দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপান ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত পার্ল হারবার নৌঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় ৪ বছরব্যাপী তীব্র যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরদ্বয়ের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে, এবং এরপর জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। আমরা জানি, প্রধানত এশিয়ায় প্রাধান্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে তীব্র ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তারই চূড়ান্ত পরিণাম ছিল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
কিন্তু যদি বলা হয়, এই যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এই ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, এটির পিছনে মূল উস্কানিদাতা ছিল সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনকেভিডি’, কিংবা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, একজন এনকেভিডি অফিসার? এটি হয়ত অনেককেই হতবাক করবে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়, সেটিতে ইন্ধন যুগিয়েছিল তদানীন্তন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনকেভিডি’ (কেজিবির পূর্বসূরী)। এবং এনকেভিডির এই কার্যকলাপে যে ব্যক্তি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন দুর্ধর্ষ এনকেভিডি অফিসার ইসহাক আখমেরভ। চলুন, গুপ্তচরবৃত্তির জগতের এই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
ইসহাক আব্দুলোভিচ আখমেরভ। ১৯০১ সালের ৭ এপ্রিল তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের ওরেনবুর্গ প্রদেশের ত্রইৎস্ক শহরে এক দরিদ্র পরিবারে আখমেরভের জন্ম। এ শহরটি বর্তমানে রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্ক প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত, এবং এটি রাশিয়া ও কাজাখস্তানের সুদীর্ঘ সীমান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আখমেরভের পরিবারটি ছিল জাতিগতভাবে তাতার এবং ধর্মগতভাবে সুন্নি মুসলিম। তার বয়স যখন মাত্র দুই মাস, তখন আকস্মিকভাবে তার বাবা আব্দুল আখমেরভ মারা যান। এরপর আখমেরভের মা ছোট্ট আখমেরভকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী কাজান প্রদেশের একটি গ্রামে চলে যান। এই গ্রামে ছিল আখমেরভের নানাবাড়ি।
আখমেরভের নানার পরিবার ছিল অনেক বড়, এবং তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। নানা ছিলেন একজন হস্তশিল্পী, এবং তিনি পশম নিয়ে কাজ করতেন। তিনি নাতিকে পশমের কাজ শিখিয়ে দেন। আখমেরভের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখন তার নানার মৃত্যু হয়। পরবর্তী পাঁচ বছর আখমেরভ নানা ধরনের কাজ করেন। কখনো তিনি স্থানীয় ঘোড়দৌড়ে বাজি ধরেছেন, কখনো ছোটখাটো দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন, আবার কখনো বা একজন পেষক (grinder) হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি একটি ছাপাখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে হিসেবে কাজ করেন, একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং অবশেষে একটি রুটির দোকানে কাজ নেন।
১৯১৭ সালের মার্চে রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী পেত্রোগ্রাদে সংঘটিত বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। এ সময় আখমেরভের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এই বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর তিনি একটি কারখানায় কেরানি হিসেবে চাকরি নেন। আখমেরভ এই চাকরি পাওয়ায় তার মা খুবই খুশি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার বুঝি ছেলের একটা হিল্লে হলো! কিন্তু যার ভাগ্যে লেখা রয়েছে এক অসাধারণ রোমাঞ্চকর জীবন, তিনি কি আর একজন সাধারণ কেরানি হয়ে বেশিদিন কাটাতে পারেন?
