শান্তিতে নোবেলজয়ী বিতর্কিত ব্যক্তিগণ

সভ্যতা ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে নোবেল পুরস্কারের অবদান অনেক। বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি- এই ক্ষেত্রগুলোতে অলংকার হিসেবে নোবেল পুরস্কার যে পরিমাণ অবদান রেখেছে তা আসলেই পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। আজকে আমরা যে যুগে বসবাস করছি তার ভীত রচিত হয়েছে গত শতাব্দীতে। আধুনিক প্রযুক্তি, আয়েশি জীবন, কালজয়ী সাহিত্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ পেরিয়ে শান্তির সময়ে প্রবেশ ইত্যাদি অনেক কিছুরই শেকড় ছড়িয়ে আছে গত শতাব্দীতে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে গত শতাব্দীর বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তির সকল ক্ষেত্রে অলংকার হিসেবে আলোকিত হয়ে আছে নোবেল পুরস্কার।

নিঃসন্দেহে নোবেল পুরস্কার অনেক প্রশংসনীয় ব্যাপার, কিন্তু তারপরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই পুরস্কারকে ঘিরে জন্ম হয় বিতর্ক। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পুরস্কারগুলো নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই, যতটা শান্তির পুরস্কারের বেলায় আছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে সবসময়ই কিছু না কিছু প্রশ্ন উঠে। এসব প্রশ্ন মাঝে মাঝে পুরো নোবেল কমিটিকেই বিতর্কের মুখে ফেলে দেয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী এরকম কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়েই আজকের আয়োজন।

১. বারাক ওবামা (২০০৯)

© New York Post

প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পরপরই ২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান বারাক ওবামা। আমেরিকার নির্বাচনের সময় সারা পৃথিবীতেই তোলপাড় হয়। তখনকার সময়ে যারা নির্বাচনের খবর রেখেছে তারা দেখেছে নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি শেষ হতে না হতেই ওবামা পেয়ে গেছেন নোবেল। নোবেল কমিটি বলছে- দুর্নীতি দমনে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, অস্ত্র ও যুদ্ধ নিরসনকল্পে গৃহীত পদক্ষেপের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অফিসিয়ালি কাজকর্মের বয়স মাত্র কয়েক মাস। এত স্বল্প সময়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এত জটিল ব্যাপারসমূহের সমাধান সম্ভব নয়। নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্ক হিসেবে থাকবে ওবামার এই পুরস্কার।

২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি আত্মজীবনীতে নোবেল কমিটির প্রাক্তন সদস্য গেয়ার লান্ডেস্টাড এই ব্যাপারে কিছু কথা বলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল যেন আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাব শক্তিশালী হয় এবং তার ক্ষমতায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

২. হেনরি কিসিঞ্জার (১৯৭৩)

© Academy of Achievement

নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল হেনরি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল প্রদান করা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে নোবেল প্রদানের প্রতি প্রতিবাদ স্বরূপ নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে তার অবস্থান ও কর্মকাণ্ড কেমন অনৈতিক ছিল তা বাংলাদেশের ইতিহাস অনুসন্ধানী সকল মানুষেরই জানা। যুদ্ধবাজ ও অশান্তির কারিগর এই ব্যক্তিকে নোবেল প্রদান করা মানে শান্তিতে নোবেলজয়ী অন্যান্যদেরকে অপমান করা।

কেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল তা জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। পূর্বে ভিয়েতনাম দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম। একসময় তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ। আমেরিকার অবস্থান ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে। কিন্তু আমেরিকার মদদপুষ্ট হয়েও হেরে যায় উত্তর ভিয়েতনামের কাছে। উত্তর ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে এক হয়ে যায় দুই ভিয়েতনাম। যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমেরিকার তৎকালীন সেক্রেটারি কিসিঞ্জার ও ভিয়েতনামের রাজনৈতিক নেতা লে দু থো একটি শান্তি চুক্তি করেন। এই চুক্তির জন্য নোবেল প্রদান করা হয় কিসিঞ্জার এবং লে দু থো-কে। কিন্তু লে দু থো এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। সারা বছর যুদ্ধ বাধিয়ে রেখে শেষ বেলায় চুক্তি করে পেয়ে যাবে নোবেল পুরস্কার, তাও আবার শান্তিতে, এ কেমন নৈতিকতা? এ কেমন সিদ্ধান্ত?

