লে কোব্যুজিয়ে: আধুনিক স্থাপত্যের এক কিংবদন্তি

কালো মোটা ফ্রেমের গোল চশমা, পরিপাটি স্যুট, বো টাই- এককথায় একটি ট্রেডমার্ক। পুরো দুনিয়ার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের নেপথ্য অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি। শার্লে এদ্যুয়া জেনেরে বা শ্যাফট এডুয়ার্ড জেনেরে, যিনি লে কোব্যুজিয়ে নামেই বিশ্বময় পরিচিত, একজন সুইস-ফরাসি স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবীদ, নকশাকার ও চিত্রশিল্পী। তবে তার আসল সুখ্যাতি আজকের দিনের আধুনিক স্থাপত্যের ইন্টারন্যাশনাল স্টাইলের অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে।

লে কোব্যুজিয়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৬ অক্টোবর ফরাসি-সুইস সীমান্তবর্তী লা শঁ দে ফঁ-তে। বাবা এদ্যুয়া জেনেরের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। পারিবারিকভাবে তারা ঘড়ি উৎপাদন ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। মা মেরি শার্লো এমিলি জেনেরে ছিলের শখের পিয়ানোবাদক ও সঙ্গীতের শিক্ষিকা।

১৩ বছর বয়সে তিনি শহরের স্কুল অব অ্যাপ্লাইড আর্ট-এ ভর্তি হন। পারিবারিক প্রথার সাথে মিল রেখে সেখানে তিনি ঘড়ি খোদাই আর এনামেলিংয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। তবে এর চেয়ে আরেকটি জিনিস তাকে বেশি আকৃষ্ট করে- ড্রয়িং। পরিচয় হয় লি’প্ল্যাটনিয়ের সাথে, যাকে তিনি তার ‘মাস্টার’ বলে উল্লেখ করেন। তার কাছে তিনি আর্ট হিস্ট্রি, ড্রয়িং প্রভৃতি শিখতে থাকেন। লে কোব্যুজিয়ের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং অঙ্কনে আশেপাশের প্রকৃতিকে জ্যামিতিক প্যাটার্নের মাধ্যমে প্রকাশের প্রবণতা লক্ষ্য করে লি’প্ল্যাটনিয়ে তাকে স্থাপত্য নিয়ে পড়তে বলেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি শুরু করেন স্থাপত্য নিয়ে যাত্রা, যার বাকিটা কেবলই ইতিহাস।

কুড়িতে পা রাখার আগেই তিনি তার শিক্ষক লুই ফেলের বাড়ির নকশা করেন। এটি আহামরি কিছু ছিল না। আমাদের চেনা-জানা লে কোব্যুজিয়েকে হয়তো সেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে বাড়িটির অলঙ্করণে তিনি কিছু সাধারণ জ্যামিতিক প্যাটার্নের মাধ্যমে পাইন গাছের নকশা ফুটিয়ে তোলেন, যার গভীরে লুকিয়ে আছে এক দর্শন, সোজা ভাষায় যাকে বলে সিমপ্লিসিটি!

কিন্তু এ শহরে বেশি দিন তার মন টেকেনি। কারণ তিনি করতে চাইছিলেন অসাধারণ কিছু। বাধাধরা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায়ও তিনি বেশি দূর যাননি। তবে কোথা থেকে তিনি শিখেছিলেন, কী তাকে বানিয়েছিল আজকের লে কোব্যুজিয়ে?

লে কোব্যুজিয়ে; Image Courtesy: ullstein bild

পরিবারের অমতে উনিশ বছর বয়সে তিনি বেরিয়ে পড়েন ইতালির উদ্দেশ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বদলে তিনি ঠিক করেন নিজেই শিখবেন। তার নিজ চোখ দিয়ে আবিষ্কার করবেন স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্মগুলো। নিজ হাতে অনবরত অঙ্কন করতে থাকেন রোমান, রেনেসাঁর সব বিখ্যাত স্থাপনা। তার চোখেই পর্যবেক্ষণ করেন প্রতিটি খুঁটিনাটি, পরিমাপ করেন নিখুঁতভাবে। ঘুরে দেখেন তুরস্ক, গ্রিস, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া। অ্যাক্রপলিসের মতো ইতিহাসখ্যাত স্থাপনাকে তিনি চোখের দেখাতেই আত্মস্থ করে ফেলেন। একে একে যান ভিয়েনা, মিউনিখ, পম্পেই ও প্যারিস শহরে। লক্ষ্য করেন সেখানকার বুর্জ্যোয়া ডেকোরেটিভ আর্ট। প্রায় ৮০টি স্কেচ বুকে তিনি তার পুরো যাত্রা অঙ্কন করে রাখেন। ১৯০৯ এর দিকে প্যারিসে তার কাজ করার সুযোগ হয় অগাস্তা পিয়ের‍্যের সাথে, যাকে বলা হয় আরসিসি বা রিইনফোর্সড কনক্রিট কন্সট্রাকশনের অগ্রদূত। ১৯১০-১১ সালে বার্লিনে তিনি সঙ্গ পান আরেক স্থপতি পিটার বেরেনের। 

