Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লরেন্স অব অ্যারাবিয়া: আরব বিদ্রোহে অটোমান সাম্রাজ্যে ত্রাস ছড়ানো যোদ্ধা

“সবাই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সবার স্বপ্ন সমান নয়। যারা রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, তারা দিনের বেলা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে অসার জ্ঞান করে। কিন্তু যারা দিনের বেলা স্বপ্ন দেখে, তারা ভয়ানক প্রকৃতির মানুষ! তারা চোখ খোলা রেখে স্বপ্ন দেখে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে চলে, সফল হয়। যেমনটা আমি করেছি!”- টি. ই. লরেন্স, সেভেন পিলারস অব উইজডম

উপরের কথাগুলো বেশ পরিচিত লাগছে কী? লাগারই কথা, যদি আপনি চোখ কান খোলা রেখে থাকেন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের এরকমই একটি উক্তি সাম্প্রতিককালে ঘন ঘন দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এবং মোটিভেশনাল স্পিচেও শোনা যায় অনেক। তবে, এরকমই একটি উক্তি আব্দুল কালামের অনেক আগেই করে গেছেন এক বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ, দুঃসাহসী যোদ্ধা, থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তেঁতে ওঠা আরব বিদ্রোহে অংশ নিয়ে, একজন ঠান্ডা মাথার অকুতোভয় সামরিক নেতা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। মোটর বাইক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারানোর পূর্বেই ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ হিসেবে ইতিহাসে ভাস্বর হয়েছেন তিনি। তার জীবনী নিয়ে হলিউডে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত সিনেমা ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’। তবে, তার জীবন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানতে ছবিটির উপর নির্ভর না করাই ভালো। সেখানে নাটকীয়তার পরিমাণটা একটু বেশিই ছিল কিছু অংশে। যা-ই হোক, তার সংক্ষিপ্ত জীবনের গল্পই আজ শোনা যাক চলুন।

থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স (১৮৮৮-১৯৩৫); source: imgrum.org

যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের ট্রেমাডগ শহরে ১৮৮৮ সালের ১৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স। তার বাবা থমাস চ্যাপম্যানের স্বীকৃত সন্তান নন তিনি। তার মা সারাহ, চ্যাপম্যানের বাসায় গৃহশিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সূত্রে তাদের মধ্যে প্রণয় সংঘটিত হয় এবং অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জন্ম হয় লরেন্সের। অবশ্য এ সত্যটি লরেন্স জানতে পেরেছিলেন ১৯ বছর বয়সে। ততদিনে চ্যাপম্যান আর বেঁচে নেই। তবে লরেন্স নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করতে পারেন, কারণ চ্যাপম্যান তাকে ছেড়ে চলে যাননি কখনো। চ্যাপম্যান মৃত্যুর আগপর্যন্ত পিতৃস্নেহ দিয়ে গেছেন লরেন্সকে।

শৈশবেই জন্মস্থান ত্যাগ করে, পরিবারের সাথে অক্সফোর্ডে চলে আসেন লরেন্স। সেখানে একটি স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পড়ালেখা সারেন। তার সম্মানে ‘সিটি অব অক্সফোর্ড হাইস্কুল ফর বয়েজ’ নামের সেই স্কুলের চারটি কক্ষের নাম ‘লরেন্স কক্ষ’ রাখা হয়েছিল পরবর্তীকালে। নিজের জীবনীতে তিনি দাবি করেছিলেন, ১৯০৫-০৭ সালে তিনি সেন্ট মো দুর্গে একটি ব্রিটিশ আর্টিলারির সাথে গোপনে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তার জনপ্রিয়তা যখন আকাশ ছোঁয়া, তখন অবশ্য তাকে নিয়ে কৌতূহলবশত অনেকে গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, সেন্ট মো দুর্গের রেকর্ডে তার দাবির কোনো প্রমাণ নেই! যা-ই হোক, ১৯০৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেসাস কলেজে ভর্তি হন।

