হলরুমে এক সারিতে ১০ জন দাবাড়ুকে দেখা যাচ্ছে। চিন্তামগ্ন দাবাড়ুরা তাদের সামনে সাজানো বোর্ডের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। গম্ভীর ভঙ্গিতে একেকজন ঘুঁটি নিয়ে চাল দিচ্ছেন। অনেকের চেহারায় ভুল চাল দেওয়ার হতাশা বিরাজমান। অনেকে ইতোমধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেছেন মগজ ঘামানো এই মহারণের মঞ্চে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ১০ জনই এক সময়ে খেলছেন মাত্র একজনের বিপক্ষে। দাবা সংক্রান্ত সিনেমা, নাটক কিংবা বইয়ের মাধ্যমে এই দৃশ্যটি আমরা অনেকেই বারবার চোখের সামনে দেখেছি। প্রত্যেক প্রতিভাবান দাবাড়ুকে একই সময়ে একাধিক খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে দেখা যায়।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতে পারেন, এ আর এমন কী! আপনাদের এই অভিব্যক্তি হয়তো মেনে নিতাম, কিন্তু সেদিনের খেলার ধরন ছিল অনেকটা ভিন্ন। কারণ, এই দশজনের বিপক্ষে যিনি খেলছেন, তিনি হলঘরের মাঝের এক চেয়ারে আসীন আছেন। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড যে, তিনি মুখ করে আছেন খেলোয়াড়দের বিপরীত দিকের দেয়ালে। একবারের জন্যও তিনি মাথা ঘুরে প্রতিপক্ষের দাবার বোর্ড পরখ করার কথা ভাবছেন না। চোখ বন্ধ করে রূপকথার রহস্যময় জাদুকরের ন্যায় তিনি মুখে মুখে চাল বলছেন এবং বাকিরা খেলে যাচ্ছেন তার বিপক্ষে।
দাবার মোট ঘর ৬৪ এবং দুপক্ষ মিলিয়ে মোট ঘুঁটি ৩২। এই খেলার সময় সেই খেলোয়াড়কে একই সাথে ৩২০টি ঘুঁটির অবস্থান মনে রাখতে হচ্ছে। এরপর মনের মধ্যে হিসাব করে নতুন চাল বলতে হচ্ছে। যেখানে দাবা খেলায় মাত্র ৩ চালের পর সম্ভাব্য চালের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৮৮ বিলিয়নের মতো, সেখানে তিনি এই অসাধ্য সাধন করে যাচ্ছেন অনায়াসে। শুধু খেলায় অংশ নিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং সবাইকে নাস্তানাবুদ করে বিজয়ীর বেশে সেদিন আসন থেকে উঠেন এই প্রতিভাবান দাবাড়ু। খেলার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। দাবার ৬৪ ঘরের মোৎসার্ট নামে অভিহিত এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের নাম ‘ম্যাগনাস কার্লসেন’।
কে এই ম্যাগনাস?
