(পর্ব ৯ এর পর থেকে)
শত্রুরাষ্ট্রের অধিকর্তা: পরাজিত জার্মানির সামরিক প্রশাসক হিসেবে ঝুকভ
জার্মানির আত্মসমর্পণের পর বার্লিন বিজয়ী মার্শাল গিওর্গি ঝুকভকে জার্মানিতে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদলের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে তিনি ‘মিত্রপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ পরিষদে’ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য, জার্মানির আত্মসমর্পণের পর মিত্রশক্তির চার বৃহৎ সদস্য- সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানিকে চার খণ্ডে বিভক্ত করে নেয় এবং প্রত্যেকে একেকটি খণ্ডের শাসনভার লাভ করে। ঝুকভ জার্মানির সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত অংশের সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং এই অঞ্চলে সোভিয়েতদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন।
১৯৪৫ সালের ৫ জুন বার্লিনে মিত্রপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ পরিষদের পশ্চিমা প্রতিনিধিরা ঝুকভের সঙ্গে দেখা করেন এবং যত শীঘ্র সম্ভব পরিষদের কার্যক্রম শুরু করার আহ্বান জানান। কিন্তু ঝুকভ শর্ত প্রদান করেন যে, পরিষদের কার্যক্রম শুরুর পূর্বে জার্মানির সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সোভিয়েতরা চাচ্ছিল তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে এবং এক্ষেত্রে যাতে মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্যরা বাধার সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য ঝুকভ এই শর্ত আরোপ করেছিলেন।
এই বৈঠকের সময় মিত্রপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ পরিষদের মার্কিন প্রতিনিধি জেনারেল ডুইট আইজেনহাওয়ার ঝুকভকে ‘চিফ কমান্ডার অফ দ্য লেজিয়ন অফ মেরিট’ পদক প্রদান করেন। কিন্তু ঝুকভের সময়ক্ষেপণ তার পছন্দ হচ্ছিল না। এজন্য সোভিয়েতরা তাদের অতিথিদের জন্য যে ভোজের আয়োজন করেছিল, সেটি থেকে আইজেনহাওয়ার চলে যাচ্ছিলেন। এসময় ঝুকভ তাকে মজা করে বলেছিলেন, “আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করব এবং থাকতে বাধ্য করব!” অবশ্য তারপরেও আইজেনহাওয়ার এই অনুষ্ঠানে বেশিক্ষণ থাকেননি। পরবর্তীতে অবশ্য ঝুকভ ও আইসেনহাওয়ারের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং কয়েকদিন পর ঝুকভ যখন ফ্রাঙ্কফুর্টে অবস্থিত মার্কিন সদর দপ্তর সফর করেন, তখন তিনি আইজেনহাওয়ারকে সোভিয়েত ‘অর্ডার অফ ভিক্টোরি’ পদক প্রদান করেন।
জুলাইয়ে ঝুকভের তত্ত্বাবধানে বার্লিনের নিকটে পটসডামে অনুষ্ঠিতব্য মিত্রশক্তির শীর্ষ সম্মেলন আয়োজিত হয় এবং স্তালিন, মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (পরবর্তীতে ক্লিমেন্ট অ্যাটলি) এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে মিত্রশক্তির মধ্যবর্তী সুপ্ত দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঝুকভ এই সম্মেলনে সোভিয়েত প্রতিনিধিদলে ছিলেন না, কিন্তু তিনি সম্মেলনের বেশ কয়েকটি সেশনে অংশগ্রহণ করেন।
পটসডাম সম্মেলনের পর ঝুকভ জার্মানিতে সক্রিয় সোভিয়েত সামরিক প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ প্রদান করেন এবং এতে জার্মানি সংক্রান্ত সোভিয়েতদের নীতিমালা নির্ধারণ করে দেন। এগুলোর মধ্যে ছিল– জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়, জার্মান জীবনধারার প্রতিটি স্তর থেকে ফ্যাসিবাদী আদর্শের বিলুপ্তি, জার্মানির নাৎসিবিরোধী দলগুলোর প্রতি সমর্থন প্রদান এবং ভবিষ্যৎ সোভিয়েত–জার্মান সম্পর্কের জন্য জার্মান জনসাধারণের শ্রদ্ধা অর্জন। ঝুকভ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, সোভিয়েত সৈন্যদলের একটি অপরাধপ্রবণ অংশ তার উল্লেখিত শেষ লক্ষ্যটি পূরণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ তারা স্থানীয় জনসাধারণের বিরুদ্ধে লুটপাট ও সহিংসতা চালাচ্ছে। ঝুকভ এই ধরনের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং প্রয়োজন হলে অপরাধপ্রবণ সোভিয়েত সৈন্যদের গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে অফিসাররা তাদের অধীনস্থ সৈন্যদের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে তাদেরকেও শাস্তি দেয়া হবে বলে ঝুকভ হুমকি দেন।