১৯১২ সালে আবার তিনি তার নিজ শহরে ফিরে যান। শুরু করেন চর্চা। এর মধ্যে একটি মজার ঘটনা ঘটে যায়। লে কোব্যুজিয়ের বড় ভাই আলবার্ট জেনেরে ছিলেন দক্ষ ভায়োলিন বাদক। পরিবারের কাছে আলবার্ট ছিলেন আদর্শ সন্তানের মতোই। অন্যদিকে শার্লে জেনেরে অর্থাৎ লে কোব্যুজিয়ে ছিলেন একজন অমনোযোগী, ঘরপালানো সন্তান। বিশেষত তার মা মেরী জেনেরের কাছে। তাই লে কোব্যুজিয়ে এমন কিছু করতে চাইছিলেন যা মেরী জেনেরেকে অবাক করে দিতে পারে। তিনি নকশা করেন লা মেইজঁ ব্লশ বা দ্য হোয়াইট ভিলা । এই ঘরের কেন্দ্রে ছিল একটি মিউজিক রুম, যা তিনি মাকে উৎসর্গ করে করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই বাড়িটি এতই চমৎকার ও সুদৃশ্য ছিল যে এটি নির্মাণ করতে গিয়ে তার পরিবার পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যায়। শেষমেশ তারা বাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

তিনি নিজ শহরে বেশি সুবিধা করতে পারেননি। ৩০ বছর বয়সে আবার ফেরত যান ইউরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্যারিসে। প্যারিস তখন জার্মান হেভি মর্টারের আঘাতে পর্যুদস্ত। চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তার ভাগ্য ততদিনেও ফেরেনি। এরই মধ্যে সাক্ষাৎ হয় চিত্রকর অ্যামেদি ওজোফঁ-এর সাথে। তার হাত ধরে পরিচয় হয় মডার্ন পেইন্টিংয়ের সাথে। এর প্রভাব বাকিটা সময় জুড়ে ছিল তাঁর স্থাপত্য ও জীবনে।

annibal simla
লে কোব্যুজিয়ের পেইন্টিং; Image Courtesy: Pinterest

এই সময়ে এভন্ট গার্দ নামে ফরাসি শিল্পীদের সংঘের সাথে তার চলাচল শুরু হয়। তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় লেসপ্রি ন্যুভো (দ্য নিউ স্পিরিট) নামক শিল্পকলার ম্যাগাজিন। শিল্পজগতে বেশ খ্যাতি কুড়োতে সক্ষম হয় লেসপ্রি ন্যুভো। তখনকার দিনের শিল্পকর্মে কিউবিজম ধারার বদলে তারা প্রবর্তন করে নতুন ধারা পিউরিজম। ছদ্মনামে এই ম্যাগাজিনে স্থাপত্যকলা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। জন্ম হয় এক নতুন চরিত্রের- লে কোব্যুজিয়ে। তার এই নামের পেছনে ছিল নিজেকে নতুন করে গড়ার আত্মবিশ্বাস।

প্যারিসের শিল্পী সমাজের প্রথা অনুসরণ করে তিনি এই ছদ্মনাম ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় একে একে প্রকাশিত হয় চল্লিশটির মতো বই, শতাধিক প্রবন্ধ।

আধুনিক স্থাপত্যে লেসপ্রি ন্যুভোর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। এই ম্যাগাজিনেই তিনি প্রাচীন স্থাপত্যের নন-স্ট্রাকচারাল ডেকোরেশনের জায়গায় নিয়ে আসেন তার নিজস্ব স্টাইল ফাংশনালিজম। ১৯২৩ সালে লেসপ্রি ন্যুভোয় প্রকাশিত লেখাগুলোর সংকলন বের করেন ‘ভের উনি আশিতেকচ” (টুয়ার্ডস আর্কিটেকচার)‘ গ্রন্থে। এই বইয়ে তিনি আধুনিক ভবনকে তুলনা করেন জীবন্ত মেশিন হিসেবে।

যুক্ত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব মডার্ন আর্কিটেক্টের প্রতিষ্ঠায়, যারা এথেন্স চার্টার নামে একটি ম্যানিফেস্টো তৈরি করে। গত শতাব্দীর ‘৫০-‘৬০ এর দশকে নগর পরিকল্পনায় বেশ প্রভাব বিস্তার করে এটি।

