২০ শতকের বিখ্যাত ফরাসি লেখক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে বিখ্যাত হয়ে আছেন তার অস্তিত্ববাদ বিষয়ক দর্শনের জন্য। দর্শনের ইতিহাসে তার ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ বইটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর একটি। এ বইয়ের জন্য তিনি পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারও। অথচ ব্যক্তিগত দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক অভিহিত করে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি! ইতিহাসে তার মতো এরকম সাহস কেবল দেখাতে পেরেছিলেন আর একজন ব্যক্তিই। যা-ই হোক, সেসব পরে জানবো। এই লেখায় আমরা মূলত সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
‘একজিসটেনশিয়ালিজম’ বা অস্তিত্ববাদে যাবার আগে ‘এসেনশিয়ালিজম’ সম্পর্কে জানতে হবে। এসেনশিয়ালিজম শব্দটির কাছাকাছি বাংলা অর্থ হতে পারে সারবাদ বা সারাংশবাদ। আপনি কখনো “জীবনের অর্থ কী” এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন? যদি হয়ে থাকেন তাহলে এটা নিশ্চিত যে হুট করেই কোনো উত্তর আপনি দিতে পারেননি। কিংবা চিন্তা-ভাবনা করে উত্তর দিয়েও আদতে নিজের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। কারণ আপনার দলেই আছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ! জীবনের অর্থ বলতে কেউ বলবে প্রেম, কেউ বলবে ঈশ্বর, আবার কেউ বলবে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আসাটাই জীবনের অর্থ। প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে সহজ উত্তর এটিই। পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রতিটি জীব/জড়ের একটি নির্দিষ্ট পরিচয়, সত্ত্বা কিংবা নির্যাস রয়েছে যা তার অস্তিত্বের অর্থ বহন করে। এই ভাবনাকে বলা হয় এসেনশিয়ালিজম। একটি চাকুর হাতল কাঠের বা লোহার হতে পারে। কিন্তু কেবল হাতলের সাথে যদি কোনো ব্লেড না থাকে, তাহলে সেটিকে কেউ চাকু বলবে না। কারণ ব্লেড হচ্ছে চাকুর পরিচায়ক নির্যাস। আবার মানুষ বুদ্ধি, বিবেক নিয়ে পৃথিবীতে আসে বলে সে মানুষ। বুদ্ধি না থাকলে দর্শনের ভাষায় বলায় যায় মানুষ হিসেবে তার ‘এসেন্স’ নেই। আমরা সাধারণত বলে থাকি লোকটি অন্তঃসারশূন্য।
যারা জীবনের অর্থ নিয়ে ভাবেন না, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু অনেক মানুষ আমৃত্যু জীবনের অর্থ খুঁজতে থাকেন এবং ব্যর্থতা নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করেন। এক্ষেত্রে ভাবুকদের সহায়তায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এসেনশিয়ালিজম নামক এই দার্শনিক মতবাদের প্রবর্তন করেন প্লেটো এবং তার শিষ্য অ্যারিস্টটল। এই তত্ত্ব বলে যে, প্রতিটি বস্তুকে নিজের অস্তিত্ব অর্থবহ করতে হলে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য বহন করতে হয়। চাকুর উদাহরণে এটি স্পষ্ট হবার কথা। প্লেটোর মতে, মানুষের জীবনের অর্থ এই যে সে মানুষ। মানুষের মাঝে মানবীয় গুণাবলী তার অস্তিত্বকে সার্থক করে। সকল মানুষের মাঝেই সেসব গুণাবলী রয়েছে। যারা এসব গুণাবলীর সদ্যবহার করে, তাদের আমরা সৎ মানুষ বলি। বিপরীত দিকে রয়েছে অসৎ মানুষ।
দর্শন হচ্ছে বহমান নদীর মতো, যা সময়ের সাথে সাথে বাঁক পরিবর্তন করে। পূর্বসূরীর করে যাওয়া চিন্তা-ভাবনার সূত্র ধরেই নতুন চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব হয়। ১৯ শতকে যেমন জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশের হাত ধরে এলো ‘নায়ালিজম’ বা ধ্বংসবাদ, যা বিশ্বাস করে সবকিছুর চূড়ান্ত অর্থহীনতায়। নিটশের এই তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় পরের শতকেই সুপ্রাচীন এসেনশিয়ালিজমের দিকে আঙ্গুল তোলেন জাঁ পল সার্ত্রে। তার মতে, আমাদের অস্তিত্ব আমাদের পরিচয়ের অগ্রবর্তী। অর্থাৎ, মানবীয় গুণাবলীর মতো উপাদানগুলোর পূর্বে আমাদের অস্তিত্ব জরুরি। অস্তিত্ব লাভ করে তবেই আমরা নিজেদের জীবনের অর্থ খুঁজি। তার এই ভাবনাই ‘একজিসটেনশিয়ালিজম’ নামক দর্শনের নতুন ধারার কাঠামো তৈরি করে।