৩. অং সান সু চি (১৯৯১)

© Foreign and Commonwealth Office/Flickr/Wikimedia Commons

সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে এতদিন কোনো বিতর্ক ছিল না। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার নির্ভীক অবস্থান ও আন্দোলনের কৃতিত্বস্বরূপ তাকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই দিক থেকে নেলসন মেন্ডেলার পরেই তার অবস্থান। কিন্তু বর্তমানে  রোহিঙ্গা নাগরিকদের নির্যাতন ও বিতারণ সমস্যার প্রেক্ষাপটে তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ‘শান্তি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা আরো অনেক আগে থেকেই ছিল, তখনও তার পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। যখন থেকে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং রোহিঙ্গা সমস্যায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকছেন, সর্বোপরি রোহিঙ্গা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নে নীরব থাকছেন তখন প্রশ্ন উঠেছে- শান্তিতে নোবেলজয়ী এই ব্যক্তি আসলে কতটা শান্তি বজায় রাখছেন? নোবেল শান্তি পুরস্কার কি আসলে তার প্রাপ্য?

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির বিতর্কিত অবস্থানের প্রতিবাদে তাকে রাক্ষস হিসেবে তুলে ধরেছে পোস্টারে। © Oded Balilty/AP

রোহিঙ্গা সমস্যার সাথে বাংলাদেশ ভারত ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সেসব দেশের মানুষ রব তুলছে নোবেল কমিটির উচিৎ তার কাছ থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া। অনলাইনে পিটিশনও করছে (যদিও সেসব পিটিশন ভুয়া)। নোবেল কমিটি তাকে বিতর্কিতভাবে পুরস্কার দেয়নি, কমিটির সিদ্ধান্তে কোনো ত্রুটি ছিল না। পরে অন্য কোনো কারণে সু চি বিতর্কিত হয়েছেন। এর জন্য নোবেল কমিটি তাদের পুরস্কার ফিরিয়ে নেবার প্রশ্ন অবান্তর। একবার পুরস্কার দেয়া হয়ে গেলে সেটা কখনো ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। আর তাছাড়া পুরস্কার দেবার পর পুরস্কার গ্রহণকারী ব্যক্তি কী করবে না করবে তা দেখার দায়িত্ব নোবেল কমিটির নয়।

৪. আল গোর (২০০৭)

© History Today

১৯৯৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিল ক্লিনটন। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ২০০৭ সালে ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রশ্নে তিনি নিজেই ছিলেন বিতর্কিত। মুখে মুখে বিদ্যুৎ সাশ্রয়য়ের কথা বলে গেছেন কিন্তু নিজেই অন্যান্য সাধারণ বাড়ির তুলনায় ২০ গুণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিগত জেটপ্লেন ছিল তার। কার্বন নিঃসরণ, সবুজ পৃথিবী প্রভৃতি নিয়ে বুলি আওড়ানো এই ব্যক্তি নিজের জেটপ্লেনে পুড়িয়েছেন মাত্রাতিরিক্ত কার্বন। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। পরিবেশ ও জলবায়ু নামক এজেন্ডাকে পুঁজি করে কামিয়েছেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। ভক্ষককেই যখন রক্ষকের আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করা হয় তখন বিতর্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

৫. মালালা ইউসুফজাই (২০১৪)