অক্সফোর্ডে অবস্থিত একটি নাইট টেম্পল; source: it.wikipedia.org

কৈশোরে লরেন্সের মাথায় প্রত্নতত্ত্বের ভূত চেপে বসে। তিনি প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে অনেক অমীমাংসিত রহস্য উদঘাটন করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্ন দেখতেন। মধ্যযুগের নাইটসম্প্রদায়ের বীরত্বের ইতিহাস তাকে মুগ্ধ করতো। তার এই আকর্ষণ তার ভ্রমণপিয়াসী মানসিকতার সাথেও দারুণভাবে মিলে যায়। অক্সফোর্ডে পড়াকালীন এর আশেপাশের প্রায় সকল চার্চে তিনি পদচিহ্ন রেখেছেন, সংগ্রহ করেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি এবং পুরাকীর্তি। এ সময় তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বেসনকে নিয়ে এক সপ্তাহের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন সাইকেলে চেপে। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাইট টেম্পলগুলোতে দুই বন্ধু গিয়ে সংগ্রহ করতেন মূল্যবান ধ্বংসাবশেষ এবং তথ্য-উপাত্ত। ১৯০৯ সালের গ্রীষ্মে, তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সিরিয়ার ক্রুসেডার দুর্গগুলোতে ভ্রমণের নিমিত্তে পায়ে হেঁটে একাকী ভ্রমণ করেছিলেন ১ হাজার মাইলের বেশি পথ! প্রত্নতত্ত্বের জন্য তার আকর্ষণ ছিল এতটাই প্রবল।

মাগদালিন কলেজ; source: ox.ac.uk

প্রচণ্ড অধ্যবসায় আর আকর্ষণের জোরে, ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে স্নাতক পাশ করেন লরেন্স। মধ্যযুগীয় সাহিত্য পড়তে ভর্তি হন মাগদালিন কলেজে। কিন্তু তার মতো দুঃসাহসী মানুষের স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশান্ত পরিবেশে নয়। সর্বদা দুঃসাহসী সব অভিযানের পরিকল্পনা ঘুরতো তার মাথায়। অপেক্ষা ছিল কেবল একটি সুযোগের। সে সুযোগ আসে ১৯১০ সালের ডিসেম্বর মাসে। দ্বিতীয়বার ভাববার আর অবকাশ পাননি। সাথে সাথেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটিয়ে বৈরুতের উদ্দেশে রওনা দেন।

প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায় প্রয়োজন হয় বলে শিখেছিলেন একাধিক ভাষা। অনর্গল বলে যেতে পারতেন ফরাসি, জার্মান, তুর্কি, গ্রিক আর ল্যাটিন ভাষা। বৈরুতে গিয়ে আরবি ভাষাটাও শিখে ফেলেন। এ সময়টা ছিল তার উত্থানের প্রস্তুতিকালের মতো। ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি তিনি আরবদের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা এবং পড়ালেখা করতে লাগলেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই তৈরি হলো তার অসংখ্য বন্ধু। স্থানীয়দের সাথে সম্পূর্ণরূপে মিশে যেতে শুধু যে ভাষাই শিখেছিলেন তা নয়, নিজের পোশাক পরিচ্ছদেও এনেছিলেন আমূল পরিবর্তন। আরবদের ঢঙে লম্বা জুব্বা আর মাথায় সুদৃশ্য উষ্ণীষে একেবারে আরবদের মতোই দেখাতো তাকে।

আরব ফ্যাশনে লরেন্স; source: spectator.co.uk

১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ততদিনে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর দিগন্তজোড়া ধু-ধু মরুভূমির প্রেমে পড়ে গেছেন লরেন্স। প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের খাতিরে পায়ে হেঁটে, ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চড়ে, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মরুভূমিই চষে বেড়ানো হয়ে গেছে তার। এসব কাজ করতে গিয়ে তৈরি করেন একটি চমৎকার ম্যাপ, যা ঘটনাক্রমে একজন ব্রিটিশ জেনারেলের নজরে আসে। জেনারেল ভদ্রলোক দেখলেন যে, তাদের হাতে থাকা ম্যাপের চেয়ে লরেন্সের ম্যাপ বহুগুণে নির্ভুল। তাছাড়া, লরেন্সের ম্যাপে যুদ্ধের জন্য কিছু কৌশলগত স্থান, যেমন নেগেভ মরুভূমি চিহ্নিত করা ছিল সুস্পষ্টভাবে, যেগুলো কিনা অটোমান সাম্রাজ্যের ব্যবহারের সম্ভাবনা ছিল। ফলে, লরেন্সের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। কায়রোতে তাকে নিয়োগ দেয়া হয় গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের জন্য।

মরুভূমিতে যুদ্ধ করে ঠিক সুবিধা করতে পারছিল না ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু, তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। আর সে বিদ্রোহে, বিদ্রোহীদের স্বাদরে গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ বাহিনীর ‘আরব ব্যুরো অব ফরেন অফিসার’ থেকে লরেন্সকেই ঠিক করা হয় বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, কারণ লরেন্সের চেয়ে ভালোভাবে আরবদের সাথে মিশতে পারেনি কোনো ব্রিটিশ নাগরিকই। অন্যদিকে, অটোমান সাম্রাজ্যের অত্যাচারী শাসনে অতিষ্ঠ আরবদের প্রতি লরেন্সের মনেও সহানুভূতি কাজ করতো। তিনি তাই নির্দ্বিধায় মেনে নিলেন সে প্রস্তাব।

