২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর মানুষ আতংকে কেঁপে ওঠে নিউ ইয়র্ক শহরের টুইন টাওয়ারে হামলা হতে দেখে। চোখের সামনে ধ্বসে পরে দুটো সুবিশাল অট্টালিকা, আর মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। কদিনের মাথায় কেউ কেউ বলে বসে, প্রায় ৫০০ বছর আগে জন্মানো এক ভদ্রলোকের লিখে যাওয়া বহু খণ্ডের ভবিষ্যৎবাণীতে নাকি উল্লেখ ছিল এ ঘটনা যে ঘটবে সে কথার। নাম তার নস্ট্রাডামুস। কে ছিলেন এই ভবিষ্যৎকথক? তাকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
এ ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোকের আসল নাম মিশেল দে নতরদাম (নটর ডেম), তবে নস্ট্রাডামুস নামেই তিনি বেশি পরিচিত। জন্ম তার ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, ফ্রান্সের দক্ষিণে সেইন্ট রেমি দে প্রোভেন্সে (Saint-Remy-de-Provence)।
ইহুদী পরিবারে জন্ম হলেও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যুগে বাস করায় তিনি ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত। তার দাদা ও নানা দুজনেই জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন দুজনের কাছ থেকেই পাঠ নিতেন। একজন ছিলেন শারীরতত্ত্ববিদ, সোজা কথায় বললে তখনকার দিনের ডাক্তার। আর আরেকজন ছিলেন ভাষাবিদ, তার কাছ থেকে তিনি শিখে নেন ক্লাসিক্যাল ভাষাগুলো।
চৌদ্দ বছর বয়সে নিজের পরিবার ছেড়ে তিনি চলে যান ফ্রান্সের আভিনিউয়ে (Avignon) পড়ালেখা করতে। সেখানে ধর্মতত্ত্ব নিয়েই পড়তেন তিনি। ক্লাসে প্রায়ই ক্যাথলিক যাজকদের সাথে বনিবনা হতো না তার। এরপর মিশেল চলে যান মঁঁপেলিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে, সেখানে তিনি অধ্যয়ন শুরু করেন ওষুধবিজ্ঞান ও জ্যোতিষবিদ্যা। এ দুটো এখন পাশাপাশি অদ্ভুত শোনালেও তৎকালীন সময়ে অবাক করা কিছু ছিল না একসাথে পড়তে গেলে।
১৫২২ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েট করেন এবং তারপর থেকে নিজেকে নস্ট্রাডামুস নামে ডাকতে থাকেন, এটা আসলে তার নিজের নামের লাতিন ভার্সন। ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েটরা এ কাজটা করে থাকত।
ডাক্তার জীবনের প্রথম কয়েক বছর কাটল ফ্রান্সে ঘুরে ফিরে। তখন ‘লে শার্বন’ (কার্বন বা কয়লা) নামের প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছিল আর তাতে ধ্বংস হয়ে যায় অনেক শহর ও গ্রাম। ধরাশায়ীদের দেহে কালো দাগ রেখে যেত বলে এ রোগের এ নাম হয়। কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছিল না এর। ডাক্তাররা তখন রোগীদের রক্ত নিঃসরণ করাত এই আশায় যে, রক্তের সাথে রোগের জীবনী যেন বেরিয়ে যায়।
তখন নস্ট্রাডামুস বললেন, রোগীদের প্রয়োজন আসলে মুক্ত সজীব বাতাস ও পানি। লো-ফ্যাট ডায়েট ও পরিষ্কার বিছানার কথাও বললেন তিনি। তিনি যে ওষুধ দিতেন পরে জানা যায় এতে ছিল প্রচুর ভাইটামিন সি। শহরের পর শহর তার চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠল। তবে ইনফেকশন নিয়ে তার প্রচারিত বিশ্বাস ছিল চার্চের কথার পরিপন্থী, এজন্য তাকে ধর্মবিরোধী হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ভয়ও ছিল।