১৯১৭ সালের মার্চে সংঘটিত বিপ্লব/অভ্যুত্থানের মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই ১৯১৭ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় সংঘটিত হলো আরেকটি বিপ্লব/অভ্যুত্থান। ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীনে বলশেভিকরা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করল একটি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। শুরু হয়ে গেল রুশ গৃহযুদ্ধ, এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রান্তিক প্রদেশগুলোতে শুরু হলো মিত্রশক্তির আক্রমণ। এই গোলযোগের মধ্যে ব্যবসা–বাণিজ্য শিকেয় উঠল। আখমেরভ যে কারখানায় চাকরি করতেন, সেটি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি আবার বেকার হয়ে পড়লেন।
অবশ্য এটি নিয়ে আখমেরভ তেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন না। তিনি পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলেন, এবং নতুন সোভিয়েত সরকার এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করে। বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত কাজান পরিষদের খরচে তাকে মস্কোয় প্রেরণ করা হয়, এবং সেখানে তিনি অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এরপর ১৯১৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি কাজানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯১৯ সালে তিনি বলশেভিক দলে যোগদান করেন, এবং এর বছরখানেক পর ১৯২০ সালে তিনি কাজান নগর পরিষদের একজন সদস্য নির্বাচিত হন।
এই সময়ে বিদেশি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে আখমেরভের দক্ষতা প্রকাশ পেতে শুরু করে, এবং আখমেরভ রাজনীতি ছেড়ে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯২১ সালে তাকে আবার মস্কোয় প্রেরণ করা হয়। তিনি সেখানে ‘কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অফ দ্য ওয়ার্কার্স অফ দ্য ইস্টে’ ভর্তি হন এবং তুর্কি ভাষা নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে অধ্যয়নকালে আখমেরভ ভাষা শেখার ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনের পাশাপাশি আরেকটি ক্ষেত্রে তার মেধা প্রদর্শন করেন– যোগাযোগ। বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারা এবং তাদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে আখমেরভের জুড়ি ছিল না। বলাই বাহুল্য, পরবর্তীতে আখমেরভের কর্মজীবনে তার এই দক্ষতা বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৯২৩ থেকে ১৯২৪ সালে আখমেরভ ‘মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি’তে অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ‘মস্কো পেডাগোজিক্যাল কলেজে’ উপ–পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এখানে শিক্ষকতা করে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তা পরবর্তীতে এজেন্ট নিয়োগের কাজে তাকে সহায়তা করে।
১৯২৫ সালে আখমেরভকে সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। সেখানে অল্প কিছুদিন ইন্টার্নশিপ করার পর তাকে বুখারা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের তেরমেজ শহরে অবস্থিত সোভিয়েত দূতাবাসে প্রেরণ করা হয়। অবশ্য এর কিছুদিনের মধ্যেই বুখারা উজবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং তুর্কি ভাষায় পারদর্শী আখমেরভকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সোভিয়েত কনস্যুলেট জেনারেলে একজন সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯২৮ সালে তিনি ইস্তাম্বুলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হন এবং ১৯২৯ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
প্রাক্তন সোভিয়েত ও রুশ কূটনীতিবিদ ইয়ুলদুজ খালিউল্লিনের (যিনি ২০ বছরে ৮টি রুশ কূটনৈতিক মিশনে কাজ করেছেন) মতে, সাধারণত একজন রুশ কূটনীতিবিদের প্রশিক্ষণার্থী থেকে রাষ্ট্রদূত/কনসাল জেনারেল হতে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ বছর সময় লাগে। কিন্তু আখমেরভ মাত্র তিন বছরে এই পথ অতিক্রম করেছিলেন! কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালেই আখমেরভ সোভিয়েত বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। তুরস্কে দায়িত্ব পালনকালে তিনি তুর্কি অভিজাত শ্রেণির প্রভাবশালী সদস্যদের সঙ্গে বিস্তৃত যোগাযোগ স্থাপন করেন, সেখানে অবস্থানরত অন্যান্য বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। একই সময় তিনি এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে হাতেকলমে শিক্ষা অর্জন করেন এবং তুর্কি, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।
রুশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসভিআর’–এর নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯২৯ সালে আখমেরভ তুরস্ক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে আসেন এবং ‘মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি’র ‘স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে’ ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে তিনি সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তদানীন্তন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘ওজিপিইউ’–এর কাউন্টার–ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে যোগদান করেন। এরপর তাকে উজবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে প্রেরণ করা হয়, এবং সেখানে সোভিয়েতবিরোধী বিদ্রোহী ও দস্যুদলগুলোকে দমনের অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, এবং এরপর তাকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়।
মস্কোয় প্রত্যাবর্তনের পর আখমেরভকে ‘ওজিপিইউ’–এর সবচেয়ে গোপনীয় বিভাগ ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টসে’ বদলি করা হয়। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে গুপ্তচরদের জন্য পৃথক কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল না, এজন্য আখমেরভকে মস্কোর ‘ইনস্টিটিউট ইফ রেড প্রফেসর্সে’ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হয়। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে সোভিয়েত স্পাইমাস্টার আর্তুর আর্তুজভ স্বয়ং আখমেরভকে ডেকে পাঠান। তিনি আখমেরভকে জানান, সোভিয়েত সরকার আখমেরভকে তার পরিচয় গোপন রেখে চীনে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আখমেরভের ‘অবৈধ’ জীবনের সূত্রপাত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যখন একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা নিজের নামে এবং অন্য কোনো পেশার আবরণে (যেমন: কূটনীতিক বা সাংবাদিক) বিদেশে দায়িত্ব পালন করেন, সেটিকে গোয়েন্দা জগতের পরিভাষা ‘লিগ্যাল’ বা বৈধ ইন্টেলিজেন্স বলা হয়। অন্যদিকে, যখন কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা নিজস্ব পরিচিতি পুরোপুরি গোপন রেখে নকল নাম–পরিচয় নিয়ে বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত হন, সেটিকে বলা হয় ‘ইলিগ্যাল’ বা অবৈধ ইন্টেলিজেন্স।
সেসময় চীনের বেইজিং ছিল বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আখড়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি, জাপান– সকল বৃহৎ শক্তির গুপ্তচরেরা বেইজিংয়ে গিজগিজ করছিল। আখমেরভকে সেখানেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সোভিয়েতদের পরিকল্পনা ছিল, আখমেরভ একজন তুর্কি ছাত্র ও প্রাচ্য বিশেষজ্ঞের ছদ্মবেশে যাবেন। সেখানে তার দায়িত্ব হবে, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে জাপানি ও ‘শ্বেত রুশ’দের পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। আখমেরভের সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয় ‘ইয়ুঙ্গা’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ সময় চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে তীব্র গৃহযুদ্ধ চলছিল, এবং এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন গোপনে চীনা কমিউনিস্টদের সহায়তা প্রদান করছিল। জিনজিয়াং প্রদেশকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনা জাতীয়তাবাদী সরকারের মধ্যে বেশকিছু সংঘর্ষও হয়েছিল। অন্যদিকে, দূরপ্রাচ্যে তীব্র সোভিয়েতবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদী জাপান কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। তদুপরি, রুশ গৃহযুদ্ধে পরাজিত বলশেভিকবিরোধী ‘শ্বেত রুশ’দের (White Russians) অনেকেই চীনে আশ্রয় নিয়েছিল, এবং তারা সোভিয়েত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে জাপানিদের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত ছিল। এমতাবস্থায় চীনের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য খুবই জরুরি।
