১৯১৯ সালের ১০ নভেম্বর তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম সাইবেরিয়া তথা বর্তমানে রাশিয়ার অধিভুক্ত আলতাই প্রশাসনিক অঞ্চলের কুরইয়া গ্রামে মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম তিমোফি অ্যালেসান্ড্রোভিচ কালাশনিকভ, এবং মা অ্যালেসান্ড্রা ফ্রোলোভনা কালাশনিকভা।
অত্যন্ত দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মিখাইল কালাশনিকভ মাত্র ছয় বছর বয়সে মারাত্মক অসুস্থতার কারণে একবার মৃত্যুপথযাত্রী হন। তিনি বাল্যকালে কাব্য রচনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই সময় তার মোট ছয়টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। তিনি দারিদ্র্যের কারণে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারেন। একসময় মিখাইল কালাশনিকভের পরিবার কৃষির পাশাপাশি শিকারের কাজেও জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে কৈশোরে মিখাইল শিকারের জন্য তার বাবার ব্যবহৃত রাইফেল ব্যবহার শুরু করেন। ধীরে ধীরে অন্যান্য অস্ত্র এবং এর প্রযুক্তির প্রতি তার ঝোঁক বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
একসময় কালাশনিকভ একটি ট্রাক্টর স্টেশনে যন্ত্র সংক্রান্ত কারিগর হিসেবে যোগদান করেন। একপর্যায়ে তিনি অস্ত্রনকশা সংক্রান্ত কাজে নিজেকে যুক্ত করতে শুরু করেন। এরপর ১৯৩৮ সালে তিনি তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘রেড আর্মি’তে যোগদান করেন। খানিকটা খর্বকায় উচ্চতা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহের কারণে মিখাইল কালাশনিকভ সোভিয়েত রেড আর্মির একজন ‘ট্যাংক মেকানিক’ হিসেবে কাজ শুরু করেন। রেড আর্মির প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় তিনি একজন তরুণ উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত পান, এবং তিনি ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপের একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন।
ট্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য অস্ত্রের বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং ব্যবহারের নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কারের জন্য সুদৃশ্য দামি ঘড়ি উপহার পান। উল্লেখযোগ্য দিক হলো— ‘মার্শাল অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’-খ্যাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত সমরনায়ক গিওর্গি কনস্তান্তিনোভিচ ঝুকভ তাকে এই উপহার দেন। একসময় কালাশনিকভ সোভিয়েত রেড আর্মির ট্যাংক রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালের অক্টোবরে জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রায়ানস্ক যুদ্ধে মিখাইল কালাশনিকভ মারাত্মক আহত হন। ১৯৪২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘসময় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
জার্মান বাহিনী সেইসময় একধরনের ‘অ্যাসল্ট রাইফেল’ ব্যবহার করত, যেটি সাব–মেশিনগানের মতো গুলিবর্ষণ করার পাশাপাশি নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারত। এই কারণে ২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনী জার্মান বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের নিকট খানিকটা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিখাইল কালাশনিকভ সোভিয়েত বাহিনীর জন্য নতুন ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। এই তাড়না থেকেই ১৯৪৪ সালে তিনি প্রাথমিকভাবে একটি আধুনিক অস্ত্রের নকশা তৈরি করতে সক্ষম হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬ সালে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে তিনি আরও উন্নত ও আধুনিক অস্ত্রের নকশা উদ্ভাবন করেন।
এরপর এই নকশা থেকে ১৯৪৭ সালে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হিসেবে একে–৪৭ যাত্রা শুরু করে। মিখাইল কালাশনিকভ দীর্ঘ প্রায় সাত বছরের পরিশ্রমে তার স্বপ্নের একে–৪৭ এর বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হন। এই অ্যাসল্ট রাইফেলের নামকরণের ক্ষেত্রে ‘A’ এর পূর্ণরূপ এসেছে রুশ শব্দ ‘Avtomat’ থেকে, যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘স্বয়ংক্রিয়’, আর ‘K’ নেওয়া হয়েছে এই অস্ত্রের আবিষ্কারক কালাশনিকভের (Kalashnikov) নামের প্রথম অক্ষর থেকে। আর ১৯৪৭ সালে এই আধুনিক অস্ত্রের উদ্ভাবনের কারণে এই সালকে কেন্দ্র করে নামকরণের শেষে ৪৭ ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৪৯ সালের মধ্যে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী একে–৪৭ ব্যবহার শুরু করে। এরপর স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত সম্মিলিত প্রতিরক্ষা জোট ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’-এর সদস্য দেশগুলোতে এই অস্ত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, কলম্বিয়া, মোজাম্বিক, কম্বোডিয়া এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশে একে–৪৭ ‘বিপ্লবের প্রতীক’ হিসেবে পরিচিত পেতে থাকে। বর্তমানে প্রতিরক্ষার স্মারক হিসেবে মোজাম্বিকের জাতীয় পতাকায় একে–৪৭ এর একটি প্রতিকৃতি সংযুক্ত করা হয়েছে।
উদ্ভাবকের নামানুসারে এটি ‘কালাশনিকভ রাইফেল’ হিসেবেও পরিচিত। এই রাইফেলের অংশগুলো খুলে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে তা আবারও সংযুক্ত করে ফেলা সম্ভব। এই অস্ত্রটি বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও সফলভাবে কার্যকরী। তবে, এই অস্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে মিখাইল কালাশনিকভ সেভাবে আর্থিক সুবিধা নিতে পারেননি। কারণ, তিনি এই বিশেষ অস্ত্রের নকশার ‘স্বত্বাধিকার’ ধরে রাখতে না পারায় বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে এই অস্ত্র তৈরি করা শুরু করে। ফলস্বরূপ, বৈশ্বিক অস্ত্রের বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন ডিজাইনের একে–৪৭ রাইফেল পাওয়া যাচ্ছে।
১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরু করা যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্লেবয়’ ম্যাগাজিন ‘পৃথিবী বদলে দিয়েছে’ এমন ৫০টি পণ্যের একটি তালিকা প্রকাশ করে। এই ম্যাগাজিনের করা ২০০৪ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, একে–৪৭ রাইফেল সেখানে চতুর্থ অবস্থানে ছিল। লন্ডনের বিখ্যাত ডিজাইন মিউজিয়াম ২০১১ সালে ‘দৃষ্টিনন্দন নকশা’র জন্য বেশ কয়েকটি পণ্য বাছাই করে। সেই পণ্যগুলোর মধ্যে একে–৪৭ অন্যতম। এমনকি, এই রাইফেল নিয়ে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত গান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মার্কিন র্যাপ গায়ক লিল ওয়েন এর গাওয়া ‘AK–47’ শিরোনামের গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
একে–৪৭ রাইফেলের উদ্ভাবনের জন্য মিখাইল কালাশনিকভ অর্জন করেন বেশ কয়েকটি পুরষ্কার। এর মাঝে রয়েছে: তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রদানকৃত স্ট্যালিন পুরস্কার, দ্য রেড স্টার পুরস্কার, এবং দ্য অর্ডার অব লেলিন পুরস্কার। এছাড়াও ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর তার ৯০ তম জন্মদিনে মিখাইল কালাশনিকভ ‘দ্য হিরো অব রাশান ফেডারেশন’ পদকে ভূষিত হন। অবশ্য মিখাইল কালাশনিকভ গণমাধ্যমের সাথে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কর্তৃক একে–৪৭ রাইফেলের অপব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি ৯৪ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত উদমুরতিয়া প্রজাতন্ত্রের ইজহেভস্ক শহরে মৃত্যুবরণ করেন।