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আইনসভা ‘সুপ্রিম সোভিয়েতে’র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ঝুকভ এই নির্বাচনে একজন প্রার্থী হন। তিনি জার্মানিতে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদলের জন্য সৃষ্ট একটি বিশেষ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের একদলীয় শাসনব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ঝুকভ যে নির্বাচিত হবেন, এটি ছিল নিশ্চিত। কিন্তু তার নির্বাচন নিয়ে বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল এবং ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় ঝুকভের একটি নির্বাচনী সভা সম্পর্কে প্রশংসাও করা হয়েছিল।
ঝুকভের আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয়
নির্বাচনের কিছুদিন পরেই ২২ মার্চ ঝুকভকে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় এবং মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়। ১ মে তারিখে ঝুকভ মে দিবস উপলক্ষে মস্কোর রেড স্কোয়্যারে আয়োজিত প্যারেড তত্ত্বাবধান করেন। কার্যত এ সময় ঝুকভ তখন পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে সফল ধাপে অবস্থান করছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, স্তালিনের বিশ্বস্ত ডানহাত হিসেবে ঝুকভের একটি লম্বা ক্যারিয়ার সুনিশ্চিত। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই ঝুকভের ভাগ্যাকাশে অন্ধকার দেখা দেয়।
১ জুন ঝুকভকে ‘উচ্চ সামরিক পরিষদে’র একটি সভায় ডাকা হয়। স্তালিন নিজে এই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং শীর্ষ সোভিয়েত রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দ এই সভায় অংশ নিয়েছিলেন। এই সভায় তাকে অহঙ্কারী আচরণ এবং সহকর্মীদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। উপস্থিত সামরিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কেউ ঝুকভের পক্ষে কথা বলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সভায় ঝুকভকে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ থেকে অপসারণ করা এবং তাকে একটি সামরিক জেলার অধিনায়ক হিসেবে বদলি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৯ জুন স্তালিন একটি অধ্যাদেশ জারি করে ঝুকভের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পুনরুল্লেখ করেন এবং ঝুকভকে ওদেসা সামরিক জেলার অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগের ঘোষণা দেন। এভাবে ঝুকভ আকস্মিকভাবে নিজেকে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক থেকে একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বহীন দ্বিতীয় শ্রেণির সামরিক জেলার অধিনায়ক হিসেবে আবিষ্কার করেন।
কার্যত অর্জিত বিজয় নিয়ে গর্ব করা কিংবা কোনো বিজয়ের একক কৃতিত্ব দাবি করা বহু সামরিক কর্মকর্তারই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঝুকভের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ঝুকভ অধিকাংশ সময়ে খুবই নিরহঙ্কার আচরণ করতেন, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তিনি ‘বালকসুলভ অহঙ্কার’ প্রদর্শন করতেন। সুতরাং ঝুকভের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ হয়ত পুরোপুরি অসত্য ছিল না। কিন্তু ঝুকভকে এজন্য যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল, সেটি ছিল মাত্রাতিরিক্ত এবং অস্বাভাবিক। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাল ফৌজের বিরাট বিজয়ের পর সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেই (যাদের মধ্যে ঝুকভ ছিলেন সর্বাগ্রে) ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এবং স্তালিন তাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন। এজন্য তাদেরকে একটি প্রচ্ছন্ন সতর্কবার্তা প্রেরণের উদ্দেশ্যেই তিনি ঝুকভকে এই শাস্তি দিয়েছিলেন।
