়ে আছি, আর তুমি বলছো কিনা এক রাত সময়টা কম?”

তিনি যেমন তেমন কোনো গণিতবিদ নন, তার জীবনবৃত্তান্ত ছিলো এতোই বৈচিত্র্যময়, যে গল্প-সিনেমাও সেখানে নস্যি। ধূমকেতু হয়ে উড়ে এসেছিলেন গণিত-সাম্রাজ্যের আকাশে, চার বছরের পরিচয়ে ‘গণিতের রাজপুত্র’ হয়ে ওঠা, এক রাত জেগে কয়েক টুকরো কাগজে হিজিবিজি করে নিজের গোটা জীবনের কাজের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব নিশ্চিত করা, এরপর ভালোবাসার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া… গল্প নয় তো কী! আর এতোকিছু করার জন্য তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র বিশ বছর!

এই গণিতবিদের নাম এভারিস্ত গ্যালোয়া। তাঁকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক বীজগণিতের পুরোধা, প্রখ্যাত ‘গ্রুপ থিওরি’ এবং ‘গ্যালোয়া থিওরি’র জনক। তবে জীবদ্দশায় নিজের কাজের যোগ্য স্বীকৃতি তিনি পাননি। তাঁর গোটা জীবনকে পর্যালোচনা করলে কেবল সংঘাতেরই খোঁজ পাওয়া যায়; ইতিহাসের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত, সৃজনশীলতা এবং ঐতিহ্যের সংঘাত, শৃঙ্খলা এবং বিশৃঙ্খলার সংঘাত, প্রতিভা এবং আত্মবিনাশী মনোভাবের সংঘাত। আর এই সংঘাতের মধ্য দিয়েও অদ্বিতীয় হয়ে গণিত সাম্রাজ্যের খেয়ালী এক রাজপুত্র হয়ে উঠেছেন গ্যালোয়া।

এভারিস্ত গ্যালোয়া © Selunec (Anastasia)

তখন সময়টা দারুণ অস্থির, অস্থিতিশীল। নেপোলিয়নের শেষের শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। দেশে কখনো রাজতন্ত্র, আবার কখনো প্রজাতন্ত্র; কখনো নেপোলিয়ন ক্ষমতায় আসছেন, আবার কখনো সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে। ফ্রান্সে চলছে এক ভীষণ রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এমনই এক অস্থিতিশীল সময়ে ফরাসি বিপ্লবের ২২ বছর পর ১৮১১ সালের ২৫ অক্টোবর প্যারিসের দক্ষিণের ছোট্ট একটি উপশহর বুর্গ লা-রিনে জন্মগ্রহণ করলেন গ্যালোয়া। বাবা নিকোলাস-গ্যাব্রিয়েল গ্যালোয়া ছিলেন বুর্গ লা-রিনের মেয়র, রাজনীতিটা হয়তো রক্তেই মিশে ছিল। কিছুটা পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার পরও রাজনীতি পিছু ছাড়েনি তাঁর। এর জন্য বেশ কয়েকবার পরে জীবন হুমকির মুখেও পড়েছে। সে নিয়ে কথা পরে হবে।

গ্যালোয়া প্রথমবারের মতো স্কুলে যান ১৮২৩ সালে, তাঁর বয়স ততদিনে হয়ে গেছে ১২ বছর। স্কুলের নামটাও বেশ গালভরা, ‘লিসে দ্য লুই ল গ্রাঁ’। বেশ নামকরা স্কুল বটে, তবে তাতে শাসন বেজায় কড়া; বাইরে থেকে দেখলে স্কুলটিকে অনেকটাই জেলখানার মতো মনে হতো। স্কুলটির মালিকানা নিয়ে তখন কিছুটা টানাপোড়েন চলছে, চারদিকে গুজব রটেছে যে স্কুলটিকে নাকি রাজতন্ত্রের পক্ষে থাকা ধর্মযাজকদের হাতে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু ছাত্ররা প্রজাতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, কোনোমতেই রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ধর্মযাজকদের হাতে স্কুলের দায়ভার তুলে দেয়া চলবে না। স্কুলের অধ্যক্ষ সেই আন্দোলনের খবর পেয়ে পরিকল্পনাকারী কিছু ছাত্রদেরকে এককথায় স্কুল থেকে বের করে দিলেন, সঙ্গে জানিয়ে দিলেন যে অষ্টাদশ লুইয়ের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে। কিছু তেজস্বী ছাত্র সেই আদেশ মানতে রাজি না হওয়াতে আরো শ’খানেক শিক্ষার্থীকে বের করে দিলেন অধ্যক্ষ। গ্যালোয়া তখন নেহায়েত শিশু, তবে এই ঘটনাই হয়তো মনে বেশ বড় একটা দাগ কেটে গিয়েছিলো।

