১৯৮৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ভোর ৫টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যান অ্যাম ফ্লাইট ৭৩ এর বোয়িং ৭৪৭ প্লেনটি মুম্বাই থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে পাকিস্তানের করাচিতে এসে থেমেছে। করাচির জিন্নাহ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এক ঘন্টা যাত্রা বিরতির পর প্লেনটি যখন পুনরায় যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখন চারজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী এয়ারপোর্ট নিরাপত্তারক্ষীর ছদ্মবেশে প্লেনটির দিকে ছুটে আসে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা অটোমেটিক মেশিনগান থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্লেনের ভেতরে প্রবেশ করে এবং প্লেনটির ৩৬১ জন যাত্রী এবং ১৯ জন ক্রুকে জিম্মি করে ফেলে।
সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য ছিল প্লেনটিকে তাদের পছন্দমতো গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন ২৪ বছর বয়সী তরুণী বিমানবালা নির্জা ভানোত। সন্ত্রাসীদের আগমন টের পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি এবং তার এক সহকর্মী গোপনে ককপিটে থাকা পাইলটদেরকে ইমার্জেন্সি কোডের মাধ্যমে সতর্ক করে দেন। সন্ত্রাসীদের বোয়িং ৭৪৭ প্লেন সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা ছিল না। তারা যখন ককপিট খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত, ততক্ষণে প্লেনটির আমেরিকান পাইলট, সহকারী পাইলট এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ককপিটের ছাদের জরুরী প্রস্থানপথ দিয়ে প্লেন ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে প্লেনটি এয়ারপোর্টের টারমাকে আটকা পড়ে যায় এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার সুযোগ পায়।
যাত্রীদেরকে ফেলে পাইলটদের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে সে সময় অনেক সমালোচনা হয়, কিন্তু নির্জা ভানোতের সতর্ক সংকেত এবং পাইলটদের পালিয়ে যাওয়ার ফলে সিদ্ধান্তের ফলেই সেদিন বেঁচে যায় প্লেনটির অধিকাংশ যাত্রী। নির্জার সংকেত না পেলে সন্ত্রাসীরা পাইলটদেরকে তাদের ইচ্ছেমতো প্লেন চালিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারত, যার ফলাফল হয়তো আরো অনেক বেশি রক্তাক্ত হতো। পাইলটরা চলে যাওয়ায় প্লেনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে সবচেয়ে সিনিয়র বিমানবালা নির্জা ভানোতের উপর। পরবর্তী ১৭ ঘন্টা ধরে তার অসাধারণ কর্তব্যবোধ, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের বিনিময়ে সেদিন প্রাণে বেঁচে যায় ৩৮০ জন যাত্রীর মধ্যে ৩৫৮ জন।
কে এই নির্জা ভানোত?
নির্জা ভানোতের জন্ম ১৯৬২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ভারতের চান্দিগড়ে। ঘটনার দিন তার বয়স ছিল ২৪ বছরের চেয়ে মাত্র ২ দিন কম। নির্জার বাবা ছিলেন ইন্ডিয়া টাইমস পত্রিকার একজন সাংবাদিক। ১৯৮৫ সালে নির্জার বিয়ে হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী এক ব্যক্তির সাথে। কিন্তু যৌতুকের দাবি করায় নির্জা মাত্র দুই মাসের সংসার ছেড়ে ভারতে ফিরে আসেন। নির্জার ইচ্ছে ছিল ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট পদে চাকরি করার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বিমানবালা হতে হয়।
বিমানে চাকরির পাশাপাশি ছুটির দিনগুলোতে তিনি মডেলিংও করতেন। মডেলিং এবং বিমানবালা – দুটো পেশার জন্যই সর্বদা হাসিমুখ এক অপরিহার্য শর্ত। সেই হাসি মুখেই তিনি ঘটনার দিন পুরো সময়টা প্লেনের যাত্রীদেরকে আশ্বস্ত করে গেছেন, যদিও বেশিরভাগ সময়ই তার মাথায় ঠেকানো ছিল সন্ত্রাসীদের পিস্তল।
কারা ছিল এই সন্ত্রাসীরা?
