১
‘জনপ্রিয়তা’ সাধারণ মানুষের কাছে খুবই আকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়। খুব কম মানুষই আছেন, যারা কিনা জনপ্রিয় হতে চান না। তবে বেশিরভাগ জনপ্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ বিষয় থাকে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সব জনপ্রিয় মানুষই কোনো না কোনো কারণে অন্য আরেকদল মানুষের কাছে খুব ঘৃণিত থাকে। সমসাময়িক দুই গ্রেট খেলোয়াড়ের দিকে তাকালে বিষয়টা কিছুটা বুঝতে পারবেন। ‘মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো’- গোটা পৃথিবী জুড়েই এই দুজনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও, তাদের হেটারেরও কমতি নেই। আমাদের দেশের সাকিব আল হাসান কিংবা তামিম ইকবালও এর উদাহরণ। দেশব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা থাকলেও কিছু মানুষ সবসময়েই এদের সমালোচনা করে যেতে থাকে।
খুব কম মানুষই জন-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে। খুব সম্ভবত মাশরাফি বিন মুর্তজা এই ঘরানার একজন মানুষ। গোটা বাংলাদেশে তিনি এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ বললেও হয়তো ভুল হবে না।
দলীয় যত খেলা আছে, তার মাঝে ক্রিকেটেই অধিনায়কের গুরুত্ব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। মাঠে থাকা অবস্থাতেই মুহূর্তের মাঝে অধিনায়ককে নানা রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বোলিং পরিবর্তন, ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা বুঝে ফিল্ডিং পরিবর্তন, অফ ফর্মে থাকা কোনো খেলোয়াড়কে সমর্থন দেওয়া, সব খেলোয়াড়ের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখা আর সাথে সাথে নিজের ফর্মের দিকে লক্ষ্য রাখা- কাজগুলো নিঃসন্দেহে কঠিন। মাঠের বাইরেও অধিনায়কের অনেক কাজ থাকে। দেখা গেল, অধিনায়ক নিজেই ফর্মের সাথে লড়াই করছেন, এমন অবস্থাতেই অন্য খেলোয়াড়ের ভুলত্রুটি নিয়েও তাকে কথা বলতে হয়।
এই কাজগুলো ঠিকভাবে করতে গেলে সবার কাছে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের ড্রেসিং রুমে সিনিয়র-জুনিয়র সবার কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষটি হলেন ‘কৌশিক’ নামের আড়ালের এই মাশরাফিই।
২
জন্ম তার নড়াইলে। এই অঞ্চলের খুব বিখ্যাত একজন মানুষ হচ্ছেন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। সেই নড়াইলেরই পথে ঘাটে ছড়িয়ে আছে এক দস্যি ছেলের অজস্র দুরন্তপনার সাক্ষ্য। খুব ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেটা প্রথাগত ক্রিকেট কিংবা ফুটবল নয়, সাঁতারে। চিত্রা নদীর সাথে তার সখ্যতা যেন নড়াইলের রূপকথার মতো। নদীর গতির বিপক্ষে নিজের গতি দিয়ে লড়াই করাই ছিল তার নেশা।
শেষ পর্যন্ত তিনি হলেন গতির রাজা। তবে সেটা পানিতে নয়, ক্রিকেটের বাইশ গজে। এলাকায় বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন মাশরাফি, একসময় হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান হিসেবেই বেশি সমাদৃত ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে সুযোগ পেলেন বিকেএসপির একটি ট্রেনিংয়ে। জীবনটা বদলে গেল বিকেএসপিতে থাকা অবস্থায় অ্যান্ডি রবার্টসের এক ক্যাম্পে। অ্যান্ডি রবার্টসের পরামর্শেই মাশরাফিকে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই টেস্ট অভিষেক হয়ে যায় মাশরাফির। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচে বাউন্সারে এক ব্যাটসম্যানের হেলমেট ভেঙে ফেলেছিলেন মাশরাফি। খেলার পরেই নাকি ওরা ঠাট্টা করে মাশরাফির সাথে তাদের একজন ব্যাটসম্যান বদলে রেখে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেই আমলে নিয়মিত ১৪৫ কি.মি. গতিতে বল করে যাওয়া একজন বোলারের জন্য এমন প্রস্তাব পাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকেই ৪ উইকেট নেন মাশরাফি। সময়টা তখন ২০০১ সাল। মাশরাফি সেই বিরল ক্রিকেটারদের মাঝে একজন, যাদের কিনা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলার আগেই টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। গত শতাব্দীর মাত্র ৩য় খেলোয়াড় হিসেবে এই কীর্তিটি ঘটান তিনি।