লিসে দ্য লুই ল গ্রাঁ; Image Source: Wikipedia

প্রথমদিকে দারুণ মেধাবী ছাত্র হিসেবেই চিনেছিলো তাকে সবাই। তবে এরপর হঠাৎই তাঁর মধ্যে অন্যরকম এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। তাঁর বয়স যখন ১৪, তখন প্রথমবারের মতো পরিচয় ঘটে গণিতের সঙ্গে। শিক্ষক হিসেবেও পেয়েছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান একজনকে, পিয়েরে ভার্নিয়ার। এরপর কোত্থেকে যেন হঠাৎ কী হয়ে গেলো তাঁর, নিতান্ত নিরীহ গোবেচারা গ্যালোয়া হঠাৎ করেই অবাধ্য আচরণ শুরু করলো। সে শুধুই গণিত করবে, আর কোনো বিষয় তাঁর ধর্তব্যের মধ্যেই নেই! এরপর থেকে শুধু গণিত আর গণিত, দিনরাত সব এক করে দিয়ে ডুবে গেলো গণিতের সমুদ্রে।

কিছুদিনের মধ্যেই গোটা স্কুলে ছড়িয়ে গেলো, শিক্ষকদের কেউ আর গ্যালোয়াকে নতুন কিছু শেখাতে পারছেন না। অগত্যা গ্যালোয়া উপরের শ্রেণীর বই কোনোভাবে সংগ্রহ করে লেগে পড়লেন অধ্যয়নে। এবার হলো আরো বিপদ, পরীক্ষার খাতায় গ্যালোয়া যা লেখেন, তার কিছুই শিক্ষকেরা বুঝতে পারেন না। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর জন্য স্কুলজীবন কঠিন হয়ে আসে, তাঁর জন্য পাশ করাটাও হয়ে উঠলো দুঃসাধ্য!

১৮২৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁর প্রথম জার্নাল প্রকাশিত হলো, সেখানে তিনি কাজ করেছিলেন ‘থিওরি অফ ইকুয়েশনস’ নিয়ে। তাতে করে আরো একটু উদ্বুদ্ধ হলেন গ্যালোয়া, ততদিনে বুঝতে শুরু করেছেন নিজের প্রতিভার কথা। ফলে সেই প্রতিভার পরিপূর্ণ উন্মেষ ঘটানোর লক্ষ্যে আবেদন করলেন ইকল পলিটেকনিকে। তবে শুধু সেটাই একমাত্র কারণ ছিলো না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাতন্ত্রের পক্ষে বিশাল এক সমর্থক ঘাঁটি ছিলো, আর রাজনীতিতে প্রবলভাবে উৎসুক গ্যালোয়া তাতেই মনস্থ করে নিলেন, এখানেই পড়তে হবে!

পাখির চোখে ইকোল পলিটেকনিক; Image Source: bestdloadvi.cf

কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যায় ভাইভা বোর্ডে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মৌখিক একটা পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো গ্যালোয়াকে, আর সেখানে সব প্রশ্নের খুবই সংক্ষিপ্ত করে উত্তর দেওয়াতে উপস্থিত শিক্ষকেরা তাঁর উত্তরের থৈ পেলেন না। ফলে আশ্চর্য এক ব্যাপার ঘটে গেলো, সেবার তিনি সুযোগই পেলেন না ভর্তি হওয়ার!

কিন্তু ভর্তি তো তাঁকে হতেই হবে! তাই পরেরবার আবারও চেষ্টা করলেন। এবার দেখা গেলো, যিনি ভাইভা নিতে বসেছেন, মেধা কিংবা প্রতিভার বিচারে গ্যালোয়ার ধারেকাছেও তিনি নেই! ফলে এবারও গ্যালোয়ার উত্তরের কূলকিনারা না পেয়ে কপাল কুঁচকিয়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন ঐ শিক্ষক। রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় গ্যালোয়া এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, শিক্ষকের দিকে ছুড়ে মারলেন ডাস্টার। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, ইকলে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা চিরকালের জন্য শেষ হয়ে গেলো।

