২০১৮ সালের ২ অক্টোবর। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের নাম ঘোষণার জন্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স থেকে তোড়জোড় চলছে। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঘোষিত হলো তিন পদার্থবিদের নাম- আমেরিকান আর্থার অ্যাশকিন, ফ্রেঞ্চ জেরার্ড মোরোউ এবং কানাডিয়ান ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। অপটিকাল টুইজার আবিষ্কারের জন্য অ্যাশকিন পাবেন পুরস্কারের অর্ধেক অর্থ। আঙুলের মতো লেজার বিমের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কণা, পরমাণু, কোষ কিংবা ভাইরাসকে নড়াচড়া করানো যাবে এর মাধ্যমে। আর পুরস্কারের বাকি অর্ধেক ভাগাভাগি করে নেবেন মোরোউ এবং স্ট্রিকল্যান্ড, যৌথভাবে চার্পড পালস অ্যামপ্লিফিকেশন (CPA) আবিষ্কারের জন্য। এর মাধ্যমে স্বল্পদৈর্ঘ্যের, কিন্তু উচ্চ শক্তিসম্পন্ন লেজার লাইটের পালস নির্মাণ সম্ভব।
সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের মাঝে সাড়া পড়ে গেলো। ৫৫ বছর পরে নোবেল জিতে নেয়া নারী পদার্থবিদের নামে সবাই ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। কিন্তু কী তাজ্জব ব্যাপার, উইকিপিডিয়ায় তো ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের নামে কোনো পেজই নেই!
তার মাত্র একদিন আগের কথা। ইতালীয় গবেষক আলেসান্দ্রো স্ট্রামিয়া নোবেল অরগানাইজেশনের এক সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছেন। তার দাবি, “পদার্থবিদ্যার সৃষ্টি এবং উন্নতি এসেছে কেবলই পুরুষদের কাঁধে ভর করে”। নারীবিদ্বেষী এই বক্তব্যের জন্য ইউরোপের খ্যাতনামা ফিজিক্স রিসার্চ সেন্টার সার্ন তাকে বরখাস্তও করে দিয়েছে। তবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কাজটি কিন্তু করলেন স্ট্রিকল্যান্ডই।
সেই কথা থাক। নারী হিসেবে না, একজন পদার্থবিদ হিসেবে ডোনা কীভাবে লেজার টেকনোলজিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছেন, সেই নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
১৯৫৯ সালের ২৭ মে কানাডার অন্টারিওতে জন্মগ্রহণ করেন ডোনা থিও স্ট্রিকল্যান্ড। অসাধারণ প্রতিভাধর এই নারীর মা লিলয়েড স্ট্রিকল্যান্ডও ছিলেন একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সুতরাং পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহটা তার জন্মগতই।
স্ট্রিকল্যান্ড ১৯৮১ সালে কানাডার হ্যামিল্টনের ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিক্সের ওপরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য যান নিউ ইয়র্কের রচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় ফরাসি পদার্থবিদ জেরার্ড মোরোউর সাথে। মোরোউ ছিলেন স্ট্রিকল্যান্ডের ডক্টোরাল সুপারভাইজর। ১৯৮৯ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তার থিসিসের নাম ছিল ‘ডেভেলপমেন্ট অফ অ্যান আলট্রা-ব্রাইট লেজার অ্যান্ড অ্যান অ্যাপ্লিকেশন টু মাল্টি-ফোটন আয়োনাইজেশন’।