নস্ট্রাডামুসের এ সাফল্যে দূরদূরান্তে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দক্ষিণ ইউরোপে দেখা হওয়া ডাক্তারদের তালিকা নিয়ে বই লিখেন, এছাড়াও আরো অনেক পুস্তক লিখে যান তিনি, যার মাঝে ডায়েট নিয়েও বই ছিল। ১৫২৯ সালে তিনি তার সেই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে যান। সেখানে এরপর তিনি তিন বছর শিক্ষকতা করেন। কিন্তু রোগ নিয়ে তার অদ্ভুত ধারণাগুলোর সমালোচনার কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয়।
ফ্রান্সের আগেন শহরে বিয়ে করে তিনি স্থায়ী হন। তার দুই সন্তান হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত প্লেগের উৎপাত ফিরে আসে। যখন নস্ট্রাডামুস ডাক্তার হিসেবে অন্যদের শুশ্রূষা করছিলেন তখন তার নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তান প্লেগে মারা গেলেন। নিজের পরিবারকে বাঁচাতে না পারায় লোকে তাকে অপবাদ দেয়া শুরু করল। তার শ্বশুরবাড়ি থেকে স্ত্রীর যৌতুক ফিরিয়ে দিতে মামলা দিয়ে দেয়া হয়।
এর পরের বছরগুলো দক্ষিণ ইউরোপ ঘুরে বেড়ালেন নস্ট্রাডামুস। ভারী বর্ষণের কারণে ১৫৪৪ সালে আবারও প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে। আবারও নিজের দক্ষতায় একটি শহরেই রোগ থামিয়ে ছড়ানো প্রতিহত করায় নস্ট্রাডামুসের সুখ্যাতি আবারও ছড়িয়ে পড়ল।
এবার তিনি চলে গেলেন ফ্রান্সের সালোনে। সেখানে নিজের মেডিক্যাল প্র্যাক্টিস শুরু করেন, আবার বিয়ে করেন এবং নতুন করে সংসার শুরু করলেন। রাতের বেলা তিনি এক পিতলের পাত্রে পানি ও ভেষজ লতাপাতা ভর্তি করে তার সামনে বসে ধ্যান করতেন। একপর্যায়ে তিনি তন্দ্রায় চলে যেতেন এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীর দৃশ্য দেখতেন বলে বর্ণিত আছে।
এ ‘ভিশন’ বা ভবিষ্যতের দৃশ্যগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করা শুরু করলেন পঞ্জিকার মতো করে। পরের বছরগুলোতে কী কী হবে না হবে তা সেখানে লেখা ছিল। ১৫৫০ সাল থেকে ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত এরকম পঞ্জিকা তিনি প্রকাশ করলেন। জনগণের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় সেগুলো। রাশিচক্রের মতো আপনার সকাল শুভ হবে, বিকাল অশুভ যাবে, ভাগ্যে প্রেম আছে- এরকমের লেখা তিনি লিখতেন না। বরং, আসছে সময়ের খুব বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চার চরণের হেঁয়ালির ছলে তিনি লিখে যেতেন, যেগুলো পরে ‘ইন্টারপ্রেট’ বা অনুবাদ করতে হত। একদিক দিয়ে সেটা যেমন তার ভবিষ্যৎবাণী ‘মিলবার’ ব্যাপারে সহায়ক, আরেক দিক দিয়ে শাসকেরা তার লেখাগুলোর সঠিক অর্থ উদ্ধার করে যেন তাকে মৃত্যুদণ্ড না দেন সেটাও খেয়াল রাখেন তিনি। তাছাড়া জাদুটোনার অপবাদ উপেক্ষা করার ক্ষেত্রেও কাজে দিয়েছিল হেঁয়ালি।