২০১৩ সালের দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এক নতুন বিজয়ীর আবির্ভাব ঘটে। সেবারের প্রতিযোগীতায় সেরার মুকুট এক নরওয়েজিয়ান তরুণ দাবাড়ুর মাথায় উঠেছিল। আর সেই দাবাড়ু ছিলেন ম্যাগনাস কার্লসেন। দাবার অন্যান্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের থেকে ম্যাগনাস কার্লসেন কিছুটা আলাদা হয়ে উঠেছেন বেশ কম বয়সে পরিণত দাবা খেলা উপহার দেওয়ার মাধ্যমে। একের পর এক প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে এই তারকা দাবাড়ু মাত্র ১৩ বছর বয়সে দাবার সম্মানজনক ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’ খেতাব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দাবার জগতের ইতিহাস সেরা রেটিংয়ের অধিকারী ম্যাগনাসের জন্ম ১৯৯০ সালের ৩০ নভেম্বর নরওয়ের টন্সবার্গ শহরের কার্লসেন পরিবারে। তার পিতা হেনরিক আলবার্ট কার্লসেন ছিলেন একজন আইটি উপদেষ্টা। তার মা সিগরান ওয়েন ছিলেন একজন রসায়ন প্রযুক্তিবিদ।
ছোট থেকে ধাঁধা এবং লেগো সেট নিয়ে খেলার সময় নিজের বুদ্ধির চমক দেখিয়েছিলেন ম্যাগনাস। তার পরিবারসূত্রে জানা যায়, মাত্র ২ বছর বয়সে ৫০ টুকরো সম্বলিত জিগ স পাজল (Jigsaw puzzle) সমাধান করে ফেলতেন তিনি। চার বছর বয়সে বড়দের মতো লেগো সেট দিয়ে জটিল গড়নের খেলনা বানাতে শিখে যান তিনি, যা অন্যান্য বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৪ বছর বয়সে দেখা যায়। ম্যাগনাসের পিতা ছেলের প্রতিভার চমক দেখে চিন্তা করলেন তাকে দাবা খেলা শেখাবেন। তিনি নিজেও টুকটাক দাবা খেলতেন। কিন্তু ম্যাগনাস দাবা একদমই পছন্দ করতেন না। বোর্ড আর ঘুঁটি ঘরময় ছুঁড়ে ফেলে একাকার করে ফেলতেন। বেচারা পিতা পড়লেন মহা মুশকিলে। ম্যাগনাস ছাড়াও তার আরও ৩ কন্যা সন্তান ছিল। তিনি তাদেরকেও দাবা শিখিয়েছিলেন। এবার এক বুদ্ধি আঁটলেন তিনি। ম্যাগনাসকে তার বড় বোনদের হারানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। প্রতিযোগিতার গন্ধ পেয়ে ম্যাগনাসের ভোল পালটে গেলো। সুবোধ বালকের ন্যায় তিনি মাত্র ৫ বছর বয়সে দাবা খেলার কায়দা রপ্ত করে ফেলেন।
৬৪ ঘরে পথচলা শুরু
দাবা খেলা রপ্ত করার পর ম্যাগনাস সব খেলনা ফেলে দাবার ঘুঁটি বোর্ড নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতেন। সাদা-কালো আয়তক্ষেত্রেগুলো তার কোমল মনে গভীর দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছিল। এক কথায় দাবার প্রেমে পড়ে গেলেন কিশোর ম্যাগনাস। পিতা হেনরিক সন্তানের দাবাপ্রীতিতে খুশি হলেন। তিনি তাকে খেলার বিভিন্ন পন্থার সাথে পরিচিতি করিয়ে দেন। ম্যাগনাস সেই ৫ বছর সময় থেকেই দাবায় বাজিমাত করতে থাকেন। পরিবার-পরিজনের বাইরে পাড়ার বড়দের সাথে দাবা খেলে জিততে থাকেন এই কিশোর। ছেলের প্রতিভা দেখে পিতা তাকে একজন পরিপূর্ণ দাবাড়ু হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন।