সেই বছরেই ওয়ানডে ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় এবং অভিষেকেই ২৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে তিনি জানান দেন যে, এক সুপারস্টার এর আগমন ঘটছে ক্রিকেট দুনিয়ায়।
৩
প্রথাগতভাবেই ভারত কিংবা বাংলাদেশে ফাস্ট বোলারের সংখ্যা কম। এর মধ্যে মাশরাফির আগমন মরুভূমির মাঝে এক চিলতে জলাধারের মতোই ছিল। ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল তার দুর্দান্ত। দুটো টেস্ট সিরিজের মাত্র ৪ টেস্টে মাশরাফির সংগ্রহ ছিল ৩১.১৬ গড়ে ১২টি উইকেট।
এরপরেই ২০০২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ মিস করেন তিনি ব্যাক ইনজুরির জন্য। তারপর আরেকটি ইনজুরির কারণে আট মাসের জন্য মাঠ থেকে বাইরে থাকেন। ইনজুরি থেকে ফিরে ২০০৩ বিশ্বকাপে মাশরাফি মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেন এবং দুটি উইকেট সংগ্রহ করেন।
২০০৩ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ড বাংলাদেশ সফরে আসে দুটো টেস্ট আর তিনটি ওয়ানডে খেলার জন্য। সেই সিরিজে মাশরাফি আবার ইনজুরিতে পড়েন এবং এবার তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হয় দীর্ঘ ১ বছরের জন্য! এই সিরিজে মাশরাফির সংগ্রহ ছিল ২১.২৫ গড়ে ৮ উইকেট।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ডাক পান মাশরাফি। প্রথম টেস্টেই রাহুল দ্রাবিড়কে আউট করেন এবং তার বলে সৌরভ গাঙ্গুলী আর শচীন টেন্ডুলকারের দুটো ক্যাচ মিস হয়। টেস্ট সিরিজটি বাংলাদেশ হেরে গেলেও ওয়ানডে সিরিজে একটি চমক দেখান মাশরাফি। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতকে ১৫ রানে হারায় বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে ম্যান অব দি ম্যাচ হন মাশরাফি। এটি ছিল বাংলাদেশের শততম ম্যাচ। দুই উইকেট, দুই ক্যাচ আর অপরাজিত ৩১ রানের একটি ইনিংস- পুরোদস্তুর অলরাউন্ডিং এক পারফর্মেন্স ছিল তার।
এভাবে ইনজুরি কাটিয়ে বারবার ফিরে এসে ধীরে ধীরে মাশরাফি হয়ে ওঠেন দলের জন্য আরো অপরিহার্য।
৪
২০০৭ বিশ্বকাপে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ডকে হারানোর ক্ষেত্রে আবারও মাশরাফি তার অলরাউন্ডিং ভূমিকা পালন করেন। নিউজিল্যান্ডকে ২ উইকেটে হারানো সেই ম্যাচে ৪টি উইকেট নেওয়ার সাথে সাথে ১৬ বলে ৩০ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস খেলেন তিনি।
তবে আসল চমকটা দেখা যায় বিশ্বকাপের মূল পর্বে। একই গ্রুপে ভারত আর শ্রীলঙ্কা থাকায় অনেকেই ধারণা করেছিল গ্রুপ পর্ব থেকেই বাংলাদেশের বিদায় হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে হট ফেভারিট ভারতকে হারায় বাংলাদেশ। ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সেই ম্যাচের ম্যান অব দি ম্যাচও হন মাশরাফি।
সফল একটি বিশ্বকাপ কাটানোর পর মাশরাফি ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দলের পক্ষে একই সাথে সবচেয়ে বেশি রান এবং সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব গড়েন।
সেই বছরেই আফ্রো এশিয়া কাপ সিরিজে পাকিস্তানি বোলার শোয়েব আখতারের পরিবর্তে এশিয়া স্কোয়াডে সুযোগ পান মাশরাফি। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক জয়েও বিপক্ষ দলের প্রথম তিনটি উইকেট সহ মাত্র ৪৪ রানে ৪টি উইকেট শিকার করেন তিনি।
