১৯১১ সালের ঘটনা। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের আওতাধীন ছাত্রাবাসটির নাম ইডেন হিন্দু হোস্টেল। ছাত্রাবাসের ফটক ঠেলে প্রবেশ করলেন এক বাংলাদেশি তরুণ। হাতের ঝোলাতে নিজের দরকারি জিনিসপাতি এবং দু’চোখে একঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছেন সুদূর কলকাতায়।
হোস্টেল বেয়ারার সহায়তায় নিজের কক্ষ বুঝে নিলেন তিনি। নতুন কক্ষ গোছগাছ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। বেশ কয়েকদিনের ভ্রমণে ক্লান্ত ছিলেন তিনি। এদিকে বেশ ক্ষুধাও পেয়েছে। তাই দুপুরের আহার করার নিমিত্তে তিনি ছাত্রাবাসের ভোজনশালার দিকে রওয়ানা দিলেন। ক্লান্ত তরুণ যখন পেছনের টেবিলে গিয়ে বসলেন ঠিক তখন ঘটলো বিপত্তি। একে একে সবাই ভোজনশালার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কোনো ছাত্র এই নতুন তরুণের সাথে খেতে রাজি নয়। সেদিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন তিনি। তিনি এমন কী অপরাধ করলেন, যে সবাই তাকে ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে?
তার বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বর্ণবাদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সেদিনের হোস্টেলের নতুন ছাত্রটি বর্ণে বৈশ্য। সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতো যারা। তাই নিজের ধর্ম, জাত রক্ষার দোহাই দিয়ে সেদিন হোস্টেলের ছেলেরা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এই বৈষম্য খাবার ঘরের দরজা পেরিয়ে ঈশ্বরের মন্দিরের সোপানের দ্বারে করাঘাত করলো। কিছুদিন পর দেখা গেলো, ব্রাহ্মণ ছাত্ররা তাকে দেবী সরস্বতীর পূজায় আসা নিষেধ করে দিলো। সেদিন পরাজিত সৈনিকের ন্যায় একাকী নিজের কক্ষে বসে দুঃখে কেঁদেছিলেন সেই তরুণ। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। সেদিন প্রেসিডেন্সি কলেজের কোনো ছাত্র কি একবার ভুলেও কল্পনা করেছিলো, এই বৈশ্য ছেলেটি একদিন তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে?
সুপ্রিয় পাঠকগণ, এতক্ষণ বলছিলাম বাংলার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার কথা। যিনি বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে একজন নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানী এবং জাতীয়তাবাদী বাঙালি হিসেবে বিশ্বাঙ্গনে প্রমাণ করেছেন সদর্পে। মেঘনাদ সাহার অবদানের কথা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানমহলে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী।
মেঘনাদ সাহা এবং শৈশব
মেঘনাদ সাহার জন্ম আমাদের বাংলাদেশেই। বর্তমান রাজধানী ঢাকার শেওড়াতলি নামক অঞ্চলে তিনি এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দোকানদার পিতা জগন্নাথ সাহার গরিব সংসারে আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম পুত্র ছিলেন তিনি। একবার তার বড় ভাই পরীক্ষায় খুব খারাপ ফলাফল করলো আর তাতে মন খারাপ হয়ে গেলো মেঘনাদ সাহার। কারণ, ভাইয়ের বাজে ফলাফল দেখে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেঘনাদ এবং তার ভাই দুজনকেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে দোকানে কাজে লেগে যেতে হবে। কিন্তু কিশোর মেঘনাদ পড়াশোনা করতে চান।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি পাড়ার ডাক্তার চাচা অনন্ত কুমারের দোকানে হাজির হলেন। অনন্ত কুমার মেঘনাদকে অনেক স্নেহ করতেন। তার পড়াশোনার প্রতি অসীম আগ্রহের কথা জানতে পেরে তিনি তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন। তার কথামতো, ডাক্তারখানার টুকটাক কাজ করার বিনিময়ে তিনি মেঘনাদের পড়াশোনার খরচ বহন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। মা ভুবনেশ্বর দেবীর নিকট প্রস্তাবনাটি মনঃপুত হয়। মেঘনাদও মন দিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯০৫ সালে ঢাকার সরকারি কলেজিয়েট স্কুলে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন।
কিন্তু ১৯০৫ সাল বাংলাদেশ অঞ্চলের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে এপার বাংলার সাথে ওপার বাংলার নীতিগত দ্বন্দ্ব থেকে বিভিন্ন আন্দোলনের জন্ম নেয়। মেঘনাদ সাহা নিজে সেই আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু এর পরিণাম ভালো হয়নি। আন্দোলনের মাশুল হিসেবে মেঘনাদ সাহাসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর ফলে মেঘনাদ সাহা অকূল পাথারে পড়েন। কিন্তু এই যাত্রায় তাকে বড় ভাই অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন। ভাইয়ের অর্থ দিয়ে তিনি তার পড়াশোনা চালিয়ে যান। ১৯১১ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম এবং গণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। সাহা নিজের ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে ঢাকা ত্যাগ করে কলকাতায় শিক্ষালাভের সিদ্ধান্ত নেন।
কলিকাতা অধ্যায়
