মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কথা। সময়টা তখন ৩৭০-৪০০ খ্রিস্টাব্দ। শহরের সব মহিলারা যখন সংসার আর সন্তান সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক সুন্দরী নারী শিক্ষকদের সাদা পোশাক পরে দর্শন, গণিত, বিজ্ঞানের মত জটিলতর বিষয়ে জ্ঞান বিলিয়ে বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। শত শত লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যেতো তার বক্তৃতা। লাবণ্যময়ী সেই নারীর চোখে মুখে ছিল কিশোরীদের মতো কৌতূহল আর সরলতা। সাদা পোশাক পরা কৌতূহলী, চঞ্চল সেই নারীটি হচ্ছেন আলেকজান্দ্রিয়ার হাইপেশিয়া। ইতিহাসের সর্বপ্রথম স্বীকৃত নারী গণিতবিদ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং আলেকজান্দ্রিয়ান লাইব্রেরির সর্বশেষ গবেষক, যার মৃত্যুর পর মিশরের জ্ঞানের আলো নিভে গিয়েছিল প্রায় এক হাজার বছরের জন্য। আজ আপনাদের বলা হবে গণিত, দর্শন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখা সেই প্রতিভাময়ী নারীর জীবন ও তার মর্মান্তিক মৃত্যুর গল্প।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ও জাদুঘর
হাইপেশিয়ার জীবনের পুরোটা জুড়েই ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ও জাদুঘর। তাই হাইপেশিয়াকে নিয়ে জানার আগে কিছুটা জেনে নেয়া যাক সেই লাইব্রেরি ও জাদুঘর সম্পর্কেই। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেট দ্বারা গোড়াপত্তন হয় আলেকজান্দ্রিয়ার। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে শহরটি প্রাচীন সভ্যতার সবচেয়ে বড় শহরে পরিণত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া ছিল তখনকার হেলেনিস্টিক সভ্যতার কেন্দ্র। তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শহরটি ঘিরে তখন নানা ধরণের জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়েছিল। মিশরীয় রাজারা তখন বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর বইপত্র সংগ্রহ করতে শুরু করেন আর এর ফলস্বরূপ খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩ সালে মিশরের দ্বিতীয় টলেমির শাসনের সময়ে, মিউসেস বা শিল্পকর্মের নয়টি দেবীর মন্দির হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি এবং জাদুঘরটির জন্ম হয়। অসংখ্য গবেষণা কাজের সংগ্রহের সাথে সাথে এতে ছিল বক্তৃতা দেওয়ার মঞ্চ, সম্মেলন কক্ষ এবং বাগান। প্রাচীন বিশ্বের বিখ্যাত সব চিন্তাবিদ, টলেমি, আর্কিমিডিস, অ্যারিস্টটল সহ অনেকেই এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন। লাইব্রেরির বইগুলো রাখা ছিল প্যাপিরাস এবং চামড়ার স্ক্রল হিসেবে। আর সেই স্ক্রলগুলোই ছিল মিশরীয় সভ্যতার আলো। এখানে সংরক্ষিত স্ক্রলের সংখ্যা আজও সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে ধারণা করা হয় সেখানে অ্যাসিরিয়া, গ্রিস, পারস্য, মিশর, ভারত ও অন্যান্য অনেক দেশ থেকে প্রায় ৪০-৭০ লক্ষ প্যাপিরাস এবং চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা স্ক্রল সংরক্ষিত ছিল।
লাইব্রেরিটির ধ্বংসের সূত্রপাত হয় জুলিয়াস সিজার দ্বারা ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন তিনি আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন এবং ঘটনাক্রমে লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে দেন। আবার পরবর্তীতে সেটি পুনরায় তৈরিও করেন। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার একটি ধীর পতন শুরু হয় সেই সময় থেকেই। পরবর্তীতে ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস প্যাগানিজমকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং সে সময় প্রধানমন্ত্রী থিওফেলাস Serepum (সেরেপাম) সহ আলেকজান্দ্রিয়ার সমস্ত পৌত্তলিক মন্দির ধ্বংস করে দেন। যেহেতু Serapeum (সেরেপাম) সে সময়ে আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির একটি অংশ ছিল, তাই কিছু ঐতিহাসিকের মতে, সে সময় আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিটির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