পুরো কুঁড়ির দশক জুড়ে তিনি মেইজঁ লা রশ, মেইজঁ গিয়েট, মেইজঁ কুক, মেইজঁ প্লেনিক্সের মতো ম্যানশন, ভিলাগুলো তৈরি করেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ছিল ভিলা সাভোয়ে।

ফ্রান্সের পোয়সে অবস্থিত এই স্থাপনাকে বলা হয় আধুনিক স্থাপত্যের সবচে’ আইকনিক, আদর্শ উদাহরণ। একইসাথে এটি তার সবচেয়ে প্রভাবশালী নির্মাণ। ক্লাসিক্যাল ওয়াল আর্কিটেকচারের জায়গায় এখানে স্থান পায় কলাম আর্কিটেকচার। এর প্রধান বৈশিষ্ট হলো স্থপতি তার ইচ্ছামতো ফ্লোরপ্ল্যান করতে পারেন কোনো রকমের সাপোর্টিং ওয়ালের কথা চিন্তা না করেই। খোলামেলা জানালা যোগায় পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। পাশাপাশি তিনি এতে যোগ করেন ছাদ-বাগান। এছাড়াও এ সময়ে তিনি কিছু এলসি (তার নামের আদ্যক্ষর) ক্যাটাগরির ফার্নিচার ডিজাইন করেন যেগুলো আজকের দিনে মডার্ন ফার্নিচারেরও আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। লে কোব্যুজিয়ের জীবনে গাড়ির নকশা করারও অভিজ্ঞতা আছে।

ইউনাইট ডি’হ্যাবিটেশন ছিল তার প্রথম বৃহৎ প্রকল্প। ফ্রান্সের মার্সেইয়ে অবস্থিত এই স্থাপনাকে ‘ভার্টিকাল গার্ডেন সিটি’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। এটি পাবলিক হাউজিং এ বিশ্বব্যাপী নজির স্থাপনকারী।

নটর ডেম ডিউ’অ চার্চ ছিল তার প্রথাবিরোধী একটি সৃষ্টি। প্রচলিত গোথিক, রোমান বা মধ্যযুগীয় চার্চের জায়গায় তিনি যোগ করেন মডার্নিজমকে। ওয়ালেস হ্যারিসন, অস্কার নেইমেয়ারের সাথে মিলে নকশা করেন জাতিসংঘের সদরদপ্তর ভবনের।

নগর পরিকল্পনার অনেকগুলো পরিকল্পনা তিনি করলেও সফল হন ভারতে। ভারতের পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা রাজ্যের প্রশাসনিক রাজধানী চন্ডিগড়। এই শহরের মাস্টারপ্ল্যান নির্মিত হয় তার হাতে। করেন চন্ডিগড়ের রাজ্য বিচারসভা। ভারতীয় নকশাদার ডিজাইন এবং নটর ডেম ডিউ’অ চার্চের মতো বাঁকানো ছাদের সঙ্গে ভারতীয় পতাকার রঙে রঙিন প্রবেশদার। সব মিলিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় তার ট্রেডমার্ক একটি প্রকল্প। এছাড়াও চন্ডিগড়ের সুদৃশ্য আইনসভাটিও তিনিই ডিজাইন করেন।

Notre Dame Du Haut
নটর ডেম ডিউ’অ চার্চের ইন্টেরিয়র; Image Courtesy: Lecina Fernández

বর্তমানকালের অনেক বড় বড় স্থপতি তার কাজ দেখেই ভালোবেসেছিলেন স্থাপত্যকে। আধুনিক নির্মাণসামগ্রী, প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহার, উনবিংশ শতাব্দীর ঘিঞ্জি শহরে বাস করা আলো, মুক্তবাতাস থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষের উপভোগ্য আবাসন নিশ্চিত করতে তার প্রচেষ্টা ছিল সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ী।

palace of justice chandigarh
প্যালেস অব জাস্টিস, চন্ডীগড়; Image Courtesy: Studydekho

১৯৬৫ সালের ২৭ আগস্ট ভূমধ্যসাগরে স্নানরত অবস্থায় মৃত্যু হয় এই প্রভাবশালী স্থপতির। ছয় দশকের পেশাদারী জীবনে তিনি আধুনিক শহর নির্মাণে ছুটে গিয়েছেন ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ভারতে। ডজনখানেক দেশে নকশা করেছেন ৭৫টির মতো ভবনের, আর যুক্ত ছিলেন চারশ’ প্রকল্পের সাথে। যন্ত্র-যুগের আধুনিকায়নের কাব্যিক রূপ যুক্ত করেছিলেন স্থাপত্যে। আজকের দিনের আধুনিক শহরগুলোর দিকে তাকালে হয়তো তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজেই। আধুনিক স্থাপত্যে তার নাম থাকবে শ্রেষ্ঠাংশে।

Related Articles

Exit mobile version