সার্ত্রের এ ভাবনা খুব সহজ মনে হলেও সে সময় তা ছিল বৈপ্লবিক। কারণ, এসেনশিয়ালিজমে বিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাস করতো তারা নিজেদের পরিচয় নিজেরা সৃষ্টি করে না, বরং সৃষ্টিকর্তা সব ঠিক করে দেন। কিন্তু অস্তিত্ববাদ মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়। এটুকু পড়ার পর যে কেউ ভাববেন যে, অস্তিত্ববাদ পুরোপুরি নিরীশ্বরবাদী। এই ভাবনাটা অমূলক নয় যতক্ষণ না আপনি আরো বিস্তারিত জানবেন। অস্তিত্ববাদ কেন নাস্তিকতার অনুরূপ নয়, তা বুঝতে হলে জানতে হবে ‘টিলিওলজি’ বা পরমকারণবাদ কী। পরমকারণবাদের মূল কথা হচ্ছে আনুষঙ্গিক সকল কার্যকরণ বাদ রেখে কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা কেবলই এর উদ্দেশ্য দিয়ে করতে হবে। মানুষের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে পরমকারণবাদের বক্তব্য অনেকটা এরকম, “সৃষ্টিকর্তা কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পৃথিবী এবং মানুষ সৃষ্টি করেছেন।”
অস্তিত্ববাদ সরাসরি পরমকারণবাদকে অস্বীকার করে। অস্তিত্ববাদের দাবি হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী এবং মানুষ কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে সৃষ্টি করেননি। অর্থাৎ, অস্তিত্ববাদ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। আর এখানেই সমস্যা জটিলতর হতে শুরু করে। যখনই আপনি পরমকারণবাদ অস্বীকার করবেন, তখনই পৃথিবীতে আপনার যাবতীয় কর্মকাণ্ড এমনকি অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে পড়বে। সহজ ভাষায় বললে, সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে না রেখে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে পৃথিবীতে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী? নির্দিষ্ট সময়কাল পর প্রতিটি মানুষই মৃত্যবরণ করে। সেক্ষেত্রে পরমকারণবাদ অস্বীকার করা মানে মৃত্যুপরবর্তী সৃষ্টিকর্তার কোনোরূপ জবাবদিহিতায় বিশ্বাস না করা। আর যদি ব্যাপারটা এরূপই হয়ে থাকে (যা প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক), তাহলে পৃথিবীতে সততা আর ন্যায়ের মতো ব্যাপারগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে তৈরি হয় নতুন এক সমস্যা, যার নাম ‘অ্যাবসারডিটি’ বা অর্থহীনতা। দর্শনের দৃষ্টিতে এই অর্থহীনতার অর্থ প্রচলিত অর্থের মতো নয়। অর্থহীনতা হচ্ছে অর্থহীন পৃথিবীতে নিরন্তর অর্থ খোঁজা, নিরুত্তর পৃথিবীতে প্রাণপণে উত্তর খোঁজা। একদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ায় সকল প্রকার ন্যায়, ন্যায্যতা, নিয়ম শৃঙ্খলা, আইনকানুন অর্থহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই আবার নিরন্তর অর্থ খুঁজে চলে। যেকোনো কাজের পেছনে অর্থ খুঁজে না পেলে মানুষ সে কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে। অস্তিত্ববাদের এ অংশের অসাড়তা দূর করতে সার্ত্রে হাজির করেন ‘অথেনটিসিটি’ বা প্রামাণিকতার গুরুত্ব।
একদিকে অস্তিত্ববাদ বলছে জীবনের কোনো অর্থ নেই, পৃথিবীর কোনো অর্থ নেই। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রতিনিয়ত অর্থ প্রয়োজন। সার্ত্রে বেঁচে থাকার এই অপরিহার্য উপাদান অর্থের খোঁজ পেয়েছেন প্রামাণিকতা থেকে। তার মতে, একজন মানুষের জীবনের অর্থ তা-ই যা সে নিজে তৈরি করে নেয়। একজন মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য তা-ই, যা সে নিজে সৃষ্টি করে নেয়। সার্ত্রে এখানে একটি চমৎকার উদাহরণ ব্যবহার করেছেন।