জন্ম এবং শৈশব
হাইপেশিয়ার জন্মসাল নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। অনেকেরে মতে তার জন্ম ৩৫০ সালে, আবার অনেকের মতে ৩৭০ সালে। তার বাবা থিওন ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিখ্যাত শিক্ষক, গণিতবিদ এবং দার্শনিক। ব্যতিক্রমধর্মী এবং মুক্তচিন্তার মানুষ হওয়ার ফলে থিওন তার মেয়েকে মিশরের অন্য আট-দশটা মেয়ের মত করে বড় না করে সম্পূর্ণ নিজের মত করে বড় করে তোলার সিন্ধান্ত নেন। তিনি হাইপেশিয়াকে দর্শন, গণিতশাস্ত্র ও নিজের পছন্দের বিষয়গুলো শেখাতে শুরু করেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ফলে হাইপেশিয়াও দ্রুত সেগুলো আয়ত্তে এনে ফেলে এবং তার মাঝে ধীরে ধীরে জ্ঞানের প্রতি প্রবল তৃষ্ণা জন্মাতে থাকে।
বাবা আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ফলে হাইপেশিয়ার ছিল লাইব্রেরিতে প্রবেশের সুবর্ণ সুযোগ। আর তিনিও সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন। দোফান্টস, প্লেটো, সক্রেটিসদের মত বড় বড় গণিতবিদ এবং দার্শনিকদের অসংখ্য বই পড়ে তিনি গণিত ও দর্শনে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং তার বাবাকে বিভিন্ন গবেষণার কাজে সাহায্য করা শুরু করেন। থিওন চেয়েছিলেন তার মেয়ে ছেলেদের চেয়ে কোনোদিকে পিছিয়ে না থাকুক। তাই তিনি হাইপেশিয়াকে শারীরিকভাবেও সুঠাম করে গড়ে তোলার জন্য সাঁতার, ঘোড়াদৌড় এবং বিভিন্ন শারীরিক কসরত সেখান। তাকে শিক্ষা দেন সুন্দর করে কথা বলার এবং যুক্তি উপস্থাপনের। ফলে অচিরেই হাইপেশিয়া তার বাবার সহচর্যে ও সহযোগিতায় একজন মুক্তচিন্তার অধিকারী, দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ও সুস্বাস্থ্যের নারীতে পরিণত হন এবং হয়ে ওঠেন একজন অসাধারণ বাগ্মী।
জীবন এবং কাজ
থিওনের পরামর্শক্রমে হাইপেশিয়া সম্পূর্ণ রোমান সম্রাজ্য ঘুরতে বের হন ভূগোল এবং অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য। ঘুরতে ঘুরতে এথেন্সে আসলে তিনি একটি বিদ্যালয়ে গণিত পড়ানো শুরু করেন এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা পান। এ খবর আলেক্সান্দ্রিয়া পর্যন্তও পৌঁছে যায় এবং ফলশ্রুতিতে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার প্রস্তাব পান এবং শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করেন। অধ্যাপনা শুরু করার পর হাইপেশিয়া দর্শন এবং গণিত বিষয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় বক্তৃতা প্রদান করা শুরু করেন। তার বাচনভঙ্গি, যুক্তির সুষ্ঠু উপস্থাপন এবং কঠিন বিষয়গুলোকে সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা শ্রোতাদের প্রবলভাবে মুগ্ধ করতে থাকে আর দিনে দিনে তার ভক্ত ও শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে দূরদূরান্তে। শুধুমাত্র তার বক্তৃতা শোনার জন্যই আলেকজান্দ্রিয়ায় অসংখ্য মানুষ আসা শুরু করে। দর্শনের নিওপ্লেটনিজমে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিওপ্লেটনিক স্কুলের প্রধান নিযুক্ত করেন।
হাইপেশিয়া তার শিক্ষার্থীদের ‘Diophantus’ ‘Arithmetica’ (‘ডিওফ্যানটাস’ ‘আরিথমেটিকা’) শেখাতেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগ বের করা এবং সেগুলো সহজভাবে অন্যদের বোঝানো। তিনি তার বাবাকে Ptolemy’s Almagest (টলেমির আলমাজেস্ট) বইটি লিখতে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়া এটাও বলা হয় যে, তিনি তার বাবাকে Euclid‘s Elements(ইউক্লিডের এলিমেন্ট) এর নতুন সংস্করণটি তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন, যা ইউক্লিডের পরবর্তী সংস্করণগুলোর জন্য ভিত্তি হয়ে ওঠে।
