আরাধানা চলচ্চিত্রের কোরা কাগাজ হে মান মেরা গানটি শুরু হবার আগে এহে…আহা… বলে যে আলাপ ছিল, তার কথা কি কেউ ভুলতে পারে? এখনো ওরকম সুর করে কেউ গান শুরু করলে সবার মনে একজনের নামই আসে– কিশোর কুমার, সবার কিশোর দা। বাংলা এবং হিন্দি- দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে চলেছেন তিনি। মৃত্যুও তাকে থামাতে পারেনি। আজও তার গান সমান জনপ্রিয়। ছোট থেকে বড় সবাই তার গানে মুগ্ধ। কিছু যেন একটা ছিল তার কণ্ঠে, যা সকল শ্রোতাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। সবাইকে বাধ্য করে তার গান শুনতে।
কী কোমল, মিষ্টি-মধুর ছিল তার কণ্ঠ, অথচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গায়ক ছিলেন না তিনি। প্রকৃতির উপহার হিসেবে গলায় সুর নিয়েই যেন জন্মেছিলেন। জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময় বাদ দিলে তার পুরো জীবনটাই সাফল্যে ভরপুর। একজন সফল অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিল কমেডি ধাঁচের। লোক হাসানোয় তার অন্ত ছিল না- সেটি পর্দার ভিতরে হোক বা বাইরে। বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, তার মতো কেউ নেই, কিশোর কুমার শুধু একজনই হতে পারে।
১৯২৯ সালে আগস্টের ৪ তারিখে ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর খান্ডওয়ার এক ছোট গলির ছোট্ট বাড়িতে জন্ম কিশোর কুমারের। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা আইনজীবী। বড় ভাই ভারতের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম দিকপাল অশোক কুমার। বলিউডের সবাই তাকে দাদামণি বলে ডাকতো। বড় ভাই আর কিশোর কুমারের মাঝে বয়সের পার্থক্য ১৮ বছর।
কিশোরের আসল নাম ছিল আভাস গাঙ্গুলি। ছোটবেলা থেকেই অন্যকে নকল করে দেখানোর শখ ছিল। সবার নকল করে বেড়াতেন তিনি। আর শখ ছিল ইওডেলিংয়ের, যেখানে বিভিন্ন পিচে সুর করে গাইতে হয়। ভারতে কিশোর কুমারই প্রথম ইওডেলিং আনেন।
ছোট বেলায় নাকি তার গানের গলা ভাল ছিল না একদম। অশোক কুমার পরে বিভিন্ন জায়গায় বলেছিলেন, একবার কিশোর কুমার পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত পাওয়ার পর তিন-চার দিন নাকি তিনি শুধু কেঁদেছেন। সেই কান্নার পর তার গলায় কী এক পরিবর্তন আসলো, গলায় সুর চলে আসলো, আওয়াজ পরিবর্তন হয়ে গেল। কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেই কয়েক দিনের কান্না অনেক যুগের কোটি মানুষের মনের খোরাক হয়ে চলে আসছে।
১৯৪৯ সালে প্রথম জিদ্দি চলচ্চিত্রে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দের জন্য গান গেয়ে চলচ্চিত্র জগতে পদচারণা শুরু করেন। এরপর ১৯৫১ সালে আন্দোলন চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের পর থেকে নউকরি, নিউ দিল্লী, আশা, চালতি কা নাম গাড়ি, হাফ টিকিট, পারোসান, ঝুমরু ইত্যাদি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই গান গেয়েছেন শুধু নিজের জন্য। ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত তিনি হয় নিজের জন্য, নাহয় দেব আনন্দের জন্য গেয়েছেন। অন্য কোনো অভিনেতার জন্য নয়।
তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে চালতি কা নাম গাড়ি, হাফ টিকিট,পারোসান– এখনো বিখ্যাত। গানগুলোর সবই প্রায় বিখ্যাত। গানগুলোর মধ্যে তার হাস্যরসাত্মক কাণ্ডগুলো যে কাউকেই অভিভূত করবে। এ সময় অভিনয় করলেও তার চলচ্চিত্রগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সলীল চৌধুরী, এস ডি বর্মণ এর মতো বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকরা। এ সময়ে তার বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে ছিল- ছোটা সা ঘার হোগা বাদাল কি ছাও মে (নউকরি), ইনা মিনা ডিকা (আশা), নাখরে ওয়ালি (নিউ দিল্লী), পাঁচ রুপিয়া বারা আনা, এক লারকি ভিগি ভাগি সি (চালতি কা নাম গাড়ি), চিল চিল চিল্লাকে (হাফ টিকিট), এক চাতুর নর, মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে (পারোসান), মেরি মেহবুব কেয়ামাত হোগি (মি. এক্স), দুখি মান মেরে (ফানটুস) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৫ সালের পর ধীরে ধীরে নায়ক হিসেবে দর্শকরা আর তাকে গ্রহণ করছিল না। এতে তিনি অনেক বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কোনোভাবেই তিনি এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার ততদিনে অন্য একটি সমস্যা দেখা দেয়। ইনকাম ট্যাক্স সমস্যা। সেখানে টাকা দেবার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় স্টেজ শো করা শুরু করলেন। দর্শকদের জন্য গান গাইতে থাকলেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রে যেহেতু তিনি নিজের এবং দেব আনন্দের জন্য ছাড়া অন্য কোনো নায়কের জন্য গান গাননি, তাই সেখানেও কাজ কমে যাচ্ছিল। এমন সময় শচীন দেব বর্মণ তাকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। নায়ক ছিলেন তখনকার সদ্য ইন্ডাস্ট্রিতে আসা রাজেশ খান্না। চলচ্চিত্রটির প্রত্যেকটি গান দর্শকরা পছন্দ করলো। কিশোর কুমার হয়ে গেলেন সুপার হিট।
এরপর থেকে বলিউডের সবাই কিশোর কুমারকে দিয়ে তাদের গান গাওয়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। এর আগে চলচ্চিত্রগুলোর সিংহভাগ গান মোহাম্মদ রফি গাইতেন। রাতারাতি সেখানে ভাগ বসালেন কিশোর কুমার। এক সময় তো এমন বিতর্ক শুরু হলো যে, কে ভাল গায়ক? রফি নাকি কিশোর? ফিল্মিস্তান নামক এক ম্যাগাজিন ছিল, যেখানে পাঠকরা এ নিয়ে লিখিত বিতর্ক করা শুরু করে দিল। এরকম দুই তিন সংখ্যা চলার পর কিশোর কুমার সেখানে একটি চিঠি লিখেন এবং তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাকে রফি সাহেবের সাথে যেন তুলনা না করা হয়। মোহাম্মদ রফি অনেক বড় শিল্পী। তার যে সঙ্গীত শিক্ষা, কিশোর কুমারের সেটি নেই। তিনি যেসব গান গেয়েছেন সেগুলো কি কিশোর কুমার কখনও গাইতে পারবেন?
