Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নিলয় দাস: সংগীতের ভুবনে ফেলে আসা অনন্য এক নাম

“যখনই নিবিড় করে
পেতে চাই তোমাকে
তখনই দু’চোখ বুজি আমি
নয়নে-স্বপনে দেখি শুধু তোমায়
বিরহ বরষায় মেঘেরই ছায়ায়”

এই গানের কথা ধরেই শান্ত মনের মাঝে গিটারের ঐকতানে বাজে এক বিষাদের সুর। ভাবনার আলোয় ধরা দেয় দূর পথের প্রান্তরে ফেলে আসা এক অসম্ভব ভালো লাগার নাম- ‘নিলয় দাস’।

নিলয় দাস। ছবিসূত্র: newsg24.com

লম্বা চুলে, সাদামাটা চেহারায় ভাবগাম্ভীর্যে ভরা শান্ত কিন্তু বেশ আবেগী এক ছেলে নিলয় দাস। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতাঙ্গনে বেড়ে ওঠা তার। প্রথাগত নিয়ম ভাঙার চিন্তা ছিলো মনে, শিখছিলেন নজরুল সংগীত। শিখতেই যে হবে; উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ, নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপিকার ও গবেষক ওস্তাদ সুধীন দাস এবং সঙ্গীত শিল্পী নীলিমা দাস যে সেই সন্তানের পিতামাতা। কিন্তু ছেলেটির মন যেন চাইছিল অন্যকিছু।

বাংলাদেশের সংগীত জগতের আরেক দিকপাল হ্যাপি আখন্দের সাথে ছিল তার বন্ধুত্ব। বন্ধুর পরামর্শে তিনি হাতে তুলে নেন গিটার। আর তাতেই পেয়ে গেলেন দিশাহীন পথের ঠিকানা, খুঁজে পেলেন জীবনের অর্থ আর বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে যোগ করলেন একের পর এক আধুনিক গানের সৃষ্টি। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের রং মিলিয়ে নিলয় দাস হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় ‘নিলয় দা’।

সুধীন দাস ও নীলিমা দাস। ছবিসূত্র: archive.thedailystar.net

১৯৬১ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় জন্ম নিলয় দাসের। খুব একটা দীর্ঘ হয়নি অত্যন্ত প্রতিভাবান এই শিল্পীর সঙ্গীত জীবন। অল্প পরিসরেই বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতকে তিনি দিয়ে গেছেন অনেক কিছু যা এখনও সব সঙ্গীত শিল্পী এক বাক্যে মেনে নিতে বাধ্য।

আর তাইতো নিলয় দাস সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশের আরেক গুণী সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, “নিলয় আসলে গিটার বাদক নয়, সত্যিকার অর্থে এক গিটার সাধক।” গিটার হাতে স্টেজ মাতানোর সময় নিলয় দাসের স্মৃতি রোমন্থনে আইয়ুব বাচ্চু বলে ওঠেন, “Niloy is the one and only classical guitarist, guitar player.”

নিলয় দাসের স্মরণে আইয়ুব বাচ্চু। ছবিসূত্র: banglanews24.com

‘নিলয় দা’ কিন্তু শুধু গিটারিস্টই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একাধারে গায়ক, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং সঙ্গীত শিক্ষকও। ১৯৮৮ সালের দিকে নিলয় দাস সংগীতাঙ্গনে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। ধীরে ধীরে তিনি শুরু করলেন নিজের একক অ্যালবামের কাজ। গীতিকার কাউসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা এবং বাংলাদেশের অন্যতম সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ফুয়াদ নাসের বাবুর সংগীত আয়োজনে সারগামের ব্যানারে প্রকাশিত হয় নিলয় দাসের প্রথম একক অ্যালবাম ‘কত যে খুঁজেছি তোমায়’। এই অ্যালবামের ‘কত যে খুজেছি তোমায়’ গানটি বেশ সাড়া ফেলে।

এরপর ১৯৯২ সালের দিকে তিনি দ্বিতীয় অ্যালবামের কাজে হাত দেন। বাংলাদেশের আরকেজন গুণী সংগীত শিল্পী আশিকুজ্জামান টুলুর সঙ্গীত পরিচালনায় ‘বিবাগী রাত‘ প্রকাশিত করেন। এই অ্যালবামের ‘আমার স্বপ্ন নগরীর দরজা খোলা’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়।

নিলয় দাসের দ্বিতীয় অ্যালবাম। ছবিসূত্র: banglanews24.com

নিলয় দাস সঙ্গীত জীবনের সেরা সময়টি অতিবাহিত করেন নব্বইয়ের দশকে। এই সময় তিনি ‘দ্য জেনমস’ এবং ‘ট্রিলজি’ নামের দুটি ব্যান্ডের সাথে গিটার বাজিয়েছেন। এর মধ্যে ‘ট্রিলজি’ ব্যান্ডটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং এই ব্যান্ডের হাত ধরে অসাধারণ গিটারের মূর্ছনায় একের পর এক মঞ্চ কাঁপাতে থাকেন নিলয় দা।

