প্রথম পর্ব: নেপোলিয়ন: দ্য লিটল কর্পোরাল (পর্ব-১)
ভূমধ্যসাগরে ভেসে থাকা কর্সিকার অবস্থানটা ইতালি আর ফ্রান্সের মাঝখানে, ভালোভাবে বলতে গেলে ফ্রান্সের কান শহর থেকে ইতালির পিসা শহরটা আরো কাছাকাছি। কখনো প্রদেশ, কখনো উপনিবেশ আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা দ্বীপ হিসেবেই বেড়ে উঠেছে কর্সিকা। তবে আঠারো শতকের আগ পর্যন্ত ইতালির সবকিছুই নিজেদের আপন করে নিয়েছিল কর্সিকানরা– হোক সেটা ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা বাণিজ্য। ইতালির বন্দরনগরী জেনোয়ার সরকারের অধীনেই কর্সিকা চালাত স্থানীয় প্রভাবশালীরা, যাদের মধ্যে একটা ছিল বোনাপার্তে পরিবার।
এরকম এক পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করলেন কার্লো বোনাপার্তে। সুদর্শন আর অমায়িক এই ভদ্রলোক পিসা থেকে আইন পাশ করেই মাত্র ১৭ বছরে বিয়ে করে বসলেন ১৪ বছর বয়সী এক মেয়েকে। কর্সিকারই আরেক প্রভাবশালী পরিবারেরই মেয়ে লেতিৎসিয়া রামোলিনি, তাই বিয়ে করতে খুব একটা ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাদের দুজনকে। কে ভাবতে পেরেছিল এই পরিবার থেকেই ইতিহাস রচিত হবে?
আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে কর্সিকার রাজনৈতিক অবস্থায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসলো। কয়েক দশক ধরে চলা জেনোয়ার দুর্নীতিপরায়ণ শাসকদের বিরুদ্ধে চলা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের পথ ধরে কর্সিকাকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে তার শাসনব্যবস্থা করায়ত্ত করলেন প্যাসকেল পাওলি নামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি। তবে তার এই শাসন বেশিদিন চলেনি। ভূমধ্যসাগরে নিজেদের প্রভাব আরো বাড়ানোর জন্য জেনোয়ার কাছ থেকে কর্সিকা কিনে নেয় ফ্রান্স। কেনার পরপরই কর্সিকা দখল করতে একটা ছোটখাটো ফ্রেঞ্চ বাহিনী কর্সিকার উপর চড়াও হয়, পাওলিকে পাঠানো হয় নির্বাসনে!
প্যাসকেল পাওলির মিত্র থাকা সত্ত্বেও কার্লো বোনাপার্তে অন্যান্য প্রভাবশালী পরিবারগুলোর মতো পালিয়ে যাননি, উপরন্তু বিদেশী ফ্রেঞ্চদেরকে কর্সিকা দ্বীপে স্বাগত জানান। ফ্রেঞ্চ সংস্কৃতি কিংবা ভাষা সবকিছুই কর্সিকানদের থেকে আলাদা, কিন্তু মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী দেশের প্রদেশ হিসেবে থাকাও কর্সিকার জন্য বেশ কিছু সুফল বয়ে এনেছিল। কার্লো বোনাপার্তে এর সুযোগ নিলেন। কর্সিকার স্থানীয় ফ্রেঞ্চ গভর্নরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে বোনাপার্তে পরিবারকে ফ্রেঞ্চ অভিজাতদের মর্যাদায় ভূষিত করলেন। এই নতুন মর্যাদা প্রভাব ফেললো বোনাপার্তে পরিবারের উপর। এর কয়েক মাসের মাথায় জন্ম নিলেন নেপোলিয়ন, তারিখটা ছিল ১৭৬৯ সালের ১৫ অগাস্ট।
নেপোলিয়নের শৈশবকাল কেটেছে কর্সিকায়। মায়ের কড়া শাসনে থাকা পরিবারের মেজ ছেলে হিসেবে বেড়ে ওঠা নেপোলিয়নের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরের নামটা ছিল তার বড় ভাই জোসেফ। জোসেফের প্রভাব নেপোলিয়নের উপর বেশ ভালোমতোই পড়েছিল।
মাত্র নয় বছর বয়সে নেপোলিয়নকে পাড়ি জমাতে হলো উত্তর ফ্রান্সের ব্রিয়েন শহরে, মিলিটারি বোর্ডিং স্কুলে থেকেই নেপোলিয়নের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হলো। বোনাপার্তে পরিবারের অভিজাত পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে নেপোলিয়ন বিনা পয়সাতেই ব্রিয়েন মিলিটারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেন। এখান থেকে বের হতে পারলেই নেপোলিয়ন সরাসরি হয়ে যাবেন ফ্রেঞ্চ আর্মির কমিশনড অফিসার। কার্লো তার দুই ছেলেকে নিয়ে চললেন ফ্রান্সে, নেপোলিয়ন গেলেন সামরিক অফিসার হতে, আর জোসেফ পথ ধরলেন একজন খ্রিস্টান যাজক হিসেবে।