ঢাকার পর মেঘনাদ সাহার নতুন ঠিকানা হয় কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯১১ সালে তিনি সেখানে মিশ্র গণিত বিভাগে ভর্তি হন। নিজের বর্ণগত পরিচয়ের কারণে সেখানে তিনি বেশ অসুবিধায় পড়েন। কিন্তু শত বাধা বিপত্তির মুখেও তিনি নিজের লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়াননি। নিষ্ঠার সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যান সাহা। প্রেসিডেন্সি কলেজে মেঘনাদ সাহার সহপাঠী হিসেবে অধ্যয়ন করতেন বাংলার আরেক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্য। ১৯১৩ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি এই কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
দেখতে দেখতে ছাত্র মেঘনাদ সাহা একজন পেশাদার পদার্থবিদে পরিণত হতে থাকেন। কিন্তু গণিতের ছাত্রের পদার্থবিদ্যায় বদলি হবার মাঝে ঘটে যায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চাকরি জীবনের শুরুর দিকে তার সাথে গণিত বিভাগের চেয়ারম্যানের মনোমালিন্য হয়। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে তাকে গণিত বিভাগ থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বদলি করে দেয়া হয়। এই ঘটনা মেঘনাদ সাহার জীবনে শাপে বর হয়ে ধরা দিল। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তিনি চলমান গবেষণাগুলো নিয়ে তদারকি করতে থাকেন। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে তখন কলকাতায় পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক বিদেশি বইগুলো পাওয়া যেত না।
এবার সাহা বিভিন্ন বিদেশি বন্ধু এবং সহকর্মীদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। পল জোহানেস ব্রাল নামক এক অস্ট্রীয় বিজ্ঞানী সাহাকে বিভিন্ন বিদেশি পুস্তক সংগ্রহে সাহায্য করেন। মেঘনাদ সাহা কলকাতার পাঠাগারে বসে সেগুলো পড়তেন আর পরিচিত হতে থাকেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক, ওয়াল্টার নার্নস্টসহ প্রমুখ বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী গবেষণার সাথে। নিজ শিক্ষক স্যার প্রফুল্ল চন্দ্রেরও বিভিন্ন রসায়ন বিষয়ক পুস্তক পাঠ করেন তিনি। এর মাধ্যমে মেঘনাদ সাহার অন্তরে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত এক বিজ্ঞান চেতনার শুভ মুক্তি ঘটে।
গবেষক মেঘনাদ সাহা
প্রেসিডেন্সি কলেজে মেঘনাদ সাহা জলবিজ্ঞান, বর্ণালীবিক্ষণ এবং তাপগতিবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণার কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন কোনো উন্নত গবেষণাগার না থাকায় বেশ অসুবিধায় পড়েন তিনি। তারপরেও নিজের সাধ্যমতো কাজ চালিয়ে যান। ১৯১৭ সালে তিনি ‘Selective Radiation Pressure’ শিরোনামে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখে Astrophysical Journal এ প্রকাশনার জন্য প্রেরণ করেন।
সেখান থেকে জানানো হলো, জার্নাল প্রকাশ করতে হলে এর সামান্য খরচ মেঘনাদ সাহাকেও বহন করতে হবে। কিন্তু মেঘনাদ সাহার নিকট যথেষ্ট অর্থ না থাকায় তিনি জার্নাল প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন। দেখতে দেখতে মেঘনাদ সাহার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের পাট চুকিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এখানে এসে পেয়ে যান সহপাঠী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। এদিকে ১৯১৮ সালে তিনি রাধারাণী সাহা নামক এক নারীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। কিন্তু এই শিক্ষা তার জীবনে তখন কোনো কাজে না আসলেও এবার তিনি এর সুফল পেলেন। তিনি এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুজনে মিলে ১৯১৯ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিত তত্ত্বের উপর প্রকাশিত নিবন্ধটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ ব্যবহার করে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন আইনস্টাইনের তত্ত্বের প্রতিপাদন করেছিলেন।
১৯১৯ সাল যেন মেঘনাদ সাহার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসলো। একই বছর তিনি আলোর সনাতন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি আলোর তত্ত্ব এবং বিভিন্ন মহাকাশীয় ঘটনাবলী ব্যাখ্যায় এর ব্যর্থতা নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। বিশেষ করে ধূমকেতুর লেজের সূর্য বিপরীতে মুখে করে থাকার ঘটনা তাকে প্রবলভাবে ভাবিয়ে তোলে। তিনি বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব নিয়ে বিশদ গবেষণা করে এর ব্যাখ্যা তৈরি করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্ব দরবারে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। তার কাজগুলো বিজ্ঞানমহলে ভূয়সী প্রশংসিত হয়। দরিদ্র রাষ্ট্রের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ধ্বংসস্তূপ থেকে হুংকার দিয়ে উঠেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। একই বছর তাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অফ সায়েন্স উপাধি প্রদান করা হয়। হার্ভার্ডের তারকা বর্ণালী সম্পর্কিত শ্রেণীবিন্যাসের তাত্ত্বিক আলোচনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি প্রদান করা হয়।
