বড় বড় আবিষ্কার আর বিখ্যাত সব মনিষীদের জীবনী পড়তে গেলে আমরা অহরহই এমন ঘটনা দেখতে পাই যে, দুর্ঘটনাবশত কিংবা অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা থেকে বৈপ্লবিক সব আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের খোরাক তৈরি হয়েছে। ইভান প্যাভলভের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তেমনই একটি ঘটনা। রাশিয়ান এই শারীরবিজ্ঞানী বাসায় একটি কুকুর পুষতেন। কোনো কারণে একবার কুকুরের মুখে লালার আগমনের দিকে তার নজর গেল। তিনি খেয়াল করলেন, তার দৃষ্টি কুকুরটির দিকে পড়তেই সেটির মুখ থেকে লালা পড়লো কয়েক ফোঁটা। এরপর পরবর্তী কয়েকদিন এক নাগাড়ে লক্ষ করলেন যে, তিনি বাড়িতে প্রবেশ মাত্রই কুকুরটির মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হচ্ছে! ব্যস, আরো একটি বিখ্যাত আবিষ্কারের শুরুটা হলো সাদামাটা, অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা থেকে!
১৯০২ সালে প্যাভলভের মাথায় এই নতুন ধারণাটি আসে যে, একটি কুকুর বিভিন্ন উদ্দীপকের বিপরীতে যে আচরণ করে, তার সবটাই এর শেখার প্রয়োজন হয় না। খাবার দেখলে কুকুরের মুখে লালা চলে আসে, এটি কোনো শিখন ফল নয়। এই প্রতিবর্তি ক্রিয়াটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া। আচরণবিদগণের ভাষায়, “স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবর্তির সৃষ্টি করে”। এই ধারণা থেকে একটি বৈপ্লবিক পরীক্ষার কথা মাথায় আসে প্যাভলভের। ‘প্যাভলভের পরীক্ষা’ কিংবা ‘প্যাভলভের কুকুর’ নামে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে পরীক্ষাটি।
স্বতস্ফূর্ত প্রতিবর্তি আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নিজের ল্যাবে উপরের ছবিটির মতো একটি ব্যবস্থা করেন প্যাভলভ। কুকুরের জিভের সাথে একটি নল লাগিয়ে দেয়া হয়, যার মাধ্যমে জিভে সৃষ্ট লালা একটি স্বয়ংক্রিয় পরিমাপকের মধ্যে চলে যাবে। এরপর তিনি নির্দিষ্ট সময় পরপর কুকুরটিকে কয়েকবার খাবার দিলেন এবং খাবার দেখার ফলে কুকুরের মুখে সৃষ্ট লালার পরিমাণ নির্ণয় করলেন। তবে, প্রতিবারই খাবার দেয়ার সময় একটি বেল বাজানোর শব্দ করলেন। কয়েকবার এভাবে করার পর দেখা গেল কেবল বেল বাজালেই কুকুরটির মুখে সমপরিমাণ বা সামান্য কম পরিমাণ লালা উৎপন্ন হচ্ছে। অর্থাৎ, কুকুরটি খাবারের সাথে বেলের শব্দের বিষয়টি একীভূত করতে শিখে নিয়েছে। এটি একটি শিখন আচরণ। কারণ, বেলের শব্দ কুকুরের নিকট অপরিচিত এবং শর্তাধীন একটি বিষয়। কিন্তু বার কয়েক একই ঘটনার সম্মুখীন হয়ে কুকুরটির আচরণ এবং প্রতিক্রিয়া প্রভাবিত এবং পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
এই পরীক্ষা থেকে প্যাভলভ আরো আবিষ্কার করলেন যে, কেবল বেল নয়, প্রায় যেকোনো শর্তাধীন বস্তুর দ্বারাই কুকুরের আচরণ প্রভাবিত করা সম্ভব। তবে, তিনি দেখতে পান যে এক্ষেত্রে, নতুন উদ্দীপকের সাথে কুকুরের আচরণের সামঞ্জস্য ঘটাতে কালসাম্য হতে হবে একেবারে নিখুঁত। স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপকের সাথে, শর্তাধীন উদ্দীপক আনয়নের সময়ের পার্থক্য অধিক হলে, শিখন আচরণ পাওয়া সম্ভব না। খাবার (স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপক) দিয়ে যদি অনেকক্ষণ পর বেল বাজানো (নতুন উদ্দীপক) হয় তাহলে কুকুরটি নতুন উদ্দীপকের সাথে নিজের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করতে পারবে না। এই নিয়মকে তিনি ‘ল অব টেম্পোরাল কন্টিগুয়িটি’ বলে অভিহিত করেন। পরবর্তীতে, আচরণ প্রভাবিত হবার এই ব্যাপারটি ‘প্যাভলভের কন্ডিশনিং’ হিসেবে আচরণবিদগণের নিকট ভীষণ রকমের খ্যাতি লাভ করে।
