দাদাসাহেব ফালকেকে বলা হয় ‘দ্য ফাদার অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশকে সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তৎকালীন বোম্বে প্রেসিডেন্সির ত্র্যম্বকেশ্বর, যেটি বর্তমানে মহারাষ্ট্র প্রদেশে পড়েছে, সেখানে এক অবস্থাসম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৭০ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গোবিন্দ সদাশিব ফালকে পৌরোহিত্য, পূজো-অর্চনা করে সংসার নির্বাহ করতেন। তাকে সবাই দজিশাস্ত্রী বলে ডাকত।
দাদাসাহেব ফালকের মা দ্বারকাবাঈ ছিলেন গৃহীণী। সদাশিব-দ্বারকাবাঈ দম্পতির ঘরে মোট সাতটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তিনটি ছেলে ও চারটি মেয়ে। সবার বড় ছেলে শিবরামপান্ত বরোদায় দেওয়ানের চাকরি নিয়ে ত্র্যম্বকেশ্বর ছাড়েন। পরের ছেলেটি বাবার সাথে পৌরোহিত্য করত। একুশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। দাদাসাহেব ছিলেন ছোট ছেলে।
দাদাসাহেব ফালকের পুরো নাম ধুণ্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে। সংক্ষেপে ডি জি ফালকে। পৌরোহিত্যের পাশাপাশি সদাশিব পন্ডিত বিদ্যার্থীদের সংস্কৃত শেখাতেন এবং বৈদ্যগিরি করতেন। তখনকার দিনে প্রায় প্রতিটি পন্ডিতই বৈদ্যগিরি করতেন। তাদের বাড়িতে ঔষধের বাক্স তোলা থাকত। বৈদ্যবিদ্যা তারা শুধু তাদের সন্তান বা প্রিয় ছাত্রকে দিয়ে যেতেন। ধুণ্ডিরাজ পিতার কাছে বাল্যকালেই সংস্কৃত ও বৈদ্যগিরির পাঠ নেন। ত্র্যম্বকেশ্বরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ফালকে সপরিবারে বোম্বে চলে আসেন।
ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে পনের বছর বয়সে তিনি স্যার জে জে স্কুল অফ আর্টসে ভর্তি হন। সেখানে চিত্রাঙ্কনের উপরে এক বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। পরের বছর তিনি বরোদায় দাদার কাছে চলে যান। দাদার কাজেকর্মে সহায়তা করতে করতে ছবি আঁকা, ছবি তোলা, রং করা প্রভৃতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৮৯০ সালে বরোদার মহারাজ শিবাজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে ফালকে জলরং ও তেলরং দিয়ে চিত্রাঙ্কনের উপর একটি কোর্স সম্পন্ম করেন। স্থাপত্যকলা ও প্রতিমানির্মাণ শিল্পেও ফালকে দক্ষতা অর্জন করেন। এ সময় তিনি একটি ক্যামেরা কিনে ছবি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকেন।
১৮৯২ সালে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিশনে’ তিনি গোল্ড মেডেল লাভ করেন। তার একজন অনুরাগী তাকে একটি দামি ও ভালো মানের ক্যামেরা উপহার দেয়। কলাভবনে তার বন্ধু-বান্ধব, গুরু-সতীর্থগণ সবার প্রশংসায় ভাসতে থাকেন তিনি। কলাভবনের আচার্য গজ্জার ত্রিরঙা ব্লকমেকিং, ফটোলিথোগ্রাফি, কালারটাইপ, অন্ধকার ঘরে ছবি প্রিন্টিং ইত্যাদি শিখে আসতে তাকে মধ্যপ্রদেশের রাতলামে কলাভবনের একজন প্রফেসরের তত্ত্বাবধায়নে প্রেরণ করেন। রাতলাম থেকে ফেরার পরে আচার্য গজ্জার তাকে কলাভবনের স্টুডিও ও ফটোল্যাব ব্যবহারের অনুমতি দেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ফালকে কলাভবনের ল্যাবেই আপাতত তার ফটোপ্রিন্টিংয়ের কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি পেশাদার ফটোগ্রাফি করার সিদ্ধান্ত নেন। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তিনি গোধরায় চলে যান। সেখানে ফালকে সপরিবারে কয়েক বছর বাস করেন। গোধরায় মহামারী প্লেগে তার স্ত্রী ও সন্তান মৃত্যুবরণ করলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি আবার বরোদায় ফিরে আসেন। বরোদায় এসে পেশাদারি ফটোগ্রাফি শুরু করেন।
এ সময় বরোদায় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ছবি তোলার ক্যামেরা ছবি তোলার সময় ব্যক্তি বা প্রাণীর ভেতরের শক্তি শুষে নিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। স্বয়ং যুবরাজ-এ-বরোদাও এটি বিশ্বাস করে বসেন। লোকের মনের এ ভুল ধারণাটি ভাঙতে ফালকেকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। বিষয়টি কোর্ট পর্যন্তও গড়ায়। ফটোগ্রাফি ব্যবসার বেহাল দশা দেখে ফালকে দলের লোকজনকে নিয়ে একটি প্রিন্টিং প্রেস স্থাপন করেন। এটি প্রথমে নাটক কোম্পানিগুলোর পর্দা প্রিন্ট করা শুরু করে। ধীরে ধীরে পোস্টার আর ছবি প্রিন্টিংও শুরু হয়।