ম্যাগনাসের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। মাত্র ৫ বছর বয়সে পৃথিবীর সকল দেশের নাম, রাজধানী, পতাকা, জনসংখ্যা এবং আয়তন মুখস্ত করেছিলেন। হেনরিক কার্লসেন ছেলের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেন দাবার বিভিন্ন চাল এবং কৌশল আয়ত্ত করতে। খেলার পাশাপাশি দাবার বিখ্যাত বই ‘ফাইন্ড দ্য প্ল্যান’ এবং ‘দ্য কমপ্লিট ড্রাগন’ পড়তে দেন ম্যাগনাসকে। উপস্থিত বুদ্ধি এবং একগাদা কৌশল মাথায় নিয়ে কার্লসেন হয়ে উঠলেন অপ্রতিরুদ্ধ। এর প্রমাণ মিললো ১৯৯৯ সালে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ছোট বিভাগের মঞ্চে। সেখানে ৮ বছর ৭ মাস বয়সে তিনি তার প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন।
এবার ম্যাগনাসের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন গ্র্যান্ড মাস্টার সিমেন আগদেস্তাইন। আরেক গ্র্যান্ড মাস্টার টরবিয়র্ন রিঙ্গডাল হানসেন-এর সম্মিলিত তালিমে কার্লসেন অল্প সময়ের মধ্যে নিজের খেলাকে পরিণত করতে সক্ষম হন। ২০০০ সালে তার রেটিং ছিল ৯০৪, যা বছর শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ১৯০৭ এ। সেবছর তিনি ২০০০ রেটিংধারী জুনিয়র চ্যাম্পিয়নের বিপক্ষে ৩ ১/২-৫ পয়েন্টে জয়লাভ করেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০টি অফিসিয়াল দাবা ম্যাচ খেলে ফেলেন। সেবছর অনূর্ধ্ব-১২ ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টে ৬ষ্ঠ এবং অনূর্ধ্ব-১২ বিশ্বকাপে ২য় স্থান অর্জন করেন তিনি।
মনে হতে পারে, ম্যাগনাস বুঝি সারাদিন দাবাই খেলতো। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তিনি ১০ বছর বয়সে ফুটবলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজেও টুকটাক ফ্রি-স্টাইল অনুশীলন করতে ভালোবাসতেন। তার পছন্দের ফুটবল ক্লাব হচ্ছে ইউরোপের সফলতম দল রিয়াল মাদ্রিদ। কয়েক বছর আগে তিনি রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখতে একটি চ্যারিটির অংশ হিসেবে পাড়ি জমিয়েছিলেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। সেখানে অধিনায়ক সার্জিও রামোসের সাথে ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন তিনি। তাছাড়া নিয়মিত ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের খবর নেন তিনি।
দাবার মোৎসার্ট
দাবা যদি সঙ্গীত হয়, তবে এর মোৎসার্ট হচ্ছেন ম্যাগনাস। এমন খেতাব পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, তাও আবার মাত্র ১৪ বছর বয়সে। ম্যাগনাস কার্লসেন এই খেতাব পেয়েছিলেন ২০০৪ সালের কোরাস টুর্নামেন্টে। সেবার সি গ্রুপে থাকা ম্যাগনাসের স্কোর ছিল ১০ ১/২-১৩। হেরেছেন মাত্র একটি ম্যাচ। টুর্নামেন্টে ম্যাগনাসের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে সিপকে আর্নস্টের বিপক্ষে খেলা ম্যচটি। নিজের ঘুঁটি স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে মাত্র ২৯ চালে ম্যাচ জিতে যান তিনি। এই ম্যাচের দর্শকরা কিশোর দাবাড়ুর খেলার ধরনে যেন শিল্পের ছোঁয়া খুঁজে পেলেন। তার ঘুঁটি চালানোর ধরন ছিল অনবদ্য। এই জয়ে ২০০৫ সালে বি গ্রুপের খেলায় আমন্ত্রণ পান তিনি। সেই সাথে লাভ করেন প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার নর্ম। উল্লেখ্য যে, পূর্ণাঙ্গ খেতাবের জন্য সাধারণত ৩টি নর্ম প্রয়োজন হয়। ও