ব্রিয়েনে মিলিটারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নেপোলিয়নের প্রথম কাজ ছিলো ফ্রেঞ্চ ভাষায় দীক্ষা নেওয়া। খুব দ্রুত ভাষাটা শিখেও ফেললেন তিনি, কিন্তু কথায় থেকে গেলো কড়া কর্সিকান টান। একদিকে ভাষার এরকম চরম দুরবস্থা, অন্যদিকে ফ্রেঞ্চদের কাছে তার অপরিচিত অদ্ভুত নাম – স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের কাছে ক্রমেই হাসির পাত্র হয়ে উঠেছিলেন নেপোলিয়ন। সুযোগ পেলেই তাকে অপদস্থ করতে ছাড়ত না সহপাঠীরা। তাই নেপোলিয়ন গুটিয়ে নিলেন নিজেকে, তাঁর বন্ধু হিসেবে স্থান পেল লাইব্রেরির অগণিত বই। ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, গণিত, চিত্রাঙ্কন আর তলোয়ার চালনা শিক্ষার পাশাপাশি চলতে থাকলো বইয়ের পাতায় জ্ঞান অন্বেষণ।
‘আমি একটা ভাল্লুকের মতো থাকতাম… আমার ছোট্ট ঘরটায় একা একা… সাথে ছিল আমার একমাত্র বন্ধু, বই…,’ ডায়েরিতে এভাবেই নিজের অবস্থা লিখে রেখেছিলেন কিশোর জুনিয়র অফিসার নেপোলিয়ন। মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের সাহিত্যের সেরা উপন্যাস, নাটক আর অন্যান্য সাহিত্যিক লেখাগুলো নেপোলিয়ন একের পর এক শেষ করতে থাকলেন। কিশোর বয়সী পড়ুয়া নেপোলিয়নের হঠাৎ মনে ধরল তিনিও সাহিত্যিকদের খাতায় নাম ওঠাবেন। নিজের লেখার ওজন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ফ্রেঞ্চ সাহিত্য থেকে কঠিন কঠিন শব্দগুলো নিয়ে আলাদা খাতাও বানিয়েছিলেন! নেপোলিয়ন একটা গথিক উপন্যাস লেখাও শুরু করেছিলেন: “সে কাউন্টেসের হাত নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে আনলো। ও! কাঁধের ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত কাউন্টেসের পুরো হাত ভিজিয়ে দিয়েছে…।”
আরো অনেক পান্ডুলিপির খণ্ডাংশ লিখে রেখেছিলেন নেপোলিয়ন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সাহিত্যিকদের দলে ভেড়া হয়নি তার। ব্রিয়েনের পাট চুকানোর পর আরো এক বছর কাটালেন প্যারিসের একোলে মিলিটারিয়ে-তে। সেখানে আর্টিলারি স্পেশালিস্ট হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেন ১৭৮৫ সালে। ১৭৮৬ সালের বসন্তে কর্সিকায় ফিরে গেলেন তিনি, বাবা মারা যাওয়ার ফলে পরিবারের হাল ধরতে হলো তাকেই। কর্সিকায় পা ফেলার পরের ৫ বছরের অর্ধেকটা সময়ই তিনি কাটিয়েছে নিজের জন্মভূমিতে, ফ্রেঞ্চ আর্মিতে অফিসারদের সংখ্যা যথেষ্ট হওয়ায় অতিরিক্ত ছুটি পেতে বেগ পেতে হয়নি তার। নেপোলিয়নের পরিবার শীঘ্রই নেপোলিয়নকে পরিবারের কর্তা হিসেবে মেনে নিলো বড় ভাই জোসেফের বদলে।
নেপোলিয়নের বেড়ে ওঠা শরীরকে চিকনদের খাতাতেই ফেলা যায়। একটু অদ্ভুত আর অগোছালো স্বভাবের নেপোলিয়ন উচ্চতার দিক থেকে ফ্রেঞ্চ পুরুষদের তুলনায় সামান্য খাটো; ৫ ফুট ২ ইঞ্চি তৎকালীন ফ্রেঞ্চ পরিমাপ অনুযায়ী, ব্রিটিশ পদ্ধতিতে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চিতে।
সাহিত্যের জগতে বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন থেকে নেপোলিয়নকে যে জিনিস আটকে রেখেছিল তা হলো তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পরিণত হতে সাহায্য করে ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ৩ বছর পরও নেপোলিয়নের চিন্তা ছিল কর্সিকাকেন্দ্রিক। তাই ফ্রান্সের রাজনৈতিক টালামাটাল অবস্থা দেখে নেপোলিয়ন খুশিই হয়েছিলেন, যদি এই সুযোগে কর্সিকার স্বাধীনতা পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডে নির্বাসিত কর্সিকার নেতা প্যাস্কেল পাওলি, যাকে কর্সিকানরা ডাকে ‘বাব্বু’ অর্থাৎ, পিতা অর্থে, সেই পাওলির কাছে ১৭৮৯ সালে নেপোলিয়ন চিঠি পাঠালেন। ‘আমি এমন এক সময় জন্মেছি, যখন পিতৃভূমি মরতে বসেছে। ৩০ হাজার ফ্রেঞ্চম্যান আমাদের সৈকতে বমি করেছে, আমাদের স্বাধীনতাকে ডুবিয়ে দিয়েছে রক্তের সাগরে…’ তাই বিপ্লবী ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি যখন পাওলির সাজা মওকুফ করে নির্বাসন থেকে মুক্তি দিল, নেপোলিয়ন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।