মনে করুন, রহিম নামক এক যুবক যুদ্ধে যেতে চায়। আবার বাড়িতে নিজের একাকী বৃদ্ধ মা কে ফেলে যেতেও তার মন সায় দেয় না। সে যদি যুদ্ধেই যায় শেষতক, তাহলে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে, যদিও তার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ খুব একটা প্রভাব ফেলবে না যুদ্ধের ফলাফলের উপর। কিন্তু সে যদি যুদ্ধে না গিয়ে মায়ের সেবা করে, তাহলে একজন মানুষ সর্বাত্মকভাবে উপকৃত হবেন, কিন্তু সামষ্টিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরকম সমস্যার সমাধান পৃথিবীর কেউ দিতে পারবে না রহিম নিজে ছাড়া। যুদ্ধে যাওয়া অথবা মায়ের সেবা করা, রহিম যে সিদ্ধান্তই নেবে সেটি হবে তার জন্য অর্থবহ। অন্য কথায়, রহিম নিজের জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য নিজের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই নির্ধারণ করবে।
এক্ষেত্রে রহিম দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পরের সাথে তুলনা করে, প্রামাণিকতা বিবেচনা করে একটি গ্রহণ করতে পারবে। তাই অস্তিত্ববাদে পৃথিবী ততক্ষণ অর্থহীন এবং উদ্দেশ্যহীন যতক্ষণ না মানুষ সেখানে কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য সৃষ্টি করে নিচ্ছে। একই বক্তব্য পৃথিবীতে শৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য উদ্ভব হওয়া নীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রেও সত্য। পৃথিবীকে শৃঙ্খলাপূর্ণ রাখতে মানুষই ন্যায়-নীতি, সততা আর ন্যায্যতার মতো ব্যাপারগুলো সৃষ্টি করেছে। একজন মানুষ যখন ডাক্তার হয়, তখন সে মানুষের চিকিৎসা করাকে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নিজে ঠিক করে নেয়। তার জীবনের গতিপথ পূর্বনির্ধারিত নয়। অন্তত অস্তিত্ববাদ তাই বলে। অস্তিত্ববাদ বিষয়ক উপরোক্ত সম্পূর্ণ আলোচনার সারকথা ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কামুর একটি উক্তিতে ফুটে উঠেছে।
“জীবনের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আমরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে যা কিছু করি তা-ই।”- আলবেয়ার কামু
জাঁ পল সার্ত্রের আরেকটি অসাধারণ কাজ হচ্ছে ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’। এই বইয়ে তিনি সকল ঘটনার পেছনে দুটি বাস্তবতা আছে বলে উল্লেখ করেন। একটি হচ্ছে সত্তা এবং অন্যটি চেতনা। একদিকে থাকে আমাদের চেতনা তৈরি করার বস্তুগত সত্তা, অন্যদিকে থাকে সেই সত্তা হতে সৃষ্ট চেতনা বা জ্ঞান। সার্ত্রে এক্ষেত্রে দুটি নাম ব্যবহার করেছেন। ‘দ্য বিং ইন ইটসেলফ’ যা হচ্ছে সত্তা নিজে এবং ‘দ্য বিং ফর ইটসেলফ’ যা হচ্ছে সত্তার জন্য সৃষ্ট চেতনা। অর্থাৎ, মোটা দাগে দুটি বিষয় পৃথিবীতে বিরাজমান। একটি হচ্ছে ‘থিং’ বা সত্তা/জীব/পদার্থ/বস্তু এবং অপরটি হচ্ছে ‘নো-থিং’ (Nothing= No thing) বা চেতনা, যা কোনো বস্তু নয়।
সার্ত্রে তার অস্তিত্ববাদের জন্য নানামুখী সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক সমালোচকের চোখে তার দার্শনিক যুক্তিতর্ক অনেকাংশে অধিবিদ্যার উপর নির্ভরশীল, যদিও সার্ত্রে সবসময় দাবি করেছেন তার দর্শনের সাথে অধিবিদ্যার সম্পর্ক নেই। ব্রায়ান সি এন্ডারসন নামক একজন আমেরিকান লেখক তো সার্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে দাবি করেন যে তিনি স্টালিনিজম ও মাওইজমের সমর্থক! তার যুক্তি এরূপ ছিল যে, অস্তিত্ববাদ দ্বারা সার্ত্রে পৃথিবীর সবকিছুকে অর্থহীন প্রমাণ করার মাধ্যমে স্টালিন আর মাও সে তুং এর মতো ব্যক্তিদের ধ্বংসযজ্ঞের সাফাই গেয়েছেন! তবে সার্ত্রে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন ফ্রাঞ্জ ফানোর ‘দ্য রেচড অব দ্য আর্থ’ বইয়ের মুখবন্ধ লিখে। এই মুখবন্ধে তিনি নিম্নোক্ত উক্তিটি করেন-
