মৃত্যুর প্রায় ৪৪ বছর পর টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক ‘শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি’ উপাধিতে ভূষিত হওয়া অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে আলাদা করে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন তার অসীম জ্ঞান আর রাষ্ট্র পরিচয়হীন সুখী মানুষ ইমেজের জন্য। বলা হয়, তার জনপ্রিয়তা এখনও পর্যন্ত এতটাই বেশি যে, প্রায় প্রতি ২০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও একবার তার নাম উচ্চারিত হয়!
কিন্তু ইতিহাসে সবসময় যেমনটা দেখা যায়, আইনস্টাইনের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিংবদন্তিতুল্য বাবার সন্তানেরা যেন জন্ম থেকেই পাদপ্রদীপের আড়ালে প্রত্যাশার এক ভারি বোঝা কাঁধে নিয়ে নিভৃতে জীবন পার করে দেয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে হয়ে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেননি, ঠিক তেমনি আইনস্টাইনের ছেলে হয়ে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে প্রচুর কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে হান্স অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকেও।
আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি বা খেতাব তার নেই। ছিলেন একজন সাধারণ প্রকৌশলী, অ্যাকাডেমিয়াতে পড়ানোই ছিল তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তার মতো খ্যাতি আর প্রতিভা থাকতেই হবে, এমন মানসিক চাপে আজীবন তাকে জর্জরিত করেছেন খোদ আইনস্টাইন। সারাক্ষণ বাবার সাথে তুলনীয় হতে হতে কীভাবে হান্সকে সেই বাবার সাথে লড়াই করেই আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে হলো, আজ তবে জেনে নেয়া যাক সেই গল্প।
হান্স অ্যালবার্টের প্রথম জীবন এবং ক্যারিয়ার
১৯০৪ সালের ১৪ মে সুইজারল্যান্ডের বার্নে জন্মগ্রহণ করা হান্স অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন অ্যালবার্ট এবং মিলেভা ম্যারিক দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান, প্রথম পুত্র। হান্সের বড় বোন লিজারেলের কী হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি। ধারণা করা হয়, হান্সের জন্মের বছরখানিক আগে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় লিজারেল। তখন তার বয়স ছিল খুবই কম, যে কারণে খুব একটা আলোচনায় আসেনি আইনস্টাইনের প্রথম সন্তান।
হান্সের বয়স তখন ৬ বছর। তাদের পরিবারে এলো নতুন সদস্য, এডওয়ার্ড আইনস্টাইন। তার ঠিক ৪ বছর পরেই আইনস্টাইন দম্পতি আলাদা থাকতে শুরু করেন। এভাবে প্রায় ৫ বছর কেটে যাওয়ার পর বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং মিলেভা ম্যারিক। কিশোর হান্সের উপর এই বিচ্ছেদের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছিল। স্কুলে গিয়ে বই-খাতায় মুখ গুঁজে দিন কাটছিল তার। বাবার সাথে যোগাযোগ হতো চিঠির মাধ্যমে। বাবা আইনস্টাইন শিশুপুত্রকে চিঠিতে নানারকম জ্যামিতিক সমস্যা পাঠাতেন, ছেলে তা সমাধান করে ফিরতি চিঠিতে বাবাকে পাঠাতো। হান্সের সাথে নানা গোপন আবিষ্কার আর সাফল্যের খবরও ভাগাভাগি করতেন তিনি।
ছেলেদের পড়ালেখার দায়ভার ন্যস্ত ছিল মায়ের উপর। হান্সকে ভর্তি করে দেয়া হলো জুরিখের সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে, যেখান থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন সাবেক আইনস্টাইন দম্পতিও। কৃতিত্বের সাথে এখান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন হান্স। ভালো ছাত্র হিসেবে কদর ছিল তার। কিন্তু হান্সের এই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেয়ার বিষয়টি পছন্দ হয়নি সিনিয়র আইনস্টাইনের।
বিখ্যাত পদার্থবিদের মতে, হান্সের সিদ্ধান্ত ছিল ‘একেবারেই ফালতু’। ক্যারিয়ার ভাবনা নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে শুরু হয় তুমুল দ্বন্দ্ব। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তার পথ ধরে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করুক। আর ছেলে চেয়েছিল নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন এক ক্যারিয়ারে পা বাড়াতে, যেখানে সে গড়ে তুলতে পারবে নিজের পরিচয়। এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে বেশ কয়েক বছর। হান্স তার ব্যক্তিগত মতামত অনুযায়ী পরবর্তী গন্তব্য বেছে নেন। বাবা-ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলতে থাকে দীর্ঘদিন।
আইনস্টাইনের পারিবারিক বন্ধন
পড়ালেখার গণ্ডি পেরিয়ে জার্মানিতে পাড়ি জমান হান্স এবং সেখানেই প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন বহু বছর। একটি সেতুর প্রজেক্টে স্টিল ডিজাইনার হিসেবে কাজের পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রি নেন তিনি। দ্বিতীয় পুত্র এডওয়ার্ডের সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল আইনস্টাইনের। এডওয়ার্ড স্কিৎজোফ্রেনিয়ার চরম মাত্রায় ভুগছিলেন। তার জীবনের বেশিরভাগ কাটে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে। ছোট ছেলেকে লেখা চিঠিতে হান্সের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ পেত বাবা আইনস্টাইনের। হান্সের ক্যারিয়ার, হঠাৎ করে বিয়ে করা- সবকিছুকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন সিনিয়র আইনস্টাইন।
১৯২৭ সালে ফ্রিদা নেট নামক ৯ বছরের বড় এক নারীকে বিয়ে করেন হান্স। তার বাবার চোখে ফ্রিদা ছিলেন ‘অতি সাধারণ একটি মেয়ে’। এককথায় এই মেয়ের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্কে জড়ানোর প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মতি তার ছিল না। ছেলেকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ফ্রিদার সাথে যেন কোনো সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা না করেন। বলেছিলেন, খুব তাড়াতাড়ি মেয়েটির উপর থেকে মোহ কেটে যাবে হান্সের।
“শেষ পর্যন্ত,” বলেছিলেন আইনস্টাইন, “এমন দিনই আসবে”।
ফ্রিদাকে কখনোই পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নিতে পারেননি আইনস্টাইন। প্রাক্তন স্ত্রী মিলেভাকে লেখা একটি চিঠিতে হান্সের প্রতি যেন আগের চেয়ে একটু বেশিই আবেগ প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু একইসাথে বিতৃষ্ণা ফুটে ওঠে পুত্রবধূর প্রতি। কবে ফ্রিদার হাত থেকে ছেলে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই যেন তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে।
“এমন চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছেলেটা,” ছেলের সাথে দেখা করে এসে সাবেক স্ত্রীকে লেখেন তিনি, “তার এমন বৌ হবে, এটা মানাই যায় না। কিন্তু ও সুখে থাকলে আমরা আর কী-ই বা করতে পারি?”