তার বাবার সাথের যৌথ কাজগুলো ছাড়া হাইপেশিয়া এককভাবে ‘দোফান্টস এর অরিথমেটিকা’, ‘অ্যাপোলোনিয়াস এর কনিকস’ এবং ‘টলেমির জ্যোতির্বিদ্যা’ সংক্রান্ত কাজগুলোর উপর বিভিন্ন ব্যাখ্যা লিখেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ‘স্যুডা’ নামক একটি বইও লিখেছিলেন তিনি।
গণিত ছাড়া বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও রয়েছে হাইপেশিয়ার অবদান। তিনি জল নিষ্কাশন করার জন্য একটি যন্ত্র, জলের স্তর পরিমাপ জন্য একটি যন্ত্র এবং তারা, গ্রহ ও সূর্যের অবস্থানের পরিমাপের জন্য অ্যাস্ট্রোলোব তৈরি করেছিলেন। এছাড়া তিনি তরলের ঘনত্ব পরিমাপের জন্য তামার তৈরি একটি হাইড্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সকলের জ্ঞানার্জনের এবং মুক্ত চিন্তা করার অধিকার রয়েছে। আলেকজান্দ্রিয়ায় বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন হাইপেশিয়া। তিনি চাইতেন সকল বাচ্চাই কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসুক এবং পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে শিখুক। এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,
“রূপকথাকে রূপকথা হিসেবে, পুরাণকে পুরাণ হিসেবে এবং অলৌকিকতাকে অলৌকিকতা হিসেবেই শেখানো উচিত। কারণ শিশুর মন সেগুলো বিশ্বাস করে নেয় এবং পরবর্তীতে কোন বড় আঘাত বা দুর্ঘটনাই সেগুলো মন থেকে মুছতে পারে।”
আরেকবার তিনি বলেছিলেন,
“নিজের চিন্তা করার অধিকারকে সংরক্ষণ কর। কারণ কিছু চিন্তা না করা থেকে ভুলভাবে চিন্তা করাও ভালো। মানুষ একটি সত্যের জন্য যতটা না লড়াই করে, তার থেকে বেশি কুসংস্কারের জন্য করে। কারণ কুসংস্কার সবসময়ই অস্পৃশ্য এবং অসার, কিন্তু সত্য হচ্ছে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি, তাই এটি পরিবর্তনশীল।”
তার এই উক্তিগুলো থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী ছিলেন।
হাইপেশিয়া সম্পূর্ণভাবে নিজেকে জ্ঞানের সাধনায় সমর্পণ করেছিলেন। অসংখ্য যোগ্য পাত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো বিয়ে করেননি এই ভেবে যে, তার পড়াশোনা এবং গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটবে। কথিত আছে, একবার এক ছাত্র রীতিমত তার প্রেমে অন্ধ হয়ে যায় এবং তাকে বিয়ে করার জন্য প্রচুড় পীড়াপীড়ি শুরু করে। হাইপেশিয়া তখন তাকে মেয়েদের একটি শারীরিক বিড়ম্বনার কথা বলে মোহমুক্ত করে ছেড়ে দেয়! তখনকার দিনে জ্ঞানের সাধনার জন্য বিয়ে না করাকে খুব সম্মানের চোখে দেখা হত। তাই হাইপেশিয়ার এই কুমারীত্ব এবং অসংখ্য পুরুষের মাঝে তার নিঃসংকোচ চলাফেরা ও ওঠাবসা অন্যদের কাছে তাকে আরো সম্মানীয় করে তুলেছিল।
কিছু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও একটি মর্মান্তিক মৃত্যু
হাইপেশিয়ার মৃত্যুকে মূলত তখনকার সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ফসল হিসেবেই ধরা হয়। তখনকার আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টান ও ইহুদি দুটি ধর্মেরই সমান অনুসারী থাকলেও, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে খ্রিস্টানদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। । তারা একসময়ের অসাম্প্রদায়িক আলেকজান্দ্রিয়াকে সম্পূর্ণ চার্চের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলো। এমনি সময় ইহুদিদের একটি নৃত্য প্রদর্শনী খ্রিস্টানদের উপর খেপিয়ে দেয়, যা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় সহিংসতার জন্য পথ খুলে দেয়। তারা অসংখ্য ইহুদিকে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এতে করে শহরে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয় এবং ক্রমবর্ধমান খ্রিস্টানরা ধীরে ধীরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপরও অত্যাচার শুরু করে। এতে করে আলেকজান্দ্রিয়ায় অর্থনৈতিক ধ্বসও নামতে থাকে।
