স্মৃতিভ্রম বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কখনও সেটা হতে পারে দুর্ঘটনাজনিত কারণে, কখনো হতে পারে জন্মগতভাবেই, আবার কখনও হতে পারে বার্ধক্যজনিত কারণে। সাধারণ মানুষের মতোই বিখ্যাত ব্যক্তিরাও হতে পারেন এই স্মৃতিভ্রমের শিকার। চলুন দেখে নেই বিশ্ববিখ্যাত পাঁচ ব্যক্তির অদ্ভুত কিছু স্মৃতিভ্রমের কাহিনী।
১) আগাথা ক্রিস্টি
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আগাথা ক্রিস্টি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রহস্যোপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম। তার গোয়েন্দা কাহিনীগুলো আজও বিশ্বব্যাপী মানুষকে মুগ্ধ করে। কিন্তু শুধু তার লেখা উপন্যাসে না, তার বাস্তব জীবনেও ঘটেছিল এক রহস্যময় ঘটনা, যে ঘটনার পরিষ্কার ব্যাখ্যা তিনি নিজেও দিয়ে যেতে পারেন নি।
১৯২৬ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে, ৩৬ বছর বয়সী আগাথা ক্রিস্টি রহস্যজনকভাবে তার ইংল্যান্ডের সানিংডেলের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। পরের দিন সকালে তার গাড়িটি বাসা থেকে এক ঘন্টার দূরের নিউল্যান্ডের একটি রাস্তার পাশে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু তার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগাথা ক্রিস্টির অন্তর্ধান রহস্য সে সময় সমগ্র ইংল্যান্ডব্যাপী বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে। যখন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, ক্রিস্টির স্বামী আর্চিবাল্ড সম্প্রতি তাকে ডিভোর্স দেওয়া জন্য জোরাজুরি করছিলেন, তখন মানুষ সন্দেহ করতে থাকে যে, তিনি হয়তো ক্রিস্টিকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলেছেন।
প্রায় ১১ দিন নিখোঁজ থাকার পর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে আগাথা ক্রিস্টির সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি টেরেসা নীলি নাম নিয়ে নিকটবর্তী হ্যারোগেট শহরের একটি হোটেলে বসবাস করছিলেন। তিনি দাবি করেন, তার স্মৃতিভ্রম হয়েছে। তিনি কীভাবে সেখানে গিয়েছেন, কেনই বা ভিন্ন নামে সেই হোটেলে উঠেছেন, কিছুই তার মনে নেই।
ক্রিস্টির নিঁখোজ হওয়ার এই রহস্য কখনওই সমাধান হয়নি। সে সময় অনেকে সন্দেহ করেছিল, তিনি হয়তো নিজেই প্রচারণার জন্য নিখোঁজ হওয়ার নাটক সাজিয়েছিলেন। অনেকে আবার এর পেছনে মধ্যে দাম্পত্য কলহ এবং পরকীয়াকেও দায়ী করেন। কারণ ক্রিস্টি যে ছদ্মনামে হোটেলে উঠেছিলেন, সেই টেরেসে নীলি নামটি তার স্বামীর পরিচারিকার নাম। অনেকে তাই ধারণা করে, ক্রিস্টির স্বামী হয়তো তার পরিচারিকার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেজন্যই স্বামীর উপর প্রতিশোধ নিতে এবং স্বামীকে মানসিকভাবে চাপে ফেলতেই ক্রিস্টি ইচ্ছে করে নিখোঁজ হয়েছিলেন।
তবে এতকিছুর পরেও একটি সম্ভাবনা থেকেই যায় যে, আগাথা ক্রিস্টির আসলেই স্মৃতিভ্রম ঘটেছিল। যেদিন তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেদিন সকালে এক প্রত্যক্ষদর্শী তাকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখেছিল। তার বর্ণনা অনুযায়ী, ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতেও ক্রিস্টির পরনে ছিল খুবই পাতলা একটি জামা। তার চেহারা ছিল বিভ্রান্ত এবং হাঁটার ভঙ্গিও ছিল অস্বাভাবিক। অনেকে তাই এক ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন যে, আগাথা ক্রিস্টির মায়ের সাম্প্রতিক মৃত্যুর ঘটনা এবং তার ডিভোর্সের জন্য স্বামীর জোরাজুরি, তার মধ্যে মানসিক অবসাদগ্রস্ততা সৃষ্টি করেছিল। এমন সময় যাত্রাপথে তার গাড়িটি আঘাত পেয়ে বিকল হয়ে গেলে তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, ফলে তার সাময়িক স্মৃতিভ্রম ঘটে।
২) রোনাল্ড রিগ্যান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ক্ষমতা ছাড়ার পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৯৪ সালে, ৮৩ বছর বয়সী রিগ্যান যখন আলঝেইমার রোগের জন্য চিকিৎসা নিতে শুরু করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে, ঠিক কবে তিনি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকা অবস্থাতেই রোনাল্ড রিগ্যানের মানুষের নাম মনে করতে সমস্যা হতো। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, একবার তিনি তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রকে প্রধানমন্ত্রী জর্জ বুশ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এছাড়াও সাবেক হোয়াইট হাউজ সংবাদদাতা লেসলি স্টেহলও তার লেখা বই ‘রিপোর্টিং লাইভ’এ প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে একই রকম ধারণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ১৯৮৬ সালে তিনি যখন একদিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, তখন এক পর্যায়ে তার কাছে মনে হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট তাকে আর চিনতে পারছেন না। লেসলি বলেন, সেই অনুষ্ঠানে তিনি প্রায় ঘোষণাই করে ফেলতে যাচ্ছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট পুরোপুরি সুস্থ নয়। কিন্তু সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার আগেই রিগ্যান আবার তার সচেতনতা ফিরে পেয়েছিলেন।
