Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিসেরো: রোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ এবং বাগ্মী

প্রাচীন রোমের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মার্কাস সিসেরো ছিলেন একাধারে একজন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, আইনজীবী, দার্শনিক, বাগ্মী, দূত এবং সংবিধান প্রণেতা। গুণধর এই ব্যক্তি সিসিলিতে কোয়েস্টর থাকাকালীন সেখানকার গভর্নর গাইয়াস ভেরাসকে দোষী সাব্যস্ত করেন। অত্যন্ত প্রভাবশালী ফেরাসের রায় কার্যকর করতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয় সিসেরোকে। তবে সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করবার জন্য তিনি তখন নিয়মিত সভা-জমায়েতে বক্তৃতা রাখতেন। আর বক্তৃতা দিয়ে তিনি এতই জনপ্রিয়তা লাভ করেন যে, তখনকার সময়ে তিনি শ্রেষ্ঠ ‘বাগ্মী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অন্যদিকে আদালতে তার বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনতেন জুরিরা। এমনকি অনেক ইতিহাসবিদের মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী।

মার্কাস টুলিয়াস সিরেরো (১০৬-৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ); source: ianchadwick.com

১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৩ জানুয়ারি, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ৭০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে, আরপিনাম নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন সিসেরো। এই শহরটি বর্তমানে আর্পিনো নামে পরিচিত এবং ইতালির লাজিওর অন্তর্গত। তার পুরো নাম মার্কাস টুলিয়াস। সিসেরো হচ্ছে তার বংশগত উপাধি, ঠিক যেমন আমাদের দেশে চৌধুরী, খান ইত্যাদি প্রচলিত। এই সিসেরো উপাধির উৎপত্তিটা বেশ মজাদার। মার্কাস সিসেরোর কোনো এক পূর্বপুরুষের নাকের ডগায় ছিল ছোট্ট একটি আঁচিল। আঁচিলটি দেখতে অবিকল ছোলা বুটের মতোই ছিল। ব্যস, নাম হয়ে গেল ছোলা বুট! মানে, সিসেরো শব্দের অর্থ হচ্ছে ছোলা বুট! যা-ই হোক, এই সিসেরো পরিবারের মার্কাস সিসেরো ছাড়া কেউই তেমন জনপ্রিয় নন বলে, ইতিহাসে তিনি কেবল সিসেরো নামেই অধিক পরিচিত।

শৈশব থেকেই সিসেরো ছিলেন বিদ্যানুরাগী। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সাহিত্যানুরাগী। বাল্যকালেই অনেক ক্লাসিক গ্রীক আর রোমান সাহিত্য পড়ে শেষ করে ফেলেন। পাশাপাশি দর্শন আর আইনশাস্ত্রেও পড়ালেখা চালিয়ে যান। তবে, সুবোধ বালক সিসেরোর নিষ্কলুষ মনে গভীরভাবে দাগ কাটে ৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঘটে যাওয়া বিখ্যাত ‘সোশ্যাল ওয়্যার’। ১৬ বছর বয়সী কিশোর সিসেরোকেও সে যুদ্ধে বাধ্যতামূলক অংশ নিতে হয়েছিল পম্পেইয়ের সৈন্যদের সাথে। আর এখানেই তার মনে রোপিত হয় রাজনীতির বীজ।