তার হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম ইন্সট্রূমেন্টাল কনসার্ট ব্যাপক সুনাম অর্জন করে যা নিয়মিত শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে অনুষ্ঠিত হতো। এরপরে জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে নিলয় দা’র। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ও সুরকার আজাদ রহমানের সুনজরে পড়েন তিনি। শিল্পকলা একাডেমিতে গিটার শিক্ষক পদে যোগ দেয়ার প্রস্তাব পান তিনি। আর এই সুযোগ পেয়ে নিলয় দাস ভারতীয় উপমহাদেশের বিশিষ্ট সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গোলাম আলী, মেহেদী হাসান সহ আরো অনেক গুণীজনের সাথে গিটার বাজানো এবং তাদের সান্নিধ্য পাওয়ার এক অকল্পনীয় সুযোগ লাভ করেন।

হ্যাপি আখন্দ। ছবিসূত্র: youtube.com

বন্ধু হ্যাপির জন্য ছিল তার অফুরন্ত ভালবাসা।  থাকবে না-ই বা কেন? একসাথেই যে ছিল তাদের সঙ্গীত জীবনের পথচলা। বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতকে নিয়ে তারা যে স্বপ্ন দেখতেন তা নিজেদের জীবন দিয়ে আলোর পথ দেখিয়ে গেছেন। হ্যাপির কথা মনে পড়তেই তাই গেয়ে উঠতেন নিলয়,

“হ্যাপি তোকে মনে পড়লেই,
একটা গিটার তোলে ঝংকার।
পিয়ানোটা বেজে ওঠে,
তোর সেই নিপুণ হাতে।
হ্যাপি তোকে মনে পড়লেই,
আবার এলো যে সন্ধ্যা।”

বন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখতে নিলয় দা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘হ্যাপি স্কুল অফ মিউজিক’। বাংলাদেশের অনেক গিটারিস্ট, সঙ্গীত শিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালক নিলয় দা’র প্রতিষ্ঠিত এই ‘হ্যাপি স্কুল অফ মিউজিক’ থেকে শিক্ষা লাভ করে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন।

কিন্তু এসবের মাঝেও স্বল্পভাষী নিলয় দা’র মনে ছিল চাপা ক্ষোভ আর বেদনা, যা তিনি জানতে দেননি কাউকে কখনোই। একসময় ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন অডিও ইন্ডাস্ট্রি থেকে। ১৯৯২ সালের পর ব্যান্ড ‘ট্রিলজি’ ও নিজের একক কোনো অ্যালবামের কাজ করার আর তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেননি তিনি। তবে অনেক সঙ্গীত পরিচালকের অনুরোধে বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবামে গান করেছেন নিলয়। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম স্টারস-১ এ আশিকুজ্জামান টুলুর সুরে ‘অবহেলা’ শিরোনামে একটি গান করেন। আরেকটি ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ‘দেখা হবে বন্ধু’-তে তার গাওয়া ‘এইটুকু খোলা রেখো পথ‘ গানটি অনেক শ্রোতারই অসম্ভব প্রিয় গানের একটি। ‘শুধু তোমার জন্য’ মিক্সড অ্যালবামে ফাহমিদা নবীর সাথে ‘মনে পড়ে গেল’ শিরোনামের একটি দ্বৈত গান করেন তিনি। ‘কাছে আসার দিন ভালোবাসার দিন’ শিরোনামের আরেকটি রোমান্টিক গানের সংকলনেও তিনি ‘ভালোবাসার দিন’, ‘তোমাকেই প্রয়োজন’, ‘ও তুমি মেয়ে’ শিরোনামের তিনটি গান করেন।

স্টুডিওতে নিলয় দাস। ছবিসূত্র: banglanews24.com

দীর্ঘ ছয় বছর পর ১৯৯৭ সালে নিলয় দাস ভিন্ন পরিকল্পনায় একটি অ্যালবামের কাজ শুরু করেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল মূলত ‘৭০ থেকে ‘৮০-এর দশকের সকল ব্যান্ড ও প্রিয় শিল্পীদের দিয়ে নিজের মতো করে একটি অ্যালবাম সাজাবেন। কিন্তু তখন তিনি নিজেও জানতেন না যে, এটাই তার জীবনের শেষ অ্যালবামে পরিণত হবে। ২০০৫ সালে দিকে নিজের কিছু মৌলিক গানের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু দুই-তিনটি গানের খসড়া বানানোর মাঝপথেই থেমে যান নিলয়।

নিলয় দাস স্মরণে। ছবিসূত্র: amargaan12.weebly.com

২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে রাত ৯টার সময় বাংলাদেশের এই গিটার মাইলস্টোন পরলোক গমন করেন। পিছে ফেলে যান অনেক যন্ত্রণা, ক্ষোভ আর অভিমান। নিলয় দা’র এই হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের সংগীত জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু ক্ষোভ জাগে মনে যখন দেখা যায় আজকের অনেকের কাছেই নিলয় দাস একটি অপরিচিত নাম। তাকে সেভাবে কোন সময় সবার সামনে তুলে ধরা হয়নি। তাই অসম্ভব অভিমানী নিলয় দা’র স্মরণে মনে বেজে ওঠে তার গাওয়া খুব পরিচিত একটি গান-

“সেই যে চলে গেলে
আর হায় এলে না ফিরে
কত যে খুঁজেছি তোমায়
অকারণ অশ্রুজলে”

ফিচার ছবিসূত্র: newsg24.com

Related Articles