য়াশিংটন পোস্টের পাতায় গ্র্যান্ড মাস্টার লুবোমির কাভালেক এই কিশোর দাবাড়ুকে নিয়ে বিশাল কলাম লিখে বসেন। সেখানে তিনি তাকে অভিহিত করেন ‘দাবার মোৎসার্ট’ হিসেবে। তবে এই উপাধি ম্যাগনাসের আগেও বহু প্রতিভাবান দাবাড়ুকে দেওয়া হয়েছিল। টুর্নামেন্টে ম্যাগনাস প্রায় ২৭০২ রেটিং অর্জন করেন। প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট তার অফিসিয়াল স্পন্সর হিসেবে নাম লেখায়।
সেবছর ১৭ মার্চ রেইচাভিকে অনুষ্ঠিত ব্লিটজ টুর্নামেন্টে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আনাতোলি কার্পোভকে হারিয়ে দিয়ে সারা ফেলে দেন তিনি। একই টুর্নামেন্টে তিনি মুখোমুখি হন সর্বকালের সেরা দাবাড়ু হিসেবে চিহ্নিত গ্যারি কাসপারভের। প্রথমবার কাসপারভকে ড্র করতে বাধ্য করেন তিনি। এই ম্যাচের মাধ্যমে তিনি যেন অগ্রিম জানান দেন নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। অবশ্য পরের ম্যাচে কাসপারভের কাছে হেরে তিনি বিদায় নেন। পরের মাসে দুবাই চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ৩য় এবং সর্বশেষ গ্র্যান্ড মাস্টার নর্ম অর্জন করেন। এর মাধ্যমে তিনি ১৩ বছর ৪ মাস ২৭ দিনে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’ খেতাব লাভ করেন।
তবে অন্যান্য তথ্যসূত্রে তাকে ৩য় বা ৫ম সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এরপরের গন্তব্য ছিল ফিদে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে তিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তবে লেভন আরোনিয়ানের কাছে হেরে প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেন।
নব্য গ্র্যান্ডমাস্টারের বিশ্বজয়
২০০৫ সালের দ্রামেন আন্তর্জাতিক দাবা উৎসবে ম্যাগনাস হারিয়ে দেন দাবার শীর্ষ দশম বাছাই অ্যালেক্সি শিরোভকে। জুনে তিনি মুখোমুখি হন দাবার কিংবদন্তি এবং তৎকালীন ২য় র্যাঙ্কে থাকা দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দের। ৪ গেমের সেই ম্যাচে তিনি র্যাপিড দাবা চ্যাম্পিয়ন আনন্দের কাছে হেরে যান ৩-১ ব্যবধানে। ২০০৬ সালের নরওয়ে দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে ম্যাগনাস কার্লসেন জ্বলে উঠেন ভিন্ন মাত্রায়। সেবার শুধু বার্গ অস্টেনস্টাডের নিকট হারেন তিনি। তবে সর্বমোট পয়েন্ট এবং প্লে-অফ অনুযায়ী জাতীয় শিরোপা হাতে উঠে তার।
২০০৭ সালে দাবার উইম্বলডন খ্যাত লিনারেস দাবা টুর্নামেন্টে ম্যাগনাস মুখোমুখি হন ভেসেলিন তোপালোভ, বিশ্বনাথন আনন্দ, পিটার ভিদলার, আলেকজান্ডার মরোইয়েভিচ এবং লেভন আরোনিয়ানের মতো বিশ্বখ্যাত দাবাড়ুদের। সেই টুর্নামেন্টে ২য় অবস্থানে থেকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। তিনি পরবর্তীতে সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ক্যাটাগরি ১৮ এবং ২০ পর্যায়ের দাবা টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
