পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, যাকে বলা হয় পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক, তার জন্ম খুব কাছাকাছি সময়ে তো নয়ই বরং খ্রিস্টের জন্মেরও ৪০০ বছর পূর্বে। আনুমানিক ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যে বছর ৮০তম অলিম্পিয়াড শুরু হয়েছিল, সে বছর প্রাচীন গ্রিসের কস দ্বীপে জন্ম নেন তিনি। আর ক্রমে হয়ে ওঠেন সমসাময়িক সবচেয়ে প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্ব। গড়ে তোলেন বিখ্যাত এক চিকিৎসার স্কুল, পাল্টে দেন প্রচলিত চিকিৎসাবিজ্ঞান আমূলে। তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো তিনি চিকিৎসা করার বিষয়টি একটি পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। পাশাপাশি এই পেশা যেন কলুষিত না হয় সেজন্য তৈরি করেন নৈতিক শপথবাক্য, তিনি হিপোক্রেটিস।
‘হিপোক্রেটিস’ নামটি ছিল তৎকালীন গ্রিসের সবচেয়ে সাধারণ নাম। বলা চলে প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন নাম হিপোক্রেটিস থাকার প্রবল সম্ভাবনা ছিল! সেজন্য ইতিহাসবিদগণ তার পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি এড়াতে তাকে ‘হিপোক্রেটিস অব কস’ কিংবা ‘হিপোক্রেটিস দ্য গ্রেট’ নামে অভিহিত করেন। তিনি জন্ম নেন সম্ভবত প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সময়ে। কেননা তার জীবদ্দশায় ডেমোক্রিটাস, সক্রেটিস আর প্লেটোরা পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চা করেছেন। অন্যদিকে এসব বড় বড় নামের ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি, বরং নিজেকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন সদর্পে। যে কারণে প্লেটোর বিভিন্ন লেখায় আমরা হিপোক্রেটিসের বর্ণনা পাই। যেমন: প্লেটো তার একটি ডায়লগ ফায়েড্রাসে বলেছেন যে, হিপোক্রেটিস ছিলেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষক। প্রোটাগোরাস নামক অপর একটি ডায়লগে প্লেটো ‘হিপোক্রেটিস অব কস’-কে গ্রিসের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অধিকাংশ প্রাচীন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীর মতোই হিপোক্রেটিসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই আজ অবধি টিকে আছে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোতে রয়েছে সত্য-মিথ্যার বিতর্ক। তবে বিখ্যাত দার্শনিক এরাটোস্থেনিসের রেফারেন্সগুলোকে বেশ নির্ভরযোগ্য বলেই ধরা হয়। যা-ই হোক, হিপোক্রেটিসের আলোচনায় আসা যাক এবার। আজকের দিনের খান, ভূঁইয়া, কিংবা চৌধুরী বংশের মতোই প্রাচীন গ্রিসের একটি বিখ্যাত উপাধি ছিল ‘অ্যাসক্লিপিয়াস’। কস দ্বীপের এমনই এক সম্ভ্রান্ত অ্যাসক্লিপিয়াড বংশে জন্মগ্রহণ করেন হিপোক্রেটিস। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া শুরু করেছিলেন এককথায় বংশপরম্পরা রক্ষার্থেই। তার পিতামহের নামও ছিল হিপোক্রেটিস, যিনি বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। হিপোক্রেটিসের বাবা হেরাক্লিডসও চিকিৎসক ছিলেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানটা হিপোক্রেটিস পুরোটাই তার বাবার নিকট শিখেছিলেন। কারণ তখনো চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ালেখার আলাদা একটি শাখা হিসেবে গড়ে ওঠেনি, খোলা হয়নি কোনো স্কুলও। এমনকি চিকিৎসা করাকে মানুষ পেশাই মনে করতো না! কোনো একটি মূল পেশার পাশাপাশা মানুষ চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করতো। যা-ই হোক, বাবার কাছে দীক্ষা নেয়া শেষে কস দ্বীপেই কাজ শুরু করেন হিপোক্রেটিস। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নাম না জানা রমণীকে বিয়ে করেছিলেন। এই দম্পতির ঘরে জন্ম হয় দুই ছেলে এবং এক মেয়ের। প্রথাগতভাবে দুই ছেলেকেও প্রশিক্ষণ দিয়ে ডাক্তার বানান হিপোক্রেটিস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেয়ের জামাই পলিবাসকেও তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে ডাক্তার বানিয়ে ছাড়েন। পিতামাতার পরই নিজের দুই ছেলেকে নিয়ে কস ছেড়ে থিসেলি দ্বীপের উদ্দেশ্যে সমুদ্রে পাড়ি জমান হিপোক্রেটিস। কসে নিজের সমস্ত দাতব্য কর্মের ভার দিয়ে আসেন মেয়ের জামাইয়ের কাঁধে। থিসেলিতে নিছক ঘুরে বেড়াতে যাননি হিপোক্রেটিস। তিনি গিয়েছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে। কোনো ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তার স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম- এ নিয়েই শেখা শুরু করেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে হিপোক্রেটিসের অবদান আলোচনা করার পূর্বে একটি ঘটনা আলোচনা করা আবশ্যক, যা গ্রীকদের চিকিৎসাশাস্ত্রকে দ্রুত বদলে যাওয়ায় সহায়তা করেছিল। ঘটনাটি হিপোক্রেটিসের জন্মের কয়েক দশক আগের। তখন চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্রীকদেরকে মাঝারি মানের মনে করা হতো। বরং মিসরীয়রা তখন চিকিৎসাশাস্ত্রকে এককভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতো বলা চলে। এর মূল কারণ হচ্ছে পারস্যদের মিসরীয়দের উপর নির্ভরশীলতা। ‘দ্য গ্রেট কিং অব দ্য পারসিয়ানস’ নামে পরিচিত রাজা দারিয়ুস একবার তার পায়ের গোড়ালিতে ভীষণ চোট পান। স্বাভাবিকভাবেই একজন মিসরীয় চিকিৎসককে দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন, কিন্তু ফল হলো উল্টো। তার গোড়ালি ফুলে ঢোল হলো আর প্রচণ্ড ব্যথায় তার রাতের ঘুম উবে গেল! টানা সাতদিন নিদ্রাহীন থাকার পর তিনি ‘মাঝারি’ মানের এক গ্রীক চিকিৎসককে নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। আর সেদিন থেকেই তিনি আবার শান্তিতে ঘুমাতে পারলেন। মাত্র এক মাসের মধ্যে তার গোড়ালি সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে গেলো। সে গ্রীক চিকিৎসকের নাম ছিল ডেমোসিডিস। এর পর থেকে পারস্যের আনুকূল্যের হাওয়া ঘুরে গেল গ্রীসের দিকে, আর গ্রীকরা হয়ে উঠলো চিকিৎসাশাস্ত্রের সর্বেসর্বা।
“কোনো রোগের ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক দু’টি কাজ করতে পারেন: ১) রোগ সারিয়ে দিতে পারেন এবং ২) সারাতে না পারলে অন্তত অবস্থার অবনতি ঘটানো থেকে বিরত থাকতে পারেন।”- হিপোক্রেটিস
হিপোক্রেটিস তার চিকিৎসাশাস্ত্র প্রশিক্ষণ দেবার স্কুল কবে খুলেছিলেন সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তিনি ও তার স্কুল চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য যে সব অবদান রেখে গেছেন সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
- ঔষধ তৈরির কৌশল আবিষ্কার।
- প্রাচীন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসালয় এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘হিপোক্রেটিস স্কুল অব মেডিসিন’।
- চিকিৎসকদের বেদবাক্য বলে পরিচিত ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ হিপোক্রেটিসের অবদান।
- চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক নিয়ম কানুন লিপিবদ্ধকরণ।
- “রোগ হওয়াটা কোনো স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়, বরং এটি অতিপ্রাকৃত কোনো রহস্য”- এরূপ ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা।
- রোগের জন্য যাদুটোনা বাদ দিয়ে বাস্তবসম্মত উপায়ে চিকিৎসার প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি করা।
- রোগীকে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে জোর দেয়া।
- ‘প্রোগনোসিস’ বা পূর্বাভাসের ধারা তৈরি করা। যেমন কোনো সর্দির রোগীর লক্ষণগুলো এবং নিরাময়ের উপায় লিপিবদ্ধ করে পরবর্তীতে একই লক্ষণের রোগী পেলে তাকে একই নিরাময় পন্থা বাতলে দেয়া।
- পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারণ যে স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে, সে বিষয়টি অনুধাবন করা।
সাফল্যের সাথে কিছু গুরুতর ব্যর্থতাও আছে হিপোক্রেটিসের। যেমন, মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ করা অমঙ্গলজনক, এরূপ ভ্রান্ত ধারণা থেকে তিনি কখনো কোনো মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করেননি এবং অ্যানাটমির জ্ঞানবিবর্জিতই থেকেছেন। অন্যদিকে কালো পিত্ত, হলুদ পিত্ত, রক্ত এবং কফ, এই চারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থাই দেহে রোগের সৃষ্টি করে বলে বিশ্বাস করতেন হিপোক্রেটিস, যা অদ্ভুত এবং একইসাথে হাস্যকর। তার আরো একটি হাস্যকর বিশ্বাস ছিল এই যে, ফোটানো পানি পান করা যাবে না, কারণ তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর! এই মুখ হা হয়ে যাবার মতো কথার পেছনে রয়েছে তার লাগসই যুক্তিও। তার মতে, পানিতে একটি উৎকৃষ্ট এবং একটি নিকৃষ্টতর অংশ রয়েছে, যা আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখতে পাই না। উৎকৃষ্টতর অংশটি আবার হালকা হয়, যে কারণে ফোটালে তা বাষ্প হয়ে যায়। তাই ফোটানো পানিতে শুধু নিকৃষ্টতর অংশটি থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য একেবারেই ভালো নয়!
হিপোক্রেটিসের জীবনে একটি বিখ্যাত ঘটনা রয়েছে। ৪২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি যখন উত্তর গ্রীসে ভ্রমণে যান, তখন সেখানে প্লেগের মহামারী চলছিল। তিনি তাদের রোগের অবস্থা এবং ধরন দেখে নিজের দেশের লোকজনের জন্যও বিচলিত বোধ করলেন। তিনি দ্রুত তার নিজের শহরে লোক পাঠালেন যেন সবাই সাবধান হয়ে যায়, কারণ দ্রুতই আসছে প্লেগ! কীভাবে বুঝলেন হিপোক্রেটিস? তিনি আবহাওয়া এবং বাতাসের দিক পর্যবেক্ষণ করে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তা সঠিকভাবে ফলেছিল! পরে তিনি ও তার ছেলেরা কসে ফিরে গিয়ে প্লেগ রোগীদের চিকিৎসা করেন। তার এসব কাজের জন্য কসবাসী তাকে একটি সোনার মুকুট উপহার দিয়েছিল।
খুব সম্ভবত ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লারিসা দ্বীপে মৃত্যুবরণ করেন হিপোক্রেটিস। তবে তার মৃত্যু নিয়ে বিতর্কের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। তার মৃত্যুর সালটি ৩৭০ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টপূর্ব ধরা হয়। তার আবিষ্কার বা অবদান আজকের সময়ে যত ছোটই মনে হোক না কেন, আদতে আজকের আধুনিক চিকিৎসার ভিত এই হিপোক্রিটাসরাই গড়ে দিয়েছেন। গ্যালের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো বছর তার চিকিৎসা বিষয়ক দর্শন সর্বত্র প্রচলিত ছিল।