নাটক কোম্পানিগুলোর সংস্পর্শে এসে ফালকে নাটক মঞ্চায়ন, দৃশ্যনির্মাণ, প্রযোজনা, মঞ্চাভিনয় প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এ সময় জার্মানির এক জাদুকর বরোদায় এসে শো করে। তার জাদু দেখে ফালকে জাদুর কলাকুশলের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জাদুকর চলে যাওয়ার আগে তার কাছ থেকে তিনি কয়েকটি ম্যাজিক ট্রিক শিখে রাখেন যেগুলো তিনি পরবর্তীতে সিনেমা নির্মাণ ও ফটোগ্রাফিতে ব্যবহার করেছিলেন।
১৯০২ সালে ৩২ বছর বয়সে ফালকে পুনর্বিবাহ করেন। প্রথম বিয়েটি করেছিলেন পনের বছর বয়সে। বিয়ের পরের বছর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চিত্রগ্রাহক ও নকশাকার পদে তার চাকরি হয়। তিন বছর সেখানে চাকরি করে তিনি ইস্তফা দেন।
ফিরে এসে একজনের সাথে অংশীদারিত্বে ‘ফালকে খোদাই ও ছাপাখানা’ (Phalke Engraving and Printing Works) নামে একটি প্রিন্টিং প্রেস স্থাপন করেন। এটির নাম বদলে পরবর্তীতে ‘লক্ষ্মী আর্ট প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ দেওয়া হয়েছিল। এই প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রাজা রবিবর্মার সাথে কাজ করার সুযোগ পান। খুব বেশি লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায় এবং আর্থিক সংকটের দরুন কয়েক বছরের মাথায় ফালকে প্রেসের পার্টনারশিপ থেকে সরে আসেন।
১৯১১ সালে তার জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটে যেটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সে বছরের ১৪ এপ্রিল বড় ছেলে বালচন্দ্রকে নিয়ে বোম্বের আমেরিকা ইন্ডিয়া পিকচার প্যালেসে ‘অ্যামেজিং অ্যানিম্যালস’ (Amazing Animals) নামক একটি সিনেমা দেখতে যান। পর্দায় জন্তুদের এমন দৃশ্য দেখে বালচন্দ্র থ বনে যান। বাড়িতে ফিরে সে সবাইকে বিশেষ করে মা সরস্বতীবাঈকে থিয়েটারের অদ্ভুত দৃশ্যের ব্যাপারে বলে বেড়ান। কেউ তার কথা বিশ্বাস না করলে ফালকে পরের দিন পরিবারের সবাইকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যান। পরেরদিন ইস্টার সানডে থাকায় থিয়েটারে ফরাসি চলচ্চিত্রকার অ্যালিস গী ব্লাশের ‘দ্য লাইফ অফ ক্রাইস্ট’ সিনেমাটি দেখানো হয়। খ্রিষ্টীয় ভক্তিমূলক সিনেমা দেখে ফালকে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীগুলো নিয়ে ভারতে সিনেমা নির্মাণের কথা ভাবতে থাকেন।
পরের এক বছর ইউরোপ থেকে ফালকে সিনেমা নির্মাণের বিভিন্নরকম সামগ্রী সংগ্রহ করতে থাকেন। তিনি একটি ক্যামেরা ও কিছু রিল সংগ্রহ করেন। এ সময় সিনেমার প্রতি মাত্রাধিক আগ্রহের জন্য তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে সিনেমা দেখা শুরু করেন। প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা পর্দার সামনে বসে থাকার কারণে এবং ঘুমের ঘাটতির কারণে তার চোখে ছানি পড়ে যায় এবং মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
বিখ্যাত চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. প্রভাকর তার চিকিৎসা করেন। কয়েক জোড়া মোটা কাচের চশমা দেওয়া হয় তাকে। ধীরেধীরে ফালকে দৃষ্টি ফিরে পাওয়া শুরু করেন। ফালকে লন্ডনে গিয়ে সিনেমা নির্মাণ শিখে আসার সিদ্ধান্ত নেন। লন্ডনে যাওয়ার টাকা পাবেন কোথায়? তখন আদাসাহেব এবং যশোবন্তরাও নাদকর্ণীর সহায়তায় তিনি তার বার হাজার টাকার বীমাপত্রটি দশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে লন্ডনগামী জাহাজের টিকিট কেটে ১৯১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফালকে লন্ডন যাত্রা করেন।