ঝুকভের নিজের বক্তব্য অনুযায়ী, তাকে এই শাস্তি প্রদানের জন্য দায়ী ছিল তার প্রতি স্তালিনের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের ঈর্ষা। তার মতে, সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর প্রধান লাভ্রেন্তি বেরিয়া এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্তালিনের রাজনৈতিক ডেপুটি নিকোলাই বুলগানিন তার বিরুদ্ধে স্তালিনকে উস্কে দিয়েছিলেন। অবশ্য ঝুকভের পক্ষে তার শাস্তি মেনে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। এজন্য তিনি জুনের মাঝামাঝি শান্তভাবে ওদেসায় চলে যান। বাহ্যিকভাবে তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করেন এবং আগস্টে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সোচিতে ছুটি কাটাতে যান। কিন্তু তার বিপদ তখনো কাটেনি।
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঝুকভের সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রার্থী সদস্যপদ (candidate membership) বাতিল করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে ‘পার্টিবিদ্বেষী’ মনোভাব পোষণ করার অভিযোগ আনা হয়। এটি ছিল একটি গুরুতর অভিযোগ, কারণ এর ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ চাইলে তাকে গ্রেপ্তারও করতে পারত। ২১ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি ঝুকভ স্তালিনকে দুইটি চিঠি প্রেরণ করেন। সেগুলোতে তিনি নিজের ‘ভুল’ স্বীকার করেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে ‘অপপ্রচার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। চিঠি দুটি স্তালিনের কাছে পৌঁছেছিল, কিন্তু স্তালিন এর কোনো উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকেন। বরং ঝুকভের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান আরো জোরদার হয়।
১৯৪৭ সালের জুনে গায়িকা লিদিয়া রুসলানোভাকে একটি সামরিক মেডেল প্রদানের জন্য ঝুকভকে তিরস্কার করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৪৫ সালের আগস্টে বার্লিনে একটি অনুষ্ঠানে ঝুকভ রুসলানোভাকে এই পদক দিয়েছিলেন। একই অভিযোগে এককালে ঝুকভের অধীনে কাজ করা রাজনৈতিক কর্মকর্তা জেনারেল কনস্তান্তিন তেলেগিনকেও তিরস্কার করা হয়। কিন্তু তেলেগিনের শাস্তি কেবল তিরস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ থেকে অপসারণ করে প্রার্থী সদস্যপদ প্রদান করা হয়। ১৯৪৮ সালে তেলেগিন, রুসলানোভা এবং রুসলানোভার স্বামী জেনারেল ক্রুকভকে ঝুকভের সঙ্গে তাদের সংযোগ থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। ঝুকভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, এসময় তিনি নিজেও প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় থাকতেন।
পরবর্তী ঘটনাবলি ছিল ঝুকভের জন্য আরো বিপজ্জনক। জার্মানির সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক থাকাকালে তিনি যেসব মূল্যবান বস্তু সংগ্রহ করেছিলেন, সেগুলোর ওপরে এ সময় তদন্ত শুরু হয় এবং স্তালিনের অন্যতম সহচর আন্দ্রেই ঝদানভকে এই তদন্ত কমিশনের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে স্তালিনের নির্দেশে মস্কোয় অবস্থিত ঝুকভের ফ্ল্যাট ও ‘দাচা’য় (গ্রামের বাড়ি) গোপন তল্লাশি চালানোর অনুমোদন প্রদান করেন। ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ভিক্তর আবাকুমভ স্তালিনের কাছে এই মর্মে প্রতিবেদন পেশ করেন যে, তার অফিসাররা ঝুকভের দাচায় প্রচুর স্বর্ণ, অলঙ্কার, রূপোর তৈরি সামগ্রী, রেশম, দামি বই, পশম, বিদেশি আসবাবপত্র এবং ২০টি হাতে তৈরি শিকারের অস্ত্র পেয়েছে। আবাকুমভ মন্তব্য করেছিলেন, ঝুকভের দাচা দেখে বলা কঠিন যে এটি মস্কোয় অবস্থিত না জার্মানিতে!