সোশ্যাল ওয়্যার; source: heritage-history.com

খ্রিস্টপূর্ব ৮০ অব্দে, সিসেরো যখন ২৬ বছরের যুবক, তিনি আরপিনামে উকিল হিসেবে আইনব্যবসা শুরু করেন। আর শুরুতেই বাজিমাত করেন একটি ‘প্রায় অসম্ভব’ কেস জিতে। ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এই আইনি লড়াইয়ে সেক্সটাস রোসিয়াস নামক, গুরুহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত এক কৃষকের পক্ষে লড়াই করেন সিসেরো। শহরসুদ্ধ মানুষ ধরেই নিয়েছিল, রোসিয়াসকে বাঁচাতে পারবেন না সিসেরো। ফাঁসি তো হবেই। কিন্তু, সবাইকে তাক লাগিয়ে সিসেরো রোসিয়াসকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। বরং, নানান যুক্তিতর্ক আর প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি রোসিয়াসের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী, ম্যাগনাস এবং ক্যাপিটোকেই দোষী প্রমাণ করে দেন! ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এই এক মামলা জয়েই সিসেরোর জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়। দিকে দিকে রটে যায়, যেকোনো অসম্ভব কেসই সিসেরোর পক্ষে সম্ভব!

এর কিছুদিন পর, সিসেরো আরো একটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল কেসে জয়লাভ করেন। ফলে, তার ব্যাপারে রটনা কিছুটা হলেও সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এই কেস জিতেই যেন খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েন সিসেরো। চারদিক থেকে অহরহ কেস আসতে থাকে তার কাছে। কোনটা রেখে কোনটা লড়বেন তিনি? তার চেয়ে বরং কিছুদিনের জন্য শহর ছেড়ে গ্রিসে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গ্রিসের এথেন্সে সময়টা কিন্তু মোটেও খারাপ যায়নি তার। একদিকে কিছুদিন বিশ্রাম হয়ে গেল, অন্যদিকে দর্শন আর রাজনীতি বিষয়ে ব্যাপক পড়ালেখা করার অবসর পান। আর এখানেই আমৃত্যু বন্ধু হিসেবে খুঁজে পান, পৃথিবীর প্রাচীনতম একজন সংবাদদাতা, পত্রলেখক টিটাস অ্যাটিকাসকে।

সেক্সটাস রোসিয়াসের মামলায় বিচারকদের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন সিসেরো; source: antarcticaedu.com

কয়েক মাস এথেন্সে থাকার পর, ভ্রমণে বের হন সিসেরো। তিনি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের এশিয়ান অংশে (বর্তমান তুরস্ক) এবং বিখ্যাত রোডস দ্বীপে ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাগ্মিতা শিক্ষা। ৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি রোমে ফিরে আসেন এবং এসেই আইন ব্যবসা পুনরায় আরম্ভ করেন। দুই বছরের মাথায় তিনি চলে যান সিসিলিতে এবং সেখানে কোয়েস্টরের পদ লাভ করেন। প্রাচীন রোমে যে ব্যক্তি কর আদায় এবং সরকারি কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করতেন, তাকে কোয়েস্টর বলা হতো। এর কিছুকাল পরই শুরু হয় তার জীবনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়াইয়ের। যদিও এবার তিনি উকিল নন, ছিলেন কোয়েস্টর পদে, তথাপি গাইয়াস ভেরাসকে দোষী সাব্যস্ত করায় তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।

ভেরাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। ভেরাস তার প্রভাব খাটিয়ে নিজের লোককে কোয়েস্টর পদে বসাতে চেয়েছিলেন, যেন তার অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারটি গোপন থাকে। কিন্তু ভেরাসের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সিসেরো নিজে এগিয়ে এলেন এবং বিশেষ আদালতের সামনে নিজেকে কোয়েস্টর করার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করলেন। কোয়েস্টর হয়েই তিনি ভেরাসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। এবার ভেরাস তার কৌশল বদলে বিচারের শুনানি যথাসম্ভব বিলম্বিত করার প্রয়াস চালান। তার ইচ্ছা ছিল, কোনোরকম সে বছরটি পার করে দিলেই, পরের বছর তার নিজের পছন্দের লোক গভর্নর হয়ে তাকে মুক্ত করবে। কিন্তু সিসেরো কি তা হতে দিতে পারেন?