ম্যাগনাসের অর্জনের খাতায় নতুন সংযোজন হয় ২০০৯ সালের বিশ্ব ব্লিটজ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। যার ফলে তিনি লন্ডন দাবা ক্ল্যাসিকে শীর্ষ বাছাই হিসেবে চিহ্নিত হন। ২০১০ সালে ফিদে প্রকাশিত নতুন তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ দাবাড়ু হিসেবে লেখা হয় এক নতুন নাম- ‘ম্যাগনাস কার্লসেন’। শীর্ষে উঠা হলো, এবার বিশ্বজয়ের পালা- এই প্রত্যয় নিয়ে ২০১৩ সালের বিশ্বকাপে অংশ নেন তিনি। ভারতের চেন্নাইয়ের হায়াট রিজেন্সির মঞ্চে মুখোমুখি হন দাবার চ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ এবং ম্যাগনাস কার্লসেন।
আগের তুলনায় অনেক পরিণত ম্যাগনাস এবার যেন সবকিছু জিতে নেওয়ার জন্যই এসেছে। তুমোল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই ম্যাচে ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৯ম গেম জিতে নেন ম্যাগনাস। বাকিগুলো ড্র করেন। ৫ম গেমে বিশ্বনাথনের ছোট ভুলের সুযোগ নিয়ে দারুণভাবে জিতে যান ম্যাগনাস। শেষ ফল দাঁড়ায় ম্যাগনাস ৬ ১/২-৩ ১/২ বিশ্বনাথন। জিতে গেলেন তিনি। শৈশবের স্বপ্ন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ তার হাতে ধরা দিলো এবার। এর মাধ্যমে দাবার ১৬তম বিশ্বজয়ী হিসেবে নাম লেখা হয় ম্যাগনাসের।
পরবর্তীতে ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালের টুর্নামেন্টেও জয়ী হয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ধরে রাখেন ম্যাগনাস। এর মধ্যে ২০১৬ সালের চ্যাম্পিয়নশিপ একটু বিশেষত্ব রাখে। কারণ, সেবার তিনি হারিয়েছিলেন দাবার সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ড মাস্টারের রেকর্ডধারী সার্গে কারজাকিনকে।
খেলার ধরন
খেলার ধরন বিবেচনা করলে ম্যাগনাস কার্লসেনকে অনেকেই বিরক্তিকর হিসেবে আখ্যা দিবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তিনি তার খেলার শুরুর চাল নিয়ে তেমন কাজ করেন না। তবে বিশেষজ্ঞদের সুরে, তিনি একজন সম্পূর্ণ খেলোয়াড়। একই সাথে ঘুঁটির অবস্থান ধরে রেখে আবার অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে খেলতে পছন্দ করেন তিনি। প্রতিপক্ষের সামান্যতম ভুলকে দীর্ঘশ্বাসে রূপান্তর করার দিক দিয়ে তার জুড়ি নেই। নিজের লক্ষ্যমাত্রা হাসিলের জন্য একের পর এক ঘুঁটি বিসর্জন দিয়ে দিতে পারেন বলে অনেকেই তার খেলায় তাল হারিয়ে ফেলে। তবে খেলা যত এগুতে থাকে, তত স্পষ্ট হতে থাকে কার্লসেনের ধারালো কৌশলের আসল রহস্য। তবে ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে বলে হার ছাড়তে হয়।
২০১৬ সালে ৪২ তম দাবা অলিম্পিয়াডে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশের দাবা গ্র্যান্ড মাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব। বলাবাহুল্য, কার্লসেনের খেলার ধরনে তিনিও ভড়কে গিয়েছিলেন। দাবাড়ুরা সাধারণত e4 অথবা d4 চাল দিয়ে খেলা শুরু করেন। তবে কার্লসেন শুরু করেন e3 দিয়ে। এর আগে এমন চাল দেননি কার্লসেন, এমন কথাও শোনা গিয়েছিল সেদিন। শুরুতেই চমকে যাওয়া রাজীব তাই খেলায় ফিরতে পারেননি আর। মাত্র ৩৩ চালে বাজিমাত করে বোর্ড ছাড়েন ম্যাগনাস কার্লসেন। এই ম্যাচ নিয়ে গ্রান্ড মাস্টার রাজীবের মন্তব্য ছিল,
“ওর প্রথম চাল দেখেই অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আজ কী ভেবে ও এই চাল দিল!”
কাসপারভ বনাম কার্লসেন- কে সেরা?