প্যান অ্যাম ফ্লাইট ৭৩ হাইজ্যাক করা এই সন্ত্রাসী দলটি ছিল আবু নিদাল অর্গানাইজেশন নামে একটি ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা প্রথমে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন পিএলওর অংশ থাকলেও পরবর্তীতে তাদের উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ১৯৭৪ সালে পিএলও থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তারা ইরাকে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০টির মতো বড় আকারের হামলা করে।
আবু নিদাল সংগঠনটি পিএলও এবং ফাতাহর নেতাদেরকে মধ্যপন্থী এবং ইসরায়েলের দালাল আখ্যা দিয়ে তাদের উপরেও হামলা করে এবং একাধিক পিএলও নেতাকে হত্যা করে। তারা এমনকি, ইয়াসির আরাফাত এবং মাহমুদ আব্বাসকেও হত্যার চেষ্টা করে। এসব কারণে পিএলওর পক্ষ থেকে সংগঠনটির প্রধান আবু নিদালকে তার অনুপস্থিতে মৃত্যুদন্ডও দেওয়া হয়।
যে চারজন সন্ত্রাসী প্যান অ্যাম ফ্লাইট ৭৩ এর প্লেনটি হাইজ্যাক করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী সহ প্লেনটিকে সাইপ্রাস অথবা ইসরায়েলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার, যেখানে তাদের সংগঠনের অনেক সদস্য বন্দী ছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে সেসব দেশ থেকে তারা নিজেদের সদস্যদেরকে মুক্ত করবে।
অভিযোগ করা হয়, এ কাজে তাদেরকে আর্থিক সহায়তা করেছিল লিবিয়া। কারণ আবু নিদাল পিএলও থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে প্রথমে ইরাকে এবং পরবর্তীতে দীর্ঘদিন লিবিয়াতে ছিল। এছাড়া ১৯৮৬ সালে মার্কিন বিমান হামলায় গাদ্দাফীর শিশুকন্যা নিহত হওয়ার পরে তিনি বিভিন্ন স্থানে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ব্যাপারে অর্থায়ন করছিলেন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে লিবিয়ানরা ১৯৮৮ সালে লকারবির আকাশে প্যান অ্যামেরই আরেকটি বিমান বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল।
কী ঘটেছিল সেদিন?
নির্জার সংকেত পেয়ে পাইলটরা পালিয়ে গেলে সন্ত্রাসীরা বিপাকে পড়ে। তারা উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে প্লেন চালাতে সক্ষম কাউকে খুঁজে না পেয়ে এয়ারপোর্টের টারমাকে থাকা প্যান অ্যামের করাচি পরিচালকের কাছে পাইলটদেরকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু তাদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনো পাইলট পাঠানো না হলে বেলা দশটার দিকে তারা রাকেশ কুমার নামে ভারতীয় আমেরিকান নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে এবং প্লেনের দরজা থেকে তার লাশ বাইরে ফেলে দেয়।
সন্ত্রাসীরা নির্জা এবং অন্য বিমানবালাদেরকে নির্দেশ দেয় প্লেনের ভেতরে থাকা মার্কিন নাগরিকদেরকে খুঁজে বের করতে। প্লেনটিতে মোট ৪১ জন মার্কিন নাগরিক ছিল। কিন্তু নির্জা এবং সানশাইন নামে তার এক সহকর্মী যাত্রীদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করার সময় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকানদের পাসপোর্টগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে থাকে। তারা কিছু পাসপোর্ট নিজেদের ইউনিফর্মের পকেটে ঢুকিয়ে পরে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। আর কিছু কিছু পাসপোর্ট নিচে ফেলে পা দিয়ে আঘাত করে সীটের নিচে ঢুকিয়ে দেয়। তাদের উপস্থিত বুদ্ধি এবং সাহসিকতায় সেদিন বেঁচে যায় ৪১ জনের মধ্যে ৩৯ জন মার্কিন নাগরিক।
কোনো মার্কিন নাগরিক খুঁজে না পেয়ে সন্ত্রাসীরা মাইক নামে ব্রিটিশ নাগরিককে পৃথক করে নিয়ে আসে। তারা তাকে প্লেনের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসতে এবং হাত দুটো উপরে তুলে রাখতে বাধ্য করে। তাদের হয়তো পরিকল্পনা ছিল মাইককেও হত্যা করার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাইক বেঁচে যায়। সন্ত্রাসীরা বাইরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য প্লেনের যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্য থেকে রেডিও পরিচালনা করতে সক্ষম কাউকে খুঁজতে থাকে। একজন রেডিও অফিসার যখন হাত তুলে এগিয়ে আসতে চায়, তখন নির্জা তাকে ইশারা দিয়ে নিবৃত্ত করে। পরবর্তীতে এয়ারপোর্ট টারমাক থেকে কর্তৃপক্ষ মেগাফোনের মাধ্যমে অন্য এক রেডিও অপারেটরের নাম জানালে সন্ত্রাসীরা তাকে দিয়ে রেডিওর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করে।
এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ এবং সশস্ত্র বাহিনী ছিনতাইকারীদেরকে আশ্বস্ত করতে থাকে যে, পাইলট খোঁজা হচ্ছে, শীঘ্রই পাইলট পাঠানো হবে। আর এর মধ্য দিয়েই তারা বাইরে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে এবং সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। এদিকে ভেতরে সন্ত্রাসীরা ধীরে ধীরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে থাকে। তাদের নেতা বারবার বিমানবালাদেরকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আশেপাশে অন্য কোনো প্লেন দেখা যাচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করতে থাকে। তাদের আশঙ্কা ছিল, আমেরিকা হয়তো তাদেরকে হত্যা করার জন্য জঙ্গী বিমান পাঠাতে পারে।
যেভাবে সমাপ্তি ঘটেছিল জিম্মি নাটকের
বেলা গড়িয়ে যখন রাত নামে, তখন ইঞ্জিন বন্ধ থাকা প্লেনের সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার করে জ্বলতে থাকা লাইট এবং এসিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। পুরো প্লেন হঠাৎ করে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা মনে করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী হয়তো আক্রমণ করার প্রস্তুতি হিসেবে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আতঙ্কিত অবস্থায় তারা অন্ধকারের ম্যধেই এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এর মধ্যেই নির্জা একজন যাত্রীর সহায়তায় প্লেনের একটি ইমার্জেন্সী দরজা খুলে ফেলেন এবং বায়ুপূর্ণ ব্যাগ বের করে দেন যেন যাত্রীরা তার উপর দিয়ে গড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে।
প্লেনের দরজা খোলার সময় নির্জার পক্ষেই সবার আগে বাইরে বেরিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব ছিল। কিন্তু তা না করে তিনি পেছনে রয়ে যান এবং যাত্রীদেরকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করতে থাকেন। যাত্রীদেরকে সাহায্য করতে গিয়েই একসময় নির্জা সন্ত্রাসীদের চোখে পড়ে যান। ততক্ষণে প্লেনের অন্য দুটি দরজাও খুলে গিয়েছিল এবং প্রায় সব যাত্রী বেরিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, মানতবাবোধকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্য দিতে গিয়ে নির্জা সন্ত্রাসীদের হাথে ধরা পড়েন। এক সন্ত্রাসী তার চুল ধরে টেনে নিয়ে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
কী ঘটেছিল সন্ত্রাসীদের ভাগ্যে?
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে চারজন সন্ত্রাসীই জীবিত ধরা পড়ে। পরে ঘটনার সাথে সম্পর্কিত আরো একজনকে গ্রেপ্তার করে পাঁচজনে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। বিচারে প্রথমে সবার মৃত্যুদন্ড হলেও পরবর্তীতে তাদের সাজা হ্রাস করে যাবজ্জীবন করে দেওয়া হয়। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতা করে হাইজ্যাকারদের নেতাকে ছেড়ে দেয় এবং পরদিনই ব্যাংকক থেকে এফবিআই তাকে গ্রেপ্তার করে। যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় তার বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং রায়ে তাকে ১৬০ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়।
বাকি সন্ত্রাসীরা তাদের সাজার মেয়াদ শেষ করে ২০০৯ সালে মুক্তি পেয়ে ফিলিস্তিনে ফিরে যায়। তাদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০১০ সালে তাদের একজন যুক্তরাষ্ট্রে ড্রোন হামলায় নিহত হয় বলে রিপোর্ট পাওয়া যায়, যদিও পরবর্তীতে তার সত্যতা পাওয়া যায়নি।
নির্জার স্মৃতিগাঁথা
নির্জা ভানোতকে তার বীরত্বের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মরণোত্তর অশোকা চক্র পুরস্কার দেওয়া হয়, যা শান্তিকালীন সময়ের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তার মানবিকতার জন্য তাকে তামঘা-ই-ইনসানিয়াত পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে জাস্টিস ফর ক্রাইমস অ্যাওয়ার্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ থেকে স্পেশাল কারেজ অ্যাওয়ার্ড সহ আরও অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৬ সালে নির্জার বীরত্বের কাহিনী নিয়ে বলিউডে নির্জা (Neerja) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন রাম মাদভানি। এতে নির্জা চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেত্রী সোনম কাপুর। চলচ্চিত্রটি এবং এতে সোনম কাপুরের অভিনয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।