আমরা সবাই প্রতিভারে করে পণ্য
ভাবালু আত্মকরুণায় আছি মগ্ন
আমাদের পাপের নিজের জীবনে জীর্ণ
করলে, যামিনী রায়
… পুঁথি ফেলে তুমি তাকালে আপন গোপন মর্মতলে
ফিরে গেলে তুমি মাটিতে, আকাশে, জলে
স্বপ্ন লালসে অলস আমরা তোমার পুণ্যবলে
ধন্য যামিনী রায়– বুদ্ধদেব বসু
যে শিল্পী নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছেন, নিজের প্রতিভাকে পণ্য করে নয়, কোনো পরসংস্কৃতির চর্চা করে নয়, বরং স্বদেশের প্রত্যন্ত অবহেলিত লোকসংস্কৃতিকে তুলির আঁচড়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিয়েছেন, তিনিই পটুয়া যামিনী রায়। শুধুমাত্র দেশপ্রেমের টানে, নিজস্বতাকে ধরে রাখার অভিপ্রায়ে তিনি পটচিত্রের একটি আন্তর্জাতিক মান ঠিক করে দিয়ে গেছেন। তাই বুদ্ধদেব বসু কবিতায় এভাবেই স্তুতি গেয়েছেন শিল্পী যামিনী রায়ের।
ব্যক্তিগত জীবন
বিশ্ববরেণ্য শিল্পী যামিনী রায় ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রমতরণ রায়। ছোট থেকেই যামিনী রায়ের মধ্যে ছবি আঁকার শিল্পীসত্ত্বা দেখা যায়। শৈশবে ঘরের দেয়ালে, মেঝেতে কিংবা হাতের কাছে যা-ই পেতেন, তাতেই পুতুল, হাতি, বাঘ, পাখি ইত্যাদি এঁকে গেছেন নিজের মনে। গ্রামে দুর্গাপূজোর সময় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে যেতেন ঠাকুর গড়া দেখতে। নিজের প্রতিভাকে দমিয়ে না রেখে ১৬ বছর বয়সেই কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯১৪ সালে ফাইন আর্টে ডিপ্লোমা করেন। তিনি চারটি পুত্রসন্তান ও একটি কন্যাসন্তানের জনক।
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতেই চিত্রকলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। আর্ট স্কুলের বিখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলাকৌশলের সাথে পরিচিত হন। পাশ্চাত্য রীতির চিত্রকলা তাকে আকৃষ্ট করে এবং ফলস্বরূপ তিনি তাতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী পল সেজান, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো ও গগ্যাঁর প্রভাব দেখা যায় তার চিত্রকলায়।
পোট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ, তৈলচিত্র ছিল তার স্টাইল ও মাধ্যম। এছাড়াও ক্লাসিক্যাল ন্যুড পেইন্টিংয়ে তার হাত ছিল প্রশংসনীয়। নিজস্ব ঢঙে তিনি এঁকে গিয়েছেন তার মতো করে। ছাত্রাবস্থায় তিনি শিক্ষকদের নজরে আসেন। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ, ভারতের আধুনিক চিত্রকলার অগ্রপথিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠছিলেন তিনি দিনে দিনে। হঠাৎই তিনি পাশ্চাত্য শিল্পে আগ্রহ হারাতে থাকেন, যেন হাঁপিয়ে উঠছেন পরসংসস্কৃতি চর্চায়। এরপর তার আঁকার বৈশিষ্ট্য, ধরন, বিষয়বস্তু, তুলির ব্যবহার ক্রমেই বদলাতে থাকে।
আঁকার ধরন
প্রথমেই বলেছি, শিল্পীজীবনের প্রারম্ভে ইউরোপীয় ছবির আদলেই ছবি এঁকেছেন যামিনী রায়। তিনি পাশ্চাত্যের ইমপ্রেশনিস্ট ধারার ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত শিল্পীদের অনুকরণে নিজের ঢঙে শিল্পচর্চা করেছেন।
