যখন কোনো ভালো-মন্দের জ্ঞান ছিলো না, কার্টুন কী জিনিস সেটাই জানতাম না, তখন থেকেই টিভির পর্দার সামনে একটা দুষ্টু বেড়াল আর ছোট্ট এক ইঁদুরের কারসাজি দেখার জন্য হাঁ করে বসে থাকতাম। সেই দুষ্টুমি আর হাস্যরসে পরিপূর্ণ সেই কার্টুনটি আমাদের চিরচেনা ‘টম অ্যান্ড জেরি’। অনেকের জীবনের প্রথম কিংবা সবচেয়ে পছন্দের কার্টুন এটি। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কেউ দেখেছে, কিন্তু উপভোগ করেনি এমন মানুষ পাওয়াও দুষ্কর।
এই জনপ্রিয় কার্টুনের অন্যতম পরিচালক ও অস্কারবিজয়ী ইলাস্ট্রেটর জিন ডেইচ ২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল চিরবিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। প্রতিভাবান ডেইচ আরেকটি জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ ‘পাপাই দ্য সেইলর’-এরও পরিচালক ছিলেন। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের শৈশবের দিনগুলো আনন্দময় করার পেছনে দায়ী যে ব্যক্তি, তার জীবনটা কেমন ছিল, তা জানার আকাঙ্ক্ষা তো থেকেই যায়। কেমন ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন? কীভাবে তার আবির্ভাব ঘটে অ্যানিমেশনের জগতে? আর কী কী কৃতিত্ব ও অর্জন রয়েছে তার জীবনে? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়েই আজকের এই লেখা।
প্রাথমিক জীবন
১৯২৪ সালে শিকাগো শহরে জন্ম এই প্রতিভাবান কার্টুনিস্ট জিন ডেইচের। একটু বড় হতে না হতেই পরিবারের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে স্থানান্তরিত হন। সময়টা ছিল ১৯২৯। সেখান থেকে হলিউডের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন ডেইচ। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা বা বিভিন্ন ধরনের ইলাস্ট্রেশন করার প্রতি তার তীব্র আগ্রহ ছিল। ১৯৪২ সালে লস অ্যাঞ্জেলস উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে পাস করে নর্থ আমেরিকান অ্যাভিয়েশনে এয়ারক্রাফটের নকশাকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ঠিক পরের বছরই ডেইচ আবার পাইলট হবার প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন। তবে তার এই প্রশিক্ষণার্থী জীবনের মেয়াদ ছিল খুবই কম। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে এর ১৯৪৫ সালে এই প্রোগ্রাম থেকে অবসরপ্রাপ্ত হন। এরপরেই ধীরে ধীরে পদার্পণ করেন অ্যানিমেশনের রঙিন জগতে।
ব্যক্তিগত জীবন
ডেইচের সাথে তার প্রথম স্ত্রী ম্যারির দেখা হয় যখন, তখন তারা দু’জনই নর্থ আমেরিকান অ্যাভিয়েশনে কাজ করতেন। ১৯৪৩ সালে তারা বিয়ে করেন। পরবর্তী সময়ে তাদের তিন সন্তান কিম, সিমন এবং সেথও আন্ডারগ্রাউন্ড কমিকস এবং অলটারনেটিভ কমিকস নিয়ে কাজ করেছেন। কিমের কার্টুন চরিত্র ‘ওয়ালডো’ সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। তবে ম্যারির সাথে সংসারজীবনের সমাপ্তি ঘটে প্রাগে যাবার পর। ১৯৫৯ সালে ম্যারিকে নিয়েই প্রাগে যান জিন ডেইচ। সেখানে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পর ডেইচ পরিচিত হন জেডেনকা নায়মানোভার সাথে। জেডেনকার জন্যই চেক প্রজাতন্ত্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন ডেইচ। ১৯৬৪ সালে তারা বিয়ে করেন। ৫৫ বছর একসাথে সংসার করার পর ৯৫ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন এই জনপ্রিয় ইলাস্ট্রেটর।
অ্যানিমেশনের জগতে ডেইচ
কার্টুনিং ও অ্যানিমেশনের জগতে ডেইচের যাত্রা শুরু হয় জ্যাজ ম্যাগাজিন ‘দ্য রেকর্ড চেঞ্জার’-এর প্রচ্ছদের নকশা এবং ইন্টেরিয়র আর্ট করার মাধ্যমে। তবে মূল যাত্রা শুরু হয়, যখন তিনি ইউনাইটেড প্রোডাকশনস অভ আমেরিকা (ইউপিএ) নামক অ্যানিমেশন স্টুডিওতে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি টেরিটুনসের সৃজনশীল পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টেরিটুনসে তিনি ‘সিডনি দ্য এলিফ্যান্ট’, ‘গ্যাস্টন লে ক্রেয়ন’ এবং ‘ক্লিন্ট ক্লোবার’-এর মতো জনপ্রিয় কিছু চরিত্র সৃষ্টি করেন। ইউপিএ-তে কাজ করার শুরুর দিকে ডেইচ ‘দ্য রিয়াল গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারস অব টেরিবল থমপসন’ নামক কমিক লেখেন এবং চরিত্রগুলো অঙ্কনের মাধ্যমে কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেন। এই কমিকের মাধ্যমে তিনি ছোট একটি শিশুর চমৎকার সব অভিযানে নিয়ে যান সবাইকে।