এই পরিস্থিতিতে আখমেরভের পরিকল্পনা ছিল, তিনি একজন তুর্কি নাগরিকের ছদ্মবেশে ইউরোপে প্রবেশ করবেন, সেখান থেকে চীনা ভিসা সংগ্রহ করবেন এবং ইতালি থেকে স্টিমারযোগে কোনো একটি চীনা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইতালির রাজধানী রোমে পৌঁছান এবং সেখানে একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে চীনে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিতে বলেন। কিন্তু তারা ছদ্মবেশী আখমেরভকে বোঝায় যে, অধিকাংশ ইউরোপীয় নাগরিক কার্যত নৌপথে নয়, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে স্থলপথে চীনে যায়, কারণ এই পথটিই অপেক্ষাকৃত দ্রুত, সস্তা ও নিরাপদ। এই তথ্য জানার পর ছদ্মবেশী আখমেরভ প্রথমে রোমে অবস্থিত চীনা দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করেন এবং এরপর সোভিয়েত দূতাবাস থেকে একটি ট্রানজিট ভিসা সংগ্রহ করেন।
কিন্তু সোভিয়েত দূতাবাস থেকে বের হওয়ার পরপরই ইতালীয় পুলিশ আখমেরভকে আটক করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। অবশ্য তাদের আসলে জানা ছিল না যে, তারা কাকে আটক করেছে। সেসময় ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির তীব্র কমিউনিস্টবিরোধী ফ্যাসিবাদী দল ক্ষমতাসীন ছিল, এবং যারাই ‘লাল দূতাবাসে’ (সোভিয়েত দূতাবাস) যেত, তাদের ওপরেই ইতালীয় পুলিশ কড়া নজর রাখত। এই সূত্রেই তারা ছদ্মবেশী আখমেরভকে আটক করে এবং তাকে প্রশ্ন করে, তিনি কেন সোভিয়েত দূতাবাসে গিয়েছিলেন? আখমেরভ একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করেন, এবং ইতালীয়রা এই ‘তুর্কি নাগরিক’কে ছেড়ে দেয়।
এরপর আখমেরভ সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে চীনে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে সোভিয়েত–মাঞ্চুকুয়ো সীমান্ত অতিক্রম করেন, এবং এ সময় আরেকটি অপ্রত্যাশিত বিপদের সম্মুখীন হন। ‘মাঞ্চুকুয়ো’ ছিল উত্তর–পূর্ব চীনে অবস্থিত একটি জাপানি আশ্রিত রাষ্ট্র এবং জাপানি সীমান্তরক্ষীরা সোভিয়েত–মাঞ্চুকুয়ো সীমান্তে প্রহরা দিত। এই পরিস্থিতিতে এক জাপানি সীমান্তরক্ষী তার দোভাষীর মাধ্যমে আখমেরভকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঘটনাচক্রে এই দোভাষী ছিল আখমেরভের মতোই তাতার জাতিভুক্ত। আখমেরভের বক্তব্য অনুবাদ করতে করতে তার সন্দেহ হয় যে, এই ‘তুর্কি নাগরিক’ হয়ত আসলে তুর্কি নয়, বরং তুর্কি ভাষায় পারদর্শী একজন তাতার! অবশ্য আখমেরভ তুরস্ক সম্পর্কে তার বিস্তৃত জ্ঞান এবং তুর্কি ভাষায় তার অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণে জাপানি সীমান্তরক্ষীদের সন্দেহ দূর করতে সক্ষম হন।
এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আখমেরভ চীনের বেইজিংয়ে পৌঁছান। তিনি সেখানে অত্যন্ত সম্মানজনক ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি’তে ভর্তি হন। এখানে প্রধানত চীনে অবস্থানরত বিদেশি ছাত্ররা এবং চীনা অভিজাত শ্রেণির সদস্যরা পড়াশোনা করত। আখমেরভ দ্রুত সেখানে একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন এবং চীনা অভিজাত শ্রেণির বেশকিছু সদস্যকে ‘এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ করতে সক্ষম হন। একই সময়ে তিনি প্রচুর তথ্য মস্কোয় প্রেরণ করতে থাকেন। তার কৃতিত্বের জন্য তিনি সিনিয়র কর্মকর্তাদের প্রশংসা অর্জন করেন। এদিকে সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আখমেরভকে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে প্রেরণের জন্য পরিকল্পনা করতে শুরু করে।
১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত ‘ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্সে’র রেসিডেন্ট নিউইয়র্কের একটি হোটেলরুমে খুন হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় যে এজেন্টদের নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের সম্পর্কে কাউকে জানাতে পারেননি। এর ফলে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্সের কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে রুশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা এবং ১৯২১ সাল থেকে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বোরিস বাজারভকে যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত ইলিগ্যাল ইন্টেলিজেন্সের নতুন রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। তাকে সম্পূর্ণ নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত গুপ্তচর নেটওয়ার্ক সাজাতে হচ্ছিল। এমতাবস্থায় তাকে সহায়তা করার জন্য আখমেরভকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করা হয়।