“একজন ইউরোপীয়কে গুলি করা মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারা! এতে একজন অত্যাচারী এবং একজন অত্যাচারিত ব্যক্তি ধ্বংস হয়, আর অবশিষ্ট থাকে একটি মৃতদেহ এবং একজন স্বাধীন মানুষ!”- জাঁ পল সার্ত্রে
সার্ত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করা হলো।
১) নওসিয়া
২) এজ অব রিজন
৩) নো এক্সিট
৪) ডার্টি হ্যান্ডস
৫) ডেভিলস অ্যান্ড দ্য গুড লর্ড
৬) সার্ত্রে (আত্মজীবনী)
৭) দ্য ট্রান্সেন্ডেন্স অব দ্য ইগো
৮) দ্য ইমাজিনারি
৯) বিং অ্যান্ড নাথিংনেস
১০) ক্রিটিক অব ডায়ালেকটিক্যাল রিজন
১১) অ্যান্টি সেমেটিক অ্যান্ড জ্যু (সমালোচনা)
১২) সিচুয়েশনস ১-১০ (সমালোচনা)
জাঁ পল সার্ত্রে ১৯০৫ সালের ২১ জুন ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার বাবা মারা গেলে তার মা তাকে নিজের পৈতৃক নিবাসে নিয়ে যান। সার্ত্রের নানাবাড়িতে ছিল দর্শনের বইয়ে সমৃদ্ধ এক বিশাল লাইব্রেরি, যা মূলত তার দার্শনিক হয়ে ওঠার বড় প্রভাবক। স্থানীয় স্কুল মাধ্যমিক শেষ করে তিনি ‘ইকোল নহমাল সুপেহাইয়ো’ কলেজে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষার জন্য। ততদিনে তিনি ইমানুয়েল কান্ট, হাইডেগার, হুসার্ল, হেগেল আর দেকার্তের মতো দার্শনিকদের দর্শন পড়ে ফেলেছেন। ইকোলে পড়ার সময়ই তার বন্ধুত্ব হয় বিখ্যাত দার্শনিক এবং নারীবাদী সাইমন ডি বিউভয়েরের সাথে।
১৯৩৯ সালের দিকে ফরাসি সৈন্যবাহিনীর সাথে যোগ দেন সার্ত্রে। এক বছরের মাথায়ই নাৎসিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বন্দী হন। প্রায় ৯ মাস বন্দী থাকার পর তার দার্শনিক জ্ঞানের জন্য নাৎসিরা তাকে ছেড়ে দেয় এবং একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চালাকালেই তার ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ ও ‘নো এক্সিট’ প্রকাশিত হয়। ষাটের দশক থেকে তিনি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠেন। তিনি কিউবা ভ্রমণ করেন এবং ক্যাস্ট্রো ও গুয়েভারার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার কলম এবং কণ্ঠ থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হতো। এরই মাঝে তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল নোবেল কমিটি। তিনি এই উক্তিটির মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
“আমি সবসময় আনুষ্ঠানিক সম্মাননা নিতে অস্বীকৃতি জানাই। একজন লেখকের নিজেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা উচিৎ না। আমার এই মনোভাব, লেখক হিসেবে আমার কর্মোদ্দম থেকে তৈরি হয়েছে। একজন লেখক যিনি সাহিত্যিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণ করেন, তাকে অবশ্যই নিজের স্ব-কর্মক্ষেত্রের ভেতরেই থাকা উচিৎ, আর তা হচ্ছে লেখা।”
সার্ত্রের জীবন সম্পর্কে দর্শন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। তিনি মনে করতেন, তার কলম যতটুকু প্রতিবাদী হবে, তার নিজেকে ঠিক ততটুকুই প্রতিবাদী হতে হবে। এজন্যই তিনি আমৃত্যু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন, যোগ দিয়েছেন অসংখ্য আন্দোলন আর প্রতিবাদে। তিনি বিয়েতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার আমৃত্যু জীবনসঙ্গী বিউভয়ের এবং তিনি, উভয়েই বহুগামীত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সত্তরের দশকে সার্ত্রের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ১৯৭৩ সালে তিনি দর্শনক্ষমতা হারিয়ে অন্ধ হন। ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল, বিউভয়েরের মৃত্যুর ৩ মাস পর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সার্ত্রে। প্যারিসের মন্টপারনাসে সমাধিক্ষেত্রে বিউভয়েরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
ফিচার ছবি: the-philosophy.com