আমির ফয়সাল এবং লরেন্স এক ফ্রেমে; source: ar.wikipedia.org

আরব বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের প্রধান নেতা ছিলেন মক্কার আমির ফয়সাল। লরেন্সের প্রথম কাজটি তাই ছিল আমির ফয়সালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। তিনি বেশ কিছু যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠীকে নিজের দলে ভেড়াতে সক্ষম হন। তাদের নিয়ে পৌঁছে যান আমির ফয়সালের কাছে। আমিরের অনুমতি নিয়েই শুরু হয় লরেন্সের সফল গেরিলা যুদ্ধ। তিনি ভালো করেই জানতেন যে, তার অনুন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অপ্রশিক্ষিত বাহিনী, আধুনিক কামান গোলায় সজ্জিত অটোমান বাহিনীর সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। তাই তিনি বেছে নিলেন গেরিলা আক্রমণের পথ। মদিনার মরুভূমির বুক চিরে চলে যাওয়া হেজাজ রেলওয়ের একটি ট্রেন লুট করেই তিনি অটোমান সাম্রাজ্যে প্রথম আঘাত হানেন। এই রেলওয়েই ছিল অটোমানদের অস্ত্র এবং খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের প্রধান ব্যবস্থা।

আকাবায় যাবার পথে লরেন্স, লরেন্স অব অ্যারাবিয়া ছবির একটি দৃশ্য; source: historyhit.com

যুদ্ধে আকাবা বন্দর ছিল একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অটোমানরা যেকোনো ধরনের নৌ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শক্ত সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তারা যা ভাবতেও পারেনি, লরেন্স করলেন ঠিক তা-ই। আকাবার পেছনের দিকে ছিল বিস্তীর্ণ এক মরুভূমি, যা পেরিয়ে আসতে পথিমধ্যেই মারা পড়ে অধিকাংশ মানুষ। অটোমানরা নিশ্চিত ছিল যে এদিক দিয়ে কেউ আকাবা আক্রমণ করতে আসবে না। আর অটোমানদের এই নির্ভাবনার সুযোগটিই কাজে লাগালেন লরেন্স। নিজের পাগলাটে স্বভাবের উপজাতি বাহিনী নিয়ে তড়িৎ গতিতে আচমকা আক্রমণে দিশেহারা করে দিলেন অটোমান বাহিনীকে, দখল করে নিলেন আকাবা।

“আমার চেনা জানা আর কোনো মানুষের পক্ষে এই সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়, যা লরেন্স করে দেখিয়েছেন!”- কমান্ডার জেনারেল স্যার এডমান্ড অ্যালেনবি

জেনারেল অ্যালেনবির সাথে লরেন্স, লরেন্স অব অ্যারাবিয়া ছবির একটি দৃশ্য; source: gettyimages.co.uk

আকাবা দখলের পূর্বে, ব্রিটিশ বাহিনীর উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানাননি লরেন্স। তথাপি, তাকে এর জন্য কোনো জবাদিহিতা করতে হয়নি। কারণ, অ্যালেনবি তাকে সে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আকাবা দখলের খবর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজে এসে অ্যালেনবির কাছে পৌঁছেছিলেন লরেন্স। তার এই সাফল্যে, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন সকলে। আমির ফয়সালের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বেড়ে যায়। এ সময়ে অসংখ্য আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন তিনি। অটোমানরা তাকে ধরার জন্য এতটাই হন্যে হয়ে ওঠে যে, তারা লরেন্সকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ২১ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করে। কম মনে হচ্ছে? মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আজকের দিনে তার মূল্য ২.১ মিলিয়ন ডলার! তার যুদ্ধে অংশগ্রহণের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা যাক।

  • অটোমানদের মূল সরবারহ লাইন হেজাজ রেলওয়ে আক্রমণ।
  • আবা এল নামক রেলওয়ে আক্রমণ এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
  • আকাবার একটি আউটপোস্ট আক্রমণ। এখানে পরাজিত হয়েছিলেন লরেন্স।
  • লেবাননের রাস বালবেক শহরের একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া।
  • মুদাওয়ারা শহরে আরো একটি রেলওয়ে আক্রমণ এবং একটি ট্রেন ধ্বংস করে দেয়া।
  • মৃত সাগরের দক্ষিণপূর্বে তাহফিলের যুদ্ধ, যেখানে একজন সাধারণ সৈনিক হিসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
  • আকাবা আক্রমণ এবং দখল, যা তার সবচেয়ে বড় সফলতা বলে গণ্য করা হয়।
  • আম্মান এবং ডেরার সংযোগ রেলওয়ে ধ্বংস করা।