২০০৯ সালে মাশরাফি আইপিএল এ কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে সুযোগ পান। তিনি মাত্র একটি ম্যাচ খেলেন সেখানে। সেই ম্যাচের স্মৃতিটা অবশ্য তার জন্য বেশ দুঃখজনক ছিল। শেষ ওভারে তিনি ২১ রান দেওয়ায় ম্যাচটি হেরে যায় কলকাতা।
৫
২০০৯ সালে মাশরাফি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে অধিনায়ক নিযুক্ত হন। কিন্তু প্রথম টেস্টেই ইনজুরিতে পড়ে দল থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। মাঝে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর মাশরাফি জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা পান তখন, যখন তিনি আবিস্কার করেন, ঘরের মাঠে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে তার নামটা নেই।
চার বছর পর সেই দুঃখটা কিছুটা লাঘব হয়, যখন তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার সুযোগ পায়।
উপমহাদেশের ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে যে, তারা সহজে অবসর নিতে চান না। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাদেরকে বাদ দিতে হয়। মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি কিনা অধিনায়ক থাকা অবস্থায় টি-২০ দল থেকে অবসর নিয়েছেন।
অধিনায়কের পরিসংখ্যানেও মাশরাফি অনেকের চেয়ে এগিয়ে। অধিনায়ক হিসেবে ১টি মাত্র টেস্ট খেলায় এবং তাতে জয় পাওয়ায় জয়ের হার শতভাগ থাকলেও সেটিকে ঠিক বিচারে আনা উচিত হবে না। তবে ওয়ানডেতে এখনো বাংলাদেশের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে রয়েছেন তিনি, যার অধীনে বাংলাদেশ হারের চেয়ে জয়ের দেখা বেশি পেয়েছে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ২৭ বার আর পরাজিত হয়েছে ১৮ বার। এছাড়া টি-২০তেও জয়ের হারে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন মাশরাফি (৩৭.০৩%)।
তবে মাশরাফিকে সম্ভবত পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করলে কিছুটা অবমূল্যায়নই করা হবে। যদিও সে বিবেচনাতেও তিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে।
মানুষের কিছু কিছু গুণাবলী কারো কারো মাঝে এমনভাবে ফুটে উঠে, মনে হয় যেন সেই গুণটি অন্য কারো পক্ষে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেও অর্জন করা সম্ভব নয়। নেতা তো অনেকেই হন, নেতৃত্বের গুণাবলীকে ধারণ করতে পারেন কজন? মাশরাফি এমন এক নেতা, যার শরীরী ভাষাতেই প্রকাশ পায় তার সামর্থ্য, যার মানসিক শক্তি থেকেই পাওয়া যায় জয়ের আভাস। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক।
বিপিএল এ প্রথম দুই মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি। তবে সেটিকে কেউ ঠিক ‘ক্রেডিট’ হিসেবে বিবেচনা করে না। বরং প্রথম দুই মৌসুমে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস যে মানের দল ছিল, তাতে চ্যাম্পিয়ন না হলে সেটাকেই কেউ যদি ‘ডিসক্রেডিট’ বললে, তাকে দোষ দেওয়া যেত না। ঝামেলাটা হয়ে গেল তৃতীয় মৌসুমে এসে। সেই মৌসুমে মাশরাফি প্রথমে কোনো দল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দল গঠনের সময় সবার চোখ ছিল সাকিব, তামিম, রিয়াদ, মুস্তাফিজ, মুশফিক, সাব্বির, নাসির, তাসকিনদের মতো পারফর্মারদের উপর। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানের মালিক নাকি প্রথমে মাশরাফিকে দলে পেয়ে খুশি হতে পারছিলেন না। খুশি না হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছুও ছিল না। ইনজুরিপ্রবণ একজন খেলোয়াড়ের বোঝা কে বইতে চাইবে?