১৯২০ সালে তিনি তার সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন। এ বছর মেঘনাদ সাহা চারটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই নিবন্ধগুলোর মাধ্যমে তিনি তাপীয় আয়নবাদ (Thermal Ionaisation) সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন। বিজ্ঞানজগতে আবির্ভূত হয় সাহা আয়নবাদ সমীকরণ। এর স্বীকৃতিস্বরূপ মেঘনাদ সাহার ঝুলিতে যোগ হয় সম্মানজনক গ্রিফিথ পুরষ্কার। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির অনুদানে তিনি ভারতবর্ষ ছেড়ে ইউরোপ যাত্রা করেন। প্রথমে লণ্ডনের আলফ্রেড ফাউলার গবেষণাগারে কিছুদিত কর্মরত থাকার পর তিনি বার্লিনের ওয়াল্টার নার্নস্ট গবেষণাগারে যোগদান করেন।
ভারতবর্ষে অন্য মেঘনাদ
১৯২৩ সালে তিনি মাটির টানে পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। এবার তার ঠিকানা হয় এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করেন। তিনি তার কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার গবেষণায় কাজে লাগান। ১৯২৫ সালে তাকে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এলাহাবাদের পর তার ঠিকানা হয় পুরাতন কর্মস্থল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এবার তিনি গবেষণার বাইরেও কিছু সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান বিষয় সংযোজন করেন। এছাড়া তিনি ভারতবর্ষের প্রথম সাইক্লোট্রন নির্মাণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতীয় নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাশাপাশি তিনি দামোদর উপত্যকা প্রকল্পের মূল নকশা তৈরি করেন।
স্কুল জীবনে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা মেঘনাদ সাহার রক্তে তখনও বিদ্রোহ মিশে ছিল। তাই তিনি বিজ্ঞানের অগ্রসরতায় কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পূর্ব থেকে তিনি জাতীয় বিজ্ঞান নীতিমালা প্রণয়ন নিয়ে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরুর সাথে মতবিরোধ হয়। মেঘনাদ সাহা আরেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে সাথে নিয়ে ভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের চেষ্টা করেছিলেন। অনেকের মতে, জওহরলাল নেহেরু একজন দূরদর্শী নেতা হলেও মেঘনাদ সাহা তার বাল্যজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ভারতবর্ষের জনগণের চাহিদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতেন। তাছাড়া বিজ্ঞানের আঙিনায় মেঘনাদ সাহা নেহেরুর চেয়ে বেশি পারদর্শী ছিলেন। এই মর্মে তিনি ১৯৪৫ সালের ১২ আগস্ট নেহেরু এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বরাবর চিঠি প্রেরণ করেন। নেহেরুর সাথে শীতল সম্পর্কের খেসারতও দিতে হয়েছিল মেঘনাদ সাহাকে। দেশ বিভাগের পর নতুন ভারতে মেঘনাদ সাহা প্রণীত বহু বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা জওহরলাল নেহেরু কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।
শেষলগ্নে মেঘনাদ সাহা
পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে তিনি স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। ১৯৫৬ সালে তিনি নিউক্লীয় পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিতে নয়াদিল্লি ভ্রমণ করেন। কিন্তু সেবার তার আর বৈঠকে অংশ নেয়া হলো না। কর্মঠ মেঘনাদ সাহা যাত্রাকালে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন। এরই সাথে নিভে যায় ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিদ্যার মহাকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। নরওয়েজীয় জ্যোতিঃপদার্থবিদ ভাইন রসল্যাণ্ড মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“যদিও বোরকে পরমাণু তত্ত্বের অগ্রদূত হিসেবে বলা হয়ে থাকে, আমার মতে পরমাণু তত্ত্বকে কেন্দ্র করে মহাকাশের তারকারাজির বর্ণালীক্রম নিয়ে একটি সুসজ্জিত তত্ত্ব তৈরি করে (১৯২০ সালে) সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী। তার নাম মেঘনাদ সাহা।”
আমরা ইতোমধ্যে আইনস্টাইন, ফ্রিৎজ হ্যাবার, ফিলিপ ল্যানার্ডসহ প্রমুখ বিজ্ঞানীর জীবনী পর্যালোচনা করে জানতে পেরেছি, বিজ্ঞানকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একটি দেশের জাতীয়তাবাদের সুশৃঙ্খল কাঠামো তৈরি করা যায়। মেঘনাদ সাহা তাই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন ভারতের রাজনীতিতে। তার হাতে গড়ে ওঠে নব্য ভারতের পুরো বৈজ্ঞানিক কাঠামো। অনেকের মতে, সাহা সমীকরণের চেয়ে তার জাতীয়তাবাদী চেতনার ফসল নিউক্লীয় ইনস্টিটিউট ছিল মেঘনাদ সাহার সেরা কীর্তি। আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভারত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু এই অগ্রসরতার অগ্রদূতের তালিকা তৈরি করলে প্রথম সারিতে উঠে আসবে যার নাম, তিনি আমাদের মেঘনাদ সাহা।
ফিচার ইমেজ: NewsGram