১৫৫৪ সালে তিনি ‘Centuries‘ লেখা শুরু করেন। প্রথম সাত খণ্ড পরের বছর প্রকাশিত হয়, এরপরের খণ্ডগুলোও তিনি লিখে ফেলেন। কিন্তু বলে দিলেন, তার মৃত্যুর আগে যেন এগুলো প্রকাশ না করা হয়। প্রথমবারে যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, সেখানে ৩৫৩টি ভবিষৎবাণী ছিল। ১৫৫৮ সালে আরো তিনশ নতুন ভবিষ্যৎবাণী সেখানে যুক্ত করা হয়। এগুলোর নাম ছিল ‘The Prophecies‘; আর তার মৃত্যুর পর যেটি মুক্তি পায় অবশেষে সেখানে ছিল ৯৪২টি ভবিষ্যৎবাণী, যার মাঝে ৯৪১টিতে ছন্দ ছিল, একটিতে ছিল না। এটিই Centuries। তখনকার প্রিন্টিং ব্যবস্থা এমন ছিল যে, যেকোনো দুটো কপিও একরকম হতো না। তাই আজও একই রকম দুটো বই পাওয়া যায় না সে সময়ের।
নস্ট্রাডামুসের লেখাগুলো ফরাসি রাজপরিবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাকে প্যারিসের রাজ দরবারে আমন্ত্রণ করেন রাজা দ্বিতীয় হেনরি (১৫১৯-১৫৫৯) ও তার স্ত্রী ক্যাথারিন দে মেদিচি (১৫১৯-১৫৮৯)। তখনকার দিনে মেদিচি পরিবারের সুযশ সারা ইউরোপ জুড়ে ছিল। রানী চেয়েছিলেন, নস্ট্রাডামুস হয়ত তার সাত ছেলের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন। ১৫৫৬ সালের অগাস্ট মাসে নস্ট্রাডামুস প্যারিসে এলেন।
তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে তার কবিতাগুলোর একটি হলো রাজা হেনরিকে নিয়েই:
“তরুণ সিংহ পরাস্ত করবে বড়জনকে
সমরক্ষেত্রে একক যুদ্ধে
সোনালি খাঁচা ভেদ করে চলে যাবে তার চোখ দিয়ে
দুই ক্ষত এক হয়ে মারা যাবেন তিনি অবর্ণনীয় কষ্টে।”
তিনি রাজাকে বললেন রাজা যেন কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোড়-দ্বন্দ্বযুদ্ধে (Jousting) না নামেন, যখন তার বয়স ৪১ বছর হবে। পরের কয়েক বছর নস্ট্রাডামুস আরামেই কাটালেন রাজপ্রাসাদে। ততদিনে ক্যাথলিকরা তার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠেছে এবং তাকে ফাঁসানোর ব্যাপারে উঠেপরে লেগেছে। তিনি নিজের সালোন শহরে ফিরে এলেন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে।
১৫৫৯ সালের ২৮ জুন রাজা দ্বিতীয় হেনরি আনুষ্ঠানিক ঘোড়-দ্বন্দ্বযুদ্ধে অংশ নিলেন। সেটা আয়োজন করা হয়েছিল তার পরিবারে দুটো বিবাহ উদযাপনকে ঘিরে। হাজারো মানুষের সামনে, তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বর্শা রাজার সোনালি শিরস্ত্রাণ ভেদ করে চোখ ফুঁড়ে ঢুকে যায় মস্তিষ্কে, কিন্তু তিনি তখনই মারা যাননি। টানা দশ দিন তিনি অবর্ণনীয় মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগবার পর মারা যান। তার বয়স তখন ছিল ৪১ বছর।
এ ঘটনার পর ফ্রান্সে নস্ট্রাডামুস পূজনীয় এক ব্যক্তি হয়ে গেলেন। ফ্রান্সের রাজ পরিবার নিয়ে করা তার অন্য ভবিষ্যৎবাণীগুলো ঘেঁটে দেখা হলো নতুন করে। দেখা গেল, বেশিরভাগই খারাপ। কুইন রিজেন্ট ক্যাথারিন দে মেদিচি সালোনে গিয়ে দেখা করলেন নস্ট্রাডামুসের সাথে ১৫৬৪ সালে। নস্ট্রাডামুস বললেন, চার চার ছেলেই রাজা হবে। তাঁর এ ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয়, চারজনই রাজা হন এবং খুব তাড়াতাড়ি মারা যান।