স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ গ্যালোয়া এবার কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন তাঁর গবেষণা নিয়ে। এবার ত্রিঘাত, চতুর্ঘাত এবং পঞ্চঘাত সমীকরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। অনেক খাটাখাটনি শেষে অবশেষে একটা সমাধানে পৌঁছুতে পারলেন, এরপর দুটো রিসার্চ পেপার তৈরি করে জমা দিলেন একাডেমি অফ সায়েন্সে। বিখ্যাত গণিতবিদ কশি (Augustin Louis Cauchy) রিসার্চ পেপারে গ্যালোয়ার কাজ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন; জানিয়ে দিলেন যে লেখাগুলো নিয়মানুসারে কোনোমতে সাজিয়ে আনতে পারলেই সেটা জার্নালে ছাপা হয়ে যাবে। গ্যালোয়ার মনে জমা হয়ে থাকা একরাশ দুঃখ-ক্ষোভ-হতাশা হঠাৎ বাষ্প হয়ে উবে গেলো। কশির মতো একজন বিখ্যাত গণিতবিদের থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন যে! দ্বিগুণ উৎসাহে কাগজপত্র নিয়মানুযায়ী সাজাতে শুরু করলেন গ্যালোয়া।

কশিই প্রথম বুঝতে পারেন, গ্যালোয়া একজন অসীম প্রতিভাবান গণিতবিদ; Image Source: Pinterest

কিন্তু বিধির ইচ্ছে ছিলো হয়তো অন্যরকম, হঠাৎই এক ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেলো সব। গ্যালোয়ার বাবা ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক, নিজ শহরে ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। আর সেই জনপ্রিয়তার ভেলায় ভাসতে ভাসতেই হয়ে গিয়েছিলেন শহরের মেয়র। রাজতন্ত্রের সমর্থক মৌলবাদী মানুষেরা এই জনপ্রিয়তাকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। ফলে একজন মৌলবাদী ধর্মযাজক গ্যালোয়ার বাবার বিরুদ্ধে নানাপ্রকার কুৎসা রটনা শুরু করে দিলেন, বেশ কিছু অশ্লীল কবিতা লিখিয়ে চারদিকে বিলি করে বেড়ালেন গ্যালোয়ার বাবার নামে। এলাকায় শুরু হয়ে গেলো তুলকালাম; ক্ষোভে-অপমানে আত্মহননের মাধ্যমে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সমাপ্তি টানলেন তিনি।

বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে এসে বিস্তারিত শোনার পর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন গ্যালোয়া, হাতেগোনা কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই ধর্মযাজকদের উপর। সেটা নিয়ে অসৎ ধর্মব্যবসায়ীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন, ছড়ালো সত্য-অসত্য নানারকম প্রোপাগান্ডা। রাজতন্ত্র এবং মৌলবাদের এই বিষাক্ত উদাহরণ দেখে গ্যালোয়ার মন বিষিয়ে গেলো। ঠিক করলেন, এবার চরমপন্থী হয়েই এই জঘন্য নিয়মরীতির শেষ টানবেন।

প্যারিসে ফিরে এসে গ্যালোয়া তাঁর সেই রিসার্চ পেপার দুটো পুরোপুরি প্রস্তুত অবস্থায় জমা দিলেন। জোসেফ ফুরিয়ারের কাছে গ্যালোয়ার কাজটিকে অসাধারণ বলে মনে হয়েছিলো, সবাই নিশ্চিত ছিলো যে ঐ বছরের সর্বোচ্চ পুরষ্কারটা তিনিই পাবেন। কিন্তু পুরষ্কার ঘোষণার সময় দেখা গেল, গ্যালোয়া কোনো পুরষ্কারই পাননি! বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে ফেললো, যখন জানা গেলো তাঁর জমা দেওয়া পেপারটির কোনো চিহ্নমাত্র নেই! তার কয়েক সপ্তাহ আগে জোসেফ ফুরিয়ার মারা যাওয়ার কারণে ঠিক কীভাবে পেপারটি লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে কেউ বলতে পারে না।

জোসেফ ফুরিয়ারের মৃত্যুর পর গ্যালোয়ার স্বপ্ন অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে; Image Source: Wikipedia

গ্যালোয়ার বুঝতে দেরি হল না যে রিপাবলিকের প্রতি অনুরাগের কারণেই তাঁর পেপারগুলো নিখোঁজ। পরের পেপারগুলোকেও ‘একাডেমিক অব সায়েন্স’ যখন যুক্তিপূর্ণ নয় ও অবোধগম্য বলে ফেরত পাঠিয়ে দিল, গ্যালোয়া নিশ্চিত হয়ে গেলেন, রাজনৈতিক কারণে তার গবেষণার কাজকে কখনোই উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হবে না। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রতিভার এহেন অবমূল্যায়ন মেনে নিতে পারেননি গ্যালোয়া, গণিত নিয়ে গবেষণা করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অতঃপর রাজনীতির দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়লে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যতম বেপরোয়া একজন হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮৩০ সারা দেশে রিপাবলিকানদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ছাত্রদেরকে সেই আন্দোলনে যোগ দিতে বিরত রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দরজা এবং ডরমিটরির দরজায় তালা মেরে সব ছাত্রদের ভেতরে আটকে রাখা হলো। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালককে ‘মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ’ বলে আখ্যায়িত করে প্রতিবেদন লিখলেন গ্যালোয়া, ফলশ্রুতিতে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হল।