আখমেরভ একজন তুর্কি নাগরিকের ছদ্মবেশে যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করেন। তার ছদ্মনাম ছিল মুস্তাফা তাগমাক। এই পরিচয়ে তিনি নিউইয়র্কে অবস্থিত ‘কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি’র ভাষাতত্ত্ব অনুষদে ভর্তি হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অধ্যয়ন/অধ্যাপনা/গবেষণা করেছেন, তাদের তালিকায় রয়েছেন– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে পাঁচজন, ৪ জন মার্কিন রাষ্ট্রপতি (থিওডোর রুজভেল্ট, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, ডুইট আইসেনহাওয়ার ও বারাক ওবামা), ২৯ জন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, ২৯ জন অস্কারবিজেতা এবং ৯৬ জন নোবেল পুরস্কারজয়ী। এক কথায়, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি বিশ্বের অভিজাতদের অন্যতম কেন্দ্রস্থল।
সুদর্শন ও মিষ্টভাষী তুর্কি নাগরিক মুস্তাফা তাগমাক (ওরফে সোভিয়েত গুপ্তচর ইসহাক আখমেরভ) অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কলম্বিয়ায় পড়াশোনা করতে থাকেন। কিন্তু এর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিপুল সংখ্যক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন এবং অগণিত পার্টি ও পিকনিকে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মার্কিন সমাজের নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ লাভ করেন, এবং এজেন্ট নিয়োগের কাজ চালিয়ে যান। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক র্যালিতেও অংশগ্রহণ করেন। তখন এটিকে অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো না, কারণ সে সময় কলম্বিয়া ছিল কমিউনিস্ট তরুণদের একটি কেন্দ্র, এবং তারা ফ্যাসিবাদের ক্রমাগত উত্থান নিয়ে শঙ্কিত ছিল।
এ রকম একটি র্যালিতেই আখমেরভের সঙ্গে এক সুন্দরী রমণীর পরিচয় হয়। তার নাম ছিল হেলেন লোয়রি। অবশ্য কেবল সৌন্দর্যের কারণে আখমেরভ হেলেনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেননি। হেলেন ছিলেন একজন কট্টর কমিউনিস্ট এবং তার মামা আর্ল ব্রাউডার ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৩০ সাল থেকে ব্রাউডার মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন এবং তার নেতৃত্বেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে কমিউনিস্টরা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। ১৯৩৬ সালে দলটিতে লক্ষাধিক সদস্য ছিল, এবং ব্রাউডার সে বছরে অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় দলটির মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের বিস্তার রোধ করা। এ সময় ইউরোপে ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্য মূল প্রতিবন্ধক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ব্রাউডার ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে’র একজন সদস্য ছিলেন এবং সেই সূত্রে তিনি প্রায়ই বিভিন্ন দেশের বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এরকমই একটি বৈঠকে আখমেরভের সঙ্গে ব্রাউডারের পরিচয় ঘটে। কিন্তু প্রাক্তন ‘এসভিআর’ কর্মকর্তা সের্গেই ইয়াকোভলেভের মতে, আখমেরভের মূল লক্ষ্যবস্তু ব্রাউডার ছিলেন না। বরং ব্রাউডারের ভাগ্নি হেলেন ছিলেন আখমেরভের সমীকরণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হোয়াইট হাউজ এবং মার্কিন পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে হেলেনের পরিচয় ছিল। আখমেরভ হেলেনকে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করার জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেন। হেলেন অবশ্য সাথে সাথেই এই প্রস্তাবে সম্মত হন।
আখমেরভ প্রথমে হেলেনকে বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহার করেন, কিন্তু দ্রুতই হেলেনের কাজের পরিসীমা সম্প্রসারিত হয়। হেলেনের সাঙ্কেতিক নামকরণ করা হয়েছিল ‘তানিয়া’। আখরেমভ দ্রুতগতিতে মার্কিন ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার জাল বিস্তার করছিলেন, এবং হেলেন এই জাল বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। হেলেনের অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট ছিল, এবং এগুলোকে আখমেরভ তার এজেন্টদের সঙ্গে নানা ধরনের বৈঠকের জন্য ব্যবহার করতেন।