১৫৬৬ সালে নস্ট্রাডামুসের বাতের ব্যথা বেড়ে যায়। জুনের শেষ দিকে তিনি তার উকিলকে ডেকে আনেন, একটি উইল করে ফেলেন তার সম্পত্তির (বর্তমান মূল্য ৩ লক্ষ মার্কিন ডলার)। কথিত আছে, ১ জুলাই তিনি তার সেক্রেটারি জ্যঁ দে শাভিঁ-কে বলেন, “আগামীকাল সূর্যোদয়ের সময় আমাকে জীবিত পাবে না।” পরের দিন সকাল বেলা তাকে মৃত পাওয়া যায় তার বিছানার পাশে মেঝেতে পরে থাকা অবস্থায়।
তাকে সমাহিত করা হয় স্থানীয় ফ্রাঞ্চিস্কান চ্যাপেলে (এখন তার একটা অংশবিশেষ লা ব্রশারি রেস্টুরেন্ট), কিন্তু পরে ফরাসি বিপ্লবের সময় সেটা স্থানান্তরিত করে নেয়া হয় কলেজিয়ালে সেইন্ট লরেন্ট-এ। এখনো তার সমাধি সেখানেই আছে।
নস্ট্রাডামুস ভক্তগণ দাবি করেন যে, তার ভবিষ্যৎবাণীগুলো সত্য। কিন্তু হেঁয়ালির ছলে লিখবার কারণে সত্য-মিথ্যা পরীক্ষা করবার উপায় থাকে না। কেউ সত্য মানতে চাইলে, সেটা সত্যই লাগে, আবার মিথ্যা প্রমাণ করতে চাইলেও সহজেই করা যায়। তার ভবিষ্যৎবাণীগুলোর মধ্যে আছে, ১৬৬৬ সালের লন্ডনের মহা অগ্নিকাণ্ড, নেপোলিয়ন ও হিটলারের উত্থান, কেনেডি হত্যা, উভয় বিশ্বযুদ্ধ, হিরোশিমা নাগাসাকিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ইত্যাদি। ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার পর তার পুরনো ভবিষ্যৎবাণী ঘেঁটে ভক্তরা বের করে ফেলেন যে, সেখানে হেঁয়ালির ছলে এ ঘটনার ভবিষ্যৎবাণী আছে। এমনকি ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষ নামা, ১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জার মহাকাশযান ধ্বংস হয়ে অভিযাত্রীদের মৃত্যু, ১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুও নাকি বর্ণনা করা আছে।
তবে, ১৯৮৩ সালের পর যখন ১৫৫৫ ও ১৫৫৭ সালে প্রকাশিত অরিজিনাল পাণ্ডুলিপিগুলো পাওয়া যায় নস্ট্রাডামুসের, তখন বর্তমানে প্রচলিত ভার্সনের সাথে বেশ অমিল দেখা যায়, এমনকি রাজা হেনরিকে নিয়ে সেই ভবিষ্যৎবাণীর অস্তিস্ত্ব পাওয়া যায় পরের এক সংস্করণে। তাঁর ভবিষ্যৎবাণীগুলোর মিল-অমিলের প্রকৃত রহস্য ভেদ করতে হলে পড়তে পারেন আমাদের আরেকটি বিস্তারিত লেখা “নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যদ্বাণীর আসল রহস্য” এখানে ক্লিক করে।
নস্ট্রাডামুসের লেখনিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হেঁয়ালিও পাওয়া যায়। তার মতে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে ৩৭৯৭ সালে। হেঁয়ালি হোক আর যেটাই হোক, কয়েক শতাব্দী ধরে নস্ট্রাডামুসের লেখাগুলো রহস্য ধরে রাখতে পেরেছে, পড়া হয়েছে সেগুলো লক্ষ লক্ষ বার। এজন্যই তাঁর নামখানা সর্বকালের সবচেয়ে নামকরা ভবিষ্যৎকথক হিসেবে টিকে আছে।
ফিচার ইমেজ: Microïds