তখন তার অংকনশৈলীই ছিল যেন বিলেতি মুডের। পাশ্চাত্য চিত্রকলায় তিনি মুগ্ধ হলেও মন সন্তুষ্ট ছিল না। কিছু একটা অনুপস্থিত ছিল সেই ছবিগুলোর মধ্যে, যা যামিনী রায়কে ভাবিয়ে তুলতে লাগলো। আর তা হলো নিজস্বতা, স্বকীয়তা, দেশপ্রীতি। ছবিতে অনুপস্থিত ছিলো দেশীয় সংস্কৃতি, স্বদেশের মানুষ, তাদের জীবনাচার ও প্রকৃতি। যা কিছু তার আপন, যেখানে তার বাস, পরিবেশ, সেসবের কোনো উপাদানই উপস্থিত ছিল না পাশ্চাত্য চিত্রে। আর তাই প্রান্তিক জায়গা থেকে শিল্পের লোকায়ত ধারাই শিল্পীকে আকৃষ্ট করলো সবথেকে বেশি। মাটির টানে ঘরে ফিরে গেলেন যামিনী রায়। চিত্রকলার কেবল ভারতীয় বৈশিষ্ট্যই নয়, খাঁটি কলকাতাইয়া কালীঘাটের পটের আঙ্গিক হয়ে উঠলো তার চর্চার প্রধান উপজীব্য। কলকাতার কালীঘাটের পটশিল্পীদের চিত্রে তিনি আকৃষ্ট হলেন।
কালীঘাট চিত্রকলা, অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে কালীঘাটের কালীমন্দিরের সন্নিহিত এলাকার মন্দিরকে কেন্দ্র করে হাট-বাজার গড়ে উঠেছিলো। কালীমন্দিরে যে তীর্থযাত্রীরা আসতেন, ফেরার পথে স্মারক হিসেবে স্মৃতিচিহ্নমূলক বস্তু সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের কালীমন্দিরের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে স্মারক হিসেবে কালীঘাট চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। চিত্রকলার বিষয় ছিল পৌরাণিক, ধর্মীয় অথবা পশুপাখি জাতীয় গ্রামীণ চিত্র। এগুলোই স্থানীয়রা নিজস্ব রঙে-ঢঙে আঁকতেন, যা কালীঘাট চিত্রকলা নামে বিখ্যাত ছিল। এমন করে শুধু কালীঘাট নয়, জন্মস্থান বেলিয়াতোড়, ওড়িষ্যা, প্রাচীন গুজরাট, মেদিনীপুর ঝাড়গ্রাম থেকেও প্রচুর পট সংগ্রহ করেন যামিনী রায়।
এরপর বেঙ্গল স্কুল ও প্রচলিত পশ্চিমা ধারার বিপরীতে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক শিল্পধারার জন্ম দেন তিনি। পটুয়াদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তৈরি করলেন পটচিত্রের। দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ এই শিল্পী স্বদেশের লোকায়ত শিল্পকে বেছে নিলেন জঁনরা হিসেবে। দৈনন্দিন গ্রাম্য জীবনের সহজ স্বাভাবিক দিকটায় ঝুঁকে পড়লেন। গ্রামীণ জীবন-জীবিকা, লাঙল হাতে চাষী, কীর্তন গায়ক, কিশোরী কন্যাদের হাসি, ঘরোয়া বধূ, বাঁশীবাদক ক্লান্ত পথিক, নৃত্যরত তরুণীদ্বয়, বাঘ, মাছ, বিড়াল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতি হলো তার অঙ্কনের বিষয়াদি। পটচিত্রের উপাদানে আরও রসদ যুগিয়েছে প্রিয় ধর্মকাহিনীগুলো। যেমন- রামায়ণ কথা, চৈতন্যের জীবনী, ক্রুশবিদ্ধ যীশুর জীবন, রাধা-কৃষ্ণ, জগন্নাথ-বলরাম ইত্যাদি। যামিনী রায়ের আঁকিয়ের পটপরিবর্তনের বিষয়টিতে শিল্প বিশ্লেষক ড. অশোক ভট্টাচার্য্য মূল্যবান মন্তব্য করেছেন,
তিনি একজন জাত পটুয়ার মতো গুণগত উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে ছবির সংখ্যাগত আধিক্যের দিকেও নজর দিয়েছেন।
বেলিয়াতোড় গ্রামের আশেপাশেই ছিল সাঁওতাল আদিবাসীদের বসবাস। যামিনী রায় ১৯২১ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যকার সময়ে নতুন এক গবেষণা চালালেন সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে। তাদের জীবনাচারকে তিনি তুলির রঙে নতুন করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন। সেখানে স্থান পেলো সাঁওতাল নারীদের নাচ, পরিবার, জীবনযাপনের দৃশ্যসহ দৈনন্দিন জীবনের রূপ।