যুক্তিতর্ক দ্বারা ভেরাসকে দোষী প্রমাণ করছেন সিসেরো; source: spiked-online.com

অবিশ্বাস্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সকল সাক্ষ্য-প্রমাণ জড়ো করে ফেললেন সিসেরো এবং পেশ করলেন আদালতে। তার প্রাথমিক বক্তৃতায়ই আদালত প্রাঙ্গণে ভেরাসের পরাজয় ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। আর পরাজয় সুনিশ্চিত বুঝতে পেরে ভেরাস, শুনানি আর সামনেই নিলেন না! তিনি বরং স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে ইতালি চলে গেলেন! আর সিসেরোর এই জয়, তাকে একজন ন্যায়বান কোয়েস্টর এবং আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি এনে দিল। এই সাফল্যের জন্যই কিছুকাল পর তাকে ‘ইডাইল’ পদে নিযুক্ত করা হয়। প্রাচীন রোমে প্রতিটি শহরে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হতো, যারা শহরের অবকাঠামোগত পরিকল্পনা এবং শস্য উৎপাদন ও বিতরণের দিকটি দেখভাল করতো। এই ম্যাজিস্ট্রেটদের বলা হতো ইডাইল

অল্প কিছুদিন পরই ইডাইলের পদ ছেড়ে দেন সিসেরো। নিযুক্ত হন কনসাল পদে (যিনি দেশের সকল কর আদায় এবং কৃষি জমি বিষয়ক দায়িত্ব পালন করেন)। কনসাল হিসেবে দায়িত্ব পালনের শুরুতেই তিনি কনসালের এবং কর আদায়ের ‘১০ জনের বিশেষ’ কমিটির একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা শুরু করলেন। তার এই সংস্কার প্রচেষ্টা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি, সমস্যা হয় অন্যত্র। কনসাল নির্বাচনে ক্যাটিলিনার হারের জন্য তার সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ হয় সিসেরোর উপর। এমনকি সিসেরো ও তার সমর্থকদের ‘গণহত্যা’র এক পরিকল্পনাও তৈরি করে ফেলে তারা। তবে গুপ্তচর মারফত এই চক্রান্তের খবর পেয়ে যান সিসেরো। দ্রুত সিনেটের জরুরি সভা আহ্বান করেন তিনি। সেখানে এই গণহত্যা ছাড়াও পুরো ইতালিতে একটি বিদ্রোহ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সবকিছু বিবেচনা করে সিনেট ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে।

ক্যাটিলিনের ষড়যন্ত্র নিয়ে বেন জনসনের নাটক; source: ebay.com

এই ঘোষণার পরই সারাদেশে গুপ্তচর নিয়োগ দেয়া হয় ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করবার জন্য। তবে যা কেউ জানতো না তা হচ্ছে, সেদিন রাতেই সিসেরোর সাথে দেখা করতে আসা একদল অতিথিই হতে যাচ্ছে তার গুপ্তহন্তারক! কিন্তু চতুর সিসেরো তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে গুপ্তঘাতকদের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে ধরিয়ে দিতে সক্ষম হন। শুধু তা-ই নয়, গুপ্তঘাতকদের বন্দী করার কয়েকদিনের মাথায়ই, সিনেটে এক বিদ্রোহের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন তিনি। সিসেরোর বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে সেই বিদ্রোহের পরিকল্পনাকারীদের ফাঁসির রায় দেয় সিনেট। সিসেরো নিজে উপস্থিত থেকে জেলের মধ্যে তাদের ফাঁসি কার্যকর করেন।