উপায়ান্তর না দেখে গ্যালোয়া এবার যোগ দিলেন রিপাবলিকান আর্টিলারিতে। কিন্তু এক  মাসের মাথায় সেটিও যখন চলে গেলো, গ্যালোয়া তখন নিঃস্ব। অর্থ-বিত্ত-বন্ধুবিহীন অবস্থায় পথে পথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন তিনি; একসময়ের বেপরোয়া, দুর্বিনীত এক কিশোর ততদিনে অভাবের নিষ্ঠুর কষাঘাত সইতে শিখে গেছেন। তাঁকে সাহায্যের কেউ নেই, অনুপ্রেরণার কেউ নেই, কাঁধে হাত রেখে কথা বলার মতো কেউ নেই; এত বড় একটা পৃথিবীতে তেজস্বী এই মানুষটি বড্ড একাকী।

এমন অবস্থায় হঠাৎ তিনি আরো বেশি আগ্রাসী এবং বেপরোয়া হয়ে উঠলেন; চরমপন্থী ভাবটা এবার প্রকাশিত হলো দারুণভাবে। সেটা এতোটাই যে, হঠাৎ একদিন ফ্রান্সের সম্রাটকে খুনের হুমকি দিয়ে বসলেন তিনি! স্বভাবতই গ্রেফতার হওয়াটা কেউ আটকাতে পারেনি। তবে বয়স নিতান্তই কম হওয়াতে সে যাত্রায় ক্ষমা পেয়ে যান তিনি। তবে তাতে তাঁর থোড়াই কেয়ার! এক মাসের মাথায় আবারও গ্রেফতার হয়ে গেলেন তিনি দেশদ্রোহের দায়ে। কারণ নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ন্যাশনাল গার্ডের পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এদিক-সেদিক। সেটিকে রাষ্ট্র ঠিক সহজভাবে নিতে পারেনি; ফলাফল ছয় মাসের হাজতবাস। সেখানে রীতিমতো প্রতিদিন তাঁর জীবনের উপর হুমকি এসেছে, তবে ঠিকই বেঁচে গেছেন কোনোরকমে।

তবে পুরো ছয় মাস জেলহাজতে তাঁকে কাটাতে হয়নি। হঠাৎ জেলখানায় মহামারী শুরু হওয়াতে জীবন রক্ষার্থে কয়েদীদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়, আর সেই তালিকায় ছিলেন তিনিও। এরপর বেশ কিছুদিন তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে উড়ো খবর শোনা যায়, কোনো এক নারী চিকিৎসকের সঙ্গে নাকি তাঁর মন দেয়া-নেয়া চলছে। ভবঘুরে-নিঃস্ব-রগচটা এই মানুষটির সঙ্গে কারো গভীর প্রণয়ের কথা শুনে ঠিক বিশ্বাস করে ওঠা যায় না প্রথম দফায়, তবে সেই গুজব যে কতটা ‘নিদারুণ’ বাস্তবতা ছিলো, সেটা ইতিহাসে লেখা রয়েছে রক্তাক্ত হরফে।

সেই চিকিৎসকের নাম ছিলো স্টেফানি ফেলিসিয়া, তিনি আবার প্যারিসের পেশ্যুঁ ডি’হারবিনভিল নামক এক অভিজাত ব্যক্তির বাগদত্তা। আর নিজের বাগদত্তার সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক থাকাটার পরিণতি তখন একটিই, ডুয়েল। ঘটনাক্রমে পেশ্যুঁ ছিলেন অত্যন্ত চৌকষ একজন শ্যুটার, তবে হার মানলেন না গ্যালোয়াও। স্টেফানির কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলেন তিনি; জানিয়ে দিলেন, ডুয়েলে লড়তে তিনি রাজি।