হেলেনের মাধ্যমেই আখমেরভ পরিচিত হন হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইটের সঙ্গে। হোয়াইট ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিরই একজন স্নাতক। ১৯৩৪ সালে হোয়াইট মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ে (United States Department of the Treasury) যোগদান করেন এবং ১৯৩৮ সালে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সদ্য সৃষ্ট ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টে’র প্রধান নিযুক্ত হন। প্রধানত অ্যাকাডেমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাই এই দপ্তরটি চালাতেন। হোয়াইট ছিলেন একজন বামপন্থী এবং তার নিজের মন্ত্রণালয়ে তো বটেই, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও তার প্রচুর জানাশোনা লোক ছিল। তদানীন্তন মার্কিন অর্থমন্ত্রী হেনরি মর্গেন্থাউয়ের ওপর হোয়াইটের ব্যাপক প্রভাব ছিল, এবং শুধু তাই নয়, তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সঙ্গেও তিনি যেকোনো সময় সাক্ষাৎ করতে পারতেন।
বলাই বাহুল্য, হোয়াইট ছিলেন মার্কিন ক্ষমতার কেন্দ্রের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাব অপরিসীম। মার্কিন আইন অনুযায়ী, যুদ্ধ বা অন্য কোনো দুর্যোগকালীন যদি মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির কিছু হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এবং এই হোয়াইট ছিলেন সেই মার্কিন অর্থমন্ত্রীর অত্যন্ত কাছের মানুষ। এজন্য তার সঙ্গে পরিচয় ও সুসম্পর্ক স্থাপন ছিল আখমেরভের জন্য ‘জ্যাকপট’ স্বরূপ।
হোয়াইট আখমেরভের প্রকৃত পরিচয় জানতেন না। হেলেন তার কাছে আখমেরভকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন ‘চীন বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে। এই পরিচিতিকে পোক্ত করার জন্য আখমেরভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিস্তৃত যোগাযোগ স্থাপন করেন। হোয়াইটের সঙ্গে আখমেরভের প্রথম সাক্ষাতেই হোয়াইট দূরপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি সম্পর্কে আখমেরভের প্রখর জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হন। ১৯৩৭ সালের জুলাইয়ে জাপান চীনের ওপর পুরোদমে আক্রমণ চালায়, এবং এর ফলে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে হোয়াইট দূরপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। প্রথম সাক্ষাতেই আখমেরভ দূরপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি নিয়ে হোয়াইটকে একটি বক্তৃতাই দিয়ে ফেলেন।
বিষয়টি কল্পনা করুন, মার্কিন অর্থমন্ত্রীর ডান হাত যে ব্যক্তি, তার কাছে একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকর্তা দূরপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছেন! এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য চলে যাবে মার্কিন অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে! তুর্কি নাগরিক মুস্তাফা তাগমাক (ওরফে সোভিয়েত গুপ্তচর ইসহাক আখমেরভ) যে হোয়াইটের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার প্রমাণ হচ্ছে, প্রথম সাক্ষাতের পর থেকে হোয়াইট প্রায়ই বিভিন্ন ক্যাফেতে আখমেরভের সঙ্গে দেখা করতেন এবং দূরপ্রাচ্য (বিশেষত চীন ও জাপান) নিয়ে আলোচনা করতেন। স্বভাবতই, ছদ্মবেশী আখমেরভের চিন্তাধারা হোয়াইটের নিজস্ব চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করতে শুরু করে, এবং সেটি মার্কিন অর্থমন্ত্রীর (ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রপতির) কাছে পৌঁছে যেতে থাকে।
সামগ্রিকভাবে, ১৯৩৮ সালের মধ্যে ইসহাক আখমেরভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার জাল বেশ ভালোভাবেই বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমশ আখমেরভের ভাগ্যে বিপদ ঘনিয়ে আসতে থাকে। আখমেরভ যখন তার মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত, তখন তার মাতৃভূমিতে রচিত হচ্ছিল তার মৃত্যুর বার্তা! সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হচ্ছিল কুখ্যাত ‘গ্রেট পার্জ’ (Great Purge), যেটি অচিরেই নিশ্চিহ্ন করে দেয় সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বহু শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্ককে।
সেই ভয়াবহ ‘পার্জ’ থেকে আখমেরভ কীভাবে বাঁচলেন এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দিলেন, সেটি নিয়ে আলোচনা দেখুন পরবর্তী পর্বে।