রাশিয়ার রিয়াজানে বসবাস করতেন এক প্রচণ্ড গোঁড়া পাদ্রী পিটার দিমিত্রিভিখ। অন্যদিকে তার স্ত্রী বারবারা তার তুলনায় বিপরীত মেরুর মানুষ ছিলেন। এই দম্পতির ঘরে জন্ম হয় ৭ ছেলে ও ৫ মেয়ের। ৭ ছেলের প্রত্যেককেই পিটার ভর্তি করে দিলেন বিভিন্ন চার্চে! ছেলেদের ভবিষ্যৎ, চার্চের পাদ্রীর বাইরে আর কোনো পেশাতেই তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না। তবে তার এই চাপিয়ে দেয়া ইচ্ছা সবাই মেনে নিলেও একজন নিতে পারেননি। বিজ্ঞানের প্রতি নিজের প্রবল আকর্ষণ বলে তিনি পিটারের দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেন। তিনি পিটারের জ্যেষ্ঠ সন্তান ইভান পেট্রোভিখ প্যাভলভ।
১৮৪৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন প্যাভলভ। অল্প বয়সেই মায়ের হাত ধরে পড়তে শেখেন তিনি। বই পড়াটা একরকম শখের মতো ছিল তার নিকট। তবে পড়ার বাইরে বাগান করা, গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে সাইকেল চালানো, আর দিনশেষে পুকুরে সাঁতার কেটে বাড়ি ফেরাই তার নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল। কিন্তু বছর বছর তার পরিবার বড় হচ্ছিল, তার ছোট ভাইবোনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আর শখগুলো সব চাপা পড়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। মায়ের উপর চাপ কমাতে কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার রাখার মতো কাজে মাকে সাহায্য করতেন শিশু প্যাভলভ। এসব করেই কেটে যায় তার জীবনের প্রথম ১০টি বছর। এরপর শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় তথা চার্চ অধ্যায়।
১৮৬০ সালে, ১১ বছর বয়সী প্যাভলভকে একটি স্থানীয় চার্চে ভর্তি করে দেন তার বাবা পিটার। প্রাথমিকভাবে চার্চের পড়ালেখা ভালোই লাগতো প্যাভলভের। দু’বছর পর একটি সেমিনারিতে ভর্তি হন ধর্মতত্ত্ব পড়ার জন্য। তবে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তার বাড়তে থাকে। সে আগ্রহের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটতে ঘটতে কেটে যায় জীবনের প্রথম ২১টি বছরই! ১৮৭০ সালে সেমিনারির বাঁধাধরা পড়ালেখা থেকে বেরিয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস নেন তিনি। রসায়ন এবং শারীরবিদ্যা পড়ার জন্য ভর্তি হন সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু হয় তার জীবনের তৃতীয় অধ্যায়।
১৮৭৫ সালে পিটার্সবার্গ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন প্যাভলভ। এরপর তিনি মিলিটারি একাডেমিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৮৮৩ সালে স্বর্ণপদক সহকারে পড়ালেখা শেষ করেন। অবশ্য এরই মাঝে, ১৮৮১ সালে সেরাফিমা ভ্যাজিলিয়েভমাকে বিয়ে করেন তিনি। ১৮৯৫ সালে পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করার মাধ্যমে জীবনের চতুর্থ অধ্যায়ে প্রবেশ করেন তিনি। মিলিটারি একাডেমির ফিজিওলজি বিভাগে একটানা ৩০ বছর অধ্যাপনা করেছেন তিনি। ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ৫ সন্তান এবং স্ত্রী সেরাফিমাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান প্যাভলভ। তার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো রাশিয়ার চিকিৎসক সমাজ।
১৯১০-১৫ সালের মধ্যে প্যাভলভ ‘ট্রান্সমার্জিনাল ইনহিবিশন’ বা টিএমআই নিয়ে গবেষণা করেন এবং এ ব্যাপারে একটি তত্ত্ব দাঁড় করান। টিএমআই হচ্ছে, অত্যাধিক বা প্রচণ্ড কোনো উদ্দীপকের বিপরীতে কোনো জীবের প্রতিক্রিয়া। টিএমআই এর উদ্দীপক অধিকাংশ সময়েই কষ্টদায়ক হয়। এই কষ্টদায়ক উদ্দীপকের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর, কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। প্যাভলভ তার গবেষণায় দেখেন যে, প্রতিটি প্রাণীই শেষ পর্যন্ত একটি ‘শাট ডাউন পয়েন্ট’ এ পৌঁছে যায়, যখন ব্যথা অনুভব করার স্নায়ুগুলো আর কাজ করে না। এই শাট ডাউন পয়েন্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টিএমআই এর তিনটি স্তর উল্লেখ করেছেন তিনি।