© eNCA

পাকিস্তানের শিশুদের জন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কনিষ্ঠ নোবেলজয়ী। তার নোবেল পুরস্কারের প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী প্রভাব রেখেছে তালেবান সন্ত্রাসী কর্তৃক তার আক্রান্ত হওয়া। শিশু বয়সে নারী শিক্ষার জন্য কাজ করে যাওয়া এবং এর জন্য সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসা আসলেই সাড়া জাগানো ঘটনা ছিল। কিন্তু নোবেল পুরস্কার অর্জন করা? এখানে অনেকেরই প্রশ্ন। কারণ মালালার মতো হাজার হাজার মানুষ আছে যারা নারী ও নারী শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন, কাজ করছেন। মালালার মতো অনেক নারী আছে যারা এসব কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়েছেন এবং এর চেয়েও জঘন্যভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদেরকে তো নোবেল কমিটি মনোনয়নও করেনি। শুধুমাত্র হাইপ তোলা এবং দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া নিশ্চয় নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। তাই দুনিয়াজুড়েই মালালার পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান।

তবে যারা এই পুরস্কারের সমালোচনা করেন তাদের কেউ কেউ একটি দিক থেকে ভুল করেন। কোনো এক কারণে তারা মালালার প্রতি নেতিবাচক থাকেন। মূলত নোবেল পুরস্কার পেয়ে মালালা কোনো অপরাধ করেননি। বিতর্ক যদি কেউ তৈরি করে থাকে তাহলে সেটা নোবেল কমিটি করেছে। সমালোচনা যদি করার থাকে তাহলে নোবেল কমিটিকেই করা উচিত।

অন্যান্যরা

এদের ছাড়াও শান্তিতে বিতর্কিত নোবেল বিজয়ীদের মাঝে আছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট মেনাশিম বেগিন। ৬০ এর দশকে ইজরায়েল ও মিশরের মাঝে যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে আরবদের অনেক স্থান দখল করে নেয় ইজরায়েল। সেজন্য আনোয়ার সাদাত শান্তি চুক্তি করেন ইজরায়েলের সাথে। এর ফলে এলাকা ফিরে পায় মিশর। এই চুক্তির জন্য ১৯৭৯ সালে দুজনকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ দুজনেই ছিলেন বিতর্কিত। দুজনেই ছিলেন সহিংস আন্দোলনের সাথে জড়িত।

আনোয়ার সাদাত ও মেনাশিম বেগিন। © Central Intelligence Agency/ Wikimedia Commons

আরো আছেন রিগোবার্তা মেঞ্চু, যিনি গুয়াতেমালা থেকে পালিয়ে মেক্সিকো চলে গিয়েছিলেন এবং অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে একটি বই লিখেছিলেন। বইতে উল্লেখ করা গুয়াতেমালার বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন এবং মানুষের সংগ্রামের বর্ণনার জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে গবেষণায় বেরিয়ে আসে তার বইয়ের বর্ণনা মিথ্যা, ভুল ও বানোয়াট তথ্যে ভরা। এই মর্মে বিতর্ক বিদ্যমান যে, তিনি এর জন্য শান্তিতে নোবেল পাবার যোগ্যতা রাখেন না।

রিগোবার্তা মেঞ্চু। © DW

এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও আছে শান্তিতে বিতর্কিত নোবেল জয়ীদের তালিকায়। শান্তির পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও অযোগ্যদের পুরস্কৃত করা হয় মাঝে মাঝে। আবার মাঝে মাঝে অতি-যোগ্যদেরকেও পুরস্কার দেয়া হয় না। যেমন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের অন্যতম ব্যর্থতা হলো মহাত্মা গান্ধীকে নোবেল না দেয়া। সাহিত্যে নোবেল পাননি লিও টলস্টয়, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, রবার্ট ফ্রস্টের মতো সাহিত্যিকেরা। বিজ্ঞানে পাননি সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রোজালিন্ড ফ্রাংকলিনের মতো মেধাবীরা। সত্যিকারের যোগ্যরা পুরস্কার পাক এবং নোবেল কমিটিও থাকুক বিতর্কের ঊর্ধ্বে, এমন আশাই করি আমরা সকলে।

ফিচার ছবি: ThoughtCo/The Daily Beast

Related Articles

Exit mobile version