ঝুকভের বক্তব্য ছিল যে, তার দাচায় প্রাপ্ত দ্রব্যাদির মধ্যে কিছু তিনি নিজের অর্থে ক্রয় করেছেন এবং কিছু উপহার হিসেবে পেয়েছেন। ঝুকভ উল্লেখ করেন যে, তার দাচার বহু আসবাবপত্র কার্যত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ই সরবরাহ করেছিল! ঝুকভ আবেদন করেন যে, তাকে যেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে থাকার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু ঝদানভ কমিশন তার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়নি। ২০ জানুয়ারি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সংস্থা পলিটব্যুরো এই মর্মে অধ্যাদেশ জারি করে যে, ঝুকভ পার্টির সদস্য থাকতে পারবেন, কিন্তু উল্লিখিত দ্রব্যাদি রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। একইসঙ্গে ঝুকভকে একটি কম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক জেলায় বদলি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঝুকভকে সভের্দলোভস্ক–কেন্দ্রিক উরাল সামরিক জেলার অধিনায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। এটি ছিল ওদেসা সামরিক জেলার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তা-ই নয়, ‘দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধে’র (সোভিয়েত ইউনিয়নে সোভিয়েত–জার্মান যুদ্ধকে এই নামেই অভিহিত করা হত) ইতিহাস থেকে ঝুকভের নাম সরিয়ে ফেলা হতে থাকে। ১৯৪৮ সালে মস্কোর লড়াই নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে ঝুকভের নাম উল্লেখ করা হয়নি বললেই চলে। ১৯৪৮ সালের আগস্টে জেনারেল রিবালকোর মৃত্যুর সংবাদ প্রাভদায় প্রচারিত হয় এবং সোভিয়েত মার্শালদের শোকবার্তা ছাপা হয়, কিন্তু মার্শালদের নামের মধ্যে ঝুকভের নাম ছিল না। ১৯৪৯ সালে অঙ্কিত একটি পোস্টারে স্তালিন ও তার শীর্ষ জেনারেলদের স্তালিনগ্রাদে পরিচালিত প্রতিআক্রমণ নিয়ে পরিকল্পনা করতে দেখা যায়, কিন্তু সেখানে ঝুকভকে উল্লেখ করা হয়নি।
অবশ্য ঝুকভের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের পরিণতি হয়েছিল এর চেয়েও ভয়াবহ। তেলেগিন, রুসলানোভা ও অন্যান্যদেরকে কারারুদ্ধ করা হয়। জেনারেল গোরদভ ও জেনারেল রিবালচেঙ্কো ঝুকভের প্রতি স্তালিনের বিরূপ আচরণের সমালোচনা করেছিলেন এবং এজন্য তাদেরকে গ্রেপ্তারের পর মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। সেদিক থেকে ঝুকভের ভাগ্য ছিল অনেক ভালো।
ঝুকভের ভাগ্য পরিবর্তন এবং পুনরুত্থানের সূচনা
১৯৪৯ সাল থেকে ঝুকভের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এই বছর মার্শাল আলেক্সান্দর ভাসিলেভস্কি সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ঝুকভের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো ছিল এবং ১৯৪৮ সালে ঝুকভের মেয়ে এরা ভাসিলেভস্কির ছেলে ইউরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ভাসিলেভস্কির উত্থান সম্ভবত ঝুকভের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে প্রাভদায় মার্শাল ফিয়োদোর তোলবুখিনের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হয় এবং শোক প্রকাশকারী মার্শালদের নামের মধ্যে ঝুকভের নামও উল্লেখ করা হয়। ১৯৫০ সালে ঝুকভ সভের্দলোভস্ক থেকে পুনরায় সুপ্রিম সোভিয়েতের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫১ সালে ঝুকভ একটি সরকারি প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে পোল্যান্ড সফর করেন এবং সেখানে সোভিয়েত–পোলিশ সম্পর্কের ওপর একটি ভাষণ প্রদান করেন, যেটি প্রাভদায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত সোভিয়েত মহাবিশ্বকোষের দ্বিতীয় সংস্করণে ঝুকভকে ইতিবাচকভাবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৫২ সালের অক্টোবরে ঝুকভ কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে একজন প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন এবং বিস্ময়করভাবে তাকে তার কেন্দ্রীয় কমিটির প্রার্থী সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ, ১৯৫০–এর দশকের প্রারম্ভে স্তালিন ঝুকভকে ধীরে ধীরে তার পুরনো মর্যাদা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। বস্তুত ঝুকভের বিশ্বাস ছিল, ১৯৫৩ সালে যদি স্তালিনের মৃত্যু না হতো, তাহলে তিনি হয়তো ঝুকভের পরিপূর্ণ মর্যাদাই ফিরিয়ে দিতেন এবং এমনকি তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীও নিযুক্ত করতেন!