১৯১৮ সালে, বিদ্রোহীরা এবং ব্রিটিশ বাহিনী সিরিয়ার দামেস্ক দখল করে নেয়। লরেন্স এই আক্রমণে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি আমির ফয়সালকে প্রভিশনাল আরব সরকারের রাজা হতে সহায়তা করেন। কিন্তু ফয়সালের রাজত্বের মেয়াদ ছিল মাত্র ২ বছর। ১৯২০ সালে ফরাসি বাহিনী আরবে ফয়সালের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে, আরব অঞ্চলকে সাময়িকভাবে দু’ভাগে ভাগ করে। এর ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীকালে ইরাক এবং সিরিয়া নামক দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের জন্ম। এই ঘটনা লরেন্সকে প্রচণ্ড আশাহত করে। তিনি একে আরবদের সাথে ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যায়িত করেন।

source: manhattanrarebooks.com

ব্রিটিশদের এহেন কর্মকাণ্ডে ব্যথিত হয়ে নিজের সামরিক পদ থেকে অব্যহতি দেন লরেন্স। ১৯২২ সালের দিকে তিনি ছদ্মনামে ‘রয়্যাল এয়ার ফোর্স’ এ যোগ দিলেও শীঘ্রই তার পরিচিতি প্রকাশ পেয়ে যায় এবং তিনি এয়ার ফোর্স থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ক্ষণকাল পরেই, অন্য একটি ছদ্মনামে ব্রিটিশদের এয়ার ফোর্সে যোগ দিয়ে চলে যান ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিমানঘাঁটিতে। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের জন্য কাজ করেছিলেন। তার সকল কৃতিত্ব এবং বীরত্ব পৃথিবীকে জানানোর কাজটি যিনি করেছেন, তিনি সাংবাদিক লাউয়েল থমাস। থমাস যদি লরেন্সের জীবনের গল্প মিডিয়াতে প্রচার না করতেন তাহলে হয়তো তার দুঃসাহসিক কৃতিত্বগুলো আমরা কোনোদিন জানতে পারতাম না। কেননা লরেন্স ছিলেন প্রচণ্ড রকমের একজন প্রচারবিমুখ মানুষ, যিনি নিজের ব্যাপারে কখনোই কারো কাছে গল্প করতেন না।

পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে প্রত্নতত্ত্ব আর সামরিক বাহিনীর সাথে লেগে থাকা লরেন্স একজন উর্বর লেখকও ছিলেন। তার কলমে রচিত হয়েছে ‘সেভেন পিলারস অব কিংডম’ নামক অসাধারণ একটি গেরিলা যুদ্ধ সংক্রান্ত বই। এই বইটি আজও ইরাক, আফগানিস্তানের গেরিলা যোদ্ধারা সামরিক কৌশল রপ্ত করতে পড়ে। আরব বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা ‘দ্য রিভোল্ট ইন দ্য ডেজার্ট’ একাধিকবার বেস্ট সেলার হয়। ১৯৩৫ সালে তিনি এয়ার ফোর্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিভৃত জীবন বেছে নেন।

এই বাইকটি চালাতে গিয়েই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান লরেন্স; source: gettyimages.co.uk

লরেন্সের মোটরবাইকের শখ ছিল আকাশ ছোঁয়া। ব্রাফ সুপেরিয়র কোম্পানির ৭টি উন্নত এবং তখনকার সাপেক্ষে অত্যাধুনিক মোটরবাইক ছিল তার। এই মোটরবাইকই তার জীবন কেড়ে নেয়। ১৯৩৫ সালের ১৩ মে ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামের ডোরসেট নামক গ্রামে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন লরেন্স। ছয়দিন হাসপাতালে থাকার পর ১৯ মে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র ৪৬ বছর। ডোরসেটের মোরিটন চার্চে সমাহিত করা হয় তাকে। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উইনস্টন চার্চিলও, যার সঙ্গে লরেন্স বেশ কিছুকাল একই অফিসে কাজ করতেন।

জীবিতাবস্থায় যিনি মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, মৃত্যুর পরও তার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়েছে! তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়ে নিউরোসার্জন হিউ ক্রেইনস মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণগুলো নিয়ে গবেষণা করেন এবং ক্র্যাশ হেলমেট তৈরি করেন, যা শত শত বাইকারের জীবন রক্ষা করছে। তার সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করবো।

“আমি তাকে আমাদের সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে মনে করি। আমরা তার মতো কাউকে আর কোনোদিন খুঁজে পাবো না। তার নাম ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবে, প্রতিটি যুদ্ধে স্মরণ করা হবে, আরব আখ্যানের সাথে মিশে যাবে চিরতরে।”

ফিচার ছবি: dorsets.co.uk

Related Articles