- ইকুইভ্যালেন্সি স্তর: যখন কেউ তার শরীরের একটি ফোঁড়া কেটে ফেলেন কিংবা একটি নড়বড়ে দাঁত তুলে ফেলেন নিজ হাতে, তখন তিনি প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েও সে তুলনায় কম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। কারণ, তিনি নিজেই সে কাজটি করছেন।
- প্যারাডক্সিক্যাল স্তর: অনেক সময় আমরা অনেক তুচ্ছ উদ্দীপকের জন্য ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখাই, আবার অনেক বড় কোনো উদ্দীপককে উপেক্ষা করে যাই। এটি হচ্ছে টিএমআই এর প্যারাডক্সিক্যাল স্তর। যেমন, কোনো শিশুকে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি সামান্য চিমটি কাটলেও দেখা যায় সে বিকট চিৎকারে কান্না জুড়ে দেয়। কিন্তু, সে নিজে খেলতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বড় রকমের ব্যথা পায়, অথচ নিশ্চুপ থাকে।
- আল্ট্রা প্যারাডক্সিক্যাল স্তর: নেতিবাচক উদ্দীপক, ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলে তাকে আল্ট্রা প্যারাডক্সিক্যাল টিএমআই বলে। যেমন, কারো মৃত্যুশোকে সাময়িকভাবে প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কায় অনেক সময় মানুষ হাসতে শুরু করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্যাভলভের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজটি তার জীবনের সেরা কাজ নয়। অন্যভাবে বললে, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গবেষণা কাজটি বিখ্যাত হয়নি! ইভান প্যাভলভের নাম মূলত সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, ‘প্যাভলভের কুকুর’ খ্যাত পরীক্ষাটির জন্য। নিঃসন্দেহে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল বিজ্ঞানের জন্য। কিন্তু, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন। প্রতিবর্তি আচরণ নিয়ে তার গবেষণা শুরু হয় মূলত কুকুরের গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি নিয়ে গবেষণা করার মধ্য দিয়েই। প্রতিবর্তি আচরণের উপর প্রাণীর ‘ডাইজেস্টিভ সিস্টেম’ বা পাচনতন্ত্রের কোনো প্রভাব আছে কিনা, কিংবা প্রাণীর স্নায়ু এবং বহিরাগত উদ্দীপকের কোনো প্রভাব পাচনতন্ত্রে পড়ে কিনা, এ বিষয়ে গবেষণা করেই ১৯০৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন প্যাভলভ।
‘ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং’ বা প্যাভলভের ভাষায় ‘কন্ডিশনাল রিফ্লেক্স’, যা-ই বলা হোক না কেন, তার এই কাজই মূলত আচরণবিদ্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার এ গবেষণার দেখানো পথ ধরেই, মানবিক আচরণের অনেক প্রতিবর্তি ক্রিয়া এবং শর্তাধীন উদ্দীপকের বিপরীতে প্রতিবর্তি ক্রিয়া নিয়ে হয়েছে বিস্তর তাৎপর্যবাহী সব গবেষণা। এসব গবেষণায় একদিকে আচরণবিদ্যা, অন্যদিকে শারীরবিদ্যা হয়েছে আরো সমৃদ্ধ। আর পাচনতন্ত্র নিয়ে তার গবেষণাই মূলত পরবর্তীকালে ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং এর পথ প্রসারিত করেছে। এসব অবদানের ফলস্বরূপ নোবেল পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন ‘কুপলি মেডাল’ এবং রয়্যাল সোসাইটির সম্মানজনক বিদেশী সদস্যপদ। তার গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক সাফল্যের সুফল আজও আমরা ভোগ করছি।
ফিচার ছবি: tainy.net