এবার দেখা যাক তার আঁকার কৌশল। বেশ ক’টি ছবি খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি চোখের কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। লম্বা বড় সরু নয়নের আধিক্য যেকোনো ছবিতে। সেই চোখ হোক পুরুষের, বিড়ালের অথবা সুনয়না যুবতীর, উপেক্ষা করার উপায় নেই। মোটা দাগে স্পষ্ট ও সপ্রতিভ হয়ে ওঠে সাঁওতাল পটচিত্রগুলো। তাঁর ছবিতে সাবজেক্টই প্রধান, পশ্চাতপট নয়।
রঙের ব্যবহার যামিনী রায়কে সবচেয়ে বেশি পৃথক করেছে সকল আঁকিয়ে থেকে। উজ্জ্বল রঙে ফুটে থাকা তার চিত্রগুলো যেন কোনো উৎসবের আমেজ বয়ে আনে। পটুয়াদের মতো তিনিও মেটে রঙে ছবি এঁকেছেন। একটি তথ্য না দিলেই নয় যে, স্বদেশপ্রেমিক শিল্পী যামিনী রায় তার পটচিত্রে শুধুমাত্র দেশজ রঙই ব্যবহার করেছেন। তিনি তার চিত্রে দেশজ উপাদান, যেমন- বিভিন্ন বর্ণের মাটি, ভূষোকালি, খড়িমাটি, বিভিন্ন গাছগাছালি, লতাপাতার রস থেকে আহরিত রং ব্যবহার করতেন। তার সকল চিত্র যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো দেশীয় উপাদানে আর রঙে। তিনি সবকিছুতেই দেশীয়ই উপাদানের সাহায্য নিয়েছিলেন, যাতে ধনী-নির্ধন সবার কাছে অনায়াসেই পৌঁছুতে পারেন। তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছেন সাধারণের জন্য। খুবই স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্যও ছিল চিত্রগুলো।
তার আঁকা বিখ্যাত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘সাঁওতাল মা ও ছেলে’, ‘চাষির মুখ’, ‘পূজারিণী মেয়ে’, ‘কীর্তন’, ‘বাউল’, ‘গণেশ জননী’, ‘তিন কন্যা’, ‘যিশুখ্রিষ্ট’, ‘কনে ও তার দুই সঙ্গী’ ও ‘ক্রন্দসী মাছের সাথে দুই বেড়াল’।
গতানুগতিক শিক্ষা লাভ করেও শেষমেষ এসকল ছবি এঁকেছেন, কেননা এখানে মাটি আর নাড়ির যোগ আছে। যামিনী রায়ের ছবি আদ্যন্ত ভারতীয় কৃষক-কুমোর সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে না আছে যন্ত্রজীবনের কোলাহল, না নগরজীবনের জটিলতা। আছে তো শুধু নিজের মানুষ, মাটির গন্ধ, শান্তি, স্বাধীনতা আর অফুরান আনন্দ। তার এই প্রথাবিরোধী চিত্রাঙ্কনের ফলস্বরূপ-
- গ্রামজীবনের সরলতা উঠে এসেছে
- সমাজের বিস্তৃত অংশের মধ্যে লোকচিত্রকলা প্রবেশ করেছে
- ভারতীয় চিত্রকলার নিজস্ব পরিচিতি সমাদৃত হয়েছে
- আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছে
রায়ের কাজ শুধু নিজ দেশেই খ্যাতি লাভ করেনি মাত্র। সারাবিশ্বে তার শিল্পকর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। সুদূর আমেরিকা, ব্রিটেন, প্যারিস ও ইউরোপে তার কাজ পৌঁছেছিলো। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে যামিনী রায়ের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। সে সময় ‘পরিচয়’ নামক কলকাতার এক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর শিল্পের আলোচনা হওয়ার ফলে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন মার্কিন সৈনিক ও অফিসারবৃন্দ ভারত সফরে আসেন, যামিনী রায়ের নয়নাভিরাম চিত্র দেখে মুগ্ধ হন তারা। অনেক চড়া দামে তার ছবি ক্রয় করেন এসব সফরকারী, যার ফলে তার ছবি দ্রুত প্রসার লাভ করে। অতঃপর ১৯৪৬ সালে লন্ডন ও ১৯৫৩ সালে নিউ ইয়র্কে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। এছাড়া আরও অনেক দেশি-বিদেশি প্রদর্শনীতে, গ্যালারিতে তার ছবি পাওয়া যাবে। ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়ামসহ আরও বেশ কিছু বিখ্যাত জায়গায় সংরক্ষিত আছে তার চিত্রকর্ম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং যামিনী রায়