প্রতিটি ক্রীড়াতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক চলে। এই বিতর্ক কখনো থেমে যায় না। এটি চিরন্তন একটি প্রথা হিসেবে পরিচিত। দাবার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ইতিহাসে বারবার একজনের নাম উঠে এসেছে। তিনি হচ্ছেন রুশ কিংবদন্তি গ্যারি কাসপারভ। কিন্তু ‘কার্লসেন এবং কাসপারভের মধ্যে কে সেরা?’ এই প্রশ্ন যেন নতুন করে শ্রেষ্ঠত্বের বিতর্কে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
কিন্তু এই প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর দেওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে, কার্লসেন যে হারে নিজের খেলার উন্নতিসাধন করে চলেছে, তা বিবেচনা করে অনেকেই তাকে এগিয়ে রাখতে চাইবেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০০৯ সালে কার্লসেনকে এক বছরের জন্য কোচিং করিয়েছিলেন কাসপারভ। দাবার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ফিদে রেটিং প্রাপ্ত খেলোয়াড় কার্লসেন (২৮৮২ রেটিং, ২০১৪ সাল) এবং দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন কাসপারভ। তার সেরা রেটিং ছিল ১৯৯৯ সালে অর্জিত ২৮৫২। তবে কাসপারভ ছিলেন ইতিহাসের প্রথম ২৮০০+ রেটিংধারী দাবাড়ু।
একটানা বেশিদিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন থাকার রেকর্ডে কার্লসেন থেকে এখনও এগিয়ে আছেন কাসপারভ। তিনি টানা ১১৮ মাস চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। টানা ৭ বছর ধরে চ্যাম্পিয়ন থাকা কার্লসেন তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন। সর্বকনিষ্ঠ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের দৌড়ে অবশ্য কার্লসেন থেকে কাসপারভ এগিয়ে আছেন ৫ মাস আগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। এই বিতর্ক নিয়ে ম্যাগনাস কার্লসেন বেশ বিনয়ের সাথে উত্তর দিয়েছেন–
“কাসপারভ টানা ২০ বছর দাবার শীর্ষস্থানে ছিলেন। তিনিই সর্বকালের সেরা দাবাড়ু। কিন্তু আমি মনে করি সময় এখন আমার হয়ে কথা বলছে। আমার বয়স এখনও ৩০ পূর্ণ হয়নি। আমাকে এই বয়সেই সর্বকালের সেরা গণ্য করতে যেতো, সেক্ষেত্রে আমাকে ১০ বছর বয়সেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে হতো।”
এখনও খেলছেন সমান তালে
ম্যাগনাস কার্লসেনকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, চটপটে এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং আপাতদৃষ্টিতে তার খেলায় তেমন কোনো খুঁত ধরা পড়েনি। ২০২০ সালে তিনি ৮২তম টাটা স্টিল টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে সার্গে তিভিয়াকোভের টানা ১১০ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। এই প্রবন্ধ রচনা পর্যন্ত তার সর্বশেষ পরাজয় ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই। এবছর ৩০ জানুয়ারি তিনি বাজি ধরার কোম্পানি ইউনিবেট-এর সাথে স্পন্সরশিপ চুক্তি করেছেন। ২০২১ পর্যন্ত ইউনিবেটের শুভেচ্ছা দূত থাকবেন তিনি।
দাবার বাইরেও সুদর্শন ম্যাগনাসের তারকাখ্যাতি রয়েছে। সিক্সটি মিনিটস-এর মতো টিভিশো তে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি লিভ টাইলারের সাথে ফ্যাশন শো-তেও অংশ নিয়েছিলেন। তালিকাভুক্ত হয়েছেন টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের কলামে। জনপ্রিয় টিভি ড্রামা দ্য সিম্পসনের একটি পর্বে তার কার্টুন সংস্করণের উপস্থিতি দেখা গেছে। এছাড়া বেশকিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে তার দাবার জীবনকে ভিত্তি করে।
এছাড়া তিনি ‘প্লে ম্যাগনাস এএস’ নামক একটি কোম্পানির মালিক। এখান থেকে দাবা খেলার বিশ্বমানের কয়েকটি অ্যাপ নির্মাণ করেছেন ম্যাগনাস। বয়স বিবেচনায় তার পেশাদারী জীবনের আরও বহু অধ্যায় রচিত হওয়া এখনও বাকি। তবে বিশ্ব দাবার সবকিছু অর্জন করে ফেলা এই দাবাড়ুর এখন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো লক্ষ্য নেই। এই কাজটি তিনি কীভাবে করবেন, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দাবাপ্রেমীরা।