টেরিটুনসে কাজ করার সময় তার পরিচয় হয় জুলস ফেইফারের সাথে। ফেইফারের সাথে আলাপ-আলোচনার পর ডেইচ তার শিশুতোষ উপন্যাস ‘মানরো’-এর উপর একটি অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। কাজটি করার জন্য মাত্র ১০ দিনের জন্য পাড়ি জমান চেক প্রজাতন্ত্রে। যেখানে বিভিন্ন কারণে থাকার সময় বাড়তে বাড়তে একসময় স্থায়ীভাবেই বসবাস শুরু করেন ডেইচ৷ তার নির্মিত একটি অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম ‘মানরো’ সকলের নিকট এতটাই সমাদৃত হয় যে এটি ‘একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট অ্যানিমেটেড শর্ট’ পুরস্কার লাভ করেন।
এর ফলে ডেইচ বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন। এই সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনের আরো কিছু কার্টুন নির্মাণের সুযোগ পান তিনি। অনেকটা খ্যাতির কারণেই অল্প সময়ের মধ্যে নিউ ইয়র্কে নিজের স্টুডিও শুরু করার সুযোগটাও পেয়ে যান। তার স্টুডিওতে মূলত টেলিভিশন কমার্শিয়ালের কাজই করা হতো।
১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তার অ্যানিমেটেড মুভি ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ’, যা সে বছরের সর্বোত্তম অ্যানিমেটেড মুভির খেতাব পায়। এই মুভির জন্য পুরস্কারও পান জনপ্রিয় জিন ডেইচ। তিনি আরো দুবার একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হন। এই দুবার মনোনীত হওয়ার কারণ ছিলো ‘হেয়ার’স নাদনিক’ আর ‘হাউ টু অ্যাভয়েড ফ্রেন্ডশিপ’ নামক দু’টি অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম। ‘টম টেরিফিক’ এবং ‘সিডনি’জ ফ্যামিলি ট্রি’র মতো সিরিজের পেছনেও কৃতিত্ব রয়েছে জিন ডেইচের। ১৯৫৮ সালে ‘সিডনি’জ ফ্যামিলি ট্রি’র জন্য তিনি অস্কারের জন্য মনোনীত হন।
এবার আসি ‘টম অ্যান্ড জেরি’ আর ‘পাপাই দ্য সেইলর’-এর কথায়। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত টম অ্যান্ড জেরির মোট ১৩টি পর্বের পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডেইচ। তিনি তার এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, অনেকেই তার কাছে সে সময়ে চিঠি লিখে বলেছিলো ‘টম অ্যান্ড জেরি’ তাদের সবচাইতে প্রিয় কার্টুন। এই সিরিজের বয়স ৮০ বছর পরেও দর্শকদের এই মতামত এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই কার্টুনের মতো অন্য কোনো কার্টুন এখনো তেমন দাগ কাটতে পারেনি সবার মনে।
তবে এই কিংবদন্তি কার্টুন নির্মাণের শুরুর দিকে তাকে বারবার সমালোচনার শিকার হতে হয়। অনেকে তো এটাও বলে যে, টম অ্যান্ড জেরি তার জীবনের সবচাইতে বাজে সিরিজ প্রমাণিত হবে। তবে তার কঠোর পরিশ্রম ও সৃজনশীল প্রতিভা যে এ ধরনের সমালোচনাকে ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, তা আর নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। ‘পাপাই দ্য সেইলর’ কার্টুন সিরিজের কিছু পর্ব নির্মাণের কাজে সহায়তা করেন জিন ডেইচ। কিন্তু এই কার্টুন সিরিজটির মূল পরিকল্পনা তার ছিল না। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মাঝের সময়ে ‘টম অ্যান্ড জেরি’-এর পাশাপাশি পাপাইয়ের জন্যও কাজ করেছিলেন।
১৯৬৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জিন ডেইচ ওয়েস্টন উডস স্টুডিওর জন্য অ্যানিমেশনের কাজ করেন। তিনি এই সময়ের মধ্যে ৩৭টি মুভির জন্য কাজ করেন। এর মধ্যে ‘ড্রামার হফ’, ‘ভয়েজেম’, ‘বানি প্ল্যানেট’ উল্লেখযোগ্য। টেলিভিশনের জন্য ‘দ্য ব্লাফারস’ ও ‘ক্রেজি ক্যাট’ সিরিজও তৈরি করেন ডেইচ। ২০০৮ সালে তিনি অবসর নেন। তবে তার কাজ কখনোই পুরোপুরি থেমে ছিল না। মৃত্যু অবধি লেখালেখির কাজ চালিয়ে যান ডেইচ, বিভিন্ন নতুন প্রজেক্টের দায়িত্বও নেন।
অ্যানিমেশনের জগতে দীর্ঘ সময় কাজ করার এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার দরুন ২০০৩ সালে তাকে আসিফা হলিউড থেকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। আর ২০০৪ সালে ডেইচ ভূষিত হন উইনসর ম্যাকে অ্যাওয়ার্ডে। ডেইচ চেকোস্লোভাকিয়ায় তার জীবনযাত্রা এবং পরবর্তী সময়ে চেক প্রজাতন্ত্রে কীভাবে জীবনযাপন করেন, তা সম্পর্কে আত্মজীবনীমূলক বই ‘ফর দ্য লাভ অভ প্লেগ’-এ লিখেন। ১৯৮৯ সালে তার এই বই প্রকাশিত হয়।