আশির দশকের মাঝামাঝিতে শর্ট লেজার পালসের ইন্টেনসিটি বিষয়ক গবেষণা কিছুটা থমকে যায়। প্রতি একক এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ক্ষমতার পরিমাণকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ইন্টেনসিটি বলে। পালসের তীব্রতা বাড়ালেই লেজার সিস্টেমের ক্ষতি হবে, এই আশঙ্কা করা হচ্ছিলো। স্ট্রিকল্যান্ড এবং মোরো এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার ফলে শর্ট লেজার পালসের প্রসারণ ঘটে, ফলে এর পিক পাওয়ার হ্রাস পায়। ফলে পুরো লেজার সিস্টেমের ওপরে ঝুঁকি কমে আসে। পালস প্রসারণের ফলে লেজার লাইটের ফ্রিকোয়েন্সিতে একটি পরিবর্তন আসে, যাকে বলা হয় চার্প (Chirp)। এ থেকেই উদ্ভাবিত হয় তাদের নোবেলজয়ী পদ্ধতিটির নাম।
স্বল্প পিক পাওয়ারের কারণে প্রসারিত পালসকে নিরাপদেই অ্যামপ্লিফাই করা যায়। পরবর্তীতে এই পালসকে আবার সংকুচিত করার ফলে এর ইন্টেনসিটি বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৫ সালে চার্পড পালস অ্যামপ্লিফিকেশনের ওপরে তারা যৌথভাবে যে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন, সেটি ছিল স্ট্রিকল্যান্ডের প্রথম পাবলিকেশন। দিনে দিনে এই প্রযুক্তি হয়েছে আরো উন্নত। এখন শর্ট লেজার পালসের ইন্টেনসিটি ১ পেটাওয়াট (১০০০০০০০০০০০০০০০ ওয়াট) পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব, শর্ট পালসের সময়সীমাও নেমে এসেছে ১ ফেমটোওয়াটে (০.০০০০০০০০০০০০০০১ ওয়াট)। এরকম ইন্টেন্সের লেজার পালস এখন কারখানায় সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণভাবে কোনো কিছু কাটতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে লাখে লাখে মানুষের চোখে ল্যাসিক সার্জারি করা হচ্ছে এই পদ্ধতির সাহায্যে।
পরবর্তীতে কানাডার অটোয়াতে অবস্থিত ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সহকারী গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন স্ট্রিকল্যান্ড। এর পরে ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির লেজার বিভাগে কাজ করেন। খ্যাতনামা প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অ্যাডভান্সড টেকনোলজি সেন্টারে ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ফটোনিক্স এবং অপ্টো-ইলেকট্রনিক ম্যাটেরিয়াল বিষয়ক গবেষণা টিমের অংশ ছিলেন তিনি। অবশেষে ১৯৯৭ সালে কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। সেই বিভাগে ফুলটাইম প্রফেসর হিসেবে যোগদান করা প্রথম নারী তিনিই। মজার ব্যাপার, যোগদানের ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রফেসর পদের জন্য আবেদন করার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দেননি তিনি। তবে নোবেলজয়ের পরে এ পদে আবেদন করেছেন এবং সাথে সাথেই প্রফেসর পদে উন্নীত হয়েছেন।
স্ট্রিকল্যান্ড ২০০৮ সাল থেকে অপটিকাল সোসাইটির সদস্য। এর লিডারের দায়িত্বও পালন করেছেন ২০১১ এবং ২০১৩ সালে।
১৯০৩ সালে সর্বপ্রথম নারী হিসেবে পদার্থে নোবেল পেয়েছিলেন প্রখ্যাত পোলিশ বিজ্ঞানী মেরি কুরি, পরে ১৯১১ সালে রসায়নেও নোবেল পেয়েছিলেন তিনি। আর ১৯৬৩ সালে ইউজিন উইগনার আর জে হ্যান্স জেনসেনের সাথে যুগ্মভাবে নোবেল পেয়েছিলেন আরেক পোলিশ নারী পদার্থবিদ মারিয়া গেপার্ট মেয়ার।
নোবেলজয়ের কথা শুনে কেমন ছিল স্ট্রিকল্যান্ডের প্রতিক্রিয়া?