সিসেরোর শত্রুর তালিকা একের পর এক বেড়েই চলেছিল। তালিকায় নতুন যুক্ত হয় ক্লডিয়াস নামক এক অভিজাত পরিবারের ব্যক্তির নাম। শুধু নারীদের জন্য নির্দিষ্ট একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, নারী ছদ্মবেশে খুঁজে পাওয়া যায় ক্লডিয়াসকে। আদালতে ক্লডিয়াস দাবি করেন যে তিনি সেদিন রোমের বাইরে ছিলেন। কিন্তু সিসেরো সাক্ষ্য দিলেন যে তিনি ক্লডিয়াসের সাথে কয়েক ঘন্টা আগেও সাক্ষাৎ করেছেন। তথাপি তার এই সাক্ষ্য কোনো কাজেই দেয় নি। ক্লডিয়াস বিচারকদের ঘুষ দিয়ে মামলা সামাল দেন। কিন্তু মামলা থেকে মুক্তি পেলেও তিনি সিসেরোকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। আর সিসেরোর ‘শত্রুর তালিকায়’ যুক্ত হয় আরেকটি নাম।

সিসেরোকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য সিনেটকে বোঝাচ্ছেন ক্লডিয়াস; source: historian-hut-articles.blogspot.com

খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ শতকে রোমে অঘোষিতভাবে ‘ফার্স্ট ট্রাইয়াম্ভিরেট’ (সমপদস্থ শাসকত্রয়- জুলিয়াস সিজার, ক্র্যাসাস, পম্পেই) এর শাসন শুরু হয়। এই শাসকত্রয় প্রভাবশালী এবং খ্যাতিমান সিসেরোকেও তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে সিসেরো সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। সে বছরই রোমের প্লেবিয়ান নির্বাচনে নির্বাচিত হন ক্লডিয়াস। ক্ষমতায় বসেই তিনি একটি নতুন আইন জারি করেন। আইনটি এরূপ যে, যেকোনো ব্যক্তি যিনি কোনো রোমের নাগরিককে সাধারণ জনগণের মতামত না নিয়ে ফাঁসি দেবে, নির্বাসিত হবে। স্পষ্টত এই আইন, সিসেরোর উপর প্রতিশোধ নিতেই তৈরি করা হয়েছিল।

অন্যদিকে, ট্রাইয়াম্ভিরেটের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় তারাও সিসেরোকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে সহজেই সিসেরোকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজের প্রতিশোধ সম্পন্ন করেন ক্লডিয়াস। ইতালির ৫০০ মাইলের মধ্যে সিসেরোর উপস্থিতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সিসেরো খুশিমনেই এই উদ্দেশ্যমূলক রায় মেনে নিয়ে ইতালি ত্যাগ করেন এবং রোমে গিয়ে দর্শনচর্চায় মন দেন। তবে স্বদেশ ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারেননি তিনি। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ অব্দেই দেশে ফেরেন এবং সিনেটে ক্লডিয়াসের উদ্দেশ্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান। সিনেট তার যুক্তিতর্কে প্রভাবিত হয় এবং তাকে পুনরায় রোমে বসবাসের অনুমতি দেয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দে সিসেরোকে রোমান সাম্রাজ্যের সিলিসিয়া অঞ্চলের (বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত) গভর্নর করে পাঠানো হয়। তার এক বছর পরই রোমে শুরু হয় জুলিয়াস সিজার আর পম্পেইয়ের মধ্যে বিখ্যাত গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে সিসেরো পম্পেইকে সমর্থন দেন। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইতিহাসবিখ্যাত ‘ব্যাটেল অব ফারসেলাস’এ পম্পেই পরাজিত হলে সিসেরো আর রোমে ফিরে যাননি। এমনকি যুদ্ধের সময় স্ত্রীর সমর্থন না পাওয়ায় স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন তিনি। এরই মাঝে মহাক্ষমতাধর অ্যান্টনিওর (জুলিয়াস সিজারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি) সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অ্যান্টনিওই হন সিসেরোর জীবনের শেষ শত্রু!