কর্সিকা তখন মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত; একভাগ ফ্রান্সের পক্ষে, অন্যভাগ পাওলির ‘কর্সিকান পার্টি’র পক্ষে; নেপোলিয়ন ভিড়ে গেলেন পরেরটিতেই। কর্সিকান পার্টির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেন, বড় ভাই জোসেফকে নির্বাচনেও দাঁড় করালেন, যদিও জোসেফ হেরে গিয়েছিলেন। ৩ বছরের মধ্যেই নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে এমনভাবে বদলে দিল যে তিনি পরে লিখেছিলেন, ‘একজন লেখক হওয়ার মতো ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে আর নেই।’
তবে কর্সিকান রাজনীতিতে নেপোলিয়নকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের এক ছোট শহরের আইনজীবী ম্যাক্সিমিলিয়ান রবসপিয়েঁ কিংবা মানসিক সমস্যায় ভোগা সুইস ডাকাতার জাঁ-পল মারাট যেভাবে শূন্য থেকে উঠে এসে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন, কর্সিকায় সেরকম কিছু ঘটেনি। কর্সিকার প্রভাবশালী সালিসেত্তি কিংবা বুত্তাফুয়োকোস পরিবারের কাছে বোনাপার্ট পরিবার ছিল নিতান্তই শিশু। এদিকে বোনাপার্ট পরিবারের হম্বিতম্বিতে বিরক্ত হয়ে বাব্বু বোনাপার্ট ভাইদের নাম দিলেন ‘ragazzoni inesperti (অভিজ্ঞতাহীন বালক)’।
১৭৯২-এর শেষদিকে হঠাৎ করে সবকিছু দ্রুতগতিতে ঘটতে থাকলো। রিপাবলিকের সূচনা হলো, রাজা ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো, শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। এদিকে ‘বুব্বা’ পাওলিও মূল ভূখণ্ডের সাথে আলাদা হওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন; বোনাপার্ট পরিবারকে তিনি সুযোগ দিলেন যেকোনো একদিকে যাওয়ার জন্য; প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির জন্য বোনাপার্ট পরিবারের জন্য ক্রমেই অবাসযোগ্য হয়ে ওঠা কর্সিকান মাতৃভূমি অথবা অস্থির রাজনীতিতে মাতাল হয়ে ওঠা ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ড। বোনাপার্ট পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিল ছোট ভাই লুসিয়েন, যিনি হলেন ফরাসি বিপ্লবের সমর্থক।
তুলোঁ শহরে জ্যাকবিন ক্লাবের এক সভায় পাওলিকে দেশদ্রোহী অ্যাখ্যা দিয়ে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানালেন। ব্যস! মাতৃভূমি কর্সিকা চিরদিনের জন্য বোনাপার্টদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ৪০ বছরের জন্য স্বায়ত্তশাসন ভোগ করা কর্সিকার ওপর ফ্রান্স পুনরায় কর্তৃত্বমূলক শাসন চাপানোর জন্য সেনাদল পাঠাল, যাতে অংশগ্রহণ করলেন স্বয়ং নেপোলিয়ন। কিন্তু ২ মাস পর টের পাওয়া গেল পাওলিকে কর্সিকা থেকে সরানোর জন্য এই সেনাদল যথেষ্ট নয়। এবার বোনাপার্ট পরিবারকে উল্টো দেশদ্রোহী অ্যাখ্যা দিলেন পাওলি। অবস্থা বেগতিক দেখে কর্সিকা থেকে সপরিবারে পালিয়ে চলে এলেন নেপোলিয়ন। পাওলির সমর্থকরা বোনাপার্ট পরিবারের বাড়িতে সদলবলে লুটপাট চালাল। মাতৃভূমি কর্সিকার সাথে চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন নেপোলিয়ন, তবে তার ইতিহাস আরও বড় কিছুর জন্য লেখা রয়েছে।
তৃতীয় পর্ব: নেপোলিয়ন: বিকামিং ফ্রেঞ্চ (পর্ব-৩)