এর আগে মাত্র দুজন নারী পদার্থে নোবেল পেয়েছেন, এ বিষয়টি অবশ্য জানা ছিল না স্ট্রিকল্যান্ডের। তিনি বলেছেন, আমি যখন পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলাম, তখন কম করে হলেও দশ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল। সুতরাং নোবেলজয়ী নারী পদার্থবিদের পরিমাণও সেরকমই হবে ভেবেছিলাম। আমি মনে করি, নারী পদার্থবিদদের কীর্তিগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা উচিত। তবে স্পষ্টতই যুগ পাল্টেছে। আশা করি, সময়ের সাথে সাথে দ্রুতই নারী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা বহুগুণে বাড়তে থাকবে।
কলেজে পড়ার সময়ে স্ট্রিকল্যান্ড নিজেই নিজের ডাকনাম দিয়ে দেন ‘লেজার জক’। সাধারণত স্কুল-কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি বাস্কেটবল, বেসবল কিংবা অন্যান্য খেলায় অংশ নেয়া ছাত্রদেরকে পশ্চিমা বিশ্বে ‘জক‘ বলা হয়। আর সবসময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ক্লাসের সদা মনোযোগী ছাত্ররা পরিচিত ‘নার্ড’ হিসেবে। শৈশব থেকেই পড়ালেখায় সিরিয়াস স্ট্রিকল্যান্ড কিন্তু নিজেকে একজন নীরস নার্ড মানতে একেবারেই নারাজ। নিজের কাজ উপভোগ করেন পুরোদমে, সারাক্ষণ সিরিয়াস থাকার অভ্যাস তার কখনোই ছিল না। লেজার নিয়ে সবসময়ে খেলায় মেতেই থাকেন যেহেতু, মাঠ কাঁপানো অন্য খেলোয়াড়দের চাইতে তিনি কম কিসে?
লেজার ফিজিক্সের ক্ষেত্রে এই যুগান্তকারী এই গবেষণার সূচনা হয়েছিল সেই আশির দশকের মাঝামাঝিতে। জেরার্ড মোরোউর নামে উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ আছে সেই ২০০৫ সাল থেকেই। তাহলে কেন ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড জায়গা পেলেন না উইকিপিডিয়ার পাতায়? যেকোনো অ্যাকাডেমিক আর্টিকেল উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত হবার আগে নয়টি বিষয় মেনে চলতে হয়। এ বছরের মার্চ মাসে স্ট্রিকল্যান্ডের নামে একটি আর্টিকেল প্রকাশের জন্য উইকিপিডিয়ায় জমা দেয়া হয়। কিন্তু এক ভলান্টিয়ার সম্পাদক মে মাসে সেই আর্টিকেলের প্রাথমিক রেফারেন্সের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তুলে সেটা বাতিল করে দেন। তাছাড়া তার কাছে সেকেন্ডারি রেফারেন্সগুলোকেও বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যহীন বলে মনে হয়েছে।
অনেকেই এই ঘটনার পেছনে বৈষম্য দেখতে পাচ্ছেন। এ পর্যন্ত উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত বায়োগ্রাফিগুলোর মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ নারীদের নিয়ে। এ বিষয়ে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ক্যাথেরিন মাহের বলেছেন, এ ব্যাপারে উইকিপিডিয়াকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এটা সত্যিকার অর্থে বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। যে সাংবাদিকেরা বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন, তারা নিজেদের সংবাদপত্র পড়ে দেখতে পারেন, সেখানে কত শতাংশ খবর নারীদের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।
আরেক পদার্থবিদ ডগলাস ডাইকারকে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন তিনি। তাদের আছে দুই সন্তান- অ্যাডাম ও হ্যানা স্ট্রিকল্যান্ড। হ্যানাও মায়ের পথেই এগোচ্ছেন, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে। অ্যাডাম অবশ্য একটু ভিন্নপথ বেছে নিয়েছেন, হাম্বার কলেজে পড়ছেন কমেডি নিয়ে। কিন্তু মায়ের থেকে খুব দূরে গেছেন, তা বলা যাবে না। কেননা হাসিখুশি মা তো বলেছেনই, সবকিছু উপভোগ করে চলতে। এখন তিনি আলট্রাফাস্ট লেজার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আলট্রাফাস্ট অপটিকাল সায়েন্সকে সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে যাচ্ছেন বহুদূরে। মাল্টি ফ্রিকোয়েন্সি মেথড দিয়ে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি যেমন মিড-ইনফ্রারেড কিংবা আলট্রাভায়োলেট নিয়ে কাজ করতে চাইছেন। প্রেসবায়োপিয়া নামক চোখের অসুখ সারানোর চেষ্টাও আছে তার। ভবিষ্যতে তার কাছে আরো বহু কিছু পাবো, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।