মানচিত্রে সিলিসিয়ার অবস্থান; source: undevicesimus.deviantart.com

অ্যান্টনিও তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে সিনেটকে দিয়ে সিসেরো এবং তার অনেক সমর্থককে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষিত করান। কিন্তু সকলের মধ্যে সিসেরোকে হত্যা করা হয় সবচেয়ে নৃশংসভাবে। হেরেনিয়াস নামক কোনো এক সৈন্য বন্দী সিসেরোকে হত্যা করে। অ্যান্টনির নির্দেশে তার দুই হাত কাটার পর তার মুণ্ডুচ্ছেদ করা হয়। ৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৭ ডিসেম্বর তার ঘটনাবহুল জীবনের সমাপ্ত ঘটে।

 “রোমান সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির চেয়ে রোমান চেতনার উৎকর্ষকেই আমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি!”- সিসেরো সম্পর্কে জুলিয়াস  সিজার

বাগ্মী হিসেবে সিসেরোর প্রভাব আকাশছোঁয়া। তার নাম থেকে ইংরেজি শব্দ ‘সিসেরোনিয়ান’ এর উৎপত্তি, যার অর্থ বাগ্মিতা! সমসাময়িককালে তো বটেই, ইতিহাসেই সিসেরোর নাম লেখা হয়ে গেছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন বাগ্মী হিসেবে। তাছাড়া, তার কর্মজীবন এতটাই ঘটনাবহুল যে, আধুনিককালের রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দার্শনিকদের তা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আর আইনজীবিদের জন্য তো সিসেরোর বক্তৃতাগুলো প্রবাদতুল্য। তবে সিসেরোকে অন্য আরেকটি কারণে আলাদাভাবে ধন্যবাদ জানানো যেতেই পারে। তিনি তার চমৎকার বক্তৃতাগুলো নিয়ম করে লিখে রাখতেন। না লিখে রাখলে যে আমরা বঞ্চিত হতাম মহামূল্যবান, জ্ঞানগর্ভ সে প্রবন্ধগুলো থেকে!

সিসেরোর আইনবিষয়ক লেখাগুলো থেকে প্রাচীন রোম এবং অন্যান্য অঞ্চলের আইনকানুন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তার ‘ডি রিপাবলিকা’ (অন কমনওয়েলথ) এবং ‘ডি লেগিবাস’ (অন ল’স) হচ্ছে তার অসংখ্য ছোট ছোট প্রবন্ধের সমাহার। তার মোট লেখার সংখ্যা আমরা জানি না। সিসেরোর বাগ্মিতার উপর লেখা ৬টি এবং দর্শনের ৮টি বই, কালের বিবর্তনে টিকে আছে আজ অবধি। তার সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালের দার্শনিক ও ইতিহাসবিদগণের লেখায় তার মোট ৮৮টি বিখ্যাত বক্তৃতার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেগুলোর মধ্যে টিকে আছে কেবল ৫৮টি। তার কয়েকটি বিখ্যাত দার্শনিক প্রবন্ধের মধ্যে ‘ডি লেগিবাস’, ‘ডি পলিটিকো’, ‘ডি অরেটর’, ‘ডি রিপাবলিকা’, ‘অরেটর’, ‘ব্রুটাস’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সিসেরোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে; source: gettyimages.com

সিসেরোর চিঠিগুলো শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতন সম্বন্ধীয় নির্ভেজাল তথ্য দেয়। সিজার, পম্পেই, ব্রুটাস, অক্টাভিয়ান, অ্যাটিকাস, মার্কাস সহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কাছে চিঠি লিখেছিলেন সিসেরো। ইতিহাসে সিসেরোর মোট ৭২টি চিঠির উল্লেখ আছে, যদিও বর্তমানকাল পর্যন্ত টিকে আছে মাত্র ৩৫টি। শেক্সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে একটি গৌণ চরিত্রে সিসেরোর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সিসেরোর জীবনের উপর সবচেয়ে নিরাবেগ এবং বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসন, তার ‘ক্যাটিলিন হিজ কন্সপিরেসি’-তে। এছাড়াও সিসেরোকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র এবং নাটক। ইতিহাসে তিনি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

ফিচার ছবি: hum3d.com

Related Articles