মার্চ ১৭, ১৮১৫। ল্যাফ্রি, ইজার, ফ্রান্স।
শীতের শেষভাগ, পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল আল্পস থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়া সরাসরি এসে ঝাপটা মারছে যুদ্ধক্ষেত্রের দুই পাশে অবস্থান নেওয়া ফ্রেঞ্চ সৈন্যদের মুখের উপর। কিন্তু এই প্রতিকূল আবহাওয়া নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, কারন যুদ্ধক্ষেত্রের বিভীষিকা কী হতে পারে তা নিয়ে খুব ভালো ধারণাই আছে এই পোড় খাওয়া সৈন্যদের– আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের দেহ পড়ে থাকতে পারে এই বিশাল প্রান্তরে, নির্জীব অবস্থায়! কিংবা ইজারের প্রান্তর কেঁপে উঠতে পারে তাদের চিৎকারে, বুলেট আর মর্টারের গোলার আঘাত তাদের দেহে ছাপ ফেলে দেবে চিরদিনের জন্য।
একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্রান্সের পঞ্চম ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট-এর ৮০০ জন সেরা যোদ্ধা, যারা বুরবোঁ রাজা অষ্টাদশ লুই-একান্ত অনুগত থাকার প্রতিজ্ঞা করেছে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের চেয়ে সংখ্যায় সামান্য বড় একটা সেনাদল, যারা কয়েক সপ্তাহ আগেই ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে ২০০ মাইল মার্চ করে এসেছে। ধূলিমলিন চেহারা আর বিধ্বস্ত-ক্লান্ত চেহারার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষুধা আর পিপাসা, যাদের স্বপ্ন রাজধানী প্যারিসে ফিরেই করায়ত্ত করবে দেশের শাসনব্যবস্থা! কিন্তু তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাঠের অপর প্রান্তের পরিপুষ্ট এবং চকচকে উর্দি পরা পঞ্চম ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট; এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলে ইতিহাসের কোনায় হারিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না তাদের।
হঠাৎ করেই সৈন্যদের ভিতর থেকে বের হয়ে এলো বিবর্ণ ধূসররঙা আর্মি জ্যাকেট পরিহিত ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির মাঝারি গড়নের একটা দেহ। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, ফ্রেঞ্চ উচ্চারণের সাথে মিশে রয়েছে কড়া কর্সিকান টান; যার জন্য প্রান্তরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা উভয় সৈন্যদলই একদা নিজেদের জীবন দিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞা করেছিল! নাম তার নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
নেপোলিয়নের নাম মুছে ফেলতে ফ্রেঞ্চ আর ইউরোপিয়ানরা কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব? তিনি এমন একজন, যিনি ত্রিশের কোঠা পেরোনোর আগেই হয়েছেন ইউরোপের সেরা সেনাপতি! তার কিছুদিনের মধ্যেই দখল করেছেন পুরো ফ্রান্স, আর চল্লিশ হতেই ইউরোপের মানচিত্র এমনভাবে পরিবর্তন করে ফেলেছেন, যা তার আগে হয়তো শেষ করেছিলেন শার্লেম্যান, কিংবা তারও আগে রোমান সাম্রাজ্যের সিজাররা! কিন্তু তার উত্থান যেরকম দ্রুত, পতনও সেরকম দ্রুতই– ১৮১৪ সালের আগস্ট মাসে যখন ৪৫তম জন্মদিন সাড়ম্বরে পালন করবেন, তিনি তখন নির্বাসন কাটাতে পাড়ি জমাচ্ছেন ইতালির কোনায় পড়ে থাকা একেবারে ছোট্ট ‘এলবা’ দ্বীপে। আর প্যারিসে তার জায়গা দখল করেছে বুরবোঁ রাজারা, যাদেরকে ফরাসি বিপ্লব বিশ বছরেরও বেশি সময় আগে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে দিয়েছিল।
ঠিক তার কয়েকদিন পরেই, ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ, ফরাসি আর ইংরেজদের পাহারাদার জাহাজের অনুপস্থিতিতে নেপোলিয়ন আর তার সমর্থকরা এলবা থেকে পালালেন নৌকায় চড়ে। তিনদিনের মাথায় দক্ষিণ ফ্রান্সের কানে পৌঁছানোর পর সেখান থেকে উত্তরে যাত্রা করলেন প্যারিসের উদ্দেশ্যে, মাঝখানে কিছু স্থানীয় মেয়র ছাড়া আর তেমন কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু তাদের সামনে এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বুরবোঁ রাজার এই সশস্ত্র ব্যাটালিয়ন, এদেরও পেছনে রয়েছে গ্রেনোবল শহরে অবস্থান নেওয়া হাজার হাজার সৈন্য। মনে হচ্ছে, তাদের এই অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চারের ইতি এখানেই, রক্তভেজা প্রান্তরে পড়ে থাকবে তাদের মৃতদেহ।
দুই বাহিনী মুখোমুখি হতেই ফিফথ ব্যাটালিয়নের সেনাপতি সামনে এগিয়ে আসলেন, “যদি আপনি আত্মসমর্পণ না করেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হবে।” কথাটা শুনেই নার্ভাস ভঙ্গিতে দুই পক্ষের সৈন্যরা নিজেদের লোড করা মাস্কেটগুলোতে হাত বুলাতে লাগলেন, যেকোনো মুহূর্তেই সেনাপতির আদেশে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে শত্রুদের উপর।
কিন্তু নেপোলিয়ন তার সৈন্যদের অস্ত্রের মুখ নিচে নামাতে বলে সামনে এগিয়ে গেলেন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ২০ ফুটের মধ্যে! “পঞ্চম রেজিমেন্টের সৈন্যরা!” চিৎকার করলেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে। “আমি তোমাদের সম্রাট! স্বীকার করে নাও!” আরো কিছুদূর হেঁটে গেলেন তিনি, নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের গায়ে জড়ানো আর্মি জ্যাকেটের বোতাম খুলে ফেলতে লাগলেন। নিজের বুক উন্মুক্ত করে তুলে ধরলেন তার সামনে দাঁড়ানো সৈন্যদের হাতে ধরা মাস্কেটের লক্ষ্য হিসেবে। “যদি তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থেকে থাকে যে নিজের সম্রাটকে খুন করতে চায়,” দৃঢ় কন্ঠে বলতে থাকলেন, “এই যে আমি এখানে!”