যামিনী রায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-শিল্পকর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই দেখা যায়, যামিনী রায়ই একজন আধুনিক শিল্পী, যিনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে লিখিতভাবে প্রথম প্রতিবেদন রেখেছেন। এই লেখা বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৪৮) প্রকাশিত হয়। কবিতা পত্রিকায় যামিনী রায় প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে বড় আনন্দ পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। স্বয়ং কবি চিঠি লিখে যামিনীকে জানিয়েছিলেন সে কথা। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।… আমার স্বদেশের লোকেরা আমার চিত্রশিল্পকে যে ক্ষীণভাবে প্রশংসার আভাস দিয়ে থাকেন আমি সেজন্য তাদের দোষ দিই নে। আমি জানি চিত্র দর্শনের যে-অভিজ্ঞতা থাকলে নিজের বিচারশক্তিকে কর্তৃত্বের সঙ্গে প্রচার করা যায়, আমাদের দেশে তার কোনো ভূমিকাই হয়নি। সুতরাং চিত্রসৃষ্টির গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে পারে না বলেই মুরুব্বিয়ানা করে সমালোচকের আসন বিনা বিতর্কে অধিকার করে বসে। সেজন্য এদেশে আমাদের রচনা অনেক দিন পর্যন্ত অপরিচিত থাকবে। আমাদের পরিচয় জনতার বাইরে, তোমাদের নিভৃত অন্তরের মধ্যে। আমার সৌভাগ্য, বিদায় নেবার পূর্বেই নানা সংশয় এবং অবজ্ঞার ভিতরে আমি সেই স্বীকৃতি লাভ করে যেতে পারলুম, এর চেয়ে পুরস্কার এই আবৃতদৃষ্টির দেশে আর কিছু হতে পারে না।
যামিনী রায়কে রবীন্দ্রনাথ আরও একটি অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন, যা বহুপঠিত এবং বহুচর্চিত। যেখানে আধুনিক দৃশ্যকলার একেবারে গোড়ার কথাটি নিঃসংকোচে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
ছবি কী– এ প্রশ্নের উত্তর এই যে– সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালো-মন্দের আর কোনো যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু – সে অবান্তর – অর্থাৎ যদি সে কোনো নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান।
রবীন্দ্র-চিত্রকলা বিষয়ে যামিনী রায়ের প্রবন্ধ এবং উত্তরে রবীন্দ্রনাথের চিঠির মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের অন্যতম দুই আধুনিক শিল্পীর মুক্ত ভাবনার আদান-প্রদান হতো এভাবেই।
যামিনী রায় এবং বিষ্ণু দে
একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘণ্টা চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত
কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায় এই নিয়ে তর্কটা চলত
মান্না দে’র বিখ্যাত ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের বেশ পরিচিত দু’টি লাইন। কলকাতার সেই প্রিয় কফি হাউজে বন্ধুদের আড্ডার বিষয় হতো কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায়। তারা দুজন ছিলেন দীর্ঘ এবং আমৃত্যু বন্ধু। ১৯২৮ বা ’২৯ সালে বিষ্ণু দে প্রথম যামিনী রায়ের আনন্দ চ্যাটার্জী লেনের বাগবাজার বাড়িতে যান অজয় সেনের সাথে চিত্র প্রদর্শনী দেখতে। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত দর্শক হয়েছিলেন শিল্পীর। যামিনী রায়ও হরহামেশা আড্ডা দিতে যেতেন বিষ্ণু দে’র দক্ষিণ কলকাতার ভাড়া বাড়িতে। সেই আড্ডায় আরও সঙ্গী হতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। আড্ডার তর্ক-বিতর্কেও তুলি-কলম দিয়ে ছবি আঁকতেন শিল্পী যামিনী রায়।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যামিনী রায়কে নিয়ে ‘যামিনী রয় অ্যান্ড দি ট্র্যাডিশন অফ পেইন্টিং ইন বেঙ্গল’ নামে ইংরেজিতে একটি বই লেখেন ১৯৩৯ সালে। এছাড়াও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ভাষায় একটি সুবিশাল প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাকে নিয়ে। সেই রচনা বিষ্ণু দে বঙ্গানুবাদ করে সাহিত্য পত্রিকায় ছাপার জন্য প্ররোচনা দিতেন। বিষ্ণু দে-ও তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে প্রচুর গদ্য-পদ্য রচনা করেছেন। যেমন- ১৯৫৯-এর ২১ জুন কবি বিষ্ণু দে ‘তাই তো তোমাকে চাই’ কবিতায় শিল্পী যামিনী রায়কে নিয়ে লিখেছেন নিম্নের পংক্তিগুলি,
একটিই ছবি দেখি, রঙের রেখার দুর্নিবার একটি বিস্তার
মুগ্ধ হয়ে দেখি এই কয়দিন, অথচ যামিনীদার
প্রত্যহের আসনের এ শুধু একটি নির্মাণ একটি প্রকাশ
হাজার হাজার রূপধ্যানের মালার একটি পলক
যেখানে অন্তত গোটা দেশ আর কাল, একখানি আবির্ভাব
যামিনী রায়ও প্রায় তার আঁকা ছবি উপহার দিতেন বিষ্ণু দেকে। কবিবন্ধু বিষ্ণুর বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকে দিয়েছেন যামিনী। তারা নিয়ম করে চিঠি আদান-প্রদান করতেন। শেষ বয়সে যখন তারা প্রতিবেশি, তখন প্রায় প্রত্যহ আসা-যাওয়া চলতো। দুজন একসাথে ধূমপান করতেন এবং অন্তরঙ্গ আলাপে ডুবে থাকতেন। বয়সে ২২ বছরের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্ব ছিল সমবয়স্কদের মতোই।
১৯৩৪ সালে যামিনী রায় তার আঁকা একটি চিত্রকর্মের জন্য ‘ভাইসরয় স্বর্ণপদক’ পান। ভারতীয় সরকার থেকে ১৯৫৫ সালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি লাভ করেন। যামিনী রায়ই সর্বপ্রথম চারুশিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মাননা, ‘ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার’ পান ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৬ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি দেয়। বিশ্বনন্দিত এই শিল্পীর জন্মস্থান বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যামিনী রায় কলেজ স্থাপিত হয়। ভারতীয় আধুনিক শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় তার নামেই নামাঙ্কিত করা হয়েছে কলেজটি। ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল যামিনী রায় পরলোকগমন করেন।
বাঙালির বাঙালিত্ব তুলে ধরতে মাছ-মিষ্টি-দই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি রয়েছে যামিনী রায়ের নাম। তার পটচিত্রে উঠে এসেছে ষোল আনা বাঙালিয়ানা। যামিনী রায় ছিলেন আর দশজনের চেয়ে আলাদা, কারণ তিনি তার পটুয়াশৈলীর কারণে নিজের বিশেষত্ব অটুট রেখেছেন। শোনা যায়, প্রতি বছর দূর্গাপূজোয় কোনো না কোনো মণ্ডপের নকশা তৈরি করা হয় যামিনী রায়ের স্টাইল অনুসরণ করে। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে কলকাতার ঘরে ঘরে স্থান পেতো যামিনী রায়ের শিল্পকর্ম। তার ছবি ঘরে থাকা মানে বলা হতো, “এই বাড়ির লোকের রুচি আছে বটে”!