মাশরাফিকে বাদ দিলেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানের অন্য খেলোয়াড়রাও খুব দুর্দান্ত মানের ছিলেন না। ইমরুল কায়েস অনেক আগেই টি-২০ এর জন্য অপাংক্তেয় ঘোষিত হয়ে গিয়েছিলেন, অলক কাপালীর নাম হয়তো অনেকের মনেই নেই। টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ঢাকার কাছে হেরে যাওয়াটা তাই কারো কাছে অবাক করার মতো কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে মাশরাফি তার জাদু দেখাতে শুরু করেন। ১২ ম্যাচের ৯টিতে বল করে ৩৭.৪০ গড়ে ৫ উইকেট নেওয়ার কিংবা ব্যাটসম্যান হিসেবে ৭ ইনিংসে ২০.৪০ গড়ে ১০২ রান করার পরিসংখ্যান তাকে ঠিকভাবে চেনাতে পারবে না।
নেতার একটি বড় গুণ হচ্ছে, তিনি তার আশেপাশের সাধারণদেরকেও অসাধারণ কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করেন। মাশরাফিও তা-ই করলেন। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আবু হায়দারকে কয়জন চিনতো? ইমরুল কায়েস তো এই সংস্করণের জন্য প্রায় বাতিলের পর্যায়েই ছিলেন। অথচ টুর্নামেন্ট শেষে দুজনেই সর্বোচ্চ উইকেট আর রানের তালিকায় দুই নম্বরে চলে এলেন। তারকা সমৃদ্ধ অন্যান্য দলকে টপকিয়ে কুমিল্লার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যে মাশরাফির, সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
৬
ক্যারিয়ারে একটিই শত্রু ছিল তার, ইনজুরি। তবে সেটিকেও খুব দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছেন ম্যাশ।
২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডেভিড ইয়ং এর কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পর তাদের কথোপকথোনের ধরনটা ছিল অনেকটা এরকম।
– কী করছো?
– কেন ক্রিকেট খেলছি। (একটু অবাক হয়ে)।
– আমার সাথে রসিকতা করো না। আসলে কী করছো? চাকরি নাকি ব্যবসা?
– আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। ব্যবসা করবো কেন? ক্রিকেট খেলছি। এবারও তো ক্রিকেট খেলতে গিয়েই ইনজুরিতে পড়েছি।
হতভম্ব ইয়াং-এর কাছে কোনো হিসেব মিললো না। ৬ বছর আগে ২০০৩ সালে যখন মাশরাফির হাঁটুতে তিন নম্বর অপারেশন হলো, তখনই তো তার খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা। তবে কি মাশরাফি একজন মেডিকেল মিরাকল!
সেই মিরাকল পরবর্তীতে আরো অপারেশন করিয়েছেন। মোট ১২ বার ইনজুরির স্বীকার হয়েছিলেন তিনি, আছে দু’ হাতে আটটি আর গোড়ালি এবং পিঠে আরো দুটো অপারেশন। তবুও ইনজুরি তাকে হারাতে পারেনি। বার বার তিনি ফিরে এসেছেন, পারফর্মও করেছেন।
খুব ছোট বেলাতেই বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন মাশরাফি। সেই আঘাতও তাকে থামাতে পারেনি। পরবর্তীতে শুধুমাত্র ইনজুরির কাছে হেরে যাবেন, এই বিষয়টাই হয়তো মাশরাফি মানতে পারেননি।
৭
মাশরাফি আসলে কেমন মানের ব্যাটসম্যান? পাড়ার ক্রিকেটে একসময় ব্যাটিংয়ের কারণেই বিখ্যাত ছিলেন ম্যাশ। তবে সেটার সাথে তো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটের তুলনা চলে না। তবুও ব্যাটসম্যান মাশরাফি সম্পর্কে সাকিব আল হাসানের একটি মন্তব্য শুনতে পারেন,
‘বাংলাদেশের হয়ে কত রান করেছেন উনি? হাজার দেড়েক। এই দেড় হাজার রান দিয়ে উনি বাংলাদেশকে যে কয়টা ম্যাচ জিতিয়েছেন, তা আমরা তিন-চার হাজার রান করে করতে পারিনি। কৌশিক ভাই নিজেকে নিয়ে খামখেয়ালি না করলে সে থাকতো বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে’।
বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মাঝে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান করার কৃতিত্ব মাশরাফির। ভারতের দিনেশ মঙ্গিয়ার বিপক্ষে টানা চার বলে চারটি ৬ মারেন তিনি এবং সেই ওভার থেকে তুলে নেন ২৬ রান।
দেশের হয়ে অনেক বড় বড় জয়ে তার অবদান অসামান্য। ২০০৭ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ড জয়ের কথা তো আগেই বলা হলো। এছাড়াও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক জয়েও ম্যান অব দি ম্যাচ মাশরাফি। সেই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে ২৬ বলে ২৫ রান করার পাশাপাশি বোলিংয়ে এসে তিনি তুলে নেন ২টি উইকেট।
কার্ডিফের অস্ট্রেলিয়া বধে সবাই আশরাফুলের কথা মনে রাখলেও, অনেকে ভুলে যায় যে, সেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কাজটা শুরু করেছিলেন এই মাশরাফি; ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ডেঞ্জারম্যান গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে ফিরিয়ে দিয়ে।
২০০৬ সালে মাত্র ২৭ ম্যাচে ৪৯টি উইকেট শিকার করেন তিনি, যা কিনা তাকে সেই মৌসুমের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিতে পরিণত করে।
৮
মাশরাফির আরেকটি অবদান খালি চোখে দেখা যায় না।
ভারতে যদি কোনো তরুণ ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করেন, তারা কার মতো হতে চায়, তাহলে বেশিরভাগ তরুণই জবাব দেবে শচীন টেন্ডুলকার, পাকিস্তানে হয়তো একই প্রশ্নের জবাবে উত্তর আসবে ওয়াসিম আকরাম। এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জাতির জন্য রোল মডেল।
ক্রিকেটার যারা হতে চায় তাদের তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশে যে সব তরুণ ফাস্ট বোলার হতে চায়, তাদের রোল মডেল কে জিজ্ঞেস করলে, বেশিরভাগই হয়তো উত্তর দেবে মাশরাফি। অথচ বাংলাদেশ ফাস্ট বোলারদের জন্য ভালো কোনো জায়গা না। উইকেট থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় না, ঘরোয়া ক্রিকেটে দল সাজানো হয় স্পিনার আর ব্যাটসম্যানদের কথা ভেবে। তাছাড়া একজন ব্যাটসম্যান অথবা স্পিনারদের চেয়ে ফাস্ট বোলারদের ক্যারিয়ার সচরাচর কিছুটা ছোট হয়। এরপরেও মাশরাফির প্রেরণায় ফাস্ট বোলার হতে চাওয়াটাকে আপনি কোনো কিছু দিয়ে মাপতে পারবেন না।
একসময় ‘পাগলা’ নামে পরিচিত এই ক্রিকেটার সময়ের সাথে সাথে নিজেকে অনেক বদলে ফেলেছেন। মানসিকতাতেও পরিপক্বতা এসেছে। একারণেই হয়তো যখন তাদের নিয়ে দেশজুড়ে প্রচণ্ড মাতামাতি চলে, তখন স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের একজন নিজেই এমন কিছু কথা বলতে পারেন।
“দেশের তুলনায় ক্রিকেট অতি ক্ষুদ্র একটি ব্যাপার। একটি দেশের অনেক ছোট ছোট মাধ্যমের একটি হতে পারে খেলাধুলা; তার একটি অংশ ক্রিকেট। ক্রিকেট কখনও দেশপ্রেমের প্রতীক হতে পারে না। সোজা কথায়-খেলাধুলা হলো বিনোদন।”
“খেলা কখনও একটি দেশের প্রধান আলোচনায় পরিণত হতে পারে না। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সমাধান বাকি। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতি, রাষ্ট্র এভাবে এনগেজ হতে পারে না। আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় তারকা বানানো হচ্ছে, বীর বলা হচ্ছে, মিথ তৈরি হচ্ছে। এগুলো হলো বাস্তবতা থেকে পালানোর ব্যাপার।”