শহরের গভর্নর অরিস্টিস তখন খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের ভেতর সমঝোতা করানোর জন্য ইহুদিদের পক্ষ নিলে চার্চের বিশপ সেরিল এবং শহরের অন্যান্য খ্রিস্টানরা চরম ক্ষেপে ওঠে। যেহেতু অরিস্টিস নিজেও একজন খ্রিস্টান ছিল, তাই তার উপর ক্রোধ তাদের আরো বাড়তে থাকে। আম্মনিয়াস নামের একজন সাধু তাকে মাথায় ইট মেরে হত্যার চেষ্টা করে। অরিস্টিসের লোকেরা তাকে মেরে ফেললে সিরিল এবং তার লোকেরা চার্চ থেকে তাকে শহীদ উপাধি দেয়।
হাইপেশিয়ার সাথে অরিস্টিসের বন্ধুত্ব ছিল। রাজনৈতিক নানা ব্যপারে অরিস্টিস তার সাথে আলোচনা করতেন এবং পরামর্শ নিতেন। এ সম্পর্কই হাইপেশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেরিল প্রথম থেকেই হাইপেশিয়াকে অপছন্দ করত, কারণ তিনি পুরুষ অধ্যুষিত সমাজে বীরদর্পে বিচরণ করতেন এবং প্রকাশ্যে নিওপ্লেটনিজম ও প্যাগানিজম নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতেন। হাইপেশিয়া তার বক্তৃতায় নির্ভীকভাবে খ্রিস্টধর্মের অসারতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। তার মতামত ছিল ধর্ম হতে হবে যুক্তিনির্ভর। তিনি চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন এবং প্রত্যেককে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার জন্য উৎসাহ দিতেন। হাইপেশিয়ার জনপ্রিয়তা এবং এ ধরণের কথাবার্তা ও চালচলন স্বাভাবিকভাবেই চার্চের সুনামের পরিপন্থী ছিল, তাই তিনি বিশপদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। সিরিল তখন খ্রিষ্টানদের মধ্যে গুজব ছড়ায় যে, হাইপেশিয়াই অরিস্টিসকে কুবুদ্ধি দিচ্ছে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। তিনি অরিস্টিসকে জাদু করেছেন, এবং তিনি একটি ডাইনি ও চার্চের শত্রু, তিনি সবাইকে বিপথে পরিচালিত করছে। এই গুজবটি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এর ফলে ৪১৫ সালের এক দুপুরে হাইপেশিয়া যখন লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পিটার নামক এক লোকের নেতৃত্বে একদল ধর্মান্ধ হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে বের করে, তাকে বিবস্ত্র করে টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে আসে। ভাঙ্গা টাইলস এবং শামুকের খোলস দিয়ে খুবলে খুবলে তার মাংস ছিড়ে ফেলে তাকে হত্যা করে। এরপর তারা তার দেহাবশেষ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। এভাবেই সমাপ্তি হয় সে সময়ের প্রথম নারী গণিতবিদ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং একজন অসাধারণ শিক্ষকের। হাইপেশিয়ার পর আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির আর কোনো শিক্ষক বা গবেষকের নাম পাওয়া যায় না। তাই ধারণা করা হয় তিনিই ছিলেন আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর শেষ গবেষক ও শিক্ষক এবং তার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী, যাদুঘর এবং এক জ্ঞাননির্ভর স্বর্ণালী সভ্যতার ইতিহাস, যা আবার পুনরায় ফিরে পেতে কয়েক হাজার বছর লেগেছিল। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর কয়েক দিন পরই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়, সাথে হাইপেশিয়ার সব কাজও নষ্ট করে ফেলা হয়।
স্কুল অফ এথেন্সে হাইপেশিয়া
কিছু ধর্মান্ধ এবং জ্ঞানের আলোর পরিপন্থী মানুষ হাইপেশিয়াকে চিরতরে মুছে ফেলতে চাইলেও যারা জ্ঞানকে ভালবেসেছে এবং তার অনুসন্ধান করেছে, তারা ঠিকই হাইপেশিয়াকে খুঁজে বের করেছে এবং শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেছে। ভ্যাটিকানের Apostolic Palace-এর দেয়ালগুলোয় ফ্রেস্কো আঁকার জন্য বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রাফায়েলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফ্রেস্কোগুলো এখন Stanze di Raffaello নামে পরিচিত। ‘স্কুল অফ এথেন্স’ সেই ফ্রেস্কোগুলোরই একটি। ছবিটিতে দেখা যায় সব মহৎ গণিতবিদ, দার্শনিক এবং শাস্ত্রীয় পুরাতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা একে অপরের কাছ থেকে তাদের ধারণা এবং জ্ঞান বিনিময় করছেন। যদিও তারা সকলে বিভিন্ন সময়ে বসবাস করেছেন, কিন্তু ছবিটির মাধ্যমে তাদের এক ছাদের নিচে একত্রিত করা হয়েছে। ছবিটিতে প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, পিথাগোরাস সহ অন্যান্য সকল মহৎ দার্শনিক, গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানী রয়েছেন।
রাফায়েল ছবিটি আঁকার সময় ঠিক মাঝখানে হাইপেশিয়াকে বসিয়ে দেন। চার্চের ফাদার ফ্রেস্কটি দেখতে এসে রাফায়েলকে জিজ্ঞাসা করেন, “মাঝখানের এই সুন্দরী মহিলাটি কে?” রাফায়েল তখন উত্তর দেন, “তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার হাইপেশিয়া, স্কুল অফ এথেন্সের একজন বিখ্যাত শিক্ষার্থী। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্র, গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক ছিলেন এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন ছিলেন।”
বিশপ তাৎক্ষনিকভাবে তাকে হাইপেশিয়াকে ছবি থেকে সরিয়ে ফেলতে বলেন। কিন্তু রাফায়েলের শিল্পী মন তাতে সায় দেয় নি। তিনি হাইপেশিয়াকে ছবিটি থেকে সম্পূর্ণ না মুছে মাঝখান থেকে সরিয়ে বাম দিকে পিথাগোরাস এবং পারমেনাইডসের মাঝখানে বসিয়ে দেন। তার গায়ের রঙ অন্যান্য গ্রিক-আলেকজান্দ্রিয় মহিলাদের তুলনায় অনেক হালকা করে দেন এবং তাকে তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের প্রিয় ভাতিজা ফ্রান্সিস্কোর আদলে আঁকেন (ফ্রান্সিসকো তখন কিশোর ছিল, সে তার চাচা পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সুরক্ষায় বসবাস করত। জুলিয়াস তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির জন্য ফ্রেস্কটি আঁকতে বলেছিলেন)। এভাবে রাফায়েল হাইপেশিয়াকে তার কাজের মধ্যে পুনরূজ্জীবিত করেন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে অসাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে তাকে স্থান দিয়ে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তাকে ফিরিয়ে দেন।
শেষ কথা
হাইপেশিয়া শুধু একজন বিজ্ঞানী, দার্শনিক বা গণিতবিদই নন, তিনি ছিলেন নারী জাগরণেরও প্রতীক। যে সময়ে নারীরা দাসী হিসেবে থাকত, আলাদাভাবে তাদের কোনো সম্মান ছিল না, ঠিক এমন এক সময়েই হাইপেশিয়া নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দ্বারা নিজেকে সমাজের একজন সম্মানীয় ব্যাক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন সেরা গণিতবিদ এবং দার্শনিক। আমাদের আজকের যুগের অনেক নারীও যেসব বিষয়ে সাহস করতে পারে না, হাইপেশিয়া দেড় হাজার বছর আগে তা করে দেখিয়েছিলেন। তাই আধুনিক সময়ের মানুষও হাইপেশিয়াকে তার বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনে অসাধারণ অবদান ও জ্ঞানের জন্য মর্মান্তিকভাবে শহীদ হওয়াকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে। তার স্মরণে চাঁদের একটি অংশকে নামকরণ করা হয়েছে ‘হাইপেশিয়া’, যেটি চাঁদের একটি গিরিখাত। যতদিন আকাশে চাঁদ উঠবে, হাইপেশিয়াও আকাশের বুকে চাঁদের সাথে জ্বলজ্বল করে যাবেন।