লন্ডনে পৌঁছে ‘বায়োস্কোপ সিনে-সাপ্তাহিক’-এর নামফলক চোখে পড়লে তিনি ত্বরিত পত্রিকাটির অফিসে ঢুকে পড়েন। ফালকে ভারতে বায়োস্কোপ সিনে উইকলির একজন নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক মি. কেপবার্নের সাথে দেখা করে তার কাছে লন্ডনে আসার উদ্দেশ্য এবং সিনেমার প্রতি আগ্রহ ব্যক্ত করেন। কেপবার্ন তাকে সিনেমা নির্মাণের বিভিন্ন ঝুঁকির ব্যাপারে সচেতন করেন। কেপবার্ন আরো বলেন যে ভারতের আবহাওয়া সিনেমা শিল্পের অনুকূলে নয়।
তবুও, নাছোড়বান্দা ফালকের আগ্রহ দেখে কেপবার্ন তাকে ওয়ালটন স্টুডিওজের প্রসিদ্ধ চলচ্চিত্রকার সেসিল হেপওয়ার্থের কাছে নিয়ে যান। হেপওয়ার্থ ফালকেকে সিনেমা স্টুডিওগুলো ঘুরিয়ে দেখান, সিনেমা নির্মাণের কলাকৌশলের ব্যাপারে সবিস্তারে বর্ণনা করেন। হেপওয়ার্থ ও কেপবার্নের পরামর্শে ফালকে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে একটি উইলিয়ামসনের ক্যামেরা এবং কোডাকের ফিল্ম ও পারফোরেটর ক্রয় করেন। দুই মাস লন্ডনে থেকে সিনেমা নির্মাণের বিভিন্ন কলাকৌশল শিখে ১ এপ্রিল ভারতে ফিরে আসেন। একইদিনে ‘ফালকে ফিল্মস কোম্পানি’ নামে ফিল্ম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ফালকে ভালো জায়গা খোঁজা শুরু করেন। তিনি তার পরিবারকে নিয়ে একটি বড় বাংলোতে ওঠেন। সেখানে ছোট্ট একটি ঘরকে ফিল্ম ডেভেলপিংয়ের জন্য সাজান। ক্যামেরা ও প্রজেক্টরকে পরীক্ষা করার জন্য ফালকে ছেলে-মেয়েদের এবং আশেপাশের ঘটনাগুলো শুট করা শুরু করেন। ফলাফল বেশ ভালো হয়। এ সময় বড় ফিচার ফিল্মের জন্য প্রযোজকদের আকৃষ্ট করতে ফালকে একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেন। ছবিটির নাম দেন ‘অঙ্কুরাচি ওয়াধ’। মারাঠি নাম। বাংলায় ‘অঙ্কুরের জন্ম’।
একটি ভাঁড়ে কয়েকটি মটরদানা বুনে দিয়ে প্রায় একমাস দানাগুলো থেকে কুশি বের হওয়া শুট করতেন। তারপর সেগুলো জুড়ে দিয়ে মিনিট খানেকের একটি শর্টফিল্মে রূপ দেন। প্রযোজকরা দেখার পরে মুগ্ধ হয়ে ফালকেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্মের জন্য মোটা অঙ্কের লোন দিতে রাজি হন। ফালকে পুরাণে ও রামায়ণে বর্ণিত রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী নিয়ে একটি ফিচার ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লিখেন।
ছবির জন্য কলাকার দরকার। তখন কলাকারের অডিশনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সেকালে ভদ্র ঘরের মেয়েদের সিনেমায় অভিনয় করতে দেওয়া হতো না। পুরুষেরাই মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করতো। রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রীর চরিত্রে একজন পুরুষ অভিনয় করেছিলেন। অভিনেতা ডি ডি দাবকে রাজা হরিশ্চন্দ্রের এবং আন্না সালুনকে হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী রাণী তারামতির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ফালকে হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্বের চরিত্রে তার পুত্র বালচন্দ্রকে অভিনয় করিয়েছিলেন। ছয় মাসের শুটিং এবং সাতাশ দিনের প্রযোজনা শেষে ৩৭০০ ফুটে চার রিলে ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছবিটি শেষ হয়।
১৯১৩ সালের ৩ মে ছবিটি বোম্বের করোনেশন সিনেমাহলে মুক্তি পায়। ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়। ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছিল একটি নির্বাক ছবি। এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে প্রথম সার্থক ও পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ছবি। প্রথম ছবি কিনা এটা নিয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক আছে। অনেক সিনেমা সমালোচক ও ইতিহাসবিদ দাদাসাহেব তোর্ণের ‘শ্রী পুন্দালিক’কে প্রথম ভারতীয় ছবির মর্যাদা দান করেন কারণ সেটি মুক্তি পেয়েছিল ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’-এর প্রায় এক বছর আগে ১৯১২ সালের মে মাসে। তবে, ভারত সরকার ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’কেই প্রথম এবং সার্থক চলচ্চিত্রের মর্যাদা দিয়েছে। (এরপর চোখ রাখুন পরবর্তী পর্বে)