কিশোর কুমার বরাবরই স্বীকার করে এসেছেন, তিনি সঙ্গীত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। তিনি মন থেকে গান। তার গাইতে ভাল লাগে। এরপর কিশোর কুমার জীবিত কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, অমিতাভের ছবি মানেই সেখানে কিশোর কুমারের নাম থাকবে। এর অন্যথা যেন হতেই পারে না। এসময় এস ডি বর্মণের সুপুত্র রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় গান গাওয়া শুরু করেন কিশোর কুমার। এখানেও সফল হলেন। একের পর এক দর্শক প্রিয় গান দিয়ে যাচ্ছিল এ জুটি। যেমন- হামে তুমসে পেয়ার কিতনা, হামে অর জিনে কি, দেখা এক খাওয়াব, সাগার কিনারে, চেহরা হে ইয়া, ইয়ে দোস্তি, রিম ঝিম ঘিরে সাওয়ান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, কিশোর কুমার যখন ডুয়েট গান গাইতেন, দর্শকদের পুরো মনোযোগ থাকতো তার গানের দিকে। এমনকি একই গান যখন দুজন শিল্পী গাইতেন, তখন কিশোর কুমার যেই ভার্সন গাইতেন, সেটাই দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেতো। যেমন- তুম বিন জাহু কাহা তে মোহাম্মদ রফির সাথে, ইউহি গাতে রাহ তে জনপ্রিয়তা পায় কিশোর কুমারের গাওয়া গান।
তিনি শুধু যে হিন্দি গান গেয়েছেন, তা কিন্তু নয়। বাংলা গানও গেয়েছেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্য গেয়েছেন তিনি অনেক গান।আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চির দিনের সাথী, আশা ছিল ভালবাসা ছিল, যদি হই চোর কাঁটা, এই তো জীবন, নারীর চরিত্র বেজায় জটিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি। তার চারুলতাতে আমি চিনিগো চিনি তোমারে গানটি গেয়েছিলেন। আবার তার ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রেও গান করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের মতে, কিশোর কুমারের গানের গলা চলচ্চিত্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোতাবেক দৃশ্যে মানিয়ে যায়।
জীবনের শেষদিকে লতা মঙ্গেশকরের কাছে একটি সাক্ষাৎকার দিতে তিনি রাজি হন। লতা মঙ্গেশকরের মতো কিংবদন্তী হয়তো কখনোই কারো সাক্ষাতকার নেননি। সেটিই ছিল প্রথম এবং শেষ। সেখানে কিশোর কুমার বলেন, তিনি কুন্দল লাল সায়গালকে তার গুরু মানেন। প্রথমদিকে যখন তিনি গান শুরু করেন, তখন তার গায়কীতে কে এল সায়গলের ভাব চলে আসতো। পরে এস ডি বর্মণের পরামর্শে তিনি সেই প্রভাব থেকে বের হয়ে নিজের গায়কী খুঁজে নেন।
জীবনের প্রথম দিকে অনেক ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছিলো তাকে। যদিও তার বড় ভাই অশোক কুমার ততদিনে বিখ্যাত অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন, তবুও তার পথ সোজা ছিল না। অনেক নির্দেশক, প্রযোজক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে কখনো পিছিয়ে যাননি। এমনও সময় এসেছিল, তিনি সঙ্গীতের কোনো একটি দলের মধ্যে কোরাস গান করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি বেশ কয়েকবার আঘাত পেয়েছেন। প্রথম প্রথম যারা তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল, তিনি তাদের কখনো ভুলতেন না। এমন একটি ঘটনা বলেছেন বিখ্যাত গীতিকার এবং কবি জাভেদ আখতার। একবার কিশোর কুমারের কাছে এক প্রযোজক আসে তাকে সাইন করানোর জন্য। কিশোর কুমার তাকে বলেন, তিনি সাইন করবেন কিন্তু বাসায় না। গঙ্গার ধারে দুটি নৌকা একসাথে পাশাপাশি থাকবে। সেখানে তারা দুজন ধুতি-কুর্তা পরে যাবেন। কপালে লাল ফোঁটা আর এবং সেই ফোঁটার উপর একটি চাল বসানো থাকবে। এভাবে সেই নৌকার উপর দাঁড়িয়ে তিনি কন্ট্রাক্ট সাইন করবেন। কিশোর কুমার যদি কারোর সাথে কাজ করতে না চান, তাহলে এমন অভিনব উপায়ে তাদেরকে মানা করে দিতেন।
১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান এই মহান শিল্পী। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি গান রেকর্ড করেছিলেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার গান এখনো রয়ে গেছে, তার সুরেলা কণ্ঠ এখনও রয়ে গেছে। নতুন কোনো সঙ্গীত পরিচালক যখন কোনো গানে সুর দেন, সুর দেওয়ার পর এখনও অনেকে আফসোস করে বলেন, যদি তার সেই গানটি কিশোর কুমার গাইতেন! কিশোর কুমার বেঁচে থাকবেন আজীবন সবার মনে, শুধু তার গাওয়া গানগুলো দিয়ে।
ফিচার ইমেজ: thebeeterindia.com