হান্স অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ঘর আলো করে আসে তিন সন্তান। তিনজনের মধ্যে কেবল একটি শিশুই শৈশব অতিক্রম করতে পারে, বাকি দুজন খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। হান্সের ছেলে টেকনিক্যাল সায়েন্সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করলেও সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর খুব বেশি সুযোগ পায়নি। ১৯৩৩ সালে নাৎসি বাহিনীর সমর্থন বৃদ্ধি এবং সেমিটিক বিরোধী মনোভাবের জন্য জোরপূর্বক জার্মানিতে পাড়ি জমাতে হয় অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে। ছেলে হান্সের কী হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। হান্সকেও তার সাথে পালিয়ে যেতে বলেন। ১৯৩৮ সালে হান্স পালান ঠিকই, কিন্তু তিনি আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীনভিলে।
যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কৃষি বিভাগে যোগ দেন হান্স। পলল স্থানান্তরে বিশেষজ্ঞ হান্স সেখানে বেশ ভালো কাজ করছিলেন। কিছুদিন পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান তিনি, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে একই বিভাগে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে ১৯৭৩ সালে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ধীরে ধীরে ছেলের সাফল্যের খোঁজ পেয়ে ক্যারিয়ার চিন্তায় সহমত পোষণ করতে থাকেন বাবা। বাবার কাছ থেকে উপদেশ নেয়া, পারিবারিক সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে তাদের ছেদ পড়া সম্পর্ক নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়।
আইনস্টাইনের উত্তরাধিকার
পিতা অন্তঃপ্রাণ পুত্র বা পিতার নয়নমণি পুত্র, এমন কোনো সম্পর্ক তাদের মধ্যে না থাকলেও আইনস্টাইনদ্বয়ের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। দুজনের মধ্যে রেষারেষির যাবতীয় সূত্রপাত তাদের ভালো থাকাকে ঘিরেই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা স্নেহ-ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সিনিয়র আইনস্টাইন তার নিজের পছন্দের বিষয় পদার্থবিদ্যার চেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতি বড় ছেলের বেশি ভালোবাসা দেখে আজীবনই মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। কিন্তু নিজ জগতে হান্সের বিচরণ এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে তাকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। গুগেনহ্যাম ফেলোশিপ, আমেরিকান সোসাইটি অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সের পক্ষ থেকে গবেষণা অ্যাওয়ার্ড, কৃষি বিভাগ থেকে অজস্র পদক আর সম্মাননা তার প্রাপ্তির ঝুলি কানায় কানায় পূর্ণ করে দিলেও বাবার আক্ষেপ ছিল একটি ‘নোবেল পুরস্কার’ না পাওয়া নিয়ে।
পিতা-পুত্রের মন কষাকষি দূর করতে বড় একটি ভূমিকা রাখে পারিবারিক টানাপোড়েন। ১৯৩৯ সালে যখন হান্সের দ্বিতীয় পুত্র ডেভিড ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, সে সময় অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এগিয়ে এসে নিজের সন্তান হারানোর স্মৃতিচারণ করে হান্সকে সান্ত্বনা দেন। হান্সের তিন ছেলের মধ্যে দুজন মারা গেলে একটি মেয়ে দত্তক নেয়ার ব্যাপারে বাবাই তাকে উৎসাহিত করেন। ১৯৫৫ সালে প্রিন্সটনে যখন বাবা আইনস্টাইন মারা যান, তার আগ দিয়ে বেশিরভাগ সময় হান্স তার সাথেই কাটাতেন। এর তিন বছর পর হান্সের স্ত্রী মারা গেলে আবারও বিয়ে করেন তিনি, কিন্তু আর কোনো সন্তান নেননি।
১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হান্স অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ছোট ছোট নাতিদের সাথে সময় কাটাতে দারুণ পছন্দ করতেন আইনস্টাইন। ওদের দেখতে প্রায়ই দক্ষিণ ক্যারোলিনায় চলে আসতেন তিনি। শুরুর দিকে হান্সকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগলেও শেষ পর্যন্ত হান্স ঠিকই দেখিয়েছেন, তিনিও বাবার চেয়ে নিজের জগতে কোনো অংশে কম যান না।