পিনপতন নীরবতা। তারপর পেছন দিক থেকে কেউ বলে উঠলো, “গুলি করো!” কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করল না। আবারো নীরবতা। কেউ ভেবে পাচ্ছে না কী করা উচিৎ। তারপর হঠাৎ করেই একটু ভিন্ন ধরনের চিৎকার শোনা গেল। “Vive l’empereur”। “সম্রাট দীর্ঘজীবী হোক!” কিছুক্ষণের মধ্যেই, পুরো ব্যাটালিয়ন ফেটে পড়ল ‘নেপোলিয়ন’ চিৎকারে। তাদের মাস্কেটগুলো মাটিতে পড়ে গেল, টুপি খুলে সম্মান জানাল সম্রাটকে, ঘিরে দাঁড়ালো তাদের নেতাকে। এলবা থেকে আসা একসময়ের সহযোদ্ধাদের সাথে আলিঙ্গন করল। কিছুক্ষণ আগেও মারমুখো দুই ফ্রেঞ্চ বাহিনী একত্রিত হলো একজনের নেতৃত্বে, যার নামের ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ নাপোলেওঁ বোনাপার্ত। নেপোলিয়ন তার ছোট্ট সেনাদলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, যেটা মাত্রই আকারে দ্বিগুণে পরিণত হলো! তারপর প্রস্তুত হতে বললেন সবাইকে, আরো উত্তরে পাড়ি জমাতে হবে তাদেরকে। গন্তব্য? রাজধানী প্যারিস।
বারো দিন পর, রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে প্যারিস থেকে পালালেন অষ্টাদশ লুই। কয়েক ঘণ্টা পরেই, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্যারিসে ঢুকলেন বীরের বেশে। প্যারিসের রাস্তায় উপচে পড়া ঢল, সম্রাটকে ঘিরে রয়েছে রক্ষীবাহিনী। গ্রান্দে আর্মির সদস্যরা নীরবে অভিবাদন জানাচ্ছে তাদের একসময়ের সেনাপতিকে, সদ্য নির্বাসন থেকে ফিরে আসা সম্রাট তিনি।
নেপোলিয়নের প্রত্যাবর্তন খুব বেশিদিন টেকেনি– ‘দ্য হানড্রেড ডেইজ’ হিসেবে পরিচিত তার নতুন শাসনামলের ইতি ঘটল ওয়াটারলুর যুদ্ধে; নেপোলিয়নের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে পরাজয়। কিন্তু এই পরাজয় তার কিংবদন্তীর ঘোড়াকে রুখতে পারেনি, ল্যাফ্রির ঘটনাই এ কথার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্স মুক্ত হলো খ্রিস্টান চার্চের প্রভাব থেকে। এদিকে লুইয়ের পতনের পর ইউরোপের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো চাপ দিতে থাকল ফ্রান্সের উপর। ফরাসি বিপ্লবের পর তাদের দেশেও বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লে উৎখাত হতে হবে তাদেরকেও। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোর আক্রমণের চেয়ে ফ্রান্স তখন নিজের সমস্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। জ্যাকবিনস আর রবসপিয়ার ক্যাথলিকদের উপর একটু বেশিই খ্যাপা, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই মাথা পেতে দিতে হতো গিলোটিনের নিচে। এমন এক গোলযোগপূর্ণ মুহূর্তে ফরাসিদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল একজন যোগ্য নেতার। ক্রমাগত গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়া ফরাসিদের একত্রিত করতে তাই সামনে এগিয়ে এলেন একজন, আমূল পরিবর্তন ঘটালেন ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থায়, তৈরি হলো নতুন সংবিধান। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত ‘দ্য কোড অভ নেপোলিয়ন’-এর বাতাস ছড়িয়ে পড়ল পুরো ইউরোপজুড়ে, রাজতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ইউরোপ এগিয়ে যেতে থাকলো গণতন্ত্রের দিকে।
ছোট্ট কর্সিকায় জন্ম নেওয়া নেপোলিয়ন তার শেষ জীবন কাটালেন তার চেয়েও ছোট্ট দ্বীপ সেইন্ট হেলেনায়। কিন্তু যে ৫১ বছর বেঁচে ছিলেন, তার মধ্যেই ইতিহাসে নিজের নাম চিরস্থায়ী রেখে গিয়েছেন। কর্সিকার ছোট্ট বালক থেকে কীভাবে ফ্রান্সের মহীরুহতে পরিণত হলেন নেপোলিয়ন? সে ঘটনাই জানানো হবে এই ধারাবাহিকে।
দ্বিতীয় পর্ব: নেপোলিয়ন: দ্য কর্সিকান বয় (পর্ব-২)