ডুয়েলের ঠিক আগের রাতে গ্যালোয়া বুঝতে পারলেন, এটাই হয়তো তাঁর জীবনের শেষ রাত। কিন্তু তিনি মারা গেলে তাঁর সারাজীবনের এত গবেষণা, এত অসাধারণ সব অরিজিনাল রিসার্চ, সবকিছু যে নিস্ফল হয়ে যাবে! কিচ্ছু যে জানতে পারবে না কেউ কোনোদিন, তিনিও হারিয়ে যাবেন কালের গর্ভে! তাই ঠিক করলেন, নিজের সব কাজকে লিপিবদ্ধ করে যাবেন তিনি। হোক সেটা সংক্ষিপ্ত, তবু সেগুলো লিখে রেখে যেতেই হবে। সুতরাং আর দেরি করলেন না গ্যালোয়া, লিখতে শুরু করলেন নিজের আবিষ্কৃত উপপাদ্যগুলো। লিখতে লিখতে চুল ছিঁড়ছেন, বারবার ঘড়ি দেখছেন, কখনও খাতার এক অংশে লিখছেন “সময় নেই, একেবারে সময় নেই হাতে”। মাঝে মাঝে লিখছেন স্টেফানির নাম, কখনও হা-হুতাশ করছেন জীবন নিয়ে, আবার ফিরে আসছেন উপপাদ্যেই। সারারাতের কঠোর পরিশ্রমশেষে কোনোক্রমে সকল উপপাদ্যগুলো একসাথে করে এক বন্ধুকে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। অনুরোধ করলেন ইউরোপের বিখ্যাত সব গণিতবিদদের কাছে যেন সেগুলো জমা দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব ঠাহর করে উঠতে না পারলেও তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।

ডুয়েলের আগের রাতে গ্যালোয়ার লেখা এক টুকরো কাগজের ছবি; Image Source: imgur.com

১৮৩২ সালের ৩০ মে। একটি নির্জন মাঠে গ্যালোয়া এবং পেশ্যুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো অস্ত্র উঁচিয়ে। বোঝা গেলো, তাঁরা ডুয়েলে লড়তে প্রস্তুত। জীবনমরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে গ্যালোয়া চারপাশে খুঁজলেন স্টেফানিকে। হা হতোস্মি, কোথায় সে! হতাশ, ক্রুদ্ধ, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ গ্যালোয়া সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিলেন নিজের পরিণতি। ডুয়েল শুরু হলো, গ্যালোয়া এবং পেশ্যুঁ একজন আরেকজনের দিকে গুলি ছুড়লেন। কিছুক্ষণ পর পেশ্যুঁর গগনবিদারী অট্টহাস্যে যখন কেঁপে উঠলো শহর, গ্যালোয়াকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখলো সবাই। মাত্র বিশ বছর বয়সে যবনিকাপাত হলো তেজস্বী, খামখেয়ালী অথচ দারুণ প্রতিভাবান এক গণিতবিদের মূল্যবান জীবনের।

সত্যিই কি গ্যালোয়াকে ভালোবেসেছিলেন স্টেফানি? ভালোবাসলে সেদিন ডুয়েলে কেন উপস্থিত ছিলেন না তিনি? কেন বাধা দেননি গ্যালোয়াকে? পেশ্যুঁ কি সত্যিই স্টেফানির বাগদত্তা ছিলেন? নাকি সবই ছিলো গ্যালোয়াকে হত্যার পেছনে সাজানো এক নাটকের অংশ? সেটা জানার উপায় নেই আর। তবু সবাই এখন জানে, বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিভাবান গণিতবিদদের একজন এই গ্যালোয়া মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন স্টেফানির জন্য, ভালোবাসার জন্য।

হ্যামিল্টনের তুলিতে সেই ডুয়েল; Image Source: Time.com

এরপর কেটে গেছে  আরো দশ বছর। কেউ সেই কাগজগুলোকে ঘেঁটে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি, কিংবা ঘাঁটলেও হয়তো কূলকিনারা করে উঠতে পারেননি। অবশেষে সেটা করতে পেরেছিলেন জোসেফ লিউভিল; মেধাবী এই গণিতবিদ কাগজগুলো ঘেঁটে লেখাগুলোর মর্মোদ্ধার করে গ্যালোয়ার নামেই প্রকাশ করলেন দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত জার্নালে। যখন গবেষণাগুলো তাবৎ দুনিয়ার সব গণিতবিদদের সামনে এলো, সবিস্ময়ে সকলে প্রত্যক্ষ করলেন ক্ষণজন্মা এক গণিতবিদের অবিস্মরণীয় সব আবিষ্কার।

রগচটা, খামখেয়ালি, একরোখা এবং অদ্ভুতরকম আগ্রাসী এক তরুণ এভারিস্তে গ্যালোয়া সকলের স্বীকৃতি এবং ভালোবাসা দুটোই পেয়েছিলেন বটে, তবে বড্ড দেরিতে।

ফিচার ইমেজ © Selunec (Anastasia)

Related Articles