নতুন সরকারে ঝুকভ: স্তালিনের মৃত্যু এবং বেরিয়ার পতন
১৯৫৩ সালের ৪ মার্চ সভের্দলোভস্কে থাকা অবস্থায় ঝুকভকে স্তালিনের অন্যতম সহচর নিকোলাই বুলগানিন পরবর্তী দিন মস্কোয় যেতে বলেন। ঝুকভ মস্কোয় পৌঁছানোর পর তাকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের একটি জরুরি বৈঠকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটিতে সভাপতিত্ব করছিলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। সেখানে পৌঁছানোর পর ঝুকভ জানতে পারেন যে, স্তালিন গুরুতরভাবে অসুস্থ। বৈঠকটিতে নতুন একটি সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গিওর্গি মালেনকভ প্রধানমন্ত্রী ও বুলগানিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন, এবং ঝুকভ ও ভাসিলেভস্কিকে বুলগানিনের ডেপুটি নিযুক্ত করা হয়। একই দিনে স্তালিনের মৃত্যু হয় এবং ৯ মার্চ আয়োজিত রাষ্ট্রীয় শবযাত্রায় ঝুকভ তাকে গার্ড অফ অনার প্রদান করেন।
১৫ মার্চ সুপ্রিম সোভিয়েত উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঝুকভের নাম অনুমোদন করে। এর মধ্য দিয়ে ঝুকভ তার পুরনো মর্যাদা ফিরে পান। তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদেরকে এসময় মুক্তি দেয়া হয় এবং যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তাদেরকেও নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৩ সালের মে মাসে প্রাভদায় ঝুকভ কর্তৃক লিখিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্তালিনের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
অবশ্য নতুন সোভিয়েত সরকারের অবস্থান তখনো সুদৃঢ় হয়নি এবং সরকারের সদস্যদের মধ্যে সূক্ষ্ম ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। বিশেষত স্তালিনের সময়কার গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর প্রধান লাভ্রেন্তি বেরিয়াকে নতুন সরকার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছিল, কারণ বেরিয়া ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও ষড়যন্ত্রে পটু। ১৯৫৩ সালের ২৬ জুন বুলগানিন ঝুকভকে টেলিফোন করে ক্রেমলিনে আসতে বলেন এবং সেখানে পার্টির শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে বেরিয়াকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঝুকভ এবং আরো কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে এই কাজের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে বেরিয়ার সঙ্গে পার্টির নেতাদের বৈঠক চলাকালে মালেনকভের ইঙ্গিতে ঝুকভ ও অন্যরা বেরিয়াকে গ্রেপ্তার করেন। বেরিয়াকে বিশ্বাসঘাতকতা, সন্ত্রাসবাদ ও বিপ্লববিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ঝুকভ মন্তব্য করেছিলেন, তিনি জীবনে যেসব কাজ করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেরিয়াকে গ্রেপ্তার করা।
বস্তুত ঝুকভকে উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা এবং বেরিয়াকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে ঝুকভকে ব্যবহার করার পিছনে নতুন সরকারের নিজস্ব কারণ ছিল। ঝুকভ ছিলেন একজন জনপ্রিয় সমরনায়ক এবং নতুন সরকারে তার অন্তর্ভুক্তির ফলে সশস্ত্রবাহিনী তো বটেই, সোভিয়েত জনসাধারণেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নতুন সরকারকে সমর্থন করতে উৎসাহিত হবে, এটি তাদের জানা ছিল। অবশ্য ঝুকভকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে বুলগানিন আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু পার্টির অন্য নেতারা তার আপত্তি অগ্রাহ্য করেন এবং ঝুকভকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করেন।
সরকারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ঝুকভ বুলগানিনকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, স্তালিন তার প্রতি যে আচরণ করেছেন তার জন্য বুলগানিন দায়ী ছিলেন, কিন্তু তিনি অতীতের সমস্যা ভুলে একযোগে বুলগানিনের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। অবশ্য বুলগানিন ঝুকভের মতো স্পষ্টভাষী বা রাজনৈতিকভাবে আনাড়ি ছিলেন না। কার্যত তিনি ঝুকভকে সোভিয়েত রাজনীতির কেন্দ্রস্থল থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করেন। উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঝুকভের যেসব দায়িত্ব ছিল, সেসব পালন করার জন্য তাকে প্রায়ই মস্কোর বাইরে থাকতে হতো এবং এর ফলে তিনি ‘লাইমলাইট’ থেকে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করতেন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে হয়তো ঝুকভ উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবেই তার অবশিষ্ট জীবন কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু সোভিয়েত রাজনীতির জটিল চক্রে ঝুকভের ভাগ্য একাধিকবার পরিবর্তিত হয় এবং এর ফলে প্রথমে উত্থান ও পরবর্তীতে পতন তার জীবনকাহিনীর নিয়মিত প্যাটার্ন হয়ে দাঁড়ায়। শীঘ্রই ঝুকভ আবির্ভূত হবেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘কিংমেকার’ হিসেবে!
(এরপর দেখুন ১১শ পর্বে)