রোনাল্ড রিগ্যানের চিকিৎসকরা অবশ্য সব সময়ই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। তাদের বক্তব্য, প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় রিগ্যান সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। তিনি আলঝেইমারে আক্রান্ত হন ক্ষমতা ছাড়ার অনেক পরে। ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই রিগ্যান বেশি জনসমক্ষে আসতেন না, আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে আসা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তার স্মৃতিভ্রষ্টতা ঠিক কতটুকু প্রকট, সেটা সাধারণ মানুষ কখনোই পুরোপুরি জানতে পারেনি।
৩) হ্যারিসন ফোর্ড
বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড একইসাথে একজন অভিজ্ঞ পাইলটও। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে তিনি তার নিজের সংগ্রহে থাকা দুই আসন বিশিষ্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি যুদ্ধ বিমান চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন। সে সময় তাকে প্রায় এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। তার দুর্ঘটনা এবং হাসপাতালে থাকার সংবাদাটি মিডিয়ার কল্যাণে সবাই জানলেও তিনি যে সে সময় স্মৃতিভ্রমে ভুগেছিলেন, সেটি কেউ জানত না। ঘটনার প্রায় সাত মাস পরে জনপ্রিয় টিভি শো ‘জিমি কিমেল লাইভ’এ তিনি সর্বপ্রথম এ তথ্যটি প্রকাশ করেন।
তিনি জানান, উড়ন্ত অবস্থায়ই প্লেনটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তখন নিকটবর্তী এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার তাকে কীভাবে প্লেনটিকে অবতরণ করাতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেন।
ফোর্ড জানান, ইঞ্জিন বিকল হওয়া, কন্ট্রোলারের সাথে যোগাযোগ হওয়া, তাদের পরামর্শ, এসবই তার মনে আছে। এমনকি তার কাছে যে পরামর্শটা বাস্তব সম্মত মনে হয়নি এবং সেটি যে তিনি কন্ট্রোলারকে জানিয়েছিলেন, তা-ও তার মনে আছে। কিন্তু এরপর তিনি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বা ঠিক কীভাবে ল্যান্ড করেছিলেন, তার কিছুই তার স্মৃতিতে নেই।
বাস্তবে হ্যারিসন ফোর্ড যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি রানওয়ে পর্যন্ত যেতে পারবেন না, তখন বাধ্য হয়ে তিনি নিকটবর্তী একটি গলফ খেলার মাঠেই প্লেনটিকে ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর এতেই প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়। গুরুতর আহত ফোর্ডের জ্ঞান ফেরে পাঁচদিন পরে। আর মাঝখান থেকে হারিয়ে যায় অজ্ঞান হওয়ার আগের কিছু সময়ের স্মৃতি।
৪) স্টিভ ওয়াজনিয়াক
বিশ্ববিখ্যাত অ্যাপল কোম্পানীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওয়াজনিয়াকও বিমান দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে স্মৃতি হারিয়েছিলেন। কিন্তু তার ঘটনাটা ছিল হ্যারিসন ফোর্ডের চেয়েও আরও মারাত্মক।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি এবং তার পরিবারের তিন সদস্য বিমান দুর্ঘটনার শিকার হন। বিমানটি তিনিই চালাচ্ছিলেন। মাটি ছেড়ে উড়তে শুরু করার সাথে সাথেই এর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় এবং এটি রানওয়ের উপর আছড়ে পড়ে। স্টিভ, তার স্ত্রী, ভাই এবং ভাইয়ের প্রেমিকা সবাই গুরুতর আহত হন।
স্টিভের মুখে এবং মাথায় দারুণভাবে আঘাত লাগে। তার একটি দাঁত পড়ে যায়। দুর্ঘটনার পর থেকে পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি বিশেষ ধরনের স্মৃতিভ্রমে ভোগেন, যাতে মস্তিষ্ক নতুন কোনো স্মৃতি নির্মাণ করতে সক্ষম হয় নি। দুর্ঘটনার সম্পূর্ণ স্মৃতি তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়। এমনকি হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে তিনি নিজের নামও মনে করতে পারেননি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও তিনি হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ের স্মৃতি মনে করতে পারতেন না। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে তার স্মৃতিশক্তি আবার ফিরে আসে।
৫) ব্র্যাড পিট
হলিউড অভিনেতা ব্র্যাড পিট বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একটি। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তার চেহারার সাথে পরিচিত। কিন্তু তিনি কি তার ভক্তদেরকে চেনেন? না, চেনার কথাও না। তবে সেটা আশ্চর্যজনক না, আশ্চর্যজনক হচ্ছে তার পরিচিতদেরকে চিনতেও তার অনেক সময় সমস্যা হয়। সিএনএন-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিখ্যাত এই অভিনেতা মনে করেন, তিনি প্রাসোপ্যাগনোশিয়া রোগে আক্রান্ত।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র চেহারা দেখে দুজন মানুষকে পৃথকভাবে চিনতে পারেন না। অর্থাৎ তারা ভিন্ন ভিন্ন চেহারার পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্যগুলো সনাক্ত করতে পারেন না। একজন মানুষকে অন্য একজনের থেকে আলাদা করে চেনার জন্য তাদেরকে চেহারা ছাড়াও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য উপাদানের সাহায্য নিতে হয়। যেমন: ব্যক্তির কন্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, দৈহিক গঠন ইত্যাদি।
ফিচার ইমেজ- videoblocks.com