“আমি ক্রিকেটার, একটি জীবন কি বাঁচাতে পারি? একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো একটি হাততালি দেয় না! তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা। তারকা হলেন লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছেন। ক্রিকেট দিয়ে আমরা কি বানাতে পারছি? একটি ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে বানানো যায়? একটি ধান জন্মায় ক্রিকেট মাঠে? যারা ইট দিয়ে দালান বানায়, কারখানায় ওটা-ওটা বানায় বা ক্ষেতে ধান জন্মায়, তারকা হলেন তারা।”
“বীর হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আরে ভাই, তারা জীবন দিয়েছেন। জীবন যাবে জেনেই ফ্রন্টে গেছেন দেশের জন্য। আমরা কি করি? খুব বাজে ভাবে বলি- টাকা নেই, পারফর্ম করি। একটি অভিনেতা, গায়কের মতো পারফর্মিং আর্ট করি। এর চেয়ে এক ইঞ্চি বেশিও না। মুক্তিযোদ্ধারা গুলির সামনে এইজন্য দাঁড়ায় নাই যে জিতলে টাকা পাবে। কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা রে! ক্রিকেটে বীর কেউ থেকে থাকলে রকিবুল হাসান, শহীদ জুয়েলরা।”
“রকিবুল ভাই ব্যাটে জয় বাংলা লিখে খেলতে নেমেছিলেন, অনেক বড় কাজ। তার চেয়েও বড় কাজ, বাবার বন্দুক নিয়ে ফ্রন্টে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ জুয়েল ক্রিকেট রেখে ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দিয়েছিলেন। এটিই হলো বীরত্ব। ফাস্ট বোলিং সামলানার মধ্যে রোমান্টিসিজম আছে, ডিউটি আছে। বীরত্ব নেই।”
“আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটি দিন রাস্তায় থুথু না ফেলত বা একটি দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই প্রবল এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটি দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। আমি তো এই মানুষদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাই বুঝি না!”
“কিছু হলেই আমরা বলি, এই ১১ জন ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। আন্দাজে! তিন কোটি লোকও হয়ত খেলা দেখেন না। দেখলেও তাদের জীবন-মরণ খেলা না। মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন রাজনীতিবিদেরা, তাদের স্বপ্ন ভবিষ্যত অন্য জায়গায়। এই ১১ জন মানুষের ওপর দেশের মানুষের ক্ষুধা, বেঁচে থাকা নির্ভর করে না। দেশের মানুষকে তাকিয়ে থাকতে হবে একজন বিজ্ঞানী, একজন শিক্ষাবিদের দিকে।”
কী বলবেন এই মাশরাফিকে, শুধুই একজন খেলোয়াড়, নাকি দেশের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা লালন করা এক দার্শনিক?
ক্যারিয়ার বড় করার জন্য অনেক আগেই টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন, টি-২০ থেকেও অবসর নিয়ে নিয়েছেন। হয়তো আর কিছুদিন পরেই ওয়ানডে ক্রিকেট থেকেও অবসর নিয়ে নেবেন তিনি।
কিন্তু মাশরাফি থাকবেন। হয়তো তিনি থাকবেন বোর্ডের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তি হয়ে, কিংবা কোচ বা অন্য কোনো দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু তার আরেকটি অনন্য জায়গা আছে, তিনি থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।
কারণ মাশরাফি ক্রিকেটটা শুধু ব্যাট বল দিয়ে খেলেন না, খেলেন হৃদয় দিয়ে।মাশরাফি শুধু একজন ক্রিকেটার নন, তিনি একজন অধিনায়ক, একজন দেশপ্রেমিক নেতা। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলা যায়, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।
তথ্যসূত্র: মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত; মাশরাফি; পৃষ্ঠা: ১৩, ৩৯১, ৪৬৪; পরিবেশক: ঐতিহ্য।