তাকে পশ্চিমারা ‘আল হাজেন’ বলে ডাকে। আবার তার জন্মভূমির নাম বসরা অনুসারে তাকে কখনো ‘আল বসরি’ নামেও ডাকা হয়। তাকে বলা হয় আলোকবিজ্ঞানের জনক। এর বাইরেও তার ছোট-বড় অবদান রয়েছে অ্যানাটমি বা অঙ্গব্যবচ্ছেদবিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, চক্ষুবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত উন্নয়নে! প্রশ্ন হতেই পারে, তিনি মানব ছিলেন, নাকি মহামানব? অ্যারিস্টটল পরবর্তী সময়ে এত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অল্প কজন বিজ্ঞানীর মধ্যে তিনি একজন।
আবু আলি আল হাসান ইবনে আল হাসান ইবনে আল হাইথাম বা সংক্ষেপে ইবনে আল হাইথাম, ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সবই তিনি বাগদাদে লাভ করেন। তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। সে সময়ে অধিক ব্যয়বহুল হওয়ায় কেবল সমাজের ধনীক শ্রেণীই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। অন্যান্য মুসলিম পরিবারগুলোর মতো ইবনে আল হাইথামেরও শিক্ষা জীবন শুরু হয় বসরার একটি মক্তব থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে।
তার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে কায়রোতে তৎকালীন খলিফা হাকিমের রাজ্যে ভ্রমণ। খলিফা হাকিম তাকে নীলনদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার দায়িত্ব দেন। উচ্চাভিলাষী এক পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ শুরু করার পর ইবনে আল হাইথাম বুঝতে পারেন যে, তখনকার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দিয়ে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অগত্যা সে পরিকল্পনা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তবে এখানে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে। কাজে ব্যর্থ হয়ে হাইথাম খলিফার ক্রোধ থেকে বাঁচতে নাকি পাগলের ভান করেছিলেন এবং গৃহবন্দী হয়ে থেকেছিলেন একেবারে খলিফা হাকিমের মৃত্যু পর্যন্ত! আর এই গৃহবন্দী অবস্থায়ই তিনি লিখেছিলেন তার সেরা বই, ‘বুক অব অপটিকস’, যাকে কিনা নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী বই গণ্য করা হয়। ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতেই মৃত্যুবরণ করেন ইবনে আল হাইথাম। তার ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, বিয়ে, সন্তান সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি ইতিহাসে জীবন্ত হয়ে আছেন তার কাজের দ্বারা। চলুন সেগুলোই আলোচনা করা যাক।
ইবনে আল হাইথাম ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তবে মুসলিমদের মধ্যে বিদ্যমান জাতিগত দ্বন্দ্ব তাকে পীড়া দিত। তিনি দীর্ঘকাল শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার ফলাফল হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এই দ্বন্দ্ব আল্লাহর দেয়া ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ভুত হয়নি, বরং মানুষই সৃষ্টি করেছে। তবে তিনি যথার্থভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করতে না পারায় মনঃপীড়ায় ভুগেছিলেন। সবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ডুব দিয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের দর্শনে।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে ইবনে আল হাইথাম ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা। তার আগে বিজ্ঞানীগণ যে পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চালাতেন তা যথাযথ ছিল না। ফলে অনেক সময় হাইথামকে বলা হয় প্রথম ‘আধুনিক বিজ্ঞানী’। তিনি যেকোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রচলন করেন। তার পরীক্ষার পন্থা অনেকাংশে আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো। তার পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার ধাপ সাতটি-
- পর্যবেক্ষণ
- সমস্যা নির্দিষ্টকরণ
- সমাধান অনুমান করা
- পরীক্ষার মাধ্যমে অনুমান যাচাই করা
- পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করা
- তথ্যের বিশ্লেষণ, তুলনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ
- ফলাফল প্রকাশ করা
ইবনে আল হাইথাম কেবল অ্যারিস্টটলে ডুবে ছিলেন না। তিনি ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, টলেমির গবেষণা ও দর্শন বিষয়ে বিস্তর পড়ালেখা করেন। কর্মজীবনে তিনি বসরার বড় সরকারি পদে কাজ করেছেন। কেউ বলেন তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন নির্মাণ প্রকৌশলী বা সিভিল ইঞ্জিয়ার। তবে তিনি যে পদেই থাকুন না কেন, বসরায় সরকারি কাজ করে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। তিনি আরো বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে চাইতেন যেখানে নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারবেন। তার ইচ্ছা পূরণ হয় যখন ১০১০ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর খলিফা আল হাকিমের প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আসে। আর কায়রো এসেই শুরু হয় তার প্রকৃত বৈজ্ঞানিক জীবনের, যা তাকে অমর করেছে। এ সময় তিনি পাগল হয়েছিলেন বা পাগল হবার অভিনয় করেছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে কায়রোতে অবস্থানকালীনই হাইথাম তার শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্র ‘বুক অব অপটিকস’ রচনা করেন। এছাড়াও তার অমর কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস, ব্যালেন্স অব উইজডম, কনফিগারেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড, অপসকুলা, মোশন অব ইচ সেভেন প্লানেটস, ট্রিটিজ অন লাইট, ট্রিটিজ অন প্ল্যাস, দ্য রেজুলেশন ইত্যাদি।
পদার্থবিজ্ঞানের উপর প্রভাব এর ক্ষেত্রে ইবনে আল হাইথামের ‘কিতাব আল মানাজির’ তথা বুক অব অপটিকসকে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সমকক্ষ ধরা হয়। তার এই সাত খণ্ডে প্রকাশিত বইটি আলোকবিজ্ঞান সম্বন্ধে সমসাময়িক তো বটেই, অনাগত কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনে। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর উপর পড়লে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। এই ধারণাটি ছিল অ্যারিস্টটলের। কিন্তু হাইথাম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটি ভুল প্রমাণিত করেন। যেমন- বহুদূরের তারকারাজি আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই। আমাদের চোখের আলো কতটা শক্তিশালী যে এতো পথ মূহুর্তেই পাড়ি দিয়ে সে তারকার কাছে পৌঁছে যায়? প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলেই তবে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়েও পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন। স্নেলের সাইন সূত্রটি বস্তুত তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তবে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কিংবা গাণিতিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি হাইথাম। তাকে পিনহোল ক্যামেরা এবং ক্যামেরা অবস্কিউরার জনকও বলা হয়। রজার বেকন এবং জোহান কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা হাইথামের বুক অব অপটিকস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
বুক অব অপটিকস ছাড়াও তিনি আলোকবিজ্ঞানের উপর ‘রিসালা ফিল-দাও’ বা ‘ট্রিটিজ অব লাইট রচনা করেন। এখানে তিনি আলোর প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, গ্রহণ, রংধনু, অধিবৃত্তিক কাঁচ, বিবর্ধন কাঁচ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। চোখের জৈবিক গঠন ও ব্যবচ্ছেদ বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেন। তিনি আলো বিষয়ক এতো গবেষণা করেন যে সেগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করতে গেলে ভিন্ন একাধিক প্রবন্ধের প্রয়োজন হবে!
ইবনে আল হাইথাম নভোজোতির্বিজ্ঞান নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ভরের মধ্যকার অদৃশ্য আকর্ষণের কারণে ত্বরণের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন (মহাকর্ষ কী জানতেন তিনি!)। তার ‘মাকালা ফি’ল কারাস্তুন’ নামক গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন বস্তুর আকর্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করেছেন যা আমরা ‘সেন্টার অব গ্রাভিটি’ নামে জানি। অন্যদিকে তিনি ‘রিসালা ফি’ল মাকেন’ বা ট্রিটিজ অব প্ল্যাসে বস্তুর গতি নিয়েও আলোচনা করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুটি বিষয়েই তার প্রায় সিংহভাগ কাজই হারিয়ে গেছে। অন্যথায় নিউটনের পূর্বেই হয়তো পৃথিবী মহাকর্ষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারতো।
‘আল শুকুক আল আ বাতলামিয়াস’ তার জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কাজগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে তিনি মূলত টলেমির বিভিন্ন কাজের সমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে তার ‘কনফিগারেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ এ তিনি টলেমির ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। ১০৩৮ সালে ইবনে আল হাইথাম প্রকাশ করেন ‘মোশনস অব ইচ অব দ্য সেভেন প্লানেটস’। এই বইতে তিনি মূলত মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্র ও তারকাদের গতি আলোচনা করেন। তবে এই বইয়ের খুব সামান্যই পাওয়া গেছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে হাইথামের ‘মোশনস অব ইচ অব দ্য সেভেন প্লানেটস’ মধ্যযুগে ইউরোপে রেনেসাঁর সময় জোতির্বিজ্ঞানের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তবে তা কীভাবে হারিয়ে গেছে সে বিষয়ে ঠিক জানা যায় না।
নির্মাণ প্রকৌশলে ইবনে আল হাইথামের কোনো লিখিত গ্রন্থ না থাকলেও তিনি একজন দক্ষ এবং মেধাবী প্রকৌশলী ছিলেন। নীলনদের সৃষ্ট বন্যা ঠেকাতে তিনি উচ্চাভিলাষী বাঁধ প্রকল্পের নকশা করেছিলেন, কিন্তু প্রাযুক্তিক অনগ্রসরতার কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তিনি একটি জলঘড়ি তৈরি করেছিলেন বলেও উল্লেখ করেছেন অনেক ইতিহাসবিদ, যদিও সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। চিকিৎসাবিদ্যায় তার অবদান চোখকে ঘিরেই। তিনি মানুষের দর্শনক্ষমতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি গ্রীক বিজ্ঞানী গ্যালেনের রক্ত সঞ্চালন বিষয়ক কাজের উপর একটি বিশ্লেষাণত্মক প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন।
গণিতে ইবনে আল হাইথাম কাজ করেছেন কণিক, সংখ্যাতত্ত্ব আর বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি নিয়ে। তিনি ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করেছেন। তিনি বুক অব অপটিকসের পঞ্চম খণ্ডে একটি সম্পাদ্য তৈরি করেন যা ইউরোপে রেনেসাঁর সময় ‘আল হ্যাজেনস প্রবলেম’ নামে বেশ জনপ্রিয় ছিল। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন, আইজ্যাক ব্যারো, জেমস গ্রেগরির মতো গণিতবিদরা তার সেই সম্পাদ্যের বীজগাণিতিক সমাধানের চেষ্টা করেন। হাইথাম বীজগণিত ও জ্যামিতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতির উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি প্রথম ১০০টি প্রকৃত সংখ্যা যোগ করার একটি সূত্র তৈরি করনে। তবে সূত্রটি তিনি প্রমাণ করেছিলেন জ্যামিতিক উপায়ে। তাছাড়া তিনি ‘অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস’এ পূর্ণ সংখ্যার উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন। তিনি জোড় পূর্ণ সংখ্যার সূত্র (2n−1(2n − 1)) আবিষ্কার করেন। অবশ্য সূত্রটি তিনি প্রমাণ করে যেতে পারেননি। গণিতবিদ ইউলার ১৯ শতকে এই সূত্রটি প্রমাণ করেন।
ইবনে আল হাইথামের মোট কাজের সংখ্যা দুশ’র অধিক, যার মধ্যে ৯৬টি বৈজ্ঞানিক। তবে সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে সামান্য বা সম্পূর্ণরূপে টিকে আছে মাত্র ৪৬টি। তথাপি সেই ৪৬টিই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন গবেষক, পর্যবেক্ষক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে। বর্তমানে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের নিকট যে মুসলিম বিজ্ঞানীর নামটি সবচেয়ে জনপ্রিয় তা হচ্ছে ‘আল হ্যাজেন’ বা আল হাইথাম। তার বুক অব অপটিকস এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। তার সম্মানে চাঁদের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয় ‘আল হ্যাজেন’। ‘অ্যাস্টেরয়েড ৫৯২৩৯ আল হ্যাজেন’ নামক একটি গ্রহাণুর নামকরণও করা হয় তার সম্মানে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ ইবনে আল হাইথামের আলোকবিদ্যা বিষয়ক কাজের ১